ইভান কর্দোবা নামটি কলম্বিয়া ফুটবলের জন্য শুধুমাত্র একটি সুখস্মৃতির নাম নয়, তাদের অর্জনের সাথে জড়িত। কলম্বিয়ায় কর্দোবা খেলতেন ডিফেন্ডার হয়ে। পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে কোনো খ্যাতিও ছিল না তার। কলম্বিয়া জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ৭৩টি ম্যাচ, ডিফেন্ডার হয়েও করেছেন মাত্র ৫ গোল। কিন্তু এই ৫ গোলের ভেতর একটি গোলের উপর ভর করে কলম্বিয়া জিতেছিল তাদের ইতিহাসের প্রথম কোপা আমেরিকার শিরোপা।
২০০১ সালে মেক্সিকোর বিপক্ষে ফাইনালে ঐ ইভান কর্দোবার একমাত্র গোলে প্রথমবার কোপা আমেরিকা জিতেছিল কলম্বিয়া। সেই ফাইনালের পর কলম্বিয়ার জার্সিতে আর কোনো গোল নেই তার।
লাতিন আমেরিকার এ দলটির সর্বোচ্চ সফলতা বলতে গেলে ঐ একমাত্র কোপা আমেরিকা জয়। এই প্রতিযোগিতার নাম যখন সাউথ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নসশিপ ছিল, তখন অন্য সব দলের মত কলম্বিয়া তেমন নিয়মিত ছিল না। কিন্তু ১৯৭৫-এর পর তারা প্রতিবার এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে আসছে। তবে পূর্বে কলম্বিয়া কখনোই শক্তিশালী কোন দল ছিল না, বর্তমানেও নেই। বিশ্বকাপে তাদের সর্বোচ্চ সাফল্য ব্রাজিল বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছানো। সেবার তাদের দলে উত্থান হয়েছিল হামেস রদ্রিগেজ নামক এক উদীয়মান খেলোয়াড়ের। ২০১৫ কোপা আমেরিকার সেরা উদীয়মান খেলোয়াড় হয়েছিলেন ডিফেন্ডার জেইসন মুরিয়ো। কিন্তু মুরিয়ো বা রদ্রিগেজ কেউই তাদের ক্যারিয়ারের শিখরে পৌঁছাতে পারেননি।
তবে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত এবারের কোপা আমেরিকা তাদের জন্য হতে পারে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনার। তারা গ্রুপ ‘বি’-তে আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে ও কাতারের মুখোমুখি হবে। কার্লোস কুইরোজ এই প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে যে দল ঘোষণা করেছেন, তা একেবারে খর্বশক্তির নয়। দলে যেমন আছেন বর্তমান সময়ের সেরা গোলরক্ষক, তেমনি উদীয়মান ডিফেন্ডার থেকে পরীক্ষিত স্ট্রাইকার।
রাশিয়া বিশ্বকাপে কলম্বিয়ার কোচের দায়িত্বে ছিলেন হোসে পেকারম্যান। ৪-৩-১-২ ফর্মেশনে সে বিশ্বকাপে খেলেছিল কলম্বিয়া। তিনজন মূল মিডফিল্ডার, যাদের তিনি তার ট্যাকটিক্সে ব্যবহার করতেন, তারা সবাই ছিলেন অতিরিক্ত রক্ষণাত্মক। আর আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডাররূপে ছিলেন একমাত্র হুয়ান কুইন্তেরো। কিন্তু বিশ্বকাপের পর কলম্বিয়া বিশাল পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে গেছে। পেকারম্যানের বিদায়ের পর কোচ পরিবর্তন হয়েছে দুইবার। তাই বর্তমান কলম্বিয়ার কোচ কার্লোস কুইরোজের সাথে হোসে পেকারম্যানের স্কোয়াড ও ট্যাকটিক্সের বিস্তর তফাৎ।
কার্লোস কুইরোজের অধীনে কলম্বিয়া খেলেছে মাত্র তিনটি ম্যাচ। তাই কলম্বিয়া দল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ কুইরোজ পেয়েছেন কম। তবে এত অল্প সময়েও পূর্বের খেলোয়াড় ও বর্তমান খেলোয়াড়দের ফর্ম বিবেচনা করলে তার দল কোপা আমেরিকায় লড়াইয়ের জন্য একদম উপযুক্ত।
কলম্বিয়ার শেষ তিন ম্যাচ দেখে কুইরোজের ট্যাকটিক্স সম্পর্কে ধারণা নেওয়া অসম্ভব। তাই ফিরে দেখা উচিত ২০১৮ বিশ্বকাপের ইরান দলকে। ছোট দল ইরানের মূল কথা ছিল, প্রতিপক্ষকে যেভাবেই হোক, গোল হতে বিরত রাখা। তাই কুইরোজ প্রথমে ইরানকে খেলাতেন ৪-১-৪-১ ফর্মেশনে, যেখানে রক্ষনাত্মক মিডফিল্ডার থেকে দ্রুত কাউন্টার অ্যাটাকে যাবার সুযোগ থাকত। তবে ঠিক এই ফর্মেশনে বর্তমান কলম্বিয়া দলকে ব্যবহার করা সম্ভব না। তাই কুইরোজ খুব সম্ভবত ৪-৩-৩ অথবা ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে ফিরে যাবেন।
কুইরোজের একাদশে প্রথম পছন্দের গোলরক্ষক ডেভিড অসপিনা। নাপোলিতে খেলা ৩০ বছর বয়সী এ গোলরক্ষক বর্তমান সময়ের সেরাদের একজন। তাই কলম্বিয়া দলে তার কোনো বিকল্প নেই।
অসপিনার মতো ভরসাযোগ্য একজন গোলরক্ষের ঠিক সামনে থাকবেন ডেভিনসন সানচেজ ও ইয়েরি মিনা’র তৈরি করা রক্ষণদূর্গ। একজন পূর্ণাঙ্গ সেন্টারব্যাক ডিফেন্ডার হবার প্রত্যেকটি গুণাবলী এদের ভেতর বিদ্যমান। দুজনই শারীরিকভাবে শক্তিশালী, দুর্দান্ত গতি ও দীর্ঘদেহী হবার কারণে ক্রস আটকানোর জন্য যথাযথ। আর বিশ্বকাপে ইয়েরি মিনা গোল করে যেভাবে নজর কেড়ে নিয়েছিলেন, কলম্বিয়ান সমর্থকেরা ভরসা করে থাকবেন তার উপর। তবে দু’জনের প্রধান সমস্যা একই, প্রচন্ড ইনজুরিপ্রবণ। তাই ইনজুরি হানা না দিলে কোপা আমেরিকায় এই রক্ষণ জুটির কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করাই যায়। তবে এদের বিকল্প হিসেবে জেসন মুরিয়োর বদলে ৩২ বছর বয়সী ক্রিশ্চিয়ান জাপাতাকে বেছে নিয়েছেন কলম্বিয়ান কোচ। ২০১৫ সালের কোপা আমেরিকায় সেরা ডিফেন্ডার খেতাব পাওয়া মুরিয়ো এবার বার্সেলোনার হয়ে বলতে গেলে মাঠেই নামেননি।
রাইটব্যাকে সান্তিয়াগো আরিয়াসের থাকা নিশ্চিত। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের হয়ে এবার মাঠে নিয়মিত নেমেছেন তিনি। প্রথম মৌসুমে হতাশ করেননি, অ্যাটলেটিকো সমর্থকেরা তাকে নিয়ে সুখী। নিজের পুরনো ফর্ম কোপায় নিতে পারলে কলম্বিয়ান সমর্থকদের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠতে পারেন আরিয়াস। তার বিকল্প হিসেবে ডাক পেয়েছেন স্টেফান মেদিনা। লেফটব্যাকে কলম্বিয়ানদের ভরসাযোগ্য কোন খেলোয়াড় নেই। কুইরোজ দলে ডেকেছেন জস লুকুমি ও ক্রিশ্চিয়ান বোর্হাকে। খুব সম্ভবত ক্রিশ্চিয়ান বোর্হা থাকবেন প্রথম একাদশে।
কলম্বিয়া দলের দায়িত্ব হাতে নেবার পর দলের সেরা খেলোয়াড়কে নিয়ে একাদশ সাজানোর সৌভাগ্য হয়নি তার। তাই হামেস রদ্রিগেজের জন্য কী পরিকল্পনা ভেবে রেখেছেন, তা অনুমান করা দুষ্কর। হোসে পেকারম্যান অবশ্য হুয়ান কুইন্তেরোকে অ্যাটাকিং মিডে রেখে একাদশ তৈরি করতেন। কুইরোজ স্কোয়াড ৪-৩-৩ ফর্মেশন ব্যবহার করলে সেন্ট্রার ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডে থাকতে পারেন উইলমার ব্যারিওস। ব্যারিওসের বামপাশের মিডফিল্ড পজিশন জেফারসন লেরমার জন্য বরাদ্দ, এবং ডান পাশে থাকতে হুয়ান কুয়াদ্রাদো। এক্ষেত্রে আক্রমণ ত্রিফলাও বদলে যেতে পারে। লেফট উইংগার হিসেবে তখন খেলবেন হামেশ রদ্রিগেজ, আর রাইট উইংগার পজিশনে লুইস মুরিয়েল। আর ফ্যালকাও অথবা দুভান জাপাতা থেকে একজন থাকবেন মূল স্ট্রাইকারের ভূমিকায়।
কিন্তু এই দলকে যদি ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে তৈরি করা হয়, তাহলে আরও শক্তপোক্ত দল তৈরি করা সম্ভব। এই ফর্মেশন অনুযায়ী রক্ষণভাগের পর থাকবেন দুইজন সেন্টার ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। এক্ষেত্রে কুইরোজের কাছে সুযোগ আছে উইলমার ব্যারিওস ও জেফারসন লেরমাকে একত্রে মধ্যমাঠের রক্ষণে খেলানো। ব্যারিওস ও লেরমা’র দায়িত্ব যেমন এক থাকবে, তেমনই এদের উভয়ের খেলার ধরনও সমপর্যায়ের। তাই মধ্যমাঠে এদের দু’জনের একসাথে থাকা মানে রক্ষণশক্তিকে আরও মজবুত করা।
ব্যারিওস ও লেরমা’র সামনে খেলবেন হামেস রদ্রিগেজ। এই সেন্ট্রাল অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার পজিশনে হামেস বেশি স্বতঃস্ফূর্ত। কিন্তু তার না থাকার চেয়ে থাকাটাই বেশি ভাবাচ্ছে। ব্রাজিল বিশ্বকাপে যে অপার সম্ভবনা নিয়ে তার উত্থান হয়েছিল, সময়ের সাথে সাথে তার অনেকটাই রং হারিয়েছে। চলতি মৌসুমে বায়ার্ন মিউনিখের হয়েও নিয়মিত মাঠে তাকে দেখা যায়নি। ইনজুরির পাশাপাশি তার চলতি ফর্মও সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। তাই দলের সেরা খেলোয়াড়কে নিয়েও একদম নিশ্চিত থাকতে পারবে না কলম্বিয়া। হামেস রদ্রিগেজের ডান পাশে রাইট মিডফিল্ডার পজিশনে থাকবেন হুয়ান কুয়াদ্রাদো এবং লেফট মিডফিল্ডার হিসেবে এদউইন কার্দোনা। কার্দোনা ও কুয়াদ্রাদোর দুজনের সাম্প্রতিক ফর্ম যথেষ্ট ভালো।
এই ফর্মেশনে শুধুমাত্র একজন পূর্ণাঙ্গ স্ট্রাইকারের থাকার সুযোগ রয়েছে। এবং এই স্ট্রাইকার পজিশনের জন্য কুইরোজ দলে রেখেছেন ফ্যালকাও, দুভান জাপাতা, লুইস মুরিয়েল ও রজার মার্টিনেজকে। অভিজ্ঞতার দাম অবশ্যই আছে, কার্লোস কুইরোজ হয়তো সেজন্যই ফ্যালকাওকে সুযোগ দেবেন। কিন্তু দুভান জাপাতা হতে পারেন বর্তমান কলম্বিয়া দলের গোলমেশিন। তারই ৩৭ ম্যাচে ২৩ গোল এবার আটালান্টাকে চ্যাম্পিয়নস লিগে নিয়ে গেছেন তিনি। ক্লাবের হয়ে যে আগুনঝড়া ফর্মে ছিলেন, সেই ফর্ম যদি জাতীয় দলে টেনে আনতে পারেন, তবে কলম্বিয়ার হয়ে কোপা আমেরিকা মাতানোর ক্ষমতা আছে জাপাতার।
তবে কলম্বিয়া কোচ চারজন স্ট্রাইকার দলে নিয়েছেন। এর কারণ হতে পারে, একসাথে দুইজন স্ট্রাইকার ও দুইজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার খেলানোর পরিকল্পনা আছে তার। যদি তাই হয়, তবে কলম্বিয়াকে দেখা যেতে পারে ৪-২-২-২ ফর্মেশনে, যে ফর্মেশনে খেলতে অভ্যস্ত প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব ওয়াটফোর্ড।
এই কলম্বিয়া দলে কৌশলের নায়ক হতে পারেন কোচ কার্লোস কুইরোজ। ইরানের মতো একটি মধ্যমমানের দলকে তিনি যেমন রক্ষণাত্মক ভূমিকায় উপস্থাপন করেছেন, একই ফুটবল দর্শন যদি সঠিকভাবে ডেভিনসন সানচেজ, ইয়েরি মিনা বা ক্রিশ্চিয়ান জাপাতার উপর প্রয়োগ করতে সফল হন, তবে কলম্বিয়ার রক্ষণ হতে পারে কোপা আমেরিকার সেরা রক্ষণ জুটিগুলোর একটি।
তাই কার্লোস কুইরোজের ঘোষিত দলটি যদি ইনজুরিমুক্ত থাকে, তাহলে এ দলটি এবার নতুন ইতিহাস রচনা করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু ডেভিনসন, ইয়েরি মিনা বা হামেস অথবা আরিয়াস, এরা যেমন প্রতিভাবান তেমনই খুব দ্রুত ফর্ম হারিয়ে ফেলার প্রবণতা বেশি। তাই সবাইকে কখনো পুরো একটি মৌসুমে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ভালো পারফরম্যান্স করতে দেখা যায়নি।
কলম্বিয়ার কোপা আমেরিকা শুরু হলো আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। গ্রুপে বাকি ম্যাচ কাতার ও প্যারাগুয়ের বিপক্ষে। অঘটন না ঘটলে কলম্বিয়া অবশ্যই গ্রুপপর্ব পার করবে, এবং পরবর্তীতে এগিয়ে যাওয়া নির্ভর করবে ইনজুরি, দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের ফর্ম, এবং অবশ্যই কার্লোস কুইরোজের ফুটবল-কৌশলের উপর।