গতিময় ফুটবলের কাছে কি দিনে দিনে হেরে যাচ্ছে শৈল্পিক ফুটবল?
সাম্প্রতিক সময়ের ক্লাব ফুটবল কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের আসরগুলোর দিকে তাকালে এ প্রশ্নটা মাথায় ঘুরপাক খাবেই। যৌক্তিকতাও আছে বটে। সাম্প্রতিক সময়ে ফুটবলের ঘরোয়া কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের আসরগুলোতে ছড়ি ঘোরাচ্ছে ইউরোপীয় দলগুলো, বিপরীতে লাতিন আমেরিকান দলগুলো ক্লাব ফুটবলের বৈশ্বিক আসরগুলোতে যেমন সুবিধা করতে পারছে না একেবারেই, পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আসরগুলোতেও হাতেগোনা কয়েকটি দল ছাড়া বাকি দলগুলো যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারছে না। তবে এটাও ভুলে গেলে চলবে না, এই দক্ষিণ আমেরিকার শৈল্পিক ফুটবলই একটা সময় নতুন মাত্রা যোগ করেছে বিশ্ব ফুটবলে।
দক্ষিণ আমেরিকায় ফুটবলের পরিচিতি ঘটে উনিশ শতকের দিকে। আর্জেন্টিনার বুয়েনোস এইরিসে কতিপয় ইউরোপিয়ানের হাত ধরে ফুটবলের যাত্রা শুরু হয় ল্যাটিন আমেরিকায়। সেখানকার প্রথম ফুটবল ক্লাব ‘বুয়েনোস এইরিস ফুটবল ক্লাব’ও তৈরি হয় ইউরোপিয়ানদের মাধ্যমে – ১৮৬৭ সালে। তারপর থেকে একে একে রিভারপ্লেট, বোকা জুনিয়র্সের মতো ক্লাবগুলো গড়ে উঠতে থাকে। ১৮৯৩ সালে আর্জেন্টিনায় আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথমবার কোনো ঘরোয়া আসর অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ম্যারাডোনা-প্যাসারেলাদের থেকে শুরু করে মাশ্চেরানো-তেভেজ কিংবা মেসিদের মতো কিংবদন্তিদের দেখা মিলেছে এখানেই। আর বর্তমানে দিবালা-মার্টিনেজ-রোমেরোদের মতো ফুটবলাররা প্রতিভার ঝলক দেখিয়ে প্রতিনিধিত্ব করে যাচ্ছেন আলবিসেলেস্তেদের।
আর্জেন্টিনায় ফুটবল পরিচিতি পাওয়ার কয়েক দশকের মধ্যে ব্রাজিলেও শুরু হয় ফুটবলের প্রচলন। অনুমান করা হয়, ল্যাটিন আমেরিকানদের মধ্যে ব্রাজিলই দ্বিতীয় দেশ, যেখানে ফুটবলের প্রচলন হয়। ১৮৯৪ সালে চার্লস মিলার নামক এক ইংলিশ ফুটবলার সাও পাওলোতে ফুটবল খেলার পরিচিতি ঘটান। এরপর থেকে সময়ের ব্যবধানে সেলেকাওদের রক্তের সাথে মিশে গেছে এই ফুটবল। ব্রাজিলে শৈশবেই বিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি ব্যায়ামাগারগুলোতেও ফুটবলের দীক্ষা দেওয়া হয়। তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ফুটবল। আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারগুলোর একটা বড় অংশ ক্যারিয়ার গঠনে ফুটবলকেই পেশা হিসেবে বেছে নেয়। বর্তমানে ১৬ হাজারেরও বেশি ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার সারা বিশ্বে খেলে যাচ্ছেন।
বিভিন্ন প্রজন্মে ব্রাজিলে মিলেছে অসংখ্য কিংবদন্তির দেখা। বৈশ্বিকভাবে ফুটবলের পরিচিতি ও জনপ্রিয়তার বৃদ্ধির প্রথম দিকে পেলে-গারিঞ্চাদের মতো কিংবদন্তিদের উত্থান হয়েছিল এখানে। পরবর্তীতে রোমারিও-রোনালদো-কার্লোসের মতো তারকাদের দেখাও পেয়েছিল ফুটবল বিশ্ব। ’৯৫ সালের পর থেকে রোনালদিনহো-কাকার মতো প্রতিভাধর ফুটবলারদের ফুটবলশৈলী সেলেকাওদের বিশ্ব ফুটবলে এনে দেয় নতুন পরিচিতি। নান্দনিক ফুটবলের প্রদর্শনীতে বিশ্ব মাতাতেন এই কিংবদন্তিরা। আর সেই ব্যাটন এখন ধরে রেখেছেন হালের নেইমার-ক্যাসেমিরো-অ্যালিসনের মতো তারকারা। প্রতিভাবান ফুটবলারদের এমন আঁতুড়ঘর শুধুমাত্র দক্ষিণ আমেরিকা নয়, পুরো বিশ্বেই বিরল। এখনও পর্যন্ত সর্বাধিক বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ড তারই প্রমাণ দেয়।
ফুটবলের এই বিস্তৃতি ধীরে ধীরে কলম্বিয়া, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ের মতো দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য দেশগুলোতেও ছড়াতে থাকে। এক পর্যায়ে দেশগুলো ঘরোয়া ফুটবলের গণ্ডি পেরিয়ে মহাদেশীয় টুর্নামেন্ট আয়োজন করা শুরু করে। ১৯১৬ সালে দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশগুলো মিলে ফুটবল ইতিহাসে প্রথমবার কোনো মহাদেশীয় টুর্নামেন্টের আয়োজন করে, যা বর্তমানে ‘কোপা আমেরিকা’ নামে পরিচিত। এছাড়াও ১৯৬০ সাল থেকে দেশগুলোর ঘরোয়া লিগের দলগুলোকে নিয়ে প্রতি বছর ‘লিবার্তাদোরেস কাপ’ অনুষ্ঠিত হয়।
ইউরোপে ফুটবলের ঘরোয়া আসরগুলোর শুরু হয়েছিল ইংলিশ আর স্কটিশদের হাত ধরে। পরবর্তীতে বেশ কিছু স্কটিশ পেশাদার ফুটবলারের আগমন ঘটে ইংলিশদের ঘরোয়া ফুটবলে, যাদের মাধ্যমে নতুন ধারার ফুটবলের সাথে পরিচিতি ঘটে ইংলিশদের। এই স্কটিশদের পাসিং ও বল-প্লেয়িংয়ের নতুন নতুন দক্ষতা ইংল্যান্ডের ফুটবলে এনে দিয়েছিল নতুন মাত্রা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত ঘরোয়া ফুটবলের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ইংলিশরা।
ফুটবলের বিস্তৃতি এই যুক্তরাজ্যের গণ্ডি পেরিয়ে খুব দ্রুত বাড়তে থাকে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে। এক পর্যায়ে ইতালি, হাঙ্গেরি, সুইজারল্যান্ডের মতো দলগুলো ইংলিশদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে ইতালিয়ানরা দক্ষিণ আমেরিকা থেকে রাইমুন্ডো ওরসি, এনরিক গুয়াইতার মতো প্রতিভাবান ফুটবলারদের জাতীয় দলে ভিড়িয়ে ফুটবলবিশ্বে আধিপত্য দেখাতে শুরু করে।
‘৬০-এর দশকে ঘরোয়া ফুটবলে ওয়েলশ ফুটবলার জন চার্লসের মতো অনেক বিদেশি শীর্ষস্থানীয় ফুটবলারদের ঘরোয়া লিগের দলগুলোতে অন্তর্ভুক্তির দিক দিয়ে উপরের দিকে ছিল আজ্জুরিরা। আর এভাবে নিজেদের অবস্থান ধীরে ধীরে উপরের দিকে নিয়ে যেতে থাকে তাঁরা।
আবার এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইংলিশ ফুটবল দল খ্যাতির চূড়ান্তে থাকলেও ধীরে ধীরে তাদের আধিপত্যে কিছুটা ভাটা পড়ে। ১৯৫০ সালে প্রথমবারের মতো ফুটবল বিশ্বকাপে খেলে তারা। গ্রুপ পর্বের একটি ম্যাচে তারা পরাজিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে, সেসময় ইংলিশ দলটির খ্যাতির তুলনায় সেই পরাজয় ছিল অবিশ্বাস্য। তার তিন বছর পর হাঙ্গেরির কাছে ৬-৩ এবং পরের বছর একই দলের কাছে ৭-১ ব্যবধানে হারে ইংল্যান্ড। তারপর থেকে কৌশলগত বিষয়গুলো নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ শুরু করে তারা। মূলত এই সময় থেকেই ফুটবলে ডায়নামিক অ্যাটাকিংকে ট্যাকটিকস হিসেবে গ্রহণ করা শুরু করে ইংলিশরা।
ঘরোয়া ফুটবলে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি খেলার ধরনের বৈচিত্র্য ইউরোপিয়ান দলগুলোকে সাম্প্রতিক সময়ে এনে দিচ্ছে একের পর এক সাফল্য। এক্ষেত্রে টিকিটাকা কিংবা পজেশন ফুটবলের পুরনো প্রথা ভেঙে কাউন্টার অ্যাটাকিং আর গতিময় ফুটবলকে প্রধান রণকৌশল হিসেবে গ্রহণ করছে ইউরোপের দলগুলো। আর এর সুফলও ভালোই পাচ্ছে তারা। বেলজিয়াম, জার্মানি, ফ্রান্সের মতো দলগুলো এই ট্যাকটিকসের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে ধরাশয়ী করে যাচ্ছে প্রতিপক্ষ দলগুলোকে। আর এই বিচিত্রধর্মী ফুটবলই হয়ে উঠেছে দর্শকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
সাম্প্রতিক সময়ে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, স্প্যানিশ লা লিগা, ফরাসি লিগ ওয়ান কিংবা জার্মানির ঘরোয়া আসর বুন্দেসলিগার মতো আসরগুলো নিয়ে ফুটবলভক্তদের মাতামাতির শেষ নেই। মূলত আসরগুলোর প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলই এই আকর্ষণ বাড়িয়েছে।
ইংলিশ লিগের কথাই ধরা যাক। এ আসরের বিগত দশ মৌসুমে আটবার হাত বদল হয়েছে শিরোপার। গত দশ মৌসুমে ম্যানসিটি, লিভারপুল, ম্যানইউ ও চেলসির মতো বড় দলগুলোর পাশাপাশি শিরোপার স্বাদ পেয়েছে লেস্টার সিটির মতো তুলনামূলক ‘অখ্যাত’ দলও।
ইউরোপীয় দলগুলোর মধ্যকার এ প্রতিযোগিতা দক্ষিণ আমেরিকায় খুব একটা দেখা যায় না। এখানে হাতেগোনা কয়েকটি দল ছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো দল তেমন নেই বললেই চলে। মহাদেশীয় টুর্নামেন্টগুলোর দিকে তাকালে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইউরোপে যেখানে সুইডেন বা ডেনমার্কের মতো মাঝারি মানের দলগুলো ফ্রান্স-জার্মানির মতো পরাশক্তিদের প্রায়ই চোখে চোখ রেখে লড়াই করে যাচ্ছে, সেখানে পেরু-ইকুয়েডরের মতো দলগুলোকে হরহামেশাই ধরাশায়ী করছে সেলেকাও-আলবিসেলেস্তেরা।
দুই মহাদেশের মধ্যকার এ ব্যবধান আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে বিশ্ব আসরগুলোতে। বিগত ১৫ বছর ধরে বিশ্বকাপে শিরোপা জয়ের মাধ্যমে যেখানে নিজেদের আধিপত্য ধরে রেখেছে ইউরোপের দলগুলো, সেখানে একবারও শিরোপার দেখা পায়নি লাতিন আমেরিকানরা। শেষ পাঁচটি বিশ্বকাপের দিকে তাকালে দেখা যায়, চারটিরই শিরোপা উঠেছে ইউরোপের ঘরে, অন্যটি লাতিন আমেরিকানদের ঘরে উঠেছিল – তাও উনিশ বছর আগে।
এসবের প্রেক্ষিতে শুরুর প্রশ্নটা আবার মাথাচাড়া দেয়, ইউরোপীয় ফুটবলের কাছে কি ধীরে ধীরে হেরে যাচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকার নান্দনিক ফুটবল?