বছরে নয় মাস ঠিক মতো দিনের আলোর দেখা মেলে না।
যেদিকে চোখ যায় আগ্নেয়গিরি, গ্লেসিয়ার, বরফ, উষ্ণ প্রস্রবন আর বিরান ভূমি। সব মিলিয়ে দেশের লোক সংখ্যা সাড়ে তিন লাখ। এমন দেশে ফুটবল যে আছে, এটা জেনেই বিশ্ব চমকে গিয়েছিলো।
বিশ্বকে চমকে দেওয়ার কাজটা অবশ্য ভালোভাবেই সম্পন্ন করেছে আইসল্যান্ড ফুটবল দল। ইউরোতে প্রথম আবির্ভাবেই পর্তুগালকে আটকে দেওয়া বা ইংল্যান্ডকে হারানো ছিলো তাদের বিজ্ঞাপন। এরপর বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে আটকে দিয়ে চলচ্চিত্রের একটা পর্ব দেখিয়ে ফেলেছে তারা। দুনিয়া জুড়ে লোকের এখন আইসল্যান্ডের বিজয় ধ্বনি ‘ভাইকিংস ক্ল্যাপ’ চেনা হয়ে গেছে।
এবার আইসল্যান্ড আরেকটা চমক নিয়ে দুনিয়ার সামনে এলো- তাদের একটা জাতীয় ক্রিকেট দলও আছে!
হ্যাঁ, বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, দুনিয়ার এই উত্তরতম প্রান্তেও পৌঁছে গেছে ক্রিকেট। মূলত অভিবাসীদের হাত ধরেই চলছে এই দেশটির ক্রিকেট। এখনও বলার মতো কোনো কাঠামো তারা দাঁড় করাতে পারেনি। তবে এরই মধ্যে একটা জাতীয় দল করে ফেলেছে তারা। আর এই জাতীয় দল সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে এই জুলাই মাসেই নিজেদের অভিষেক এক দিনের ম্যাচ খেলে ইতিহাস গড়ে ফেলেছে। এখন তারা বলতে পারে, আমরাও ক্রিকেট খেলি।
ওহ, না। ভুল বলা হলো। আইসল্যান্ডে তারা আসলে ‘ক্রিক্কেট’ (Krikket) খেলেন; অন্তত স্থানীয়রা এভাবেই বলে অভ্যস্ত। স্থানীয়দের সাথে যোগাযোগটা ঠিক রাখতে অভিবাসী ক্রিকেটাররাও খেলার নামটা ওভাবে উচ্চারণ করেন।
আইসল্যান্ড ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হলেন দেরিক দেওনারায়েন। দেরিক এই দেশটিতে এসেছেন গায়ানা থেকে। আইসল্যান্ডের নাগরিক তার বান্ধবীকে বিয়ে করে এখানে থিতু হয়েছেন। এই জাতীয় দলটির সহঅধিনায়ক অভিষেক রাজ চৌহান। নাম শুনেই বুঝতে পারছেন, অভিষেক এসেছেন ভারত থেকে। তিনি ভাগ্যের সন্ধানে ২০১৪ সালে এই দেশটিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। আর এমন করেই দেরিক, অভিষেকসহ ৩৫ জন মিলে গড়ে তুলেছেন আইসল্যান্ডের ক্রিকেট পরিবার।
হ্যাঁ, এখন অবধি আইসল্যান্ডের ক্রিকেটারের সংখ্যা ৩৫। এদের সবারই অন্য কোনো পেশা আছে। সেই কাজের পাশাপাশি, কাজে একটু ছুটি নিয়ে তারা খেলছেন ক্রিকেট।
৩৫ সংখ্যাটা শুনে আপাতত কম মনে হতে পারে। তবে অভিষেক বলছেন, শুরুতে এই সংখ্যাটাও তাদের কাছে কল্পনাতীত মনে হতো,
‘চার বছর আগে আমি যখন আইসল্যান্ডে প্রথম অনুশীলন করি, তখন মোট ক্রিকেটারের সংখ্যা ছিলো ৫ জন। এখন আমরা ৩৫ জনে পরিণত হয়েছি। এটা আমাদের জন্য, আমাদের ক্রিক্কেটশ্যামব্যান্ড আইসল্যান্ডের জন্য খুবই উৎসাহের খবর।’
অভিষেক যে নামটি বললেন, সেই ‘ক্রিক্কেটশ্যামব্যান্ড আইসল্যান্ড’ হলো এই দেশটির ক্রিকেট অভিভাবক সংস্থা।
আইসল্যান্ডের ক্রিকেটার কম থাকতে পারে, ক্রিকেট লিগ না থাকতে পারে, কিন্তু গর্ব করার উপাদানের অভাব নেই। তাদের কিছু লোক দাবি করেন, ইংল্যান্ডে নয়, ক্রিকেটের জন্ম নাকি খ্রিষ্টের জন্মের আগে এই জায়গায় হয়েছিলো! যদিও এই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ ঐতিহাসিকেরা পাননি। ইতিহাসবিদরা বলেন, গত শতকের একেবারে শেষ দিকে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে কিছু শখের ক্রিকেটার এখানে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে পাড়ি দিয়ে ক্রিকেটের একটা ভূমি তৈরি করেছেন।
অভিষেক বলছিলেন, তাদের এই দলে প্রায় সব টেস্ট খেলুড়ে দেশের নাগরিক আছে। আর এটাই নাকি তাদের শক্তি,
‘আমি একজন বারটেন্ডার। বস্তুত, দলের বাকি প্রায় সবাই হোটেলে কাজ করে। আমাদের দলে সব টেস্ট খেলুড়ে দেশের খেলোয়াড় আছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা…. সব। বিভিন্ন পরিবেশ ও পরিচিতি থেকে এসেও আমাদের একটা সাধারণ আগ্রহ হলো ক্রিকেট।’
কিন্তু ক্রিকেট খেলাটা এখানে নিশ্চয়ই সোজা কাজ নয়। যেখানে ফুটবল খেলার জন্যই বিশেষ ব্যবস্থা দরকার হয়, সেখানে ক্রিকেট চলে কীভাবে?
অভিষেক এখানে তার ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতাটা বলছিলেন,
‘চরম আবহাওয়ার জন্য এখানে কোনো প্রাকৃতিক টার্ফে খেলা হয় না। গ্রীষ্মের সময় আমরা রিকজাভিকে একটা ফুটবল মাঠে কৃত্তিম টার্ফে ক্রিকেট খেলছি। ফুটবল মাঠে খেলার জন্য আমাদের আগে থেকে অনুমতি নিতে হয়। সাধারণত সপ্তাহশেষে আমরা ৩-৪ ঘন্টা খেলার সুযোগ পাই। আর শীতে আমরা ইনডোরে খেলি।’
এখানে ক্রিকেট খেলতে গেলে সব বল নাকি ব্যাকফুটে খেলার মানসিকতা থাকা চাই! অন্তত তেমনই বলছিলেন অভিষেক,
‘অ্যাস্ট্রোটার্ফে খেলাটা একেবারে ভিন্ন একটা চ্যালেঞ্জ। ফাস্ট বোলারদের প্রতিটা বল কাঁধ বরাবর চলে আসে। ফলে ব্যাটসম্যানকে প্রতিটা বল ব্যাকফুটে খেলার মানসিকতা রাখতে হয়।’
গ্রীষ্মে আরেকটা মজা আছে। যেহেতু এখানে সূর্যাস্ত হয় খুব অল্প সময়ের জন্য; তাই মাঝরাতেও আপনি আলো না জ্বালিয়েও ক্রিকেট খেলতে পারবেন। এই সুযোগটা নিয়ে থাকে আইসল্যান্ডের ক্রিকেটাররা। ফুটবল কর্তৃপক্ষের সাথে ঝামেলা কমাতে মাঝরাতে, যখন কোনো ফুটবল খেলা থাকে না, তখন গিয়ে তারা ক্রিকেট খেলেন।
অভিষেক বলছিলেন,
‘কখনো কখনো অনুমতি নেওয়ার ঝামেলা কমাতে আমরা আমাদের খেলাটা মাঝরাতে আয়োজন করি। ওই সময় ফুটবল ম্যাচ থাকে না। আর মাঝরাতে খেললে আমাদের কাজেরও কোনো সমস্যা হয় না। আমাদের জন্য মাঝরাতে খেলাটা কেবল মজা নয়; প্রয়োজন।’
ক্রিকেটটাকে অভিষেকরা বেশ গুরুত্বের সাথেই নিয়েছেন। তিনি বলছিলেন, প্রথম যখন তাদের খেলতে দেখেছিলেন স্থানীয় আইসল্যান্ডের বাসিন্দারা, তারা নাকি ভিনগ্রহের কোনো প্রাণী দেখার মতো চমকে উঠেছিলেন। এখনও স্থানীয়দের মধ্যে তেমন কোনো সাড়া তারা তৈরি করতে পারেননি; যদিও আশার কোনো কমতি নেই।
আইসল্যান্ড দলটি এখন ইংল্যান্ডে আছে; সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে খেলার জন্য। কিন্তু এই সফরে তারা একটি পয়সাও পাবে না। উল্টো যার যার কর্মক্ষেত্র থেকে বিনা বেতনের ছুটি নিয়ে আসতে হয়েছে তাদের।
অভিষেক বলছিলেন, ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসাই তাদের এই ছুটে বেড়ানোর প্রেরণা,
‘আপনি এক জীবনে সবকিছু অর্জন করতে পারবেন না। আমাদের এই ভালোবাসাটাই আমাদের উপার্জন। কিন্তু এটা দূর্ভাগ্যজনক যে, আমরা সরকারের কাছ থেকে কোনো সহায়তা পাই না। এটা দুঃখজনক যে, আমাদের কয়েক জন গুরুত্বপূর্ন খেলোয়াড় এখানে আসার জন্য ছুটি পায়নি।’
অভিষেকদের দলের একজন কোচও আছেন। ইংল্যান্ড ও ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের (ইসিবি) সার্টিফিকেট পাওয়া একজন কোচ হলেন ড্যারেন ট্যালবট। তিনি এখানে আসার আগে ক্যারিয়ারে বিভিন্ন স্তরে কোচিং করিয়েছেন। এখন আর উপার্জনের জন্য নয়, নতুন একটা স্বপ্নের জন্য কাজ করছেন।
ট্যালবট আইসল্যান্ডের ক্রিকেট নিয়ে খুবই আশাবাদী একজন মানুষ। তিনি বলছিলেন,
‘এখানে প্রতিভার অভাব নেই। আমাদের অধিকাংশ ক্রিকেটার যার যার দেশে ক্রিকেট খেলে এসেছে। আমার ধারণা আইসল্যান্ড দল ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিভাগে লড়াই করার যোগ্যতা রাখে। এখানে আমার মনে হয় চ্যালেঞ্জ মূলত অবকাঠামো।’
‘আইসল্যান্ডে কোনো ক্রিকেট সরঞ্জামের দোকান নেই। ফলে আমি যখন দেশে আসি, ওদের জন্য কিছু কিছু ক্রিকেট সরঞ্জাম নিয়ে যাই। আবার খেলোয়াড়রা যার যার দেশ থেকে কিছু আনিয়ে নেয়।’
ট্যালবট, অভিষেক বা অন্য যে কোনো ক্রিকেটার; এদের স্বপ্ন আছে। কিন্তু তারা জানেন যে, তারা এখনও আইসিসির স্বীকৃতি পাওয়া থেকে বহুদূরে অবস্থান করছেন। আইসিসির শর্ত অনুযায়ী স্বীকৃতি পেতে হলে আট দলের একটা সিনিয়র লিগ থাকতে হয় দেশে। কিন্তু সাড়ে তিন লাখ লোকের দেশে ক্রিকেট যেখানে স্থানীয়রা চেনেই না, সেখানে এই স্বপ্ন দেখাটা বাড়াবাড়ি। এটা ট্যালবটরাও বোঝেন যে, নিকট ভবিষ্যতে ২০০ ক্রিকেটার তৈরি করাটা সহজ হবে না।
এখন আইল্যান্ডে একটা ক্রিকেট কাপ হয়-ভোলকানিক অ্যাশেজ। সেখানে অংশ নেয় দুটি দল- রিকজাভিক ভাইকিংস ও কোপাভোগুর পাফিনস।
আইসল্যান্ডে একটা ‘আইপিএল’ও শুরু হচ্ছে-আইসলেনস্ক প্রিমিয়ার লিগ। সিক্স এ সাইড এই টুর্নামেন্টে অংশ নিচ্ছে পাঁচটি দল- রিকজাভিক ভাইকিংস, হাফনারফোরদুর হ্যামারস, সেল্টারনেস সানসেটসম গ্রোয়াবের গেইসার্স ও কোপাভোগুর পাফিনস।
তবে এই দৃশ্য নিয়ে হতাশ হয়ে বসে থাকতে রাজি নন ক্রিকেটাররা ও কোচ। তারা এখন ‘ক্রাউড ফান্ডিং’-এর মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করার চেষ্টা করছেন। এই টাকা তারা ব্যয় করবেন স্কুলগুলোতে ক্রিকেট ছড়িয়ে দিতে। একদিন তারা সত্যিই দেখতে চান এই আইসল্যান্ডে পা শক্ত করে দাড়িয়েছে ক্রিকেট।
ওহ, না। ক্রিক্কেট!