১.
এই পৃথিবীতে পরম শ্রেষ্ঠত্বের বিচার করাটাই হয়তো সবচেয়ে কঠিন কাজ। এই শ্রেষ্ঠত্বের পেছনে ছুটতে গিয়ে অনেকেই হতাশার সাগরে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েন, আর সেকারণেই মহাভারতে বলা হয়েছে “শ্রেষ্ঠ নয়, উত্তম হওয়ার চেষ্টা করো।” তবুও শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি মানুষের দুর্বলতা চিরকালীন, এজন্যই আমরা প্রায় সবখানে একদম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে নির্বাচন করার চেষ্টা করি। শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন যেমন সহজ কোনো বিষয় নয়, একইভাবে শ্রেষ্ঠ একজনকে খুঁজে বের করাও সহজ নয়। বিশেষ করে যখন কোনো খেলার সেরা একাদশ বানানো হয়, তখন এই ধরনের বিতর্ক একদম তুঙ্গে উঠে যায়। ক্রিকেটও এর ব্যতিক্রম নয়। এখানেও সর্বকালের সেরা একাদশ বানাতে গেলে রথী-মহারথীদের মাঝে মাত্র এগারোজনকে বেছে নেওয়াটা বেশ দুরূহ কাজ।
এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ স্পিনার বাছাইয়ের ক্ষেত্রে পুরো পৃথিবী দু’ভাগ হয়ে যায়। কেউ বলে মুরালিকে নাও, আবার কেউ বলে ওয়ার্নকে ছাড়া একাদশই হবে না! কেউ মুরালির মতো ধারবাহিক পারফর্মারকে দলে নেওয়ার পক্ষে কেউ, আবার ইমপ্যাক্ট আর ম্যাজিকাল স্পেলের কথা চিন্তা করে ওয়ার্নকে নেওয়ার পক্ষপাতী। একদম বিতর্কহীন উপায়ে একজনকে কি বেছে নেওয়া সম্ভব? পরিসংখ্যানের বিভিন্ন পাতা ঘেঁটে সেই চেষ্টাটাই করা হোক।
২.
পরিসংখ্যানের উপাত্ত ঘাঁটার আগে একটি ব্যাপার পরিষ্কার করে নেওয়া যাক। কিছু ক্রিকেটভক্ত এখনও মুরালির বোলিং অ্যাকশনকে বৈধতা দিতে নারাজ, তাই তারা ওয়ার্ন-মুরালি বিতর্কে মুরালিকে পাত্তাই দিতে চান না। এক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, মুরালি একবার নয়, দুবার নয়, তিনবার বায়োমেকানিক্যাল পরীক্ষা দিয়েছেন এবং তিনবারই তার বোলিং অ্যাকশনকে আইসিসি বৈধ ঘোষণা করেছে। মুরালির হাত জন্মগতভাবেই বাঁকা, তাই তিনি বোলিং করার সময়ে চাকিংয়ের ব্যাপারে অনেকেরই বিভ্রম সৃষ্টি হয়। তাছাড়া সর্বোচ্চ ১৫ ডিগ্রি হাত বাঁকাতে পারার আইনটি মুরালির সময়েই পাশ হয় এবং তার দেওয়া তৃতীয় পরীক্ষা বর্তমান সব নিয়ম মেনেই হয়েছিল। এখনকার আইন বেশি কড়া আর মুরালির সময়ে আইন দুর্বল ছিল- এমনটি ভাবারও অবকাশ নেই। তবুও কারো সংশয় থাকলে নিচের ভিডিও ক্লিপটি দেখে নিতে পারেন এবং ওয়ার্ন ও মুরালি দুজনেই বৈধ বোলার- এটা মেনে নিয়েই আমরা আমাদের বিশ্লেষণে যাচ্ছি।
শেন ওয়ার্ন ও মুত্তিয়া মুরালিধরন- দুজনেরই টেস্ট অভিষেক ১৯৯৩ সালে। ওয়ার্ন অবসর নেন ২০০৭ সালে আর মুরালি ২০১০ সালে। তিন বছর আগে অবসর নেওয়া সত্ত্বেও মুরালির চেয়ে ১২ টেস্ট বেশি খেলেন ওয়ার্ন! সংখ্যাটা আরো বাড়তো যদি না ডোপ কেলেঙ্কারিতে ওয়ার্ন এক বছর মাঠের বাইরে না থাকতেন। এমনটি হওয়াই অবশ্য স্বাভাবিক, কারণ শ্রীলঙ্কার চেয়ে অস্ট্রেলিয়া সবসময়েই বেশি টেস্ট খেলে এসেছে। শ্রীলঙ্কার অধিকাংশ টেস্ট সিরিজ যেখানে দুই বা তিন ম্যাচের হয়, সেখানে অস্ট্রেলিয়া প্রায়শই চার বা পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলে থাকে। বিশেষ করে নিয়মিত বিরতিতে অ্যাশেজ খেলায় অস্ট্রেলিয়ার পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ সংখ্যা অনেক বেশি।
ওয়ার্ন ১৪৫ টেস্টে পেয়েছেন ৭০৮ উইকেট, উইকেটপ্রতি খরচ করেছেন ২৫.৪১ রান। অন্যদিকে ১৩৩ টেস্ট খেলে ৮০০ উইকেট পেয়েছেন মুরালি, উইকেটপ্রতি খরচ করেছেন ২২.৭২ রান। প্রতিটি উইকেটের জন্য মুরালিকে গড়ে করতে হয়েছে ৫৫টি বল আর ওয়ার্নকে প্রতি উইকেটের জন্য ৫৭.৪ বল করতে হয়েছে। মুরালি ওভারপ্রতি ২.৪৭ রান খরচ করেছেন আর ওয়ার্ন খরচ করেছেন ২.৬৫ রান। ওয়ার্ন ইনিংসে কমপক্ষে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন ৩৭ বার, অন্যদিকে মুরালি এক ইনিংসে কমপক্ষে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন ৬৭ বার। মুরালি ম্যাচে দশ উইকেট নিয়েছেন ২২ বার আর ওয়ার্ন এই কীর্তি গড়েছেন দশবার। একদম খালি চোখে দুজনের পরিসংখ্যান দেখলে মুরালি সবকিছুতেই ওয়ার্নের চেয়ে এগিয়ে থাকবেন।
৩.
তবে সবকিছু এত সহজে নির্ধারণ করা গেলে এই বিতর্ক তো কখনোই এত জমজমাট হতো না, সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য পরিসংখ্যানের ভেতরের খুঁটিনাটি জানা খুবই জরুরি। এবার এই কঠিন কাজটিই করা যাক।
মুরালি আর ওয়ার্নের মধ্যে তুলনা করার আগে মনে রাখতে হবে শ্রীলঙ্কায় জন্ম নেওয়ার কারণে মুরালি স্বাভাবিকভাবেই স্পিন সহায়ক পরিবেশে বোলিং করার সুযোগ বেশি পেয়েছেন। অন্যদিকে ওয়ার্ন ঘরের মাঠ হিসেবে পেয়েছেন পেসারদের স্বর্গ হিসেবে বিবেচিত মাঠগুলোকে, যেখানে স্পিনারদের জন্য সাহায্যের পরিমাণ ছিল খুবই সীমিত। মুরালি ঘরের মাঠে ৭৩ টেস্ট খেলে ১৯.৬ গড়ে পেয়েছেন ৪৯৩ উইকেট। ঘরের বাইরে ৬০ ম্যাচ খেলে পেয়েছেন ৩০৭ উইকেট, কিন্তু উইকেটপ্রতি খরচ করতে হয়েছে ২৭.৮ রান! আরেকটু গভীরে গেলে স্পিন কন্ডিশনের গুরুত্ব আরো স্পষ্ট হবে, মুরালি উপমহাদেশে ৯৭ টেস্ট খেলে ২১.৬৯ গড়ে শিকার করেছেন ৬১২ উইকেট, কিন্তু উপমহাদেশের বাইরে ৩৬ টেস্ট খেলে পেয়েছেন ১৮৮ উইকেট আর উইকেটপ্রতি প্রায় ৪.৫ রান বেশি খরচ করেছেন।
অন্যদিকে ওয়ার্ন তার ঘরের মাঠে ৬৯ টেস্ট খেলে ২৬.৪ গড়ে পেয়েছেন ৩১৯ উইকেট আর অস্ট্রেলিয়ার বাইরে ৭৬ টেস্ট খেলে ২৪.৭ গড়ে পেয়েছেন ৩৮৯ উইকেট। তার মানে দেখা যাচ্ছে যে ঘরের মাঠে মুরালির মতো স্পিন সহায়ক পিচ পেলে ওয়ার্নের রেকর্ড আরো ভালো হতে পারতো।
৪.
কিন্তু এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আছে। মুরালি শ্রীলঙ্কায় জন্ম নেওয়ায় স্পিন সহায়ক উইকেট পেয়েছেন এটা যেমন সত্যি, তেমনি ওয়ার্ন অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম নেওয়ায় ইংল্যান্ডের মতো স্পিনে দুর্বল দলের বিরুদ্ধে বেশি খেলতে পেরেছেন এটাও কিন্তু সত্যি। এক্ষেত্রে একটি তথ্য দিলে ব্যাপারটি আরো স্পষ্ট হবে। ইংল্যান্ডের মাঠে ওয়ার্ন ২২ টেস্ট খেলে ২১.৬৫ গড়ে পেয়েছেন ১২৯ উইকেট। অন্যদিকে মুরালি ইংল্যান্ডে ৬ টেস্ট খেলে ১৯.২ গড়ে পেয়েছে ৪৮ উইকেট।
ভারতীয় উপমহাদেশে ওয়ার্ন ২৫ টেস্ট খেলে পেয়েছেন ১২৭ উইকেট, কিন্তু উইকেটপ্রতি খরচ করেছেন ২৬.৮১ রান– যা তার হোম কিংবা অ্যাওয়ে দুই গড়ের চেয়েই বেশি! কিন্তু প্রথাগত যুক্তি অনুসারে উপমহাদেশে ওয়ার্নের রেকর্ড আরো ভালো হওয়ার কথা, কারণ এখানে স্পিনাররা বেশি সুবিধা পায়, অথচ তা হয়নি! তার মানে শুধু পরিবেশ নয়, প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তা ও স্পিন খেলার ব্যাপারে পারদর্শিতা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
৫.
ওয়ার্ন-মুরালি বিতর্কে একটি পয়েন্টে বিশেষজ্ঞরা মুরালিকে কিছুটা এগিয়ে রাখেন- সেটা হচ্ছে সতীর্থদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সমর্থনের পরিমাণ। ওয়ার্ন যেখানে সতীর্থ হিসেবে ম্যাকগ্রা, লি, গিলেস্পিদের মতো পেসারকে পেয়েছেন, সেখানে এক চামিন্দা ভাস ছাড়া বলার মতো বিশ্বমানের কোনো বোলার মুরালি সঙ্গী হিসেবে পাননি। এক্ষেত্রে একটা পরিসংখ্যান দেখলেই ব্যাপারটা সবার বোধগম্য হয়ে যাবে। বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়েকে বাদ দিয়ে বাকি সাত টেস্ট প্লেয়িং দেশের বিরুদ্ধে শ্রীলঙ্কার খেলা ১০৬ টেস্টের মধ্যে মুরালি একাই নিয়েছেন ৬১১ উইকেট আর বাকিরা মিলে নিয়েছেন ৮৮৯ উইকেট! অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার খেলা ১৪২ টেস্টে ওয়ার্ন একা নিয়েছেন ৬৯১ উইকেট আর বাকিরা নিয়েছেন ১,৭৫৪ উইকেট!
ভালো সঙ্গী পাওয়াটা ওয়ার্নকে কিছুটা হলেও সুবিধা দিয়েছে, প্রতিপক্ষ চাইলে মুরালির বিপক্ষে অতি রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে খেলার সিদ্ধান্ত নিতে পারতো, কারণ অন্য কোনো লঙ্কান বোলারের ওপর চড়াও হওয়ার পথ তাদের কাছে খোলা ছিল। কিন্তু ওয়ার্নের দলে সবাই ভালো বোলার হওয়ায় প্রতিপক্ষ এই সুযোগ পেত না, উল্টো লি-ম্যাকগ্রাদের দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে অনেক সময় ওয়ার্নের ওপর চড়াও হতে গিয়েও প্রতিপক্ষকে উইকেট হারাতে হয়েছে।
তবে ভালো সঙ্গী পাওয়ার উল্টো দিকটাও আমাদের দেখতে হবে। মুরালির দলে তেমন ভালো বোলার না থাকায় শুধুমাত্র তাকে ঘিরেই শ্রীলঙ্কা তাদের গেমপ্ল্যান সাজাতো আর স্বাভাবিকভাবেই তিনি বেশি ওভার করার সুযোগ পেতেন। মুরালি তার ক্যারিয়ারে মোট বল করেছেন ৭৩৩৯.৫ ওভার যা তার দলের মোট ওভারের ৩৩ শতাংশ। উল্লেখ্য, টেস্ট ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বল করার রেকর্ডটা মুরালিরই দখলে। অন্যদিকে দলে অনেক বিশ্বমানের পেসার থাকায় অনেক সময় দেখা গেছে যে ওয়ার্ন বোলিংয়ে আসার আগেই সিংহভাগ উইকেট অজি পেসাররা ভাগাভাগি করে ফেলেছে! এ কারণেই মুরালির চেয়ে ১২ টেস্ট বেশি খেলেও ওয়ার্ন বল করতে পেরেছেন ৬৭৭৪.১ ওভার। তাই ভালো সতীর্থ পাওয়ায় অতিরিক্ত সুবিধা যেমন ওয়ার্ন পেয়েছেন, ঠিক সেভাবে তার বিপরীত প্রতিক্রিয়াও তাকে সহ্য করতে হয়েছে।
৬.
শেন ওয়ার্ন তার পুরো ক্যারিয়ারে ম্যাচসেরার পুরস্কার জিতেছেন ১৭ বার (যৌথভাবে তৃতীয় সর্বোচ্চ) আর মুরালি জিতেছেন ১৯ বার (দ্বিতীয় সর্বোচ্চ)। মুরালি সিরিজসেরা হয়েছেন ১১ বার (সর্বোচ্চ) আর ওয়ার্ন হয়েছেন ৮ বার (যৌথভাবে তৃতীয় সর্বোচ্চ)। দলে অনেকগুলো ম্যাচ উইনার থাকলে ম্যাচ কিংবা সিরিজসেরার পুরস্কার জেতা কিছুটা কঠিন, সেটাই ওয়ার্নের ক্ষেত্রে হয়েছে। তাছাড়া একজন বোলারের গুরুত্ব বোঝাতে খেলার চতুর্থ ইনিংসে তার পারফরম্যান্সকেও বড় মাপকাঠি হিসেবে অনেকে বিবেচনা করেন। ওয়ার্নের খেলা ৫২টি চতুর্থ ইনিংসে উইকেটসংখ্যা ১৩৪টি আর উইকেটপ্রতি খরচ করেছেন ২৩.৬ রান। চতুর্থ ইনিংসে সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়ার রেকর্ডটি ওয়ার্নেরই দখলে। অন্যদিকে ৩৪ বার চতুর্থ ইনিংসে বল করে মুরালি উইকেট নিয়েছেন ১০৬টি, উইকেটপ্রতি রান দিয়েছেন ২০.৮৫ রান। তাই চতুর্থ ইনিংসে উইকেট বেশি পেলেও ১৮ ইনিংস বেশি খেলা সাথে উইকেটপ্রতি মুরালির চেয়ে তিন রান বেশি খরচ করায় ওয়ার্নকে এই ফ্যাক্টরে এগিয়ে রাখারও উপায় নেই।
৭.
ওয়ার্ন ও মুরালি দুজনই মোটামুটি সব প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ছড়ি ঘোরালেও পারেনি শুধুমাত্র ভারতের বিপক্ষেই সেভাবে ছড়ি ঘোরাতে পারেনি। এর মূল কারণ মোটামুটি আমরা সবাই জানি, “ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা চোখ বুজেও স্পিন খেলতে পারে”- এটা ক্রিকেটেরই একটা প্রবাদবাক্য। মুরালি-ওয়ার্নের মতো স্পিনাররাও সেই প্রবাদবাক্যকে ওল্টাতে পারেননি। ভারতের বিপক্ষে ২২ টেস্ট খেলে প্রায় ৩৩ গড়ে ১০৫ উইকেট নিয়েছেন মুরালি, অন্যদিকে ওয়ার্ন ১৪ টেস্ট খেলে নিয়েছেন ৪৩ উইকেট আর উইকেটপ্রতি খরচ করেছেন ৪৭.৮ রান।
সামগ্রিক পরিসংখ্যানে ভারতের বিপক্ষে মুরালির রেকর্ড ওয়ার্নের চেয়ে ভালো হলেও ভারতের মাঠে ওয়ার্নের রেকর্ডই ভালো। ওয়ার্ন যেখানে ৯ টেস্ট খেলে ৪৩.১ গড়ে ৩৪ উইকেট নিয়েছেন, সেখানে মুরালি ১১ টেস্ট খেলে নিয়েছেন ৪০ উইকেট আর উইকেটপ্রতি ওয়ার্নের চেয়ে প্রায় ২.৪ রান বেশি খরচ করেছেন। তাই দুজনকেই যে ভারতের বিপক্ষে কম-বেশি ভুগতে হয়েছে সেটা বেশ স্পষ্ট। এছাড়া অন্যান্য প্রতিপক্ষের মাঠ হিসাব করলে নিউ জিল্যান্ড ও উইন্ডিজে ওয়ার্নের চেয়ে মুরালির বোলিং গড় তুলনামূলক ভালো, পক্ষান্তরে দক্ষিণ আফ্রিকায় মুরালির চেয়ে ওয়ার্নের বোলিং গড় কিছুটা গড় ভালো।
৮.
ওয়ার্ন মুরালি বিতর্কে মুরালির বিপক্ষে সবচেয়ে বড় পয়েন্ট হচ্ছে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলের বিপক্ষে বেশি উইকেট লাভ। তখনকার সময়ে জিম্বাবুয়ে ও বাংলাদেশ বাকি দলগুলোর চেয়ে টেস্টে পিছিয়ে ছিল, এই দুই দলের বিপক্ষে মুরালি ২৫ টেস্ট খেলে শিকার করেছিলেন ১৭৬ উইকেট, প্রতি উইকেট পেতে খরচ করেছিলেন মাত্র ১৫.১ রান। অন্যদিকে এই দুই দলের বিপক্ষে ওয়ার্ন মোটে তিনটি টেস্ট খেলতে পেরেছিলেন, এই তিন টেস্টে ওয়ার্ন ২৫.৭ গড়ে পেয়েছিলেন ১৭ উইকেট। যদি এই দুই দলের বিপক্ষে ম্যাচগুলো বাদ দেওয়া হয় তবে মুরালি ১০৮ টেস্টে ২৪.৮৭ গড়ে পেয়েছিলেন ৬২৪ উইকেট, অন্যদিকে ওয়ার্ন ১৪২ টেস্টে ২৫.৪ গড়ে পেয়েছিলেন ৬৯১ উইকেট। অর্থাৎ জিম্বাবুয়ে ও বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলা ম্যাচগুলো বাদ দিলেও মুরালির গড় ওয়ার্নের চেয়ে ভালো। উইকেটসংখ্যায় ওয়ার্ন এগিয়ে থাকলেও ৩৫ ম্যাচ বেশি খেলায় সেটিও খুব একটা বড় পার্থক্য না। তাই এই বিতর্কে সবল প্রতিপক্ষ কিংবা দুর্বল প্রতিপক্ষের মাপকাঠি সেভাবে খাটছে না।
৯.
এবার প্রতিপক্ষের ব্যাটিং অর্ডার অনুযায়ী দুজনের উইকেটগুলো ভাগ করা যাক। এখানে টপ অর্ডার বলতে ব্যাটিং ক্রমের প্রথম তিনজন ব্যাটসম্যান, মিডল অর্ডার বলতে মাঝের চারজন ব্যাটসম্যান এবং টেলএন্ডার বলতে শেষ চারজন ব্যাটসম্যানকে বোঝানো হয়েছে। শেন ওয়ার্ন টেস্ট ক্যারিয়ারে যত উইকেট পেয়েছেন তার মধ্যে ২৩ শতাংশ ছিল টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের, ৩৯.৮ শতাংশ ছিল মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান আর টেলএন্ডারদের উইকেট ছিল ৩৭.১ শতাংশ।
অন্যদিকে মুরালির ৮০০ উইকেটের মধ্যে টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের উইকেট ছিল ২৫.৩%, মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান ছিল ৪২.৩% আর টেলএন্ডার ছিল ৩২.৫ শতাংশ। এক্ষেত্রে একটা ব্যাপার আগেই বলা হয়েছে, ওয়ার্নের দলে ভালো মানের সব বোলার থাকায় টপ অর্ডারের উইকেট অনেক সময়েই অজি পেসাররা ভাগাভাগি করে নিতো। কিন্তু মুরালিকে ১০ ওভার পরেই বোলিংয়ে আসতে হতো, তাই স্বাভাবিকভাবেই তিনি টপ অর্ডারের বিপক্ষে বল করার সুযোগ বেশি পেয়েছেন।
এবার তখনকার সেরা ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে ওয়ার্ন-মুরালির রেকর্ডটা একটু দেখে নেওয়া যাক। স্পিন খেলার ক্ষেত্রে সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ধরা হয় ব্রায়ান লারাকে। তার বিপক্ষে ওয়ার্ন-মুরালি দুজনকেই কিছুটা নাজেহাল হতে হয়েছে। তবে সাফল্য যে একেবারে তারা পাননি, তা কিন্তু নয়। লারার বিপক্ষে ৩৫ ইনিংস খেলে তাকে মোট ছয়বার আউট করেছেন ওয়ার্ন। অন্যদিকে ১৬ ইনিংসে মুখোমুখি হয়ে পাঁচবার লারার উইকেট শিকার করেছেন মুরালি। সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান শচীনের বিপক্ষে দুজনের রেকর্ড দেখা যাক। ২২ ইনিংস খেলে শচীনকে তিনবার আউট করতে পেরেছেন ওয়ার্ন, সেখানে ২৬ ইনিংসে মুখোমুখি হয়ে আটবার শচীনের উইকেট পেয়েছেন মুরালি।
তবে শুধু উইকেট পার ইনিংস দেখে কোনো বিবেচনায় আসা ঠিক হবে না। আগেই বলা হয়েছে, মুরালি একাই তার দলের সিংহভাগ ওভার করতেন, তাই সেরা ব্যাটসম্যানদের আউট করার দায়িত্বটা সম্পূর্ণভাবে তার ঘাড়েই পড়তো। অন্যদিকে ওয়ার্ন বেশি ইনিংস খেললেও এই দুই লিজেন্ডকে করা তার বল-সংখ্যা কিন্তু মুরালির চেয়ে কম। ওয়ার্ন-মুরালিকে মোকাবেলা করা প্রসঙ্গে ব্রায়ান লারা বলেছিলেন,
প্রথমদিকে মুখোমুখি লড়াইয়ে মুরালি আমাকে অনেকবার বিভ্রান্ত করেছে, যেটা ওয়ার্নের ক্ষেত্রে হয়নি। তবে সময় যত গিয়েছে, মুরালিকে খেলার ব্যাপারে আমার আমি তত বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়েছি। ওয়ার্নের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আবার উল্টো, সে বরং সময়ের সাথে আমার জন্য আরো বেশি ভয়ঙ্কর হয়েছে। এই দুজন আমার সময়ের সেরা স্পিনার ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
১০.
কিংবদন্তি এই দুই স্পিনারের মাঝে অদ্ভুত কিছু মিলও রয়েছে। দুজনেই দলের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হওয়া সত্ত্বেও কখনো নিজ দলের অধিনায়ক হতে পারেননি! মুরালির মধ্যে নেতৃত্বগুণ ঠিক সেভাবে ছিল না। তাছাড়া রানাতুঙ্গা আর জয়াসুরিয়ার পর শ্রীলঙ্কা নেতৃত্বের ক্ষেত্রে তরুণদের প্রাধান্য দেওয়ায় মুরালি সুযোগটাও পাননি। তবে ওয়ার্নের অধিনায়ক না হওয়াটা অনেক বেশি হতাশাজনক। ওয়ার্নকে বলা হয় ক্রিকেটে অব্যবহৃত সবচেয়ে ক্ষুরধার মস্তিষ্কের অধিকারী। একজন যোগ্য নেতা হওয়ার সব গুণ ওয়ার্নের মাঝে ছিল, কীভাবে সতীর্থদের কাছ থেকে সেরাটা আদায় করতে হবে তা তিনি জানতেন। তবে শুধুমাত্র শৃঙ্খলাজনিত সমস্যার কারণে তাকে কখনোই অধিনায়ক হিসেবে মনোনীত করেনি অস্ট্রেলিয়া!
তাছাড়া দুজনের ক্যারিয়ার জুড়েই বিতর্ক বেশ বড় একটা অংশজুড়ে ছিল। তবে একজনকে ঘিরে বিতর্ক ছিল অন দ্য ফিল্ডে, আরেকজনকে ঘিরে বিতর্ক ছিল অফ দ্য ফিল্ডে। বোলিং অ্যাকশন নিয়ে সন্দেহ ওঠায় খেলার মাঠে দুবার মুরালিকে বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে। যদিও প্রতিবারই তিনি নিজের বোলিং অ্যাকশনের বৈধতা প্রমাণ করেই ফিরেছেন কিন্তু সফল হয়ে আসার এই প্রক্রিয়া কিন্তু মোটেও সহজ ছিল না। অন্যদিকে নারী কেলেঙ্কারি, ডোপ কেলেঙ্কারিসহ এমন আরো বহু বিতর্কে জড়িয়ে ওয়ার্ন বারবার সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছেন। ডোপ কেলেঙ্কারির জন্য তো ১ বছর নিষিদ্ধ থেকে মাঠের বাইরেও থাকতে হয়েছিল তাকে। এসব প্রতিকূলতা কাটিয়ে ওয়ার্ন খেলে গেছেন তার আপন গতিতেই।
দুজনের মধ্যে আরেকটি মিল হচ্ছে তাদের অস্বাভাবিক ভালো পারফরম্যান্সের কারণে দুজন অসাধারণ স্পিনার দলে ঠিকমতো সুযোগই পাননি। মুরালি থাকাকালে হেরাথ কখনোই দলের প্রধান স্পিনার হতে পারেননি। অবশ্য পরবর্তীতে মুরালির অবসরের পর হেরাথ ঠিকই নিজেকে মেলে ধরেছিলেন। এদিক থেকে ম্যাকগিল আরো বড় অভাগা। ওয়ার্নের প্রভাবে বেচারা দলে ঠিকমত সুযোগই পাননি, আর ওয়ার্ন অবসর নেওয়ার কিছুদিন পর ম্যাকগিল নিজেও অবসরে চলে যান! বটগাছের বড় হওয়াটা সব মানুষই দেখে, কিন্তু একটা বটগাছ বড় হওয়ার সময়ে তার ছায়ায় পড়ে কত চারাগাছ অকালে ঝরে যায় তা ক’জনই বা মনে রাখে?
১১.
ওয়ার্ন আর মুরালির মাঝে যেকোনো একজনকে বাছাই করার লক্ষ্যে কাজ করতে গিয়ে জট মনে হয়ে আরো বেশি পাকিয়ে যাচ্ছে। আসলে ওয়ার্ন-মুরালি দুজনেরই অবস্থান সাফল্যের এমন উচ্চশিখরে যে এই দুজনের মধ্যে যেকোনো একজনকে বেছে নেওয়া অসম্ভব কঠিন একটি কাজ। দুজনের মধ্যে পার্থক্য খুবই সামান্য, কেউ এক মাপকাঠিতে এগিয়ে গেলে অন্যজন ঠিকই আরেক মাপকাঠিতে এগিয়ে সবকিছু সমান করে দেন।
ক্রিকেটবিশ্ব আসলে ভাগ্যবান যে এই দুই মহারথীকে একসাথে খেলতে দেখা গিয়েছিল। এই দুজনের মাহাত্ম্য তাদের অবসরের পর মানুষ আরো ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে। আজ ক্রিকেটে মানসম্মত স্পিনারের বড্ড অভাব, যারা আছেন তারা একটু প্রতিকূল পরিবেশেই নিজেদের আর মেলে ধরতে পারে না। বর্তমান সময়ের সেরা দুই স্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিন ও রশিদ খানের কথাই ধরা যাক। উপমহাদেশের বাইরে খেলা হলে তো অশ্বিনের একাদশে জায়গা পাওয়া নিয়েই টানাটানি লেগে যায়। অন্যদিকে রশিদ খানও গত বিশ্বকাপে কিছুটা প্রতিকূল পরিবেশে সম্পূর্ণ ব্যর্থ ছিলেন।
অথচ ওয়ার্ন আর মুরালি বছরের পর বছর যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেদের বারবার প্রমাণ করে গেছেন, দলকে এনে দিয়েছেন বহু ঐতিহাসিক জয়। এখন শ্রেষ্ঠ দুজনের মধ্যে একজনকে যদি বেছে নিতেই হয় তবে দুটি পথ খোলা রয়েছে- আপনি পরিসংখ্যানের সমস্ত উপাত্তকে গুরুত্ব দিতে পারেন। ওপরে পরিসংখ্যানের বিভিন্ন উপাত্ত ঘেঁটে একটা ব্যাপার কিন্তু পরিষ্কার। অধিকাংশ মাপকাঠিতে ওয়ার্নের চেয়ে মুরালিই অল্প কিছু ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন। আপনি যদি দলে ধারাবাহিক পারফরমার চান তাহলে একমাত্র স্পিনার হিসেবে মুরালিকে নিতে পারেন। অন্যদিকে খাদের কিনারা থেকে একক নৈপুণ্যে ম্যাচ ঘোরানোর ব্যাপারে মুরালির চেয়ে ওয়ার্নই কিছুটা এগিয়ে ছিলেন। তাই আপনি যদি লেগস্পিন ও ম্যাজিকাল স্পেলের ভক্ত হয়ে থাকেন তবে আপনার একাদশে মুরালির বদলে ওয়ার্নকে নিতে পারেন।
তবে এত বিতর্কে না গিয়ে শুধু একটি দৃশ্য কল্পনা করুন- একদিকে ওয়ার্ন তার লেগব্রেক আর ফ্লিপার দিয়ে ব্যাটসম্যানকে নাজেহাল করছেন অন্যপ্রান্তে মুরালি তার অফব্রেক ও দুসরার সাথে এক লাইন-লেংথে বারবার বল করে ব্যাটসম্যানকে বিভ্রান্ত করছেন- ফিল্ডিং টিমের জন্য এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কী হতে পারে! দুই স্পিনার রাখাটা সব পরিবেশের জন্য হয়তো মানানসই নয়, কিন্তু অসাধারণ দুই ঘূর্ণিজাদুকর একসাথে বোলিং করছেন- শুধুমাত্র এমনটা কল্পনা করার জন্য একটু কম মানানসই দল বানানো যেতেই পারে!