ফুটবল এমন একটি খেলা যেখানে মিশে থাকে প্রচন্ড আবেগ ও উত্তেজনা। একটি ফুটবল খেলার অন্যতম উত্তেজনাদায়ক মুহূর্ত হলো যখন একজন খেলোয়াড় গোল করেন। এখন গোলের পর আবগের বশে সেই খেলোয়াড় উৎযাপনের জন্য অনেক কিছুই করে ফেলেন। এরমধ্যে একটি খুব সাধারণ একটি ঘটনা হচ্ছে তার গায়ের জার্সি খুলে ফেলা। কিন্তু এই সাধারণ ঘটনার পরিণতি হচ্ছে একটি হলুদ কার্ড। নিত্যনতুন নিয়মের পৃষ্ঠে জর্জরিত ফুটবলারদের রোবট বানানোর যে প্রক্রিয়া চলছে তারই এক অন্যতম সংযোজন বলা যায় এটিকে।
২০০৪ সালের পূর্বে ফুটবলে জার্সি খুলে ফেলা নিয়ে কোন বাঁধাধরা নিয়ম ছিল না। খেলোয়াড়েরা তাদের গোলের পর উদযাপনের জন্য অহরহ খুলে ফেলতেন জার্সি। বলতে গেলে যেকোনো আইকনিক গোলের জন্য এটি ছিল একটি ট্রেডমার্ক সেলিব্রেশন। তবে এরপরই জার্সির উপর নতুন করে কিছু নিয়ম আরোপ করেন কর্তৃপক্ষ। তখন জার্সি খোলাকে মাঠে একটি নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং এর জন্য একটি হলুদ কার্ড দেখানোর নিয়ম আসে।
তবে হলুদ কার্ড দেখালেই বা কী, খেলোয়াড়েরা কি আদৌ এই নিয়ম মেনে চলেন? না, তারা এই ঝুঁকি মাথায় নিয়েই জার্সি খুলে উদযাপন করেন। তবে আগের তুলনায় জার্সি খোলার হার অনেক কমেছে। এখন খেলার একদম শেষের দিকে, মনে রাখার মতো কোনো গোল কিংবা জয়সূচক গোলের পর তারা জার্সি খোলেন। আবার এটিও খেয়াল রাখতে হয় যে খেলায় আগে কোনো হলুদ কার্ড খেয়েছেন কি না। তখন যদি জার্সি খুলেন তবে দুই হলুদ কার্ডের জন্য তাকে দেখতে হবে লাল কার্ড। মোটকথা যে তারা এই নিয়মবহির্ভূত কাজটি একটি ঝুঁকি মাথায় নিয়েই করে থাকেন।
খেলোয়াড়দের কাছে যেমন এই নিয়মটি অপছন্দের, তেমনি সমর্থকদের কাছেও। তাদের মতে এটি একটি তুচ্ছ নিয়ম যা উদযাপনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সবসময়। একদম বেরসিক মানুষই পারে এমন আনন্দের মুহূর্তে এমন একটি নিয়ম দিয়ে রাখতে। কিন্তু এই ২০০৪ এর আগেও তো এই জার্সি খোলা নিয়ে কোনো আইন ছিল না। খেলোয়াড়েরা বলতে গেলে একদম যাচ্ছেতাইভাবেই মাঠে নিজেদের গোল উদযাপন করত। সেখানে জার্সি খোলাটা ছিল একদম সাধারণ মানের একটি উদযাপন।
কিন্তু এরপর কী এমন হলো যে এই জার্সি খুলতেই নিষেধ করা হলো?
ফুটবলে খেলা সম্পর্কিত সকল আইন পরিচালনার কাজ করে থাকে আন্তর্জাতিক ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বোর্ড। ফিফা তাদের রুলবুকের ১২ নম্বর উপধারায় খেলোয়াড়েরা গোল করার পর কী করতে পারবে আর কী করতে পারবে না, এই নিয়ে বলা আছে। এর মধ্যে যা যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে – মাঠের চারপাশের উঁচু বেড়ার নিরাপত্তা বেষ্টনি বেয়ে ওঠা কিংবা সেই নিরাপত্তা বেষ্টনি ডিঙিয়ে সমর্থকদের ভেতরে এমন ভঙ্গিতে চলে যাওয়া যা কোনো সিকিউরিটি ইস্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়, দর্শকদের দিকে উস্কানিমূলক কিংবা ব্যঙ্গাত্মক কোনো অঙ্গভঙ্গি করা, মুখোশ বা একই রকম কোনো বস্তু দিয়ে মুখ ঢেকে রাখা, জার্সি খুলে ফেলা এবং জার্সি খুলে তা মাথায় বেঁধে রাখা।
যতই খেলোয়াড়দের এই নিয়মগুলোর ভেতর বেঁধে রাখার চেষ্টা করা হোক না কেন, তারা থোড়াই কেয়ার করেন তার। অনেক খেলোয়াড় তো আছেন যে একই সাথে একাধিক নিয়মও ভেঙে থাকেন। উদাহরণ হিসেবে শাবোল্কস হাসজতির কথা বলা যায়। ২০১২-১৩ মৌসুমে হ্যানোভার- ওয়ের্ডার ব্রেমেনের খেলায় হ্যানোভারের হয়ে অতিরিক্ত যোগ করা সময়ে গোল করে হ্যানোভারকে ৩-২ গোলে এগিয়ে দেয়ার পর দৌড়ে যান গ্যালারিতে সমর্থকদের দিকে। সেখানে গিয়ে জার্সি খুলে নিরাপত্তা বেষ্টনি ডিঙিয়ে গিয়ে সমর্থকদের সাথে উদযাপনে সামিল হন। একাধিক নিয়ম ভাঙায় রেফারি তখন তাকে দেখানও একাধিক হলুদ কার্ড। ফলে মাঠ ছাড়তে হয় তাকে।
তবে এভাবে একই সময়ে একাধিক হলুদকার্ড দেখানোর ব্যাপারটি ফুটবলে কিছুটা দুর্লভ। কারণ ঐ একই বছর ট্রয় ডিনি লিস্টার সিটির সাথে খেলার শেষ সেকেন্ডের গোলে প্রিমিয়ার লিগে ওয়াটফোর্ডের প্রমোশনের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার খেলায় একইভাবে সেলিব্রেশন করলেও রেফারি তাকে দেখান শুধু একটি হলুদ কার্ড।
এইভাবে খেলায় জার্সি খুলে সেলিব্রেশন করে হলুদ কার্ড পাওয়ার ঘটনাটি একদম সাধারণ হয়ে গেছে। বলতে গেলে লিগগুলোয় প্রতি সপ্তাহেই এমন ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এমন হলুদ কার্ড দেখানোর পেছনে যৌক্তিকতা কী?
কারণ বলতে গেলে অনেকগুলোই বলা যায়। কিন্তু যখন নিয়মটি করা হয়, তখন নির্দিষ্ট করে ৫টি কারণ দেখানো হয়েছিল।
একদম শুরুতে বলা হয়েছিল স্পন্সরদের বিনিয়োগকৃত অর্থ বিফলে যেতে না দেয়া। স্পন্সররা টাকা দিয়ে খেলোয়াড়দের জার্সিতে তাদের নাম ও লোগো লাগায় তাদের প্রচারণার জন্য। তারা চাইবেই যে খেলার গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোয় যাতে তাদের নাম স্পষ্ট দেখা যায়। একটি খেলার গোলের ছবিই সবচেয়ে বেশি প্রচার মাধ্যমে ছড়ায়। গোলের পর আইকনিক সেলিব্রেশনগুলো জমা থাকে ফটোগ্রাফারদের জন্য। ওই ছবিগুলোই ফলাওভাবে প্রচারিত হয় পুরো বিশ্বে। এমন মুহূর্তে যদি জার্সি গায়ে না থাকে, তবে স্পন্সররা প্রচারের একটি বড় সুযোগ হারাবে। এই দিক বিবেচনা করলে জার্সি খোলাকে নিষিদ্ধ করা যৌক্তিক।
এরপর এই জার্সি খুলে সেলিব্রেশন করাকে মাত্রাতিরিক্ত সেলিব্রেশন হিসেবেও ধরা হয়। জার্সি খুলে এভাবে সেলিব্রেশন অনেক সময় উত্তেজিত করে তোলে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড় ও দর্শকদের; পরে যা অনেক সময় কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতিতেও রূপ নেয়। তবে সব মাত্রাতিরিক্ত উদযাপনের ফল এমন হয় না। অনেক সময় খেলোয়াড় পারেন না নিজের আবেগকে ধরে রাখতে। যেমন ২০১২ সালে কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্সের বিপক্ষে ৯০+৪ মিনিটে গোল করে ম্যানচেস্টার সিটির শিরোপা নিশ্চিতের পর সার্জিও আগুয়েরো জার্সি খুলে যে বুনো উল্লাস করেছিলেন, তা উস্কানিমূলক ছিল না, ছিল না কিউপিআরের কাউকে উদ্দেশ্য করেও। সেই শিরোপা-নির্ধারণী গোলের পর যে কেউই তার আবেগ ধরে রাখতে পারবে না, সেটাই বরং স্বাভাবিক।
এছাড়া এই নিয়মের মাধ্যমে খেলোয়াড়েরা জার্সির নিচে আলাদা শার্টে একটি বার্তা লিখে তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার যে চেষ্টা করে, তা-ও প্রতিহত করা হয়। বার্তাগুলো অনেকসময় হয় উষ্কানিমূলক, কিংবা রাজনৈতিক, কিংবা ধর্মীয় ব্যাপার। ১৯৯৫ সালে রবি ফাউলার এভাবে সেলিব্রেশন করে একটি বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দিয়েছিলেন। সে বছর অন্য একটি কোম্পানির কর্মচারীদের ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদ করায় মার্সি ডকস এন্ড হারবোর কোম্পানি তাদের কোম্পানি থেকে একই সাথে ৫০০ জনকে বরখাস্ত করে দেয়। জনরোষে পরে কয়েকজনকে পরে চাকরি ফিরিয়ে দেয়া হলেও তাদের কর্মপরিবেশ খুবই খারাপ করে দেয়া হয়। তখন এই ঘটনার প্রতিবাদে কিছু করার চিন্তা করেন ফাউলার ও স্টিভ ম্যাকমানাম্যান। উয়েফা কাপ উইনার্স কাপে এসকে ব্র্যান বারগেনের বিপক্ষে গোল করে তুলে ধরেন জার্সি। জার্সির নিচে থাকা অন্য পোষাকে কেলভিন ক্লেইনের লোগোর ডিজাইনে সেখানে লেখা ছিল,
‘500 Liverpool DOCKERS Sacked since September 1995’
এখানে কেলভিন ক্লাইনের লোগোর মতো করে লেখার উদ্দেশ্য ছিল এইভাবে লোগোর বিকৃতি করে বিষয়টিকে আরো উষ্কে দেয়া। এই পরিকল্পনা সফল হওয়ার সুযোগ ছিল খুবই বেশি, কারণ কেলভিন ক্লাইন ছিল সেদিনের খেলার দুই দলেরই জার্সি প্রস্তুতকারক। বলা বাহুল্য, ফাউলারের এই আইডিয়াটি সফল হয়। বিতর্কিতভাবেই এই জিনিস প্রচার হতে থাকে সবখানে। এটাকে রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে বিবেচনা করে উয়েফা জরিমানা করে ফাউলারকে।
এইরকম ঘটনা যেন আবার না ঘটে, এজন্য এর বিপক্ষেও একটি হলুদ কার্ডের নিয়ম জুড়ে দেয়া হয়। বলা হয় যে কোনোরকম বার্তাই খেলোয়াড়েরা দিতে পারবেন না। এমনি এটি যদি নিজের আপনজনকে জন্মদিকে শুভেচ্ছা জানানো কিংবা আহত সতীর্থকে সমবেদনা জানানোও হয়, তবুও তা একটি হলুদ কার্ড পাওয়ার মতো অপরাধ।
২০১০ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে জয়সূচক গোল করে জার্সি খুলে ফেলেছিলেন আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা। ইনিয়েস্তার জার্সির নিচে থাকা গেঞ্জিতে ইনিয়েস্তা নিজের বয়সভিত্তিক জাতীয় দলের প্রয়াত সতীর্থ দানি হারকে কে উদ্দেশ্য করে একটি বার্তা দিয়েছিলেন। বিশ্বকাপের ঠিক আগের বছর হারকে এই দুনিয়ার মায়া ছেড়েছিলেন। উস্কানীমুলক কিংবা অন্য কোন বিতর্কিত লেখা না হলেও শুধু নিয়মের কারণে এই আবেগপূর্ণ বার্তা দিয়েও হলুদ কার্ড দেখেন ইনিয়েস্তা। বলতে গেলে রেফারি নিয়ম রক্ষার খাতিরে হলুদ কার্ড দেখান তাকে।
কিছু বার্তা অবশ্য হাস্যরসাত্মকও হয়ে থাকে। যেমন বারবার ঝামেলায় জড়ানো বালোতেল্লি ম্যানচেস্টার সিটিতে খেলার সময় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে গোল করে জার্সি উঁচিয়ে ধরে দেখিয়েছিলেন,
“Why always me?”
বার্তাটি যে পরিষ্কারভাবে তার বারবার ঝামেলায় জড়ানো নিয়ে, তা বুঝতে কোনো কষ্ট হয়নি দর্শকদের।
আবার এইভাবে জার্সি খুলে সেলিব্রেশন নষ্ট করে খেলার কিছু মূল্যবান সময়। ২০২২ বিশ্বকাপে সব ধরনের নষ্ট করা সময়ের পই পই হিসাব করে পরে যোগ করা হলেও এমনভাবে সময় গণনা সম্ভব হয় না বাকি সব খেলায়। কারণ সেটা একে তো সময়সাপেক্ষ, তার উপর এর জন্য আলাদা করে লোকবল নিয়োগ দিতে হয়।
গোলের পর একজন খেলোয়াড়কে খুব অল্প সময়ের মতো দেয়া হয় উদযাপন করার জন্য। এই সময়ের মধ্যেই সবাইকে আবার কিক-অফের জন্য প্রস্তুত হতে হয়। সে যদি জার্সি খুলেও ফেলে, তাকে এই সময়ের মধ্যেই তা পরে খেলায় যোগ দিতে হবে। অনেক খেলোয়াড়ই এই সময়ের মধ্যে জার্সি সঠিকভাবে পড়ে ফেলতে পারেন না। উদাহরণ হিসেবে ডিয়েগো ফোরলানের কথা বলা যায়। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে খেলার সময় সাউদাম্পটনের বিপক্ষে এক খেলায় খেলার শেষদিকে জয়সূচক গোল করে জার্সি খুলে উদযাপন করেন। কিন্তু এরপর কিক-অফের আগে সেটি ঠিকভাবে পড়তে ব্যর্থ হন। জার্সি বারবার পেঁচিয়ে যাচ্ছিল। ঠিকভাবে পড়তে না পারায় জার্সিটি খুলে তিনি হাতে নিয়েই খেলা শুরু করেন এবং সেই অতিরিক্ত যোগ করা সময়ে এভাবেই খেলতে থাকেন। অর্ধনগ্ন কিম্ভুতকিমাকার রূপে তার এই অবস্থা দর্শকদের জন্য হাসির খোরাক ছিল। রেফারির মতে এটি খেলায় আইডেন্টিফিকেশন প্রবলেম তৈরি করে। তবে ফোরলানের মতো সোনালি চুলের অন্য কোনো খেলোয়াড় খালি গায়ে মাঠে ছিল না। তো সেখানে খেলোয়াড় চিহ্নিত করতে কোনো সমস্যা হওয়ারও কথা না।
কিন্তু ঐ যে আইনে বলা আছে! আইনের দোহাই দিয়ে এটিকে সমস্যা বলতেই হবে। যদিও খালি গায়ে খেলা কোনোভাবেই নিয়মের মধ্যে পড়ে না, তবুও যে আইনের স্বপক্ষে বলতে গেলে তেমন শক্ত যুক্তি পাওয়া যায় না, সেই আইনের দোহাই দিয়ে নিয়ম বলবৎ রাখার চেষ্টা করা একটু অদ্ভুত ব্যাপারই।
গোলের পর জার্সি খুলে ফেলা মোটেই কোনো অপকর্ম নয়, কিন্তু ফুটবলের ক্ষেত্রে এটি প্রচণ্ড অর্থবহ। একটি হলুদ কার্ডের সতর্কতা দিয়ে খেলোয়াড়দের প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয়া হয় খেলাটাকে, প্রতিপক্ষকে, দর্শককে সম্মান করার কথা। যেকোনো অখেলোয়াড়োচিত আচরণ প্রতিরোধ করতেই নিয়ম নিয়ে আসা। সীমার বাইরে উদযাপন যেকোনো সময়েই খেলার স্পিরিট নষ্ট করে দিতে পারে। এ কারণে খেলোয়ারদের এই নিয়মটি মেনে চলা জরুরি যাতে করে সৌন্দর্য্যমণ্ডিত এই খেলার মর্যাদা ও সম্মান বজায় থাকে।