নিজ মাতৃভূমির জন্য ক্রিকেটে অসামান্য অবদান রাখার কারণে ব্রিটিশ রাজা ও রানী কর্তৃক এখন পর্যন্ত ২5 জন নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। যার দরুণ তাদের নামের শুরুতে সম্মান সূচক ‘স্যার’ বসানো হয়। গত শতকে নাইটহুড অ্যাওয়ার্ডের প্রচলন ছিলো। কিন্তু এই শতকে কোনো ক্রিকেটার নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড পাননি। তাছাড়া উপমহাদেশের কোনো ক্রিকেটারকে নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়নি। একমাত্র ভারতীয় হিসাবে নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন ‘স্যার বিজয় আনন্দ’। তখন ভারত পরাধীন ছিলো, এরপর আর কোনো ভারতীয় ক্রিকেটার এই পুরস্কারে পুরস্কৃত হননি। নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড পাওয়া ক্রিকেটারদের তালিকায় ইংল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটারদেরই জয়জয়কার।
১. স্যার ফ্রান্সিস ল্যাচি
ফ্রান্সিস ল্যাচি ১৮৮০ থেকে ১৮৯৭ সাল পর্যন্ত হ্যাম্পশায়ার এবং ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির হয়ে ৫০টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলেছিলেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে গড়পড়তা পারফরমেন্সের কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার সৌভাগ্য হয়নি তার। ৫০টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ৩২.৭৭ ব্যাটিং গড়ে ২,৫৮৯ রান করার পাশাপাশি ৫২ উইকেট শিকার করেছিলেন। ফ্রান্সিস ল্যাচি ক্রিকেট বিশ্বে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন ২৮ বছর ধরে ম্যারিলিবন ক্রিকেট ক্লাবের সেক্রেটারির দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালন করার জন্য। তিনি ১৮৯৮ সাল থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত ম্যারিলিবন ক্রিকেট ক্লাবের সেক্রেটারি পদে বহাল থেকে ক্রিকেটের উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। যার দরুন ১৯২৬ সালে প্রথম ব্যক্তি হিসাবে ক্রিকেটে অসামান্য অবদান রাখায় নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন স্যার ফ্রান্সিস ল্যাচি।
২. স্যার ফ্রেডেরিক টুন
ক্রিকেটে অসামান্য অবদান রাখার জন্য যে ক’জন ব্যক্তি নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে অপরিচিত নাম ফ্রেডেরিক টুন। ফ্রেড টুন কখনও প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটও খেলেননি। নিজে না খেললেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ক্রিকেটকে মাঠে ফিরাতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন টুন। তিনি ইংল্যান্ডের ম্যানেজার হিসাবে ১৯২০-২১, ১৯২৪-২৫ এবং ১৯২৮-২৯ মৌসুমে তিনবার অস্ট্রেলিয়ায় সফলভাবে অ্যাশেজ সিরিজ সম্পূর্ণ করেন। এছাড়া ১৮৯৭-১৯০২ সাল পর্যন্ত লাইচেস্টারশায়ারের সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর বাকি জীবন ইয়র্কশায়ারের সেক্রেটারি হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন তিনি। ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা এবং কমনওয়েলথ ও নিজ জন্মভূমির মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন করার জন্য তাকে ১৯২৯ সালে নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। নাইটেড হওয়ার এক বছর পর ১৯৩০ সালের ১০ই জুন স্যার ফ্রেডেরিক টুন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।
৩. স্যার বিজয় আনন্দ (দ্য রাজকুমার অফ বিজিয়ানাগ্রাম)
প্রথম এবং একমাত্র ভারতীয় ক্রিকেটার হিসাবে এই সম্মাননায় সম্মানিত হন তিনি। ১৯৩৬ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হওয়ার আগে নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড জেতেন বিজয় আনন্দ। নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার ১২দিন পর লর্ডসে ভারতের অধিনায়কের দায়িত্ব সহ টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে বিজয় আনন্দের।
১৯৩০-৩১ মৌসুমে এমসিসির ভারতে সফরে আসার কথা থাকলেও রাজনীতিগত সমস্যার কারণে শেষপর্যন্ত সফরে আসেনি এমসিসি। এরপর বিজয় আনন্দ নিজে একটা দল গড়ে ভারত সফরে আসেন। তিনি তার দলে জ্যাক হবস এবং হারবার্ট সাটক্লাইফের মতো ক্রিকেটারদের আনতে সক্ষম হন। ক্রিকেটার হিসাবে খুব একটা সফলতার মুখ দেখেননি তিনি। মাত্র তিনটি টেস্ট খেলার পরেই তার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ইতি ঘটে। কিন্তু ক্রিকেটের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি।
৪. স্যার পেলহাম ওয়ার্নার
পেলহাম ওয়ার্নার ১৯৩৭ সালে নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড জেতেন। তিনি ইংল্যান্ডের হয়ে ১৫টি টেস্ট ম্যাচে প্রতিনিধিত্ব করেন, যার মধ্যে দশটি ম্যাচে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করে চারটিতে জয় এনে দিয়েছিলেন ইংল্যান্ডকে। পেলহাম ওয়ার্নার তার অভিষেক টেস্ট ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে ১৩২* রানের ইনিংস খেলেন। সেইসাথে প্রথম এবং একমাত্র অভিষেক টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান হিসাবে ওপেনিংয়ে ব্যাট করতে নেমে শেষপর্যন্ত অপরাজিত থাকার কীর্তি গড়েন।
তিনি ১৫টি টেস্টে ২৩.৯২ ব্যাটিং গড়ে ৬২২ রান করেন। এছাড়া ৫২১টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ৬০টি শতক এবং ১৪৯টি অর্ধশতকের সাহায্যে ২৯,০২৮ রান করেন। পেলহাম ওয়ার্নার ১৯৩৭ সালে নাইটেড হওয়ার আগে ১৯০৪ এবং ১৯২১ সালে দু’বার উইজডেন বর্ষসেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন।
৫. স্যার ডোনাল্ড ব্রাডম্যান
প্রথম এবং একমাত্র অস্ট্রেলিয়ান হিসাবে নাইটেড হন সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার ডন ব্রাডম্যান। ক্রিকেটে অসামান্য অবদান রাখার কারণে ব্রাডম্যান ১৯৪৯ সালে নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড জেতেন। ১৯৪৮ সালে তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার পরের বছরেই তিনি নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড জেতেন।
দ্য ডন ৫২টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ২৯টি শতক এবং ১৩টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৯৯.৯৪ ব্যাটিং গড়ে ৫,৯৯৬ রান করেছিলেন। অস্ট্রেলিয়া, নিউ সাউথ ওয়েলস এবং সাউথ অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ২৩৪টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ১১৭টি শতক এবং ৬৯টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৯৫.১৪ ব্যাটিং গড়ে ২৮,০৬৭ রান করেছেন।
৬. স্যার হেনরি লেভেসন গাওয়ার
লেভেসন গাওয়ার ১৯৫৩ নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড জেতেন। ইংল্যান্ডের হয়ে তিনটি টেস্ট ম্যাচ খেলে ২৩.৭৫ ব্যাটিং গড়ে ৯৫ রান করেছিলেন তিনি। সারি এবং অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির হয়ে ২৭৭টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলে ২৩.৭২ ব্যাটিং গড়ে চারটি শতক এবং ৪২টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৭,৬৩৮ রান করেছিলেন। লেভেসন গাওয়ার ১৯০৯ সালে ইংল্যান্ড টেস্ট দলের নির্বাচক ছিলেন। এছাড়া ১৯২৪ সালে নির্বাচকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান ও ১৯২৭ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।
৭. স্যার জ্যাক হবস
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রাহক এবং সবচেয়ে বেশি শতক হাঁকানো ব্যাটসম্যান জ্যাক হবস ১৯৫৩ সালে নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড জেতেন। আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের ৬১টি টেস্ট ম্যাচে ১৫টি শতক এবং ২৮টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫৬.৯৪ ব্যাটিং গড়ে ৫,৪১০ রান করেছিলেন।
জ্যাক হবস তার ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় সারির হয়ে প্রতিনিধিত্ব করে গিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে ৮৩৪টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ১৯৯টি শতক এবং ২৭৩টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫০.৭০ ব্যাটিং গড়ে ৬১,৭৬০ রান করেছিলেন।
৮. স্যার লিওনার্দো হাটন
লিওনার্দো হাটন ক্রিকেটে অসামান্য অবদান রাখার দরুন ১৯৫৬ সালে নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড জেতেন। হাটন ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্ট ক্রিকেট খেলেন। তার ক্যারিয়ারের গুরুত্বপূর্ণ সময় কেড়ে নিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তবুও তিনি তার সময়কার অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন।
১৯৩৮ সালে অস্ট্রেলিয়া বিপক্ষে তার ৩৬৪ রানের ইনিংসটি এখন পর্যন্ত কোনো ইংলিশ ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত টেস্ট ইনিংস। এছাড়া ২০ বছর পর্যন্ত তার ইনিংসটি টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস ছিলো। ঐ বছরেই তিনি উইজডেন বর্ষসেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হয়েছিলেন। লিওনার্দো হাটন ৭৯টি টেস্টে ১৯টি শতক এবং ৩৩টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫৬.৬৭ ব্যাটিং গড়ে ৬,৯৭১ রান করেছিলেন। ইংল্যান্ড এবং ইয়র্কশায়ারের হয়ে ৫১৩টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ১২৯টি শতক এবং ১৭৭টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪০,১৪০ রান করেছিলেন।
৯. স্যার লিরি কনস্টানটাইন
লিরি কনস্টানটাইন ১৯০১ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর ত্রিনিদাদে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২৮ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ১৮টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ৫৬টি উইকেট শিকারের পাশাপাশি চারটি অর্ধশতকের সাহায্যে ১৯.২৪ ব্যাটিং গড়ে ৬৩৫ রান করেছিলেন।
তার প্রথম শ্রেণীর ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিলো ১৯২১-২২ মৌসুমে। তিনি ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত ১১৯টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ৪৩৯ উইকেট শিকারের পাশাপাশি পাঁচটি শতক এবং ২৮টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪,৪৭৫ রান করেছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের অলরাউন্ডার কনস্টানটাইন ক্রিকেটে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৬২ সালে নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড জেতেন।
১০. স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেল
ফ্রাঙ্ক ওরেল ১৯৬৪ সালে নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড জেতেন। তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ৫১টি টেস্ট ম্যাচে নয়টি শতক এবং ২২টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪৯.৪৮ ব্যাটিং গড়ে ৩,৮৬০ রান করেছিলেন। বাঁহাতি মিডিয়াম-ফাস্ট বোলিংয়ে তার ঝুলিতে জমা পড়েছে ৬৯ উইকেট।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ, বার্বাডোজ এবং জ্যামাইকার হয়ে ২০৮টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ৩৯টি শতক এবং ৮০টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫৪.২৪ ব্যাটিং গড়ে ১৫,০২৫ রান করেছিলেন। ইনিংসে ১৩বার পাঁচ উইকেট সহ শিকার করেছেন ৩৪৯ উইকেট।
১১. স্যার নেভিল কার্ডাস
নিজে ক্রিকেটার না হলেও ক্রিকেট আঙ্গিনায় বেশি পরিচিত মুখ নেভিল কার্ডাস। ধারাভাষ্যকার ও সাংবাদিক হবার পাশাপাশি ক্রিকেট নিয়ে বেশকিছু বইও লিখেছেন তিনি। তৎকালীন নামকরা সব ক্রিকেটারের সাথেই তার ভালো সম্পর্ক ছিলো। ক্রিকেটের প্রতি তার ভালোবাসার পুরস্কারস্বরূপ ১৯৬৭ সালে নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড দিয়ে তাকে সম্মানিত করা হয়।
১২. স্যার গ্যারফিল্ড সোবার্স
ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হিসাবে এখনও তার নাম উচ্চারণ করা হয়। তিনি মাত্র ২১ বছর বয়সে ৩৬৫* রানের ইনিংস খেলে টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের নতুন রেকর্ড গড়েছিলেন। গ্যারি সোবার্স ৯৩টি টেস্ট ম্যাচে ২৬টি শতক এবং ৩০টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫৭.৭৮ ব্যাটিং গড়ে ৮,০৩২ রান করেছিলেন। সর্বকালের সেরা এ অলরাউন্ডার তিন পদ্ধতিতে বল ছুঁড়তে পারতেন। তিনি বাঁহাতি ফাস্ট-মিডিয়াম, স্লো। লেফট-আর্ম অর্থোডক্স, স্লো লেফট-আর্ম চায়নাম্যান অ্যাকশনে বল করতে পারতেন। টেস্ট ক্রিকেটে ইনিংসে ছয়বার পাঁচ উইকেট সহ মোট ২৩৫ উইকেট শিকার করেছেন
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটেও গ্যারি সোবার্স ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। ৩৮৩টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ৮৬টি শতক এবং ১২১টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫৪.৮৭ ব্যাটিং গড়ে ২৮,৩১৪ রান সংগ্রহ করেছেন। বল হাতেও তিনি ছিলেন দুর্দান্ত, প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তার উইকেট সংখ্যা ১,০৪৩! ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই তারকা ক্রিকেটার ক্রিকেটে অসামান্য অবদান রাখার কারণে ১৯৭৫ সালে নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড জেতেন।
১৩. স্যার জর্জ অ্যালেন
জর্জ অ্যালেন ১৯০২ সালের ৩১ জুলাই অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে জন্মগ্রহণ করেন। তার বয়স যখন ছয়, তখন অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। ১৯২১ সালে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে এই বোলিং অলরাউন্ডারের। ১৯৩০ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে লর্ডস টেস্টের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অ্যালেনের অভিষেক ঘটে।
১৯৩০ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ২৫টি টেস্ট ম্যাচে ৮১টি উইকেট শিকারের পাশাপাশি, একটি শতক এবং তিনটি অর্ধশতকের সাহায্যে ২৪.১৯ ব্যাটিং গড়ে ৭৫০ রান করেছেন। ইংল্যান্ড, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি এবং কাউন্টি ক্রিকেটে মিডলসেক্সের হয়ে ২৬৫টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ১১টি শতক এবং ৪৭টি অর্ধশতকের সাহায্যে ২৮.৬৭ ব্যাটিং গড়ে ৯,২৩৩ রান করেছিলেন। এছাড়া ইনিংসে ৪৮বার পাঁচ উইকেট এবং ম্যাচে নয়বার দশ উইকেট সহ ৭৮৮টি উইকেট শিকার করেছিলেন তিনি। ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষে জর্জ অ্যালেন ১৯৮৬ সালে ক্রিকেটে অসামান্য অবদান রাখার দরুন নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড জেতেন।
১৪. স্যার রিচার্ড হ্যাডলি
ক্রিকেটে নিউজিল্যান্ডকে পরাশক্তি হিসাবে পরিণত করেন রিচার্ড হ্যাডলি। তিনি একক নৈপুণ্যে নিউজিল্যান্ডকে বহু ম্যাচ জিতিয়েছেন। গত শতকের আশির দশকে সেরা চার অলরাউন্ডারের একজন ছিলেন রিচার্ড হ্যাডলি। তার ঈর্ষণীয় ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ হয় ১৯৯০ সালে। সে বছরেই নিউজিল্যান্ডের একমাত্র ক্রিকেটার হিসাবে নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড জেতেন তিনি, যার ফলে তার নামের শুরুতে সম্মান সূচক ‘স্যার’ পদবী যুক্ত করা হয়।
টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম বোলার হিসাবে চারশো উইকেট শিকার করা রিচার্ড হ্যাডলি তার ৮৬ টেস্টের ক্যারিয়ারে ৪৩১টি উইকেট শিকার করেছিলেন মাত্র ২২.২৯ বোলিং গড়ে। লোয়ার-মিডল অর্ডারে বেশ কার্যকরী ব্যাটসম্যান ছিলেন রিচার্ড হ্যাডলি। দুটি শতক এবং ১৫টি অর্ধশতকের সাহায্যে ২৭.১৬ ব্যাটিং গড়ে ৩,১২৪ রান করেছিলেন। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১১৫ ম্যাচে ২১.৫৬ বোলিং গড়ে ১৫৮টি উইকেট শিকারের পাশাপাশি ২১.৬১ ব্যাটিং গড়ে ১,৭৫১ রান করেছিলেন। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ৩৪২ ম্যাচে ১,৪৯০ উইকেট শিকারের পাশাপাশি ১২,০৫২ রান করেছিলেন। লিস্ট-এ ক্রিকেটেও তিনি সফল ছিলেন। ৩১৭ ম্যাচে ৪৫৪ উইকেট শিকারের পাশাপাশি ৫,২৪১ রান সংগ্রহ করেছিলেন।
১৫. স্যার কলিন কাউড্রি
কলিন কাউড্রি ১৯৩২ সালের ২৪শে ডিসেম্বর, ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ বছর বয়সে ইংল্যান্ডে ফিরে আসলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে সপরিবারে ভারতে চলে আসেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ক্রিকেট খেলার তাগিদে ইংল্যান্ড পাড়ি জমান কলিন কাউড্রি। তার পিতাও ছিলেন একজন ক্রিকেটার।
কলিন কাউড্রি ইংল্যান্ডের হয়ে ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেট খেলেছেন। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম ক্রিকেটার হিসাবে ১০০টি টেস্ট ম্যাচ খেলার কৃতিত্ব তার। কলিন কাউড্রি ১১৪টি টেস্ট ম্যাচে ২২টি শতক এবং ৩৮টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪৪.০৬ ব্যাটিং গড়ে ৭,৬২৪ রান করেছিলেন। তিনি প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ছয়টি টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে শতক হাঁকিয়েছিলেন। ২৬ বছরের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ৬৯২ ম্যাচে ১০৭টি শতক এবং ২৩১টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪২.৮৯ ব্যাটিং গড়ে ৪২,৭১৯ রান করেছিলেন তিনি। অসাধারণ ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষে তিনি ১৯৯২ সালে নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড জেতেন।
১৬. স্যার ক্লাইড ওয়ালকট
বার্বাডোসের এই ব্যাটসম্যান ১৯৯৪ সালে নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড জেতেন। ক্লাইড ওয়ালকট তার সময়কার অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন। সেই সাথে উইকেটরক্ষকের দায়িত্বও পালন করতেন তিনি। ডানহাতি ফাস্ট-মিডিয়াম বল করে শিকার করেছিলেন ১১ উইকেট।
১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ক্লাইড ওয়ালকট ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ৪৪টি টেস্ট ম্যাচে ১৫টি শতক এবং ১৪টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫৬.৬৮ ব্যাটিং গড়ে ৩,৭৯৮ রান করেছিলেন। উইকেটরক্ষক হিসাবে ১১টি স্ট্যাম্পিং করেছেন তিনি, সেই সাথে ৫৩টি ক্যাচও লুফে নিয়েছেন তার ৪৪ টেস্টের ক্যারিয়ারে। ১৪৬টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে শতক হাঁকিয়েছেন ৪০টি! তার বিপরীতে অর্ধশতক ৫৪টি। ৫৬.৫৫ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ১১,৮২০ রান।
১৭. স্যার এভারটন উইকস
থ্রি ডব্লিউজের মধ্যে স্যার ক্লাইড ওয়ালকট এবং স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেল আগেই নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড জিতে নিয়েছিলেন। স্যার এভারটন উইকসও ১৯৯৫ সালে ক্রিকেটে অসামান্য অবদান রাখার জন্য নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড জেতেন।
উইকস ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ৪৪টি টেস্ট ম্যাচে ১৫টি শতক এবং ১৯টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫৮.৬১ ব্যাটিং গড়ে ৪,৪৫৫ রান করেছিলেন। এছাড়া ১৫২টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ৩৬টি শতক এবং ৫৪টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫৫.৩৪ ব্যাটিং গড়ে ১২,০১০ রান করেছিলেন।
১৮. স্যার অ্যালেক বেডসার
অ্যালেক বেডসার ১৯৯৬ সালে নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড জেতেন। তিনি ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৫ সাল ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছিলেন। ৫১টি টেস্টে ২৩৬ উইকেট শিকার করেছিলেন তিনি। এছাড়া ৪৮৫টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে শিকার করেছেন ১,৯২৪ উইকেট।
১৯. স্যার কনরাড হান্ট
স্যার কনরাড হান্ট ১৯৯৭ সালে নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড জেতেন। তিনি তার সময়কার সেরা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে একজন। তিনি ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ৪৪টি টেস্টে আটটি শতক ১৩টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪৫.০৬ ব্যাটিং গড়ে ৩,২৪৫ রান করেছিলেন।
২০. স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস
ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাটসম্যানদের একজন ছিলেন ভিভ রিচার্ডস। হেলমেট ছাড়া তৎকালীন ফাস্ট বোলারদের শট বল অনায়াসে খেলতেন। তিনি ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বোলারদের রীতিমতো শাসন করে গিয়েছেন।
১২১টি টেস্টে ২৪টি শতক এবং ৪৫টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫০.২৩ ব্যাটিং গড়ে ৮,৫৪০ রান করেছিলেন। সেই সময়ের ক্রিকেটে তিনি টেস্ট ম্যাচে ৮৪টি ছয় হাঁকিয়েছিলেন। একদিনের ক্রিকেটে তিনি ছিলেন আরও ভয়ংকর, ইনিংসের শুরু থেকেই বোলারদের বেধড়ক পেটাতেন। ১৮৭টি ওডিআইতে নব্বইয়ের বেশি স্ট্রাইক রেটে ১১টি শতক এবং ৪৫টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৬,৭২১ রান করেছিলেন। সেই সাথে বল হাতে শিকার করেছিলেন ১১৮টি উইকেট। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ৫০৭ ম্যাচে ১১৪টি শতক এবং ১৬২টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪৯.৪০ ব্যাটিং গড়ে ৩৬,২১২ রান করেছিলেন। সেই সাথে ৫০০টি লিস্ট-এ ম্যাচে ২৬টি শতক এবং ১০৯টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪১.৯৬ ব্যাটিং গড়ে ১৬,৯৯৫ রান করেছিলেন। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার শেষে ভিভ রিচার্ডস ১৯৯৯ সালে নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড জেতেন।
২১. স্যার ইয়ান বোথাম
গত শতকের আশির দশকের সেরা চার অলরাউন্ডারেরর মধ্যে কাগজে কলমে কিছুটা এগিয়ে থাকবেন ইয়ান বোথাম। তিনি ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এই ১৫ বছরে ১০২টি টেস্ট ম্যাচে ১৪টি শতক এবং ২২টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৩৩.৫৪ ব্যাটিং গড়ে ৫,২০০ রান করেছিলেন। জেমস অ্যান্ডারসন এবং স্টুয়ার্ট ব্রড তাকে টপকে যাওয়ার আগে ৩৮৩ উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলার ছিলেন তিনি। ১১৬টি ওডিআইতে ২৩.২১ ব্যাটিং গড়ে ২,১২৩ রান এবং ১৪৫ উইকেট শিকার করেছিলেন।
এছাড়া ইংল্যান্ড, ডারহাম, সমারসেট, কুইন্সল্যান্ড এবং ওরচেস্টারশায়ারের হয়ে ৪০২টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ৩৮টি শতক এবং ৯৭টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৩৩.৯৭ ব্যাটিং গড়ে ১৯,৩৯৯ রান সংগ্রহের পাশাপাশি ১,১৭২টি উইকেট শিকার করেছিলেন! লিস্ট-এ ক্রিকেটেও দাপটের সাথেই খেলে গিয়েছিলেন, দশ হাজারের বেশি রানের সাথে উইকেট সংখ্যা ছয় শতাধিক। ক্যারিয়ারে অনেক পুরস্কারের মধ্যে নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড জেতেন ২০০৭ সালে।
২২. স্যার ওয়েসলি হল
ওয়েসলি হল ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ৪৮টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ইনিংসে নয়বার পাঁচ উইকেট এবং ম্যাচে একবার দশ উইকেট সহ ১৯২টি উইকেট শিকার করেছেন। ২০১২ সালে নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড জেতেন তিনি।
২৩. স্যার কার্টলি অ্যামব্রোস
বাংলাদেশের বর্তমান বোলিং কোচ কোর্টনি ওয়ালশের সাথে জুটি বেঁধে গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ব্যাটসম্যানদের নাস্তানাবুদ করতেন কার্টলি অ্যামব্রোস। কোর্টনি ওয়ালশ নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড না জিতলেও অ্যামব্রোস ঠিকই এই অ্যাওয়ার্ড জেতেন। তিনি ২০১৪ সালে নাইটেড হন।
কার্টলি অ্যামব্রোস ৯৮টি টেস্ট ম্যাচে ৪০৫ উইকেট এবং ১৭৬টি ওডিআইতে ২২৫ উইকেট শিকার করেছিলেন।
২৪. স্যার অ্যান্ডি রবার্টস
ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্বর্ণযুগের বোলিং অ্যাটাকের অন্যতম অস্ত্র ছিলেন অ্যান্ডি রবার্টস। অ্যান্ডি রবার্টস ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছিলেন। নয় বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ৪৭টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ইনিংসে ১১বার পাঁচ উইকেট এবং ম্যাচে দু’বার দশ উইকেট শিকার সহ ২০২টি উইকেট শিকার করেন তিনি। এছাড়া ৫৬টি ওডিআইতে শিকার করেছেন ৮৭টি উইকেট। অ্যান্ডি রবার্টস ২০১৪ সালে নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড জেতেন।
২৫. স্যার রিচি রিচার্ডসন
স্যার কার্টলি অ্যামব্রোস এবং স্যার অ্যান্ডি রবার্টসের সাথে একইদিনে ২০১৪ সালে নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড জেতেন স্যার রিচি রিচার্ডসন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। শিবনারায়ণ চন্দরপল যেমন ব্রায়ান লারার ছায়া হয়ে ছিলেন, তেমনি রিচার্ডসনও ভিভ রিচার্ডসের ছায়ায় ছিলেন।
রিচার্ডসন ৮৬টি টেস্ট ম্যাচে ১৬টি শতক এবং ২৭টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪৪.৩৯ ব্যাটিং গড়ে ৫,৯৩৯ রান করেছিলেন। এছাড়া ২২৪টি ওডিআইতে পাঁচটি শতক এবং ৪৪টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৩৩.৪১ ব্যাটিং গড়ে ৬,২৪৮ রান করেছিলেন। বর্তমানে আইসিসির ম্যাচ রেফারির দায়িত্ব পালন করছেন স্যার রিচি।