স্কোরবোর্ডে তখন ৮১ রান, উইকেটের ঘরে দেখা যাচ্ছে ৩ সংখ্যার অস্তিত্ব। এরপরের ব্যাটিংয়ের ধরনটা আসলে কেমন হওয়া উচিত?
সাধারণ ধারণা বলে, তিন অংক ছোঁয়ার আগেই কোনো দল ৩ উইকেট হারিয়ে ফেলছে মানে দল কিছুটা চাপে। ঠিক তখনই আরেকটা উইকেট খোয়ানোর অর্থ মহাবিপর্যয়। রান করার বদলে পুরো ৫০ ওভার খেলে আসাটাই তাই লক্ষ্য তখন। কারণটা অনুমেয়, ৩০০ বলের কোটা পূরণ করতে পারলে আর কিছু হোক বা না হোক, অন্তত একটা লড়াই করার মতো পুঁজি পাওয়া যাবে। দিনশেষে নিজে কিংবা সমর্থকেরা অন্তত এটুকু সান্ত্বনা তো পাবেন, ‘থাক, দলটা আগাপাশতলা লড়ে তো গেছে।’
এই প্রচেষ্টার হাজারখানেক উদাহরণ মিলবে ইতিহাসেই। চেষ্টাটা যে বাংলাদেশেরই বেশি, আপনার অজানা থাকার কথা নয় এই তথ্যটাও। তবে যদি একটু বেপরোয়া হওয়ার চেষ্টা করা যায় তখন? লড়াইয়ের চেতনা নিয়ে খেলেও তো হারতেই হচ্ছে বেশিরভাগ দিন। তার চেয়ে কিছুটা সাহসী হয়ে জেতার চেষ্টা করে দেখলে কী ক্ষতি হয় এমন? প্রশ্নটার মুখে নিজেদের ফেলে দেখেছিল ইংল্যান্ড। উত্তর কেমন করে পাওয়া গিয়েছিল, সেটাও আপনার জানাই।
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের যা ছাঁচ, তার সরলীকরণ করা যায় এই কথাতে, ‘আগে সেট হও, পরে ব্যাট চালাও।’ একের পর এক দ্বিপক্ষীয় সিরিজে ছাঁচটা খাপে খাপ এঁটে যাওয়াতে তা দুর্ভাবনার কারণও হয়নি সেভাবে। বরং, বিশ্বকাপ নিয়ে স্বপ্নটা এবার বড়সড়ই।
তবে স্বপ্নযানটা স্পিডব্রেকারের মুখে পড়ল গেল দুইটা সিরিজে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বহুদিন পরে ঘরের মাঠে প্রথম সিরিজ হার, এর আগে ভারতের বিপক্ষে শেষ ওয়ানডেতে বিশাল ব্যবধানে হারের পরে বোঝা গেল, প্রতিদিন তো এক ছাঁচে জেতা যাবে না। বরং, কিছুদিন আসবেই, যখন দ্রুত রান তোলাই হবে চাহিদা। সেই দিনগুলোতে বাংলাদেশের ব্যাটিং হয়ে দাঁড়িয়েছিল বড় দুশ্চিন্তাই।
সমস্যার উৎস খুঁজে পাওয়া গেছে যখন, সমাধানও নিশ্চয়ই আছে। সমাধানটা কী হতে পারে, তা দেখা গেল ১৮ মার্চে, সাকিব আল হাসান আর তাওহীদ হৃদয়ের ব্যাটে।
তামিমের পর লিটনও যখন ফিরলেন পাওয়ারপ্লেতেই, তখন মুশফিকুর রহিমকেই প্যাভিলিয়নের সিঁড়ি ভেঙে নামতে দেখার প্রত্যাশা ছিল সবার। ক্রিজে নাজমুল হোসেন শান্তও ছিলেন বলে ডানহাতি-বাঁহাতি সমন্বয় ধরে রাখতেও মুশফিককে নামানোর নেপথ্যে যুক্তিও ছিল যথেষ্ট জোরালো। তবে বাংলাদেশ হাঁটতে চাইল ভিন্ন পথে। ওয়ান-ডাউনে দুর্দান্ত খেলতে থাকা সাকিবকে মিডল-অর্ডারে নামানো হয়েছিল গত সিরিজেই, এবার তার ব্যাটিং পজিশন নড়ানো হলো আরও একটু। উঠে এলেন চারে।
ড্রেসিংরুমে বসেই দেখেছেন, উইকেটে বল ধরছে। আর লিটন আউট হলেন যেই বলটায়, সেটা যেন ব্যাটারের কাছে এলোই না এক মহাকালেও। নিজে ওপেনার বলেই ম্যাচের শুরুতে উইকেটের মন্থরগতি নিয়ে নিজের অসন্তোষ লুকাননি তামিম ইকবালও।
প্রথম দিকে উইকেট ব্যাটিং-বান্ধব ছিল না, প্রথম ২০ ওভার। আমি আরেকটু ভালো উইকেট আশা করেছিলাম। প্রথম ২০-২৫ ওভার ব্যাটিংয়ের জন্য সহজ ছিল না। উইকেট তখন ধীরগতির ছিল, এরপর ধীরে ধীরে ভালো হয়েছে।
– তামিম ইকবাল
এমন পরিস্থিতিতে দলের টু-ডাউন ব্যাটারের কাছে চাওয়াটা থাকা ইনিংস গড়ে দেওয়ার। তবে লক্ষ্য রাখতে হতো, ইনিংস গড়তে গিয়ে খুব বেশি সময় যেন না নিয়ে ফেলেন তিনি। সাকিবের কাছেও লক্ষ্যটা একই থেকে থাকবে অনুমান। এবং, লক্ষ্য পূরণে তিনি লেটার মার্কস পেয়েই উত্তীর্ণ।
ক্রিজে দুই বাঁহাতি, আইরিশ দলে তিনজন অফ স্পিনার – ম্যাচ-আপ তত্ত্ব মেনে আইরিশ অধিনায়ক অ্যান্ড্রু বালবার্নি খুব স্বাভাবিকভাবেই বেশিরভাগ বল করাতে চাইলেন অফ-স্পিনারদের দিয়ে। শান্ত-সাকিবের ৪২ বল স্থায়ী জুটির ৩৩টিই ছোড়া হলো অফ-স্পিনারদের হাত ধরে। অফ-স্পিনটা সাকিবকে সেরকম করে ভোগায়নি কখনোই, ভোগাল না গতকালও। সাকিব তখন সুযোগ পেলেন ১৮ বল খেলার, তুললেন ১৩ রান। ইনিংসের গোড়ার দিকে সংখ্যাটা বৈশ্বিক মানদণ্ডেই বেশ ভালো।
তবে শান্ত নয়, বাংলাদেশ তাদের ব্যাটিংয়ে নতুন একটা মাত্রা যোগ করল পরের জুটিতে। ওয়ানডেতে মাঝের ওভারে ব্যাটিং বাংলাদেশের জন্য ধাঁধাই হয়ে উঠেছিল সাম্প্রতিক সময়ে। সাকিবকে নিচে নামিয়েও লাভ হয়নি কেননা অন্য কারও কাছ থেকে মিলছিল না যোগ্য সঙ্গত। শেষ পর্যন্ত রহস্যের একটা কূলকিনারা বোধহয় পাওয়া গেল তাওহীদ হৃদয়ের সৌজন্যে। এ ম্যাচেই অভিষিক্ত হওয়া তিনি সাকিবের সঙ্গে মিলে ১২৫ বলে যোগ করলেন ১৩৫ রান। ৫০ ওভার শেষে বাংলাদেশ তাদের ইতিহাস-সর্বোচ্চ ৩৩৮ রান করার পরও যে ক্রিকবাজ লিখল, ‘রান কিছুটা কমই হয়ে গেল’, তার মূলে দু’জনের জুটিটাই।
বাংলাদেশের মিডল-অর্ডারের জুটিগুলো যে মডেল অনুসরণ করে, তা থেকে বেরিয়ে সাকিব-হৃদয় মিলে যেই জুটিটা গড়লেন, সেখানে সেট হতে সময় নেওয়ার কোনো ব্যাপার থাকল না। বরং, প্রথম থেকেই রান রেটের গতিটা এমনভাবে ধরে রাখলেন যে, কখনোই মনে হলো না বাংলাদেশ চাপে পড়েছে।
বল | রান |
১-২০ | ১৫ |
২১-৪০ | ২০ |
৪১-৬০ | ১৭ |
৬১-৮০ | ১৭ |
৮১-১০০ | ২৬ |
১০১-১২০ | ৩৬ |
১২১-১২৫ | ৩ |
সাকিবকে ছাপিয়ে হৃদয়ই অবশ্য অগ্রণী ভূমিকায় থাকলেন এদিন। ইনিংসের শুরু থেকেই বলপ্রতি রান তোলায় মনোযোগ থাকল তার। আর এমনিতে পাল্লা দিয়ে উঠতে থাকা রানরেটের গ্রাফ শুনলে যেরকম চার-ছক্কাময় একটা ইনিংসের ছবি ভেসে ওঠে মনের কোণে, তার সঙ্গে সাকিবের জুটিটা ব্যতিক্রম হয়ে রইলো এখানেও। বাংলাদেশের ইনিংসের মাঝের সময়টায় চার-ছয় না হওয়ার দৃশ্যটা অবশ্য নিয়মিতই, তবে অন্য দিনগুলোতে চার-ছক্কা না হওয়া মানেই রান তোলার গতি শ্লথ হয়ে যাওয়া। গতকালও জুটির প্রথম দুই-তৃতীয়াংশে চার-ছয়ের ছড়াছড়ি দেখা যায়নি একদমই। বিশেষ করে জুটির ৪১ থেকে ৮০ বলের মধ্যে বল সীমানাছাড়া হয়নি একবারও। তবুও ওই সময়ে ওভারপ্রতি রান উঠল ৫.১ করে। বাউন্ডারি না হাঁকানো গেলেও রানের চাকা ঠিকই সচল রাখতে হবে ইনিংসের মাঝের ওভারে, ইংল্যান্ডের দেখিয়ে দেওয়া মডেলটার সার্থক প্রতিলিপিই যেন এই দিনে দেখা গেল সিলেটে।
চার-ছক্কা না হওয়ার পরও রানরেটের লাগাম টানা যায়নি যেহেতু, আইরিশ বোলাররাই চাপে পড়েছিলেন তখন। ওই চাপটাকে পড়ে পর্বতপ্রমাণ বানিয়ে ছেড়েছেন সাকিব আর হৃদয় মিলে। ব্যক্তিগত মাইলফলক নিয়ে সাকিব ভাবনায় পড়েছেন, এমন অভিযোগ তার নামের পাশে জোড়া যায়নি কোনোকালেই। হ্যারি টেক্টরের এক ওভারে ২২ রান নিয়ে যখন প্রথমবারের মতো সেঞ্চুরির ঘ্রাণ পেতে শুরু করলেন সাড়ে তিন বছরের মধ্যে, তবুও তাকে শট খেলা থেকে থামানো গেল কই! ৮৯ বলে ৯৩ করে ফিরলেন গ্রাহাম হিউমের বলে কট বিহাইন্ড হয়ে।
সাকিবের নার্ভাস নাইন্টিজে আউট হওয়ার দিনে সেঞ্চুরি পাননি হৃদয়ও। তবে এর আগে যা দেখিয়ে গেলেন – চাপের মুখে পাল্টা আক্রমণ করেও সফল হওয়া – তেমন প্রাপ্তির আনন্দেই তো ভাসতে চাইছিল বাংলাদেশ।