১
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একটা সময় পাটিগণিতে ‘স্রোতের অনুকূলে আর স্রোতের প্রতিকুলে’ বিষয়ক বলে কিছু অংক ছিল।ধরা যাক, একজন সাঁতারু ১০ মাইল/ঘণ্টা বেগে সাতার কাটতে পারে। নদীর স্রোতের গতিবেগ ২ মাইল/ঘণ্টা। তাহলে সেই সাঁতারু যখন স্রোতের দিকে সাঁতার কাটবে, তখন নদীর স্রোত তার গতির সাথে যুক্ত হবে। সেই মুহূর্তে সে সাঁতরাতে পারবে আসলে (১০+২) = ১২ মাইল/ঘণ্টা বেগে। একই ভাবে সে যদি স্রোতের বিপরীতে সাতার কাটে তখন তার গতি হয়ে যাবে (১০-২) = ৮ মাইল/ঘণ্টা।
তার মানে একই দক্ষতা সম্পন্ন সাঁতারু একই ভাবে সাঁতার কাটার পরেও শুধু মাত্র পরিস্থিতির কারণে একই দূরত্ব পার হবার জন্য দুই রকম সময় নেবে। একজন পারফর্মারের পারফর্ম করার ক্ষেত্রে শুধু মাত্র নিজের পারফর্মেন্সটাই গুরুত্বপূর্ণ না, সাথে আরো অনেক বাহ্যিক বিষয় কাজ করে। প্রতিটি খেলোয়াড়ই তার পছন্দের পরিবেশের বাইরে গেলে কিছুটা অস্বস্তিতে ভোগেন। একই ভাবে প্রতিটি খেলোয়াড়ই তার চেনা পরিবেশে সবচেয়ে সেরা সার্ভিসটা দিতে পারেন।
এখন কথা হচ্ছে আপনি স্বাভাবিক ভাবেই সবসময় আপনার সেরা পরিবেশটা পাবেন না। বরং, কিছু কিছু খেলোয়াড় আছেন যারা কিনা প্রতিকুল পরিবেশকেও কিছু কারিশমা দ্বারা নিজের পক্ষে নিয়ে আসে। তারাই গ্রেট বলে বিবেচিত হন। তারা চেনা পরিবেশের সাথে সাথে বিরুদ্ধ পরিবেশেও ভিন্ন ভাবে সফল। এদেরকে তাই একটু আলাদা ভাবে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। ক্রিকেটে খুঁজতে দিলে ওয়াসিম আকরাম খুব আদর্শ একটা উদাহরণ। ওয়াকারের চেয়ে স্ট্রাইক রেট কিংবা ম্যাচ প্রতি উইকেটে পিছিয়ে থাকার পরেও ইতিহাস ওয়াসিমকেই এগিয়ে রাখে তার বিভিন্ন পরিস্থিতি জয় করার ক্ষমতা থাকার কারণে।
যাই হোক, অনেক শোনা হলো ক্রিকেট আর সাঁতারের কথা। এখন ফুটবল মাঠের এমনই একজনের কীর্তির কিছু অংশের কথা শোনা যাক। আর সেই কীর্তিমান মানুষটির নাম দিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা।
২
একজন খেলোয়াড়ের বিশ্বকাপের সেরা পারফর্মেন্স কোনটা? এই সম্পর্কে কোন স্বীকৃতি এখনো দেওয়া হয়নি। তবে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের মতে প্রথম দুটোর মাঝে একটাতে ম্যারাডোনার ৮৬ এর পারফর্মেন্স থাকবে সেটা নিশ্চিত। তার সাথে লড়াই হবে পেলের ৭০ কিংবা ৫৮ এর পারফর্মেন্স। সে যাই হোক, এগুলোর তুলনায় ৯০ এর বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার পারফর্মেন্স খুবই মলিন মনে হবারই কথা। পরিসংখ্যানের বিচার পুরো আসরে তার অ্যাসিস্ট মাত্র ১টি, কোন গোল নেই। একজন মিডফিল্ডার বিশেষ করে ম্যারাডোনার মান অনুযায়ী এটা একেবারেই সাধারণ হবার কথা।
৯০ এর বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা এবং আর্জেন্টিনার পারফর্মেন্সটা একটু লক্ষ্য করুন। প্রথম ম্যাচে ক্যামেরুনের কাছে ১-০ গোলের হার। তবে সেই ম্যাচের খেলা দেখলে বুঝা যায় যে ক্যামেরুনের লক্ষ্য ছিল ম্যারাডোনার পায়ে বল গেলেই তাকে শারীরিক ভাবে আঘাত করা।
দ্বিতীয় ম্যাচে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে ২-০ গোলের জয়ে ম্যারাডোনার কোন গোল কিংবা অ্যাসিস্ট নাই। ৩য় ম্যাচে রোমানিয়ার বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্র হওয়া ম্যাচেও কোন গোল কিংবা অ্যাসিস্ট নেই।
সেই বিশ্বকাপে গ্রুপ ছিল ৬ টি, প্রতি গ্রুপ থেকে সরাসরি ২ টি করে দল পরের পর্বে যাবে। প্রতি গ্রুপের ৩য় সেরা দল থাকে ৬ টি, সেখান থেকে প্রথম ৪ টি দল নিয়ে আগের ১২ দলের সাথে যোগ করে দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়। আর্জেন্টিনা ছিল এই চার দলের একটি (ইউরো ২০১৬ এর পর্তুগালের মতো)।
দ্বিতীয় পর্বে ব্রাজিলের মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা। সেদিন ম্যাচের একমাত্র গোলটি করেন ক্লদিও ক্যানিজিয়া, ম্যারাডোনার একটা পাস থেকে। যা ছিল, পুরো টুর্নামেন্টে ম্যারাডোনার একমাত্র অ্যাসিস্ট।
পরের ম্যাচ যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে। গোলশূন্য ড্র সেই ম্যাচ শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে গড়ায়। টাইব্রেকারে ম্যারাডোনা পেনাল্টি মিস করেন, কিন্তু গোলকিপার গোয়াকোচিয়া সেই যাত্রায় আর্জেন্টিনাকে বাঁচিয়ে নিয়ে যান।
ইতালির বিপক্ষে সেমিফাইনালটাই ছিল সবচেয়ে কঠিন। সেই ম্যাচে শিলাচ্চির গোলে প্রথমেই ইতালি এগিয়ে যায়, কিন্তু ৬৭ মিনিটে ক্যানিজিয়ার গোলে ম্যাচে ফেরত আসে আর্জেন্টিনা। শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে আবারও ম্যাচটা জিতে নেয় আর্জেন্টিনা। তবে ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে ১-০ গোলের হার মেনে নেয় আর্জেন্টিনা।
৩
১৯৯০ এর বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার পারফর্মেন্স বিশ্লেষণ করার আগে জানা উচিৎ, সেই মৌসুমে আসলে ম্যারাডোনা ক্লাব পর্যায়ে কেমন ফর্মে ছিলেন? সেবার ম্যারাডোনা ন্যাপলিকে নিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো ইতালিয়ান সিরি ‘এ’ টাইটেল জিতেন। ১৬ গোল করে নিজে হন ন্যাপলির পক্ষে সিরি ‘এ’ র সর্বোচ্চ গোলদাতা। এছাড়া সব মিলিয়ে লিগের ৩য় সর্বোচ্চ- তার চেয়ে বেশি গোল করেন বাস্তেন (১৯) আর ব্যজিও (১৭)।
এমন ফর্মে থাকা একজন খেলোয়াড় কিভাবে বিশ্বকাপে গোল বিহীন থাকেন? এই বিষয়টা বুঝতে হলে সর্বপ্রথম আপনাকে আরো কিছু বিষয় জানতে হবে। যেকোন একটা কাজে সফলতা পাওয়ার জন্য তিনটা বিষয় আপনার থাকতে হবে, Vision, Mission and Goal. বিষয়টা সহজভাবে বুঝানোর চেষ্টা করা যাক।
Vision হচ্ছে কোন একটা কাজ করার ইচ্ছে। মনে করুন আপনি গুলিস্তান থেকে নিউমার্কেট যাবেন। এখন এই যাওয়ার টার্গেটটাই আপনার Vision. গুলিস্তান থেকে নিউমার্কেট যাওয়ার জন্য আপনি কিছু পন্থা অবলম্বন করবেন, হয়তো বাসে যাবেন, কিংবা রিক্সায় অথবা পায়ে হেঁটে। এটা হচ্ছে আপনার Mission এবং এই Mission বাস্তবায়িত করার জন্য আপনাকে কিছু কাজ করতে হবে যেমন বাসে করে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছানোর জন্য নির্দিষ্ট বাসটাই ধরতে হবে কিংবা যে বাসটা গুলিস্তান থেকে নিউমার্কেটে যায় সেই বাসটাতেই উঠতে হবে। আপনি যদি সাভারের বাসে উঠেন তাহলে কখনোই নিউমার্কেটে পৌছুতে পারবেন না । এখানে, নিউ মার্কেটে যাওয়া হচ্ছে আপনার Goal.
একজন মানুষকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছুতে হলে তার Vision, Mission এবং Goal সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। অবাস্তব Vision থাকলে সেটা বাস্তবায়ন করা মোটামুটি অসম্ভব। যেমন, আপনার Vision হলো নিউমার্কেটে যাওয়া কিন্তু আপনার Mission হচ্ছে নৌকায় চড়ে যাওয়া! তাহলে সমস্যা। এই Vision-এর দিক থেকে ম্যারাডোনা ছিলেন অন্যান্য অনেক খেলোয়াড়ের চেয়ে এগিয়ে।
৯০ এর বিশ্বকাপে বাকি দলগুলোর তুলনায় শক্তিতে ম্যারাডোনার দলটা ছিল অনেকটা স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই করার মতোই। ম্যারাডোনা জানতেন যে, এই দলে তিনি যদি পারফর্ম করতে যান তাহলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে হয়তো সফল হবেন কিন্তু তার বাজে দিনে দলের ভরাডুবি হবে সেটা নিশ্চিত। এই কারণে তিনি পেছন থেকে নির্দেশনা দেবার চিন্তা করলেন।
অন্যান্য খেলাতেও এই কাজ অনেকে করেছেন। ক্রিকেটের উদাহরণ দিয়েই বুঝানোর চেষ্টা করা যাক; শেবাগ ওপেনিং পজিশনে সেট করার জন্য গাঙ্গুলী নিজের পজিশন ছেড়ে নিচে নেমে এসেছিলেন। এতে গাঙ্গুলীর ক্যারিয়ার কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিন্তু দল উপকৃত হয়েছে।
ম্যারাডোনার কাজটাও ছিল অনেকটা এমন। তিনি তার খেলোয়াড়দেরকে নিজের মতো খেলার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন যাতে বাকিরা নির্ভার ভাবে খেলতে পারেন। কাজটা ছিল অনেকটা এমন, ধরুন আপনাকে ৩০০ রান তাড়া করতে হবে। দলের ব্যাটিং লাইনের অবস্থা যদি খুব খারাপ হয় তাহলে সচরাচর সবচেয়ে সেরা ব্যাটসম্যানটা ওপেনিংয়ে নামবে না। ওপেনিংয়ে নামা ব্যাটসম্যানটা সেঞ্চুরি করলেও, যদি ১০০ রান বাকি থাকা অবস্থায় আউট হয়ে যায় সেটা বাকি সবাই মিলে হয়তো পূরণ করতে পারবে না। কারণ সেই সাহসটাই তারা হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু যখন তারা দেখবে যে, তাদের পরেও কেউ একজন আছে যে কিনা তারা আউট হয়ে যাবার পরেও নৌকাটা তীরে পৌঁছে নেবার সামর্থ্য রাখে, তখন তাদের সামর্থ্যটাও বেড়ে যায়। এই কাজটাই করেছিলেন ৯০ এর ম্যারাডোনা। নিজে পারফর্ম যতটুকুই হোক, টার্গেট ছিল অন্যদের কাছ থেকে সেরাটা বের করার। সেই কাজে তিনি ছিলেন সফল।
ফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল জার্মানি, যারা কিনা আগের বিশ্বকাপেও আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল। জার্মানির সেই দলটা ছিল ভয়ানক রকমের শক্তিশালী। সেই জার্মানি ৮২ এর বিশ্বকাপেও ফাইনালে খেলেছিল। পাওলো রসির চমকে দুর্দান্ত ভাবে ফিরে আসা ইতালির সাথে আর পেরে উঠেনি।
৮৬ এর ফাইনালেও ৫৫ মিনিটের ২ গোলে পিছিয়ে পড়েছিল। কিন্তু ৭৪ আর ৮০ মিনিটের দুই গোলে দুর্দান্ত ভাবে ফিরে এসেছিল জার্মানি। শেষ পর্যন্ত ম্যারাডোনার পাসে বুরাচাগা জার্মান কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দেয়।
৯০ এর ফাইনালে জার্মানির আসাটা আর্জেন্টিনার মতো ধুঁকে ধুঁকে নয়, গ্রুপ পর্ব থেকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবেই এসেছিল। দ্বিতীয় পর্বে হারিয়েছিল গুলিত-কোম্যান-রাইকার্ড-বাস্তেনদের নেদারল্যান্ডকে। কোয়ার্টারে চেকোস্লাভিয়া আর সেমিতে ইংল্যান্ডকে। ফাইনালে তাই জার্মানি ফেভারিট হিসেবেই যাত্রা শুরু করে।
৪
এতোকিছুর পরেও, ৯০ বিশ্বকাপ ফাইনালটা বিতর্কিত নানা কারণেই। সেই বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার সবচেয়ে প্রিয় খেলোয়াড় ক্যানিজিয়া ফাইনাল মিস করেন, সেমি ফাইনালে হলুদ কার্ড পাওয়ার কারণে। জনশ্রুতি আছে যে। আর্জেন্টিনাকে আরো দুর্বল করে দেবার জন্যেই নাকি সেমিতে ক্যানিজিয়াকে ইচ্ছাকৃত হলুদ কার্ড দেখানো হয়েছিল যাতে তিনি ফাইনালে খেলতে না পারেন।
বিষয়টা সত্য কিনা তার প্রমাণ নেই, তবে ফাইনালে অযাচিত সমর্থন দেওয়া হয়েছিল জার্মানিকে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর্জেন্টিনার টার্গেটই ছিল ডিফেন্সিভ খেলে ম্যাচটা টাইব্রেকারে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু ভাগ্য সেদিন বিরূপ। ম্যাচের ৬৫ তম মিনিটেই আর্জেন্টিনার একজন খেলোয়াড় লাল কার্ড দেখলে, তারা ১০ জনের দলে পরিণত হয় । সেই লাল কার্ড ছিল সেই পর্যন্ত হওয়া বিশ্বকাপ ফাইনালের প্রথম লাল কার্ড। তবে সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনা ঘটে ৮৫ তম মিনিটে। পেনাল্টি বক্সের ভেতরে ফাউল করায় বিতর্কিত পেনাল্টি দেওয়া হয় আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। পেনাল্টি থেকে গোল করেন জার্মানির ব্রেহমে। এর দুই মিনিট পর আবার আরেকজন আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়কে লাল কার্ড দেখানো হলে আর্জেন্টিনা ৯ জনের দলে পরিণত হয়। সেদিন আর্জেন্টিনা আর পেরে উঠেনি। আর ম্যাচটা টাইব্রেকারে গেলে কি পারতো? তাও জানার উপায় নেই। তবে এমন হলে, আক্ষেপ কিছুটা থেকেই যায়।
৫
‘দল দুর্বল পেয়েছেন, প্রতিপক্ষ দুর্দান্ত, সাথে রেফারিরও বিরূপ সমর্থন’- এই তিনটার একটা বিষয়ও পক্ষে গেলে হয়তো বা ম্যারাডোনা আরেকটা বিশ্বকাপ জিতেই যেতেন। অবশ্য সেটি না করতে পারলেও ম্যারাডোনা সেই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার সেরা খেলোয়াড় এবং টুর্নামেন্টের ৩য় সেরা খেলোয়াড় হন। বিশ্বকাপের অল স্টার একাদশে আর্জেন্টিনা থেকে উনার বাইরে আর মাত্র একজন খেলোয়াড়ই সুযোগ পান, গোলকিপার গোয়াকচিয়া।
এত সব সীমাবদ্ধতা স্বত্বেও বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে ফাইনালে উঠতে পারাটাকেই তাই খুব বড় অর্জন হিসেবে বিবেচিত হয়। ৯০ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন না হয়েও বিশ্বকাপ ও আর্জেন্টিনার ইতিহাসে ম্যারাডোনা তাই আলাদা একটি অবস্থান নিশ্চিত করে রেখেছেন।
Featured Image: ESPN.com