গ্লেন ম্যাকগ্রাকে টপকে পেসার হিসাবে টেস্ট ক্রিকেটে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি টেস্ট উইকেটের মালিক ইংল্যান্ডের পেসার জেমস অ্যান্ডারসন। ভারতের বিপক্ষে দ্য ওভালে সিরিজের সর্বশেষ টেস্ট ম্যাচে মোহাম্মদ শামিকে বোল্ড করে ম্যাকগ্রাকে টপকে যান তিনি। বর্তমানে ৫৮৯ উইকেট নিয়ে তিনি টেস্ট ক্রিকেটে সর্বকালের সেরা উইকেট শিকারি পেসার।
বয়সের সাথে সাথে আরও পরিণত হচ্ছেন, ২০১৫ সালে সীমিত ওভারের ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর পর তিনি যেন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছেন। ২০১৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৪৪টি টেস্ট ম্যাচে মাত্র ২০.৮৯ বোলিং গড়ে ১৮৪ উইকেট শিকার করেছেন। ২০১৫ সালের আগেও যেখানে তার বোলিং গড় ত্রিশের আশেপাশে ছিলো, বর্তমানে সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ২৬.৮৪।
ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি পেসার জেমস অ্যান্ডারসনের ১৫ বছরের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের মাইলফলক স্পর্শ করার মুহূর্তগুলো নিয়ে আজকের লেখা।
টেস্ট উইকেট নাম্বার – এক
২০০৩ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে জেমস অ্যান্ডারসনের টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। তবে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটার আগেই ইংল্যান্ডের হয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেকও ঘটেছিলো তার, ২০০৩ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপও খেলেছিলেন তিনি।
টেস্ট ক্রিকেটে নিজের প্রথম উইকেট শিকার করতে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি জিমিকে। নিজের ১৮তম বলে জিম্বাবুয়ের ওপেনার মার্ক ভারমিউলিনকে দুর্দান্ত এক অফ কাটারে বোল্ড করে উইকেটের খাতা খোলেন তিনি। অ্যান্ডারসন তার অভিষেকেই লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম লেখান, ১৬ ওভার বোলিং করে ৭৩ রান খরচায় পাঁচ উইকেট শিকার করেন।
টেস্ট উইকেট নাম্বার – ১০০
টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটার পাঁচ বছর পর ইংল্যান্ডের বোলিং আক্রমণের নেতৃত্ব তার কাঁধে পড়ে। অথচ ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত দলে নিয়মিত সুযোগ পেতেন না তিনি। এরপর ২০০৮ মৌসুমে ট্রেন্টব্রিজে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ৪৩ রানের বিনিময়ে ৭ উইকেট শিকার করার পর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
টেস্ট ক্রিকেটে নিজের ২৯তম টেস্ট ম্যাচে শততম টেস্ট উইকেট শিকার করেন তিনি। ২০০৮ সালের ৭ই আগস্ট দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান জ্যাক ক্যালিসকে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলে তিনি এই মাইলফলক স্পর্শ করেন। দ্য ওভালে সিরিজের চতুর্থ টেস্ট ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ১৯৪ রানেই গুটিয়ে গিয়েছিলো দক্ষিণ আফ্রিকা, অ্যান্ডারসন ৪২ রানের বিনিময়ে ৩ উইকেট শিকার করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ড সে ম্যাচে ৬ উইকেটে জয় পায়। তিনি ২৬ বছর ৮ দিন বয়সে জ্যাক ক্যালিসের উইকেট তুলে নেওয়ার মধ্য দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে শততম উইকেট শিকার করেন।
টেস্ট উইকেট নাম্বার – ২০০
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে জেমস অ্যান্ডারসন নন-সুইং কন্ডিশনে খুব সাদামাটা বোলার ছিলেন। পিচ থেকে বাড়তি সুবিধা না পেলে অনেকটাই আনাড়ি বোলারদের মতো বোলিং করতেন। তবে ২০১০-১১ মৌসুমের অ্যাশেজে এই দৃশ্যপট বদলে যায়। পাকিস্তানের মোহাম্মদ আসিফের কাছে থেকে পরামর্শ নিয়ে ওবল-সিম ডেলিভারি রপ্ত করে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানদেরকে নাস্তানাবুদ করেছিলেন। ঐ অ্যাশেজে ইংল্যান্ড তিনটি টেস্টে জয় পেয়েছিলো, সবক’টি টেস্টের প্রথম ইনিংসে তিনি চারটি করে উইকেট শিকার করেছিলেন।
অ্যান্ডারসনের রাজত্বে ২৪ বছর পর অস্ট্রেলিয়ার মাটি থেকে অ্যাশেজ পুনরুদ্ধার করেছিলো ইংল্যান্ড। তিনি ঐ সিরিজে ২৬.০৪ বোলিং গড়ে ২৪ উইকেট শিকার করেছিলেন। ঐ অ্যাশেজে ইংল্যান্ড একটি টেস্টে পরাজিত হয়েছিলো, তার ২০০তম উইকেটটিও ঐ ম্যাচে এসেছে। পিটার সিডল তার ২০০তম টেস্ট উইকেট, দুর্দান্ত এক আউটসুইংগারে পরাস্ত হয়ে সিডল ক্যাচ দেন কলিংউডের হাতে। অ্যান্ডারসন তার ৫৫তম টেস্ট ম্যাচে ২০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন।
টেস্ট উইকেট নাম্বার – ৩০০
নিউ জিল্যান্ডের ওপেনার পিটার ফুলটনের উইকেট তুলে নিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে নিজের ৩০০তম উইকেট শিকারের মাইলফলক স্পর্শ করেছিলেন জেমস অ্যান্ডারসন। ২০১৩ সালের ১৬ই মে লর্ডসে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঐ ইনিংসে পাঁচ উইকেট শিকার করেছিলেন তিনি, যার মধ্যে দিয়ে তিনি আবারও লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম লেখিয়েছিলেন।
নিউজিল্যান্ডের ইনিংসের প্রথম ওভারে অ্যান্ডারসন দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে হামিশ রাদারফোর্ডের উইকেট শিকার করেন। লেগ স্ট্যাম্পে পিচ করে সুইং করে বের হয়ে যাওয়ার সময় রাদারফোর্ডের ব্যাট স্পর্শ করে বল স্লিপে যায়। তিনি তার ক্যারিয়ারে এমনভাবে বহু ব্যাটসম্যানকে বোকা বানিয়েছেন। রাদারফোর্ডের উইকেট তুলে নেওয়ার পর পিটার ফুলটনকে এক আউটসুইং ডেলিভারিতে পরাস্ত করে ৮১তম টেস্ট ম্যাচে ৩০০ উইকেট শিকারের মাইলফলক স্পর্শ করেন। এরপর ঐ ইনিংসে কেন উইলিয়ামসন এবং রস টেইলরের উইকেটও শিকার করেছিলেন তিনি।
লর্ডসে ঐ টেস্টের নায়ক ছিলেন অবশ্য স্টুয়ার্ট ব্রড। তিনি দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৪৪ রানের বিনিময়ে ৭ উইকেট শিকার করলে নিউজিল্যান্ড ৬৮ রানেই সবকটি উইকেট হারিয়ে ১৭০ রানে পরাজিত হয়। ব্রড তার অপ্রতিরোধ্য বোলিং স্পেলের সুবাদে ম্যাচসেরার পুরস্কার জিতে নিয়েছিলেন।
টেস্ট উইকেট নাম্বার – ৩৮৪
২০১৫ বিশ্বকাপের মৌসুম শেষে প্রায় আট মাস পর টেস্ট ক্রিকেট খেলতে মাঠে নামে ইংল্যান্ড। বিশ্বকাপের পর প্রথম টেস্ট ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জয় পেতে ব্যর্থ হয়েছিলো ইংল্যান্ড। ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে ম্যাচ বের করে আনতে পারেনি তারা। তবে নর্থ সাউন্ডে অনুষ্ঠিত এই টেস্ট ম্যাচের মধ্য দিয়ে ইয়ান বোথামকে টপকে ইংল্যান্ডের সর্বকালের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হিসাবে নিজের নাম লেখান জেমস অ্যান্ডারসন।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় ইনিংসে অ্যান্ডারসনের লেগ কাটারে পরাস্ত হয়ে উইন্ডিজের অধিনায়ক দীনেশ রামদিন ফার্স্ট স্লিপে ক্যাচ দেন। রামদিনের উইকেটটি ছিলো তার জিমির ক্যারিয়ারের ৩৮৪তম উইকেট। যার মাধ্যমে ইয়ান বোথামকে টপকে ইংল্যান্ডের সর্বকালের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলার হিসাবে নিজের নাম লেখান। ঐদিন বোথাম স্কাই স্পোর্টসের ধারাভাষ্যকার হিসেবে মাঠে উপস্থিত ছিলেন। তিনি জিমিকে অভিনন্দন জানান।
রেকর্ড গড়লেও আট নাম্বারে ব্যাট করতে নামা জেসন হোল্ডারের ডিফেন্স ভাঙতে পারেননি তিনি। হোল্ডার ২১৬ মিনিট ব্যাট করে শতক হাঁকালে ম্যাচ ড্র হয়।
টেস্ট উইকেট নাম্বার – ৪০০
নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ২০০৮ সালে এবং ২০১৩ সালের টেস্ট দুর্দান্ত পারফরমেন্স করেছিলেন জেমস অ্যান্ডারসন। কিন্তু ২০১৫ সালে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে নিজের ছায়া হয়ে ছিলেন তিনি। দুই ম্যাচে যদিও নিউ জিল্যান্ডের তিনজন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানকে শূন্য রানে ফিরিয়েছিলেন। তবুও নিজের সেরাটা দিতে পারেননি তিনি। দুই ম্যাচে ৪৩.০০ বোলিং গড়ে শিকার করেছিলেন ৬ উইকেট।
এর মধ্যে হেডিংলিতে দ্বিতীয় টেস্টে নিউজিল্যান্ডের ওপেনার মার্টিন গাপটিলের উইকেট শিকারের মধ্য দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে চারশো উইকেট শিকারের মাইলফলক স্পর্শ করেন। অ্যান্ডারসনের অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বল খেলতে গিয়ে সেকেন্ড স্লিপে দাঁড়ানো ইয়ান বেলের হাতে ধরা পড়েছিলেন গাপটিল। একই ওভারের চতুর্থ বলে কেন উইলিয়ামসনকেও সাজঘরে ফেরান তিনি।
জেমস অ্যান্ডারসন ৩২ বছর ৩০৩ দিন বয়সে এবং ১০৪ টেস্টে চারশ’ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেছিলেন।
টেস্ট উইকেট নাম্বার – ৫০০
২০১৭ সালে ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিন ম্যাচ টেস্ট সিরিজের প্রথম টেস্টে ইংল্যান্ড জয় পেলেও দ্বিতীয় টেস্টে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। পাঁচ উইকেট হাতে রেখেই ইংল্যান্ডের দেওয়া ৩২২ রানের লক্ষ্য অতিক্রম করে তারা।
২০১৭ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর। লর্ডসে সিরিজ-নির্ধারণী তৃতীয় টেস্টে টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এই ম্যাচে মাত্র তিন উইকেট শিকার করলেই পাঁচশ’ টেস্ট উইকেট পূর্ণ হবে অ্যান্ডারসনের। এমতাবস্থায় প্রথম ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুই ইনফর্ম ব্যাটসম্যান ক্রেইগ ব্র্যাথওয়েট এবং কাইল হোপের উইকেট শিকার করেন তিনি। এরপর ইনিংসের বাকিটা সময় তাণ্ডব চালান বেন স্টোকস। তিনি মাত্র ২২ রান খরচায় ৬ উইকেট শিকার করলেও প্রথম ইনিংসে এই মাইলফলক স্পর্শ করা হয়নি অ্যান্ডারসনের।
তবে বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি তাকে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুতেই কাঙ্ক্ষিত এই মাইলফলক স্পর্শ করেন তিনি। নিজের দ্বিতীয় ওভারের শেষ বলে ক্রেইগ ব্র্যাথওয়েটকে বোল্ড করে ৫০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন তিনি। ঐ ইনিংসে মাত্র ৪২ রান খরচায় ৭ উইকেট শিকার করেছিলেন তিনি, যা তার ক্যারিয়ার সেরা বোলিং ফিগার। ১২৯তম টেস্টে এবং ৩৫ বছর ৪০ দিন বয়সে তিনি এই কীর্তি গড়েন। ক্যারিয়ারের যেকোনো সময়ের চেয়ে ৩৫ বছর বয়সী অ্যান্ডারসন সেরা বোলিং করেছিলেন।
টেস্ট উইকেট নাম্বার – ৫৬৪
ভারতের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ শুরু হওয়ার আগে জেমস অ্যান্ডারসনের উইকেট সংখ্যা ছিলো ৫৪০টি। গ্লেন ম্যাকগ্রাকে টপকানোর জন্য পাঁচ ম্যাচের সিরিজে ২৪ উইকেট শিকার করতে হতো তাকে। পাঁচ ম্যাচে ১৮.১২ বোলিং গড়ে ২৪ উইকেট শিকার করে শেষ পর্যন্ত এই সিরিজেই গ্লেন ম্যাকগ্রাকে টপকে যান তিনি।
সিরিজের শেষ ম্যাচে মোহাম্মদ শামিকে বোল্ড করে গ্লেন ম্যাকগ্রাকে টপকানোর পাশাপাশি দলের জয় নিশ্চিত করেন তিনি। বর্তমানে ১৪৩ টেস্টে ২৬.৮৬ বোলিং গড়ে ৫৮৯ উইকেট শিকার করেছেন অ্যান্ডারসন।