দ্য হিন্দু পত্রিকার সাংবাদিক বিজয় লোকপল্লীর সাথে এক অনুষ্ঠানে বিশাল থিয়েটারের পেছনের সারিতে বসে আছেন রাজিন্দর গোয়েল। একজন অতিথি বক্তৃতা দেয়ার জন্য দাঁড়ালেন। স্বয়ংক্রিয়ভাবে দাঁড়িয়ে গেলেন গোয়েলও। লোকপল্লী তাকে বললেন, “আরে গোয়েল সাহেব, বসে পড়ুন। উনি তো আর আপনাকে দেখবেন না।“
রাজিন্দর গোয়েল একটা কথাই বলেছিলেন, “না, তিনি আমার ক্যাপ্টেন।“
বিজয় লোকপল্লীর ভাষ্যমতে, ৫৬ বছর বয়সী অংশুমান গায়েকোয়াড় আর ৫৩ বছর বয়সী সন্দ্বীপ পাতিল পর্যন্ত তাকে দেখলে হাতের সিগারেট লুকিয়ে ফেলতেন।
মহিন্দর অমরনাথের ভাষায়, “এমন ক্রিকেটারের জন্ম হরহামেশাই হয় না। ড্রেসিংরুমে তার উপস্থিতিই ছিল অনেক কিছু। ষাট-সত্তরের দশকে আমরা শুধু তার ব্যাপারেই কথা বলতাম। তার মতো ব্যাট করতে চাইতাম, তার মতো ফিল্ডিং করতে চাইতাম, তার মতো অধিনায়ক হতে চাইতাম। আমরা সবাই পতৌদি হতে চাইতাম।“
নবাব মনসুর আলী খান পতৌদি তথা টাইগার পতৌদির কথাই বলছিলাম। ব্যাট হাতে অনবদ্য, ফিল্ডিংয়ে সদা তৎপর, মাঠ ও মাঠের বাইরে ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে বর্ণিল ব্যক্তিত্বের একজনকে নিয়েই আলোচনা করা যাক।
সোনার চামচ মুখে জন্ম নেয়া এক ব্যাপার, আর ক্রিকেট মাঠে রাজত্ব করা আরেক ব্যাপার। কিন্তু টাইগার পতৌদি ছিলেন মাঠ ও মাঠের বাইরের ‘রাজপুত্র’। ষাটের দশকে টানা আট বছরে টাইগারের অধিনায়কত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি, অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডে ধবলধোলাই হয়ে আসার পরেও না। কারণ সবাই জানতেন যে, তিনিই যোগ্য ব্যক্তি, যোগ্য অধিনায়ক।
সেই যুগে এম এল জয়সিমহা, সেলিম দুররানীর মতো ক্রিকেটাররা দলে থাকলেও পতৌদি ছিলেন ‘অনন্য’। তার খেলা, ব্যক্তিত্ব পরবর্তী প্রজন্মকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছিল যে পাড়ার ক্রিকেটে ছেলেরা এক চোখ বন্ধ করে খেলত। কেননা, টাইগার কেবল এক চোখেই দেখতে পেতেন এবং এই সীমাবদ্ধতা নিয়েও অবিশ্বাস্য দক্ষতায় দীর্ঘদিন ক্রিকেট খেলেছিলেন। সেই গল্পে পরে আসা যাবে।
পতৌদি ছিলেন একজন বিপজ্জনক ও সাহসী ব্যাটসম্যান। প্রথাগত পাঠ্যবই অনুযায়ী কখনোই ব্যাটিং করেননি, বরং এতটাই অপ্রথাগত ব্যাটিং করতেন যে, অনেক সময় বিপক্ষ অধিনায়ক ফিল্ডিং সাজাতে হিমশিম খেতেন। দুর্দান্ত কাভার ড্রাইভ খেলতে পারতেন টাইগার। বিজয় মার্চেন্ট তার কাভার ড্রাইভকে ওয়ালি হ্যামন্ডের কাভার ড্রাইভের সাথে তুলনা করতেন।
উইনচেস্টারের লকার্স পার্ক প্রিপারেটরি স্কুলের ছাত্র থাকাবস্থায় নিজের ক্রিকেটীয় প্রতিভার পরিচয় দেন মনসুর আলী খান পতৌদি। ১৯৫৯ সালে স্কুলের দলকে নেতৃত্ব দেন তিনি এবং মৌসুমে ১০৬৮ রান করার পথে ডগলাস জার্ডিনের করা রেকর্ড ভাঙেন।
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক দু’বছর আগেই হয়েছিল তার। সাসেক্সে খেলার পাশাপাশি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দলেও খেলেছিলেন। অক্সফোর্ডকে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন টাইগার।
১ জুলাই, ১৯৬১ সালে ঘটে সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা। হোভে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় একটা কাচের টুকরা টাইগারের ডান চোখে ঢুকে যায় এবং দুর্ভাগ্যবশত এক চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন তিনি। ফলে একটি সম্ভাবনাময় ক্রিকেট ক্যারিয়ারের অপমৃত্যু হতে যাচ্ছিল। কিন্তু হার মানার পাত্র থোড়াই ছিলেন টাইগার। না হলেই কি না এই দুর্ঘটনার ছয় মাসের মাঝে ভারতের হয়ে টেস্ট অভিষেক হয়ে যায় তার!
অবিশ্বাস্যভাবে শারীরিক এই প্রতিবন্ধকতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ক্যাপটা দিয়ে ডান চোখ ঢেকে দাপটের সাথে ব্যাটিং করেছেন। একটা কার্যকর চোখ দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট খেলা কতটা চ্যালেঞ্জিং তা একটু বোঝার চেষ্টা করি।
কলিন মিলবার্ন ছিলেন তার সময়ের সবচেয়ে আগ্রাসী নর্দাম্পটনশায়ারের ব্যাটসম্যান। গাড়ি দুর্ঘটনায় তিনি তার এক চোখ হারিয়েছিলেন ক্যারিয়ারের মাঝপথে। দুর্ঘটনার আগে ৪৬ গড়ে রান করা মিলবার্ন আর ফিরতেই পারেননি টেস্ট দলে, দুর্ঘটনা থেকে সেরে উঠার পর ২৮ প্রথম শ্রেণীর ইনিংসে ১টি মাত্র ফিফটি করেছিলেন, ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে।
১৯৭১-৭২ এ চোখের অপারেশন করিয়েছিলেন সুনীল গাভাস্কার। তিনি তার ‘সানি ডেইজ’ বইয়ে লিখেছেন, “সেই কয়েকদিনের অভিজ্ঞতায় আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে মনসুর আলী খান পতৌদি কতটা সীমাবদ্ধতার মাঝেও ব্যাট হাতে বোলারদের শাসন করেছেন। আমার এক চোখে ব্যান্ডেজ ছিল। ঐসময় একটা ভালো চোখ নিয়ে কোনো কাজই ঠিকমতো করতে পারতাম না। না পারতাম এক গ্লাস পানি ঠিকমতো খেতে, না পারতাম আইসক্রিম খেতে, দেখা যেত আইসক্রিমে কামড় দিতে গিয়ে শূন্যে খাবি খাচ্ছি। আমার এই অভিজ্ঞতা পতৌদির প্রতি আমার সম্মান বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।“
দৃষ্টিশক্তির এই প্রতিবন্ধকতা ঠিক কতটুকু প্রভাব ফেলেছিল টাইগারের ব্যাটিংয়ে?
দুর্ঘটনার আগে চার ইনিংসে তার রান ছিল ৬৫, ৬৫, ৫৫ ও ১০৮। সেই মৌসুমে দুর্ঘটনার আগপর্যন্ত তার রান ছিল ৫৫ গড়ে ১২১৬। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকর্ড ছিল টাইগারের বাবার করা ১৩০৭ রান।
দুর্ঘটনার চার মাসের মাথায় ক্রিকেটে ফেরেন তিনি এবং ফিরেই জম্মু ও কাশ্মীরের বিপক্ষে ৫১ রানের ইনিংস খেলেন। ভারত বোর্ড প্রেসিডেন্ট একাদশের হয়ে এমসিসির বিপক্ষে ব্যারি নাইট, টনি লক আর টেড ডেক্সটারকে একহাত নিয়ে করেন অনবদ্য ৭০।
একমাসেরও কম সময়ের মাঝে ফিরোজ শাহ কোটলায় সিরিজের ৩য় টেস্টে অভিষেক হয় টাইগার পতৌদির। কলকাতায় ৪র্থ টেস্টে করেন ৬৪ ও ৩২। চেপকে শেষ টেস্টে করেন বিস্ফোরক ১০৩।
১০৩ রানের ইনিংসের সময় প্রতিপক্ষ অধিনায়ক টেড ডেক্সটার এতটাই রক্ষণাত্মক ভঙ্গিমায় চলে গিয়েছিলেন যে অফস্পিনার ডেভিড অ্যালেন যখন বল করছিলেন তখন চারজন ফিল্ডারকে বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। শতরান পূর্ণ করার পরপরই ডজনকে ডজন অনুরাগী মাঠে ঢুকে পড়েছিল অভিনন্দন জানাতে। ততদিনে সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনার ছ’মাসও পূরণ হয়নি।
টেস্ট ক্রিকেট বা প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তার পরিসংখ্যান যথেষ্ট সাদামাটা মনে হতে পারে। যখন আপনি ভাববেন ৩৫ এমন কোনো গড় নয়, তখনই নেভিল কার্ডাস বলবেন, “পরিসংখ্যান একটা আস্ত গাধা।” টাইগার পতৌদি এই সামান্য সংখ্যাটার চেয়েও অনেক বেশি দুঃসাহসী ব্যাটসম্যান ছিলেন। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের সেই বিখ্যাত টেস্টের কথাই ধরা যাক।
ম্যাচটা ভারত ইনিংস ব্যবধানে হেরে গেলেও পতৌদির বীরোচিত ভূমিকার জন্য এই ম্যাচ ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসবেত্তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম ইনিংসে ভারতের স্কোর ২৫ রানে ৫ উইকেট। ম্যাচের আগে পতৌদি জানিয়েছিলেন হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটের কারণে খেলবেন না তিনি। আকস্মিকভাবে ম্যাচের দিন সকালে বললেন, “আমি খেলবো।” এটা অনুমেয় ছিল যে তার চোট সারেনি, কিন্তু মানুষটা যে মনসুর আলী খান পতৌদি!
সেই ইনিংসে বোলারদের এমন বেধড়ক পেটালেন যে লিন্ডসে হ্যাসেট তাকে সেরা সময়ের ব্র্যাডম্যানের সাথে তুলনা করেন।
খোঁড়ানো পা- চোটগ্রস্ত হ্যামস্ট্রিং নিয়ে প্রথম ইনিংসে ৭৫ ও ২য় ইনিংসে ৮৫ রান করেছিলেন টাইগার। রবার্ট মেনজিস এই ম্যাচে তার পারফরম্যান্স সম্পর্কে বলেন, “With one good eye and one good leg, if you could hit our fast bowlers all over the place, I shudder to think what (he) could’ve done with two good eyes and two good legs.“
২১ তম জন্মদিনের ৭৭ দিন পর অধিনায়কত্ব বুঝে নেন পতৌদি। অনেকে তাকে ভারতের অন্যতম সেরা অধিনায়ক মনে করেন। তবে তার অধিনায়কত্বে ভারত ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট জিততে পারেনি।
তবে দুর্বল দলের জায়গায় শক্তিশালী অস্ত্র হাতে থাকলে কেমন করতেন পতৌদি?
১৯৬৬-৬৭-তে হোভে সফররত ওয়েস্ট ইন্ডিজ এক প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছিল সাসেক্সের বিপক্ষে। সাসেক্সের অধিনায়ক ছিলেন পতৌদি। প্রথম ইনিংসে ১২৩ রানে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে গুটিয়ে দেয়ার পর ব্যাটিংয়ে নামে সাসেক্স। চার্লি গ্রিফিথ ও রুডলফ কোহেনের শুরুর তোপ থেকে পিটার গ্রেভস ও ওকম্যানকে দূরে রাখতে নিজেই তিন নম্বরে নেমে যান পতৌদি। সাসেক্সের প্রথম ৪০ রানের ৩২ রানই আসে পতৌদির ব্যাট থেকে। গ্রেভস-ওকম্যান ব্যাটিংয়ে নামতে নামতে ক্লান্ত হয়ে যান গ্রিফিথ-কোহেন। সুযোগ কাজে লাগিয়ে ৫৯ রানের ম্যাচজয়ী জুটি গড়েন তারা। দুদিনের মাঝেই সাসেক্স ৯ উইকেটে ম্যাচ জিতে যায়।
এই উদাহরণ প্রমাণ করে অধিনায়ক হিসেবে পতৌদির যোগ্যতাকে। ভারত দলে তার হাতে সাসেক্সের মতো ভালো পেসার ছিল না, কিন্তু সীমিত অস্ত্র নিয়েই জয়ের জন্য লড়তেন পতৌদি। ম্যাচের আগে করে আসা পরিকল্পনা অনেক সময় মাঠেই পাল্টে ফেলতেন ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী, যেটার চর্চা অন্তত ভারতে ছিল না। ব্যাটিং অর্ডারে পরিবর্তন বা বোলারদের নিয়ে জুয়া খেলতে দ্বিধাবোধ করতেন না টাইগার। অনেক সময়ই ব্যর্থ হতেন, কিন্তু তার সময়ে চেষ্টার অভাবে প্রতিপক্ষের কাছে উড়ে যায়নি ভারত।
নিজের খেলা ৪৬ টেস্টের ৪০টিতেই ছিলেন অধিনায়ক, দলকে জয় উপহার দিয়েছেন ৯ টেস্টে, হেরেছেন ১৯টিতে, ড্রও ঠিক ততটিই। ১৯৬৮-তে বিদেশের মাটিতে প্রথম টেস্ট ম্যাচ ও টেস্ট সিরিজ জয়ে নেতৃত্ব দেন তিনি। ১৯৫৭-৭০ পর্যন্ত পূর্বসূরি রণজিৎসিংজি ও দুলীপসিংজির পদাঙ্ক অনুসরণ করে খেলেছেন সাসেক্সের হয়ে, অধিনায়কত্বও করেছেন। ১৯৬৮ সালে উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটারও হয়েছেন।
মাঠ ও মাঠের বাইরে রাজকীয় ভঙ্গিমা ধারণ করতেন টাইগার। ইয়ান চ্যাপেল একবার তাকে তার পেশা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। পতৌদি উত্তর দিয়েছিলেন, “I am a prince.“
চ্যাপেল এত সহজে ছেড়ে দেয়ার পাত্র নন। আবারও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন। উত্তর এসেছিল “I am a bloody prince.“
পতৌদি অত্যন্ত দূরদর্শী অধিনায়ক ছিলেন। তার সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। প্রথাগত রক্ষণাত্মক অধিনায়কত্ব করতেন না। জিততে চাইতেন।
অংশুমান গায়েকোয়াড় যখন ভারত দলে সুযোগ পান তখন অধিনায়ক ছিলেন টাইগার। গায়েকোয়াড় টিপসের জন্য গিয়েছিলেন তার কাছে। পতৌদি তাকে বললেন, “দেখ, ভারতের হয়ে খেলতে এসেছ। যদি ব্যাটসম্যান হও, রান করতে জানতে হবে। যদি বোলার হও, উইকেট নিতে জানতে হবে। যদি না জানো, ফিরে যাও। সময় নষ্ট করার প্রয়োজন নেই।“
অধিনায়ক হিসেবে ৯ টেস্ট জেতা অধিনায়ক বা ৩৫ গড়ের একজন সাধারণ ব্যাটসম্যান নন, নবাব মনসুর আলী খান পতৌদি ছিলেন তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু। কেবল এক চোখ নিয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছেন ক্রিকেটে, জিততে চেয়েছেন, ভারতকে জেতাতে চেয়েছেন। প্রথা ভেঙে নতুনভাবে ভেবেছেন। যখন অধিনায়কত্ব পান, তখন ছিলেন দলের কনিষ্ঠতম সদস্য। কিন্তু তার অধিনায়কত্ব নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেননি। রাজপুত্র বা নবাব বলে নয়, দলকে রাজার মতো নেতৃত্ব দেয়ার কারণে। সৌরভ গাঙ্গুলীকে বলেছিলেন, “খেলোয়াড় কোথা থেকে আসছে সেটা মুখ্য নয়, জেতাটাই আসল।” নিজেও সবসময় বিশ্বাসী ছিলেন এই নীতিতে। ভারতীয় ক্রিকেটে টাইগার পতৌদি তাই হয়ে থাকবেন অন্যতম বর্ণিল এক চরিত্র।