এই যে আমাদের ক্রিকেটে এত সাফল্য, তা একদিনে হয়নি। একটুখানি ব্যর্থতা এলে সমর্থকরা যখন সমালোচনার কাঁটাতারে ক্রিকেটার আর টিম ম্যানেজমেন্টকে ঝুলিয়ে রাখে, সেটাও একদিনে হয়নি। হবে কী করে, এদেশে তো ক্রিকেটই ছিল অবহেলিত! ঢাকাই ফুটবলের জৌলুশের সামনে ক্রিকেট পাত্তাই পেতো না! অথচ সেই ক্রিকেটই এখন কোটি মানুষকে এক করে রেখেছে।
অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশে এই বাংলায় ক্রিকেট ছিল। ভারত আলাদা হলে বাংলাদেশ হয়ে যায় পাকিস্তানের অংশ, অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান। তখন থেকে একটু একটু করে ক্রিকেটের অগ্রগতি। তবে অন্যান্য খাতের মতো ক্রিকেটেও পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে অবহেলিত ছিল এখানকার ক্রিকেট। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আর অধিকার আদায়ের পর্বভিত্তিক লড়াইয়ের মতো এ দেশের ক্রিকেটও লড়েছে নিজের জায়গা করে নেওয়ার জন্য।
পাকিস্তান আমলে ক্রিকেটেও সমান আগ্রহ ছিল…
১৯৪৭ সালে এই উপমহাদেশে ব্রিটিশদের রাজত্ব শেষ হয়। কিন্তু যাওয়ার আগে তারা এই ভারতীয় উপমহাদেশকে ভারত, পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে ভেঙে দিয়ে যায়। নতুন দেশ হিসেবে ভারত ও পাকিস্তান নতুন করে আশা-ভরসাকে পাথেয় করে দেশ ও জাতির পুনঃনির্মাণ শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় ক্রীড়াক্ষেত্রেও পুনঃনির্মাণ শুরু হয়।
যে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের রোষ পুষে রেখেছিল উপমহাদেশের জনগণ, তাতে হয়তো ক্রিকেটকে ত্যাগ করারই কথা ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিনের জনপ্রিয় খেলাটি ততদিনে দুই দেশেই সমান জনপ্রিয়তা পেয়েছে, যে কারণে ক্রিকেটকে ফেলে দেওয়া অসম্ভব ব্যাপার ছিল। তার চেয়েও বড় কথা, এই ক্রিকেটই একসময় অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে ভারত-পাকিস্তানের কূটনৈতিক মাধ্যম হয়ে ওঠে, যার ধারাবাহিকতা এখনও বজায় রয়েছে।
বেশকিছু উদ্যমী মানুষের হাত ধরে পশ্চিম পাকিস্তানে ক্রিকেট প্রতিনিয়ত উন্নতি করতে থাকলো। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে এর ঠিক উল্টো চিত্র। নাটোরের মহারাজা এবং সারদারঞ্জন রায় পূর্ব পাকিস্তানের ক্রিকেটীয় চিত্রনাট্য থেকে সরে যাওয়ার পর এখানকার ক্রিকেট পড়ে রইলো একেবারে ক্লাসের শেষ বেঞ্চে। ফুটবল আর হকি ধীরে ধীরে ক্রিকেটের জায়গা নিতে থাকলো।
সবচেয়ে বড় কথা, ঢাকা জেলা যখন ১৯৩৭ সালে আইলিংটন করিন্থিয়ানস দলকে হারিয়ে দিল, তারপর থেকে এই জনপদে ফুটবলের কদর অনেকগুণে বেড়ে যায়।
তবে এটাও মনে রাখতে হবে, ইংল্যান্ডের এই দলটি মাত্র ওই একটি ম্যাচেই হেরেছিল। অবিভক্ত ভারতে তারা ৩৮ ম্যাচ খেলে জিতেছিল ৩৬টিতেই, পরাজয় কেবল এই ঢাকায়। কিন্তু তাদের বিপক্ষে ওই একটি জয়ই ঢাকার ফুটবলকে এগিয়ে নিয়েছিলো, যার বৈভব ছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ জন্ম নেওয়ার পরও।
তারপরও ক্রিকেট ছিল…
সাংবাদিক ওসমান সামিউদ্দিনের বিখ্যাত বই ‘The Unquiet Ones’ থেকে জানা যায়, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরও নতুন দুই দেশের ক্লাবগুলো খেলা চালিয়ে গিয়েছিলো, সেটা ফুটবল ও ক্রিকেট দুটোই। রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক মুহাম্মদ কামরুজ্জামান ২০১১ বিশ্বকাপের সময় লিখেছিলেন,
‘যদিও দেশভাগের বছরে ফুটবল ও ক্রিকেট লিগ বন্ধ করা হয়েছিল, তারপরও বিভিন্ন ক্লাব তাদের ক্রিকেটীয় স্পিরিট ধরে রাখতে শীত মৌসুমে প্রীতি ম্যাচ খেলতো।’
ইস্ট পাকিস্তান ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন যেভাবে হলো
১৯৪৮ সালে উইন্ডিজ থেকে একটি ক্রিকেট দল এবং কমনওয়েলথ দেশভুক্ত কিছু দল পাকিস্তানে খেলতে আসে। তাতে পূর্ব পাকিস্তানের একেবারেই আসে-যায়নি। কিন্তু ফিরোজ খান নুন, যিনি কিনা একজন পাঞ্জাব জমিদার এবং ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী, ১৯৫১ সালে এসে পূর্ব পাকিস্তান ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন গড়ার কথা চিন্তা করলেন। তার পরপরই এখানে ক্রিকেট লিগের আয়োজন বাড়তে থাকলো।
মাসুদ সালাউদ্দিন নামের একজন সাবেক ভারতীয় অলরাউন্ডার, যিনি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৯৩৫-৩৬ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দু’টি অনানুষ্ঠানিক টেস্ট খেলেন, তিনি দেশভাগের পর পাকিস্তানে চলে আসেন এবং অ্যাসোসিয়েশন তৈরি হওয়ার পর তিনি এখানে ক্রিকেট নিয়ে কাজ শুরু করেন।
মায়ানমারের একটি ক্রিকেট দলের সফর
১৯৫১ সালের দিকে পশ্চিম পাকিস্তানের এক ব্যবসায়ী নিজ অর্থায়নে বার্মা (মায়ানমার) থেকে একটি ক্রিকেট দলকে ঢাকায় সফর করান। দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে এটাই ছিল প্রথম কোনো বিদেশি ক্রিকেট দলের সফর। দলটি সিআই শিট দিয়ে ঘেরা বাউন্ডারিওয়ালা ঢাকার ডিএসএ মাঠে সবুজাভ উইকেটে বেশ কয়েকটি প্রীতি ম্যাচ খেলে। স্থানীয় দল প্রতিটি ম্যাচে তাদেরকে হারিয়েছিলো।
যদিও বলা হয়, সফরকারীরা একরকম ‘ছেড়ে দেওয়ার’ মতো করে ম্যাচগুলো খেলেছিল। সাদা পোশাক রেখে দিয়ে তারা রঙিন পোশাক পরেছিল, মাথায় পরেছিল খড়ের ক্যাপ। এমনকি মাঠের মধ্যেই ধূমপান করার দৃশ্য প্রমাণ করেছিলো, ম্যাচগুলোকে তারা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। তাদের শরীরী ভাষাতেও ছিল না পেশাদার ক্রিকেটারদের ছোঁয়া। অবাক হলেও সত্যি যে, এত কিছুর পরও স্থানীয় ক্রিকেট দল এ নিয়ে কোনো প্রশ্নই তোলেনি। বরং তারা খুশি ছিল যে, ফুটবল ম্যানিয়ার এই দেশেও ক্রিকেট হচ্ছে!
পরিবর্তনের হাওয়া
ভাষা আন্দোলনের পর পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে দারুণ পরিবর্তন আসে। সালাম, বরকত, শফিক আর জব্বারের রক্ত ঝরার আন্দোলনে বাংলার মানুষ তাদের অধিকার নিয়ে সচেষ্ট হয়ে ওঠে যার হাওয়া লাগে ক্রীড়াক্ষেত্রেও। বিশেষ করে ক্রিকেটে।
১৯৫২-৫৩ মৌসুমে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক সিরিজ খেলতে ভারত সফরে যায় পাকিস্তান। সিরিজ শেষ করে সেবার পশ্চিম পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অধিনায়ক আবদুল হাফিজ খারদার চট্টগ্রামে নেমে তিনি বাংলার মানুষকে ক্রিকেটের ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করেন।
একই সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে ম্যাচের আয়োজন করা হয়। চট্টগ্রামে একটি ও ঢাকায় তিনটি ম্যাচ আয়োজনের পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল চট্টগ্রাম ইস্পাহানি পরিবারের সদস্য ও পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড প্রধান, জাস্টিস এআর কর্নওয়ালিসের।
পূর্ব পাকিস্তান অ্যাসেম্বলির নেতা এটিএম মুস্তফাকে অধিনায়ক করে ১৬ সদস্যের একটি দল ঘোষণা করে ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশন (ইপিএসএফ)। দু’দিনের ম্যাচ ছিল সবগুলো এবং সিরিজ হয়েছিলো ড্র, তবে নজর কেড়েছিলেন কয়েকজন স্থানীয় ক্রিকেটার। সিরিজের শেষে পশ্চিম পাকিস্তান মায়ানমারে খেলতে যায়। ওই সিরিজে পূর্ব পাকিস্তানের ড. মাজহারুল ইসলাম দামাল এবং উইকেটরক্ষক কাজী মহসীনকে অল পাকিস্তান দলে জায়গা দেওয়া হয়, যদিও তাদেরকে নেওয়া হয়েছিল কেবলই পশ্চিম পাকিস্তানের দু’জন ক্রিকেটারের ইনজুরির কারণে।
তবে পশ্চিম পাকিস্তানের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওই সিরিজ পূর্ব পাকিস্তানের ক্রিকেটের বীজে অঙ্গুরোদগম ঘটিয়ে দিয়েছিলো, যার ধারাবাহিকতায় একের পর এক উদ্যোগ, সাফল্য ক্রিকেটকে ঘিরে বাংলায় আসতে থাকে।
ঢাকা স্টেডিয়াম নির্মাণ
১৯৫৫ সালে ঢাকা স্টেডিয়াম তৈরি করা হয়, বর্তমানে যা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম নামে পরিচিত। ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজনের লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তানের এই স্টেডিয়াম এখানকার ক্রিকেটকে দিয়েছিলো নতুন দিগন্ত। ধীরে ধীরে নতুন প্রজন্মের কাছে ক্রিকেট পছন্দের জায়গাটা করে নিতে থাকলো। ১৯৫৫ সালের পহেলা জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বিশেষ দিন, নতুন এই স্টেডিয়ামে সেদিনই প্রথম টেস্ট ম্যাচ আয়োজন করা হয়; সফর করেছিলো ভারত।
জুয়েল-রকিবুলদের ক্রিকেট
অবিভক্ত পাকিস্তানে বাঙালি ক্রিকেটারের নাম আসলে সবার আগে আসবে রকিবুল হাসান ও শহীদ জুয়েলের নাম। পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকা স্টেডিয়ামের কারণে ক্রিকেট যখন এখানে নতুন গতি পেলো, তখনই ক্রিকেটার হিসেবে আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল আর রকিবুল হাসানদের জন্ম নেওয়া। তারা নিজেদের ক্রিকেট দক্ষতাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ঢাকার সবুজ উইকেটে উইসলি হল, অ্যালান ডেভিডসন আর ফ্রেড ট্রুম্যানদের মতো বোলারদের ঘাম ঝরিয়ে ছাড়তে চাইতেন তারা।
দু’জনের পরিশ্রমই কাজে দিয়েছিলো। জুয়েলের স্ট্রোক খেলার ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানি নির্বাচকদের নজর কেড়েছিলো, একই সঙ্গে রকিবুলও নজর কাড়তে পেরেছিলেন।
তাদের সঙ্গে এই বাংলায় মেধাবী ক্রিকেটারদের মধ্যে ছিলেন খাজা মোহাম্মদ আতাহার, কেএম ওমর, আমিরুল্লাহ মুন্নি, কেএম হাসান, চাঁদ খান, সুকুমার, মোহাম্মদ হাকিম, আলতাফ হক বকুল, লুৎফর রহমান মাখন, সোহরাব খান, মোহাম্মদ ইনাম, এসএ মজিদ কোরান, লতিফ এবং দৌলতজ্জামান।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ
পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৭১ সালের মার্চ মাস ত্থেকে। পুরো দেশের প্রায় সব বয়সী মানুষ যোগ দেয় সশস্ত্র সংগ্রামে। যেখানে যোগ দিয়েছিলেন ক্রিকেটাররাও। শহীদ হয়েছিলেন জুয়েল।
ক্রিকেট এখন দেশের প্রধান ও সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। স্বাধীনতার পর নদীতে অনেক জল গড়িয়েছে, বাংলাদেশের ক্রিকেটও পার করেছে অনেক ব্যর্থতা আর সাফল্যের সূচক। পুরো দুনিয়া বাংলাদেশকে বিশেষভাবে চেনে ক্রিকেটের কারণে। এখানকার সমর্থকরাও ক্রিকেট বলতে আপ্রাণ। সৌভাগ্যের তালিকায় এই খেলায় লাল-সবুজ পতাকার ছায়াতলে যোগ হয়েছে শত সাফল্য, যাকে পাথেয় করে ক্রিকেটে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন নিয়ে নিরন্তর এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।