১০ নভেম্বর, ২০০৩। জিম্বাবুয়ে তখন প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ম্যাচ আয়োজন করার উত্তেজনায় কাঁপছে। ঠিক ওই সময়ই কাঁপুনি যেন আরো বের গেল হারারে স্পোর্টস ক্লাবে ক্রিকেটারদের এক কাণ্ডে। সাংবাদিকদের ডেকে এনে একটা বিবৃতি দিলেন। দাবি করলেন, তাদের স্বদেশভূমিতে গণতন্ত্রের মৃত্যু হয়েছে।
জিম্বাবুয়েতে তখন রবার্ট মুগাবের জমানা। সেই সময় দলের সেরা দুই মাঠে খেলতে নামলেন কালো আর্মব্যান্ড জার্সিতে বেঁধে। তাদের দেশে গণতন্ত্রের নামে যে অরাজকতা চলছে, সেটা ক্রিকেট মাঠে এই দু’জনের সুবাদেই জানতে পারে বিশ্ববাসী। সেই দু’জন হলেন: হেনরি ওলোঙ্গা ও অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার।
এর মধ্যে অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার হলেন তার নিজের সময়ের সেরা উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানদের একজন। কারো কারো মতে, তিনি ইতিহাসেরও সেরা। ৬৩ টেস্টে ফ্লাওয়ারের গড় ৫১.৫৪। টেস্টে উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যানদের মধ্যে (কমপক্ষে এক হাজার রান করা) তার চেয়ে বেশি গড় কেবল আর একজনের, তিনি হলেন দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি এবি ডি ভিলিয়ার্স। কিন্তু ৫৭.৪২ ব্যাটিং গড়ের ভিলিয়ার্স উইকেটরক্ষণের কাজে ছিলেন অনিয়মিত। আর ফ্লাওয়ারকে টানা ১০ বছর সেই কাজটা রোজই করে যেতে হয়েছে।
শচীন টেন্ডুলকার কিংবা ব্রায়ান লারাদের সময়কার ব্যাটসম্যান ফ্লাওয়ার। ফলে, সময়ের সেরা তাকে কোনোভাবেই বলা যাবে না। তবে, উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যানের আধুনিক ধারণার অন্যতম রূপায়ক তিনি। টেস্টে ব্র্যাডম্যানের ৯৯.৯৪-এর ব্যাটিং গড়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শচীনের ১০০ সেঞ্চুরি প্রভৃতি রেকর্ড আদৌ ভাঙবে কি না, সে নিয়ে যেমন সন্দেহ আছে, তেমনি উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান হিসেবে ফ্লাওয়ারের রেকর্ডটা লম্বা সময় টিকে থাকলেও তা নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
বিশ্ব ক্রিকেটে ফ্লাওয়ারের যা অবস্থানই থাকুক না কেন, জিম্বাবুয়ের ইতিহাসে তিনি অবিসংবাদিত সেরা। আফ্রিকান এই দেশটি থেকে ক্রিকেটে তার চেয়ে কোনো বড় তারকা বা পারফরমার – কোনোটাই আগে কখনো আসেনি। নব্বই দশকের শেষ ভাগে ক্রিকেটের মানচিত্রে জিম্বাবুয়ে যে আস্তে আস্তে করে ‘বড় ব্যাপার’ হয়ে উঠেছিল, তার অন্যতম প্রধান কারণ হলেন ফ্লাওয়ারদের দুই ভাই – অ্যান্ডি ও গ্র্যান্ট। এর মধ্যে পারফরম্যান্স দিয়ে অ্যান্ডিই যে এগিয়ে ছিলেন, তা বলাই বাহুল্য।
ওয়ানডেতেও তিনি দারুণ পারফরমার ছিলেন। ১৯৯২ বিশ্বকাপে তার ওয়ানডে অভিষেক হয়। এরপর থেকে তিনি পরের তিনটি বিশ্বকাপেই খেলেন। ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন দলের অধিনায়ক। দুই মেয়াদে তিনি দলের অধিনায়ক ছিলেন।
নেতা হিসেবে তার অর্জনটা নেহায়েত কম নয়। ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে তার নেতৃত্বেই প্রথমবারের মতো টেস্টে পাকিস্তানকে হারিয়েছিল জিম্বাবুয়ে। সেই সময় পাকিস্তানকে হারানো মুখের কথা ছিল না। দলে ওয়াসিম আকরাম ও আকিব জাভেদের মতো পেসাররা ছিলেন। সেই ম্যাচে অ্যান্ডি নিজে খেলেন ১৫৬ রানের ইনিংস। ভাই গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার ২০১ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন। দু’জন মিলে ২৬৯ রানের জুটি গড়েন, আর সেটাই পাকিস্তানকে ছিটকে ফেলে ম্যাচ থেকে।
টেস্টে অ্যান্ডির প্রিয় প্রতিপক্ষ ছিল ভারত। ভারতের বিপক্ষে ১০টি টেস্ট ইনিংসে তার রান ৮২০। গড়টা আকাশচুম্বী – ১১৭.১৪! এর মধ্যে আছে তিনটি সেঞ্চুরি আর চারটি হাফ সেঞ্চুরি। সেরা ইনিংসটা ২৩২ রানের!
২০০৩ সালের বিতর্কিত সেই বিশ্বকাপেই শেষবারের মতো জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপান তিনি। জিম্বাবুয়েতে তার শেষটা মোটেও ভাল হয়নি। যদিও, এরপর কখনোই আরেকজন অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার খুঁজে পায়নি দলটি। কেউ তার ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেনি। টেস্ট কিংবা ওয়ানডে – দুই ফরম্যাটেই জিম্বাবুয়ের হয়ে সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহকের জায়গাটা আজও দখল করে আছেন অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছাড়ার পর শুরু হয় ফ্লাওয়ারের নির্বাসনের জীবন। তিনি বড় একটা সময় কাটান ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্রিকেটের দল এসেক্সে। অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায় কিছু সময় কাটালেও সেটা খুব বেশি দিনের ব্যাপার ছিল না। বরং তিনি কালক্রমে হয়ে উঠেছিলেন এসেক্সের ঘরের ছেলে। ২০০৬ সালের শেষে সেখানেই নিজের ক্যারিয়ার শেষ করেন ফ্লাওয়ার।
ক্রিকেট ইতিহাসে এমন মাত্র কয়েকজন ক্রিকেটার আছেন, যারা নিজের দেশের অধিনায়কত্ব করার পর কোনো না কোনো টেস্ট খেলুড়ে দেশের কোচিংও করিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে সফলদের একজন হলেন অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার।
২০০৭ সালে ইংল্যান্ডের সহকারী কোচ হিসেবে নিয়োগ পান ফ্লাওয়ার। তখন মাত্রই তিনি ক্রিকেটার হিসেবে পেশাদার ক্যারিয়ার শেষ করেছেন। যদিও, মাত্র দু’বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তাকে প্রধান কোচের দায়িত্ব দেয় ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি)। কারণ, খুব বিশৃঙ্খল একটা পরিস্থিতিতে বরখাস্ত করা হয় পিটার মুরসকে। এরপর তার যা অর্জন, তা অনেকাংশেই ছাড়িয়ে গেছে তার খেলোয়াড়ি জীবনকেও। জিম্বাবুয়ের কিংবদন্তি হিসেবে তিনি যতটা না পরিচিত, একালে তার চেয়েও বেশি তিনি পরিচিত কোচ হিসেবে।
দায়িত্ব নেওয়ার দু’বছরের মধ্যেই বাজিমাৎ করেন ফ্লাওয়ার। ইংল্যান্ডকে দু’বার অ্যাশেজ জেতান। একবার ইংল্যান্ডে, একবার অস্ট্রেলিয়ায়। তার কোচিংয়েই ২৪ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়া থেকে অ্যাশেজ জিতে ফেরে ইংল্যান্ড দল।
এখানেই শেষ নয়, প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডকে কোনো আইসিসি ইভেন্ট জয়ের আনন্দে ভাসান তিনি। ‘ক্রিকেটের আঁতুরঘর’ নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জিতে নেয়। সেটা ছিল ২০১০ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ।
সেই বছরই ভারতকে হটিয়ে টেস্ট র্যাংকিংয়ের শীর্ষে উঠেছিল ইংলিশরা। এরপর ২০১২-১৩ মৌসুমে অনেক দিন বাদে ভারত থেকে টেস্ট সিরিজ জিতে ফেরে ফ্লাওয়ারের শীষ্যরা। জাতীয় দলের কোচিং ছাড়লেও তিনি ছিলেন ইসিবির সাথেই। ২০১৪ সাল থেকে তিনি ইংল্যান্ড লায়ন্স দলের কোচ।
বাংলাদেশের কোচ হিসেবে অনেকবারই তার নাম উঠেছে, গুঞ্জন শোনা গেছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) বেশ কয়েকবার তাকে পাওয়ার চেষ্টা করলেও সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ইসিবির দায়িত্বে থাকতে তিনি বিসিবিসহ অসংখ্য বোর্ডের প্রস্তাবই ফিরিয়ে দিয়েছেন অনেক সময়।
জিম্বাবুয়ের এই কিংবদন্তি ইসিবি ছাড়েন ২০১৯ সালের অক্টোবরে এসে। ইতি ঘটে এক যুগের বর্ণাঢ্য এক অধ্যায়ের। এখন তিনি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের কোচিংয়ে ব্যস্ত। যোগ হয়েছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে টি-টেন লিগের কোচিংয়ে। কে জানে, হয়তো এরপর শীঘ্রই নতুন কোনো চ্যালেঞ্জে মাঠে নামবেন!
ফ্লাওয়ার নিজের জীবনের বড় সময় ব্যয় করেছেন ইংলিশ ক্রিকেটে। যদিও জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট নিয়ে তার আক্ষেপের কোনো অন্ত নেই। জিম্বাবুয়ের সাবেক উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান টাটেন্ডা টাইবুর আত্মজীবনী ‘কিপার অফ ফেইথ’-এর মুখবন্ধে সেই কথা ফুটে উঠেছে।
ফ্লাওয়ার লিখেছেন,
‘আমাদের ক্রিকেট ব্যবস্থাপনার ওপরের মহল ও সরকার – সব জায়গাতেই লেজেগোবরে অবস্থা। এমন অবস্থায় জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের দুর্দিন দেখাটা খুবই হৃদয়বিদারক। দেশে এখন ক্রিকেটকে খুবই অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। যদিও, এমন হওয়ার কথা ছিল না। জিম্বাবুয়ে প্রাকৃতিক সম্পদে খুবই সমৃদ্ধ, এর শিক্ষাব্যবস্থাও দারুণ। তারপরও এখানকার ক্রিকেটের গল্পটা ট্র্যাজেডি ছাড়া কিছুই নয়। এই খেলাটির সাথে অনেক মানুষের হৃদয়, রক্ত, ঘাম ও চোখের জল মিশে আছে। তারপরও আজ ক্রিকেট কেবল সম্পদের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। আবারও সেই সুদিন কি ফিরবে? আমি মনে করি, সময়ে সাথে সাথে সব কিছুই ফিরে পাওয়া সম্ভব!’
শুধু অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারই নন, ক্রিকেটে জিম্বাবুয়ের সুদিনে ফেরার অপেক্ষায় আছেন আরো অনেকেই!