পৃথ্বী শ’ শুরুটাই করেছিলেন সেই ১৪ বছর বয়সে ‘নতুন টেন্ডুলকার’ উপাধি পেয়ে। এরপর থেকে এই ১৮ বছর বয়স অবধি তার শরীরে লেগেছিলো এই তকমা। অভিষেকে সেঞ্চুরি করে টেন্ডুলকারের সাথে তুলনাটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন।
শিশু ক্রিকেটার হিসেবে টেন্ডুলকারের সান্নিধ্য পেয়েছেন অনেকবার। সেই ৮ বছর বয়সে টেন্ডুলকার প্রথম দেখেছিলেন পৃথ্বীকে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে এখনকার পৃথ্বীর মূল্যায়ন করেছেন শচীন টেন্ডুলকার। ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এই তরুণকে নিয়ে কথা বলেছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা সাবেক ক্রিকেটার।
অনেক খেলোয়াড়ই তাদের ক্যারিয়ার দারুণ হৈ চৈ নিয়ে শুরু করেন। কিন্তু তাদের সবার তো পৃথ্বীর মতো শুরুটা হয় না।
আমি নিশ্চিত, এটা ওর জন্য খুবই স্বস্তির ব্যাপার হয়েছে যে, ও প্রথমবার মাঠে নেমেই একটা বড় স্কোর করতে পেরেছে। ঘরোয়া স্তরে যেসব ছেলেরা খুব ভালো করে, তাদের নিয়ে সবসময় একটা প্রশ্নচিহ্ন থাকে যে, তারা কি আন্তর্জাতিক স্তরেও একইরকম সাফল্য পাবে? সে যতই প্রতিভাবান হোক না কেন, এই প্রশ্নচিহ্নটা থাকেই। আর একটা সেঞ্চুরি এই ধরণের প্রশ্ন অনেকটাই বন্ধ করে দেয়। এই সংখ্যাটা (সেঞ্চুরি) জাদুর মতো। এতে সবাই ভিন্নভাবে ভাবতে শুরু করে। আমি যতদূর বুঝি, ওর প্রথম যে বাধাটা পার করতে হতো, সেটা এখন অনেকটাই দূরে সরে গেছে। এতে দলে ওর জায়গাটা পাকা হয়েছে। আর সে ঘোষণা করতে পেরেছে যে, সে এখানে থাকার যোগ্য।
পৃথ্বীর সম্পর্কে আপনার মূল্যায়নটা কী?
আমি ওকে যতটুকু দেখেছি, তাতে ও খুব দ্রুত শিখতে পারে। আমার কাছে প্রতিভাবান হওয়া একটা ভিন্ন কথা। আর সেই প্রতিভা দিয়ে আপনি আসলে কতটুকু করার চেষ্টা করছেন, সেটাই আসল কথা। আপনি যদি আন্তর্জাতিক স্তরে সফল হতে চান, তাহলে আপনার দ্রুত শেখার ক্ষমতা থাকতে হবে। যখন কেউ এই স্তরে পারফর্ম করতে চায়, টিকে থাকতে চায় এবং পৃথিবীর বিভিন্ন মাঠে ও কন্ডিশনে লম্বা সময় ধরে সফল হতে চায়, তার জন্য মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাটা খুব জরুরী একটা ব্যাপার। আমি মনে করি, তার ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি ও কন্ডিশনে মানিয়ে নেওয়ার একটা আগ্রহ আছে। আর আমার কাছে এটাই পৃথ্বীর সবচেয়ে শক্তির জায়গা।
এটা কি সত্যি যে মুম্বাইয়ের বাচ্চারা অনেক বেশি খেলার সুযোগ পায় বলেই তাদের উচ্চতর স্তরে এসে বড় ইনিংস খেলার সম্ভাবনা বেশি থাকে?
আপনি যত বেশি ম্যাচ খেলবেন, ততই ভালো। অন্য আরেকদিন আমি ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র একটা আয়োজনে (টাইমস শিল্ড টুর্নামেন্ট) বলেছিলাম, মুম্বাই সামনের দিনগুলোতে আরও অনেক রঞ্জী ট্রফি জিতবে। এর কৃতিত্ব ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ আয়োজিত টাইমস শিল্ডকে দিতে হবে। কারণ এই টাইমস শিল্ডেই সারা দুনিয়া থেকে সেরা ক্রিকেটাররা এসে অংশ নিচ্ছে। এটা ক্রিকেটারদের পাশাপাশি মুম্বাই ক্রিকেটেরও উপকার করছে, কারণ খেলার সামগ্রিক মান এতে বাড়ছে এবং স্থানীয় খেলোয়াড়েরা দারুণ উপকৃত হচ্ছে। এই ঐতিহ্যটা ধরে রাখা দরকার।
পৃথ্বী তার ব্যাকফুটে খেলা নিয়ে একটা সময় চিন্তিত ছিলেন। তিনি আপনার সাথে কথা বলেছিলেন। তিনি কি বেশি চিন্তিত ছিলেন?
সে বেশ কিছুদিন আগে আমার সাথে এটা নিয়ে আলাপ করেছিলো। আমি ওকে যেটা জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তোমার কি এতে কোনো অস্বস্তি হচ্ছে?’ ও উত্তর দিয়েছিলো, ‘না’। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বোলাররা কি এ নিয়ে অস্বস্তিতে আছে? স্কোরবোর্ড কি তোমার পক্ষে কথা বলছে না? যদি এসব সমস্যা না-ই হয়, তাহলে বিনা প্রয়োজনে তুমি কিছু বদলাবে কেন? কোনো কিছু যখন ভেঙে পড়েনি, জোর করে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করো না। তুমি যদি মানিয়ে নিতে পারো, তাহলে সেটাই ভালো। সময়ের সাথে সাথে তোমার অভিজ্ঞতা তোমার খেলায় অনেক পরিবর্তন আনবে। আর তোমাকে সেই স্রোতের সঙ্গেই চলতে হবে।
ক্রিকেটারদের ক্যারিয়ার যত এগোতে থাকে, পরিবর্তন আসতে থাকে। আমরা দেখেছি, আপনি আপনার নিজের খেলায় অনেক পরিবর্তন এনেছিলেন। আর সেটার সাথে নিজেকে মানিয়েও নিয়েছিলেন।
এই স্তরে ও যত বেশি ক্রিকেট খেলবে, তত পরিবর্তন আসতে থাকবে। এটা অনিবার্য। কিন্তু তার আগ অবধি নিজেই নিজের ভুল খুঁজে বের করার দরকার নেই। তার যা যা পরিবর্তন দরকার, সেটা সময়ের সাথে সাথে হবে। কিন্তু এখন অবধি সবকিছু ঠিক আছে। ফলে সমস্যা খুঁজে বেড়ানোর তো দরকার নেই।
আপনি সম্প্রতি নাকি পৃথ্বীকে বলেছেন যে, ‘কেউ তোমার ব্যাটিং গ্রিপ পরিবর্তন করতে চাইলে তুমি সেই লোককে আমার সাথে কথা বলতে বলবে’?
ওর সাথে আমার এরকম কথা হচ্ছিলো। আমি ওকে যেটা বললাম, ‘যতক্ষণ না অবধি কোনো কিছু নিয়ে সমস্যায় পড়ছ, ততক্ষণ কোনো কিছু পরিবর্তন করো না।’ তুমি যদি নিয়মিত কোনো একটা নির্দিষ্ট কারণে আউট হতে থাকো, তাহলেই কেবল সেই সমস্যা নিয়ে ভাবতে পারো।
পৃথ্বীকে নিয়ে আপনার একেবারে প্রথম স্মৃতি কী? ওকে প্রথমে কি ব্যাট করতে দেখেছিলেন?
হ্যা। সেটা বছর দশেক আগের কথা। জগদীশ চাভান নামে আমার এক বন্ধু একদিন পৃথ্বীকে দেখতে বলেছিলো। ও জানায়, ‘একটা ছেলে তোমার সাথে দেখা করতে চায়। তুমি যদি ছেলেটাকে একবার দেখো, খুব ভালো হয়।’ তখন ও খুব ছোট। পৃথ্বী তার খেলার কিছু বিষয় নিয়ে আমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলো। একদিন দেখা হয় পৃথ্বীর সঙ্গে। প্রথম দর্শনেই জগদীশকে বলেছিলাম, এই ছেলে একদিন ভারতের হয়ে খেলবে। আমার এখনো মনে আছে ওকে (জগদীশকে) সেদিন বলেছিলাম, ‘তুমি ভবিষ্যৎ একজন ভারতীয় ক্রিকেটারকে দেখছো।’ ও আমাকে বলেছিলো, ‘তুমি নিশ্চিত?’ আমি বলেছিলাম, ‘আমার কথা মনে রেখো, এই ছেলে ভারতের হয়ে খেলবে।’ পৃথ্বীকে প্রথম দেখাতেই আমার এই কথাটা মনে হয়েছিলো।
আপনি ওর মধ্যে বিশেষ কী দেখেছিলেন?
স্রেফ মৌলিক ব্যাপারগুলো। যেভাবে সে ওই বয়সে বলের সঙ্গে চোখের সমন্বয় করছিলো, সেটা সত্যি অসাধারণ। লাইন-লেংথ ধরতে পারে দারুণভাবে। ওই বয়সে ব্যাটিংয়ে কেউ শক্তি প্রয়োগ করতে পারে না, বয়সের সঙ্গে চলে আসে। কিন্তু টেকনিক ক’জনের ঠিক থাকে? তখনই বলেছিলাম, পৃথ্বী প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এক প্রতিভা। ও ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য একটা বিশেষ উপহার। আমার মনে হয়েছিলো, সবার ভেতর এই গুণ থাকে না, যা ওর মধ্যে আছে।
এখন সে যখন শুধু ভারতের হয়ে খেললোই না, অভিষেকে সেঞ্চুরিও করলো, এটা নিশ্চয়ই আপনার কাছে বিশেষ কিছু মনে হয়েছে?
বাস্তব ব্যাপার হলো, জগদীশ আমাকে আজ (বৃহস্পতিবার) বিকেলে কল করেছিলো। বললো, ‘এটা এত বিশেষ একটা উপলক্ষ যে, টেক্সট করলে হতো না। কল করতে হতো।’ এর কারণ হলো, আমি পৃথ্বীকে নিয়ে জগদীশের সাথে কিছু কথা বলেছিলাম, যেগুলো সব সত্যি হয়েছে।
আপনার নিজের খুব কম বয়সে অভিষেক হয়েছিলো এবং আপনি লম্বা সময়ের জন্য শুরু করেছিলেন। এই লম্বা সময় টিকে থাকার মূল ব্যাপারটা কী ছিল?
এটার মূল ব্যাপার ছিল মানিয়ে নিতে পারা ও খাপ খাওয়ানো। আপনি যদি সময়ে সময়ে নিজের খেলাকে নতুন পরিস্থিতির সাথে একটু মানিয়ে নিতে পারেন, তাহলে লম্বা সময় টিকবেন। এই স্তরে সঠিক ব্যাটিং করাটাই সবসময় শেষ কথা নয়। এখানে মূল ব্যাপারটা হলো সবসময় নতুন পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে পারা ও খাপ খাওয়ানো। আপনি যদি ধারাবাহিকভাবে এটা করতে পারেন, তাহলে অন্য সব সমস্যাও দূর হয়ে যাবে। স্মার্টনেসটাই এখানে মূল ব্যাপার। এই সবকিছু মিলিয়েই হয় আরকি।
পৃথ্বী কেবল শুরু করলেন, বয়স মাত্র ১৮। এই বয়সী একজন খেলোয়াড়কে ১৫-১৮ বছর আরও চালিয়ে যেতে হলে কী ভাবা উচিত?
স্রেফ স্রোতের সাথে চলা। খুব বেশি হিসাব বা চিন্তা করা যাবে না, নিজের ক্রিকেটটা উপভোগ করতে হবে। প্রতিবার মাঠে নামাটাই বিশেষ কিছু, সেটাই যেন অনেক গর্বের একটা ব্যাপার হয়। আমার জন্য এটাই ব্যাপার ছিল। আমি মাঠে নামার সময়, সেটা ভারত হোক বা মুম্বাইয়ের হয়ে, অনেক গর্ব নিয়ে মাঠে নামতাম। স্রেফ এই খেলাটাকে যতটা সম্ভব শ্রদ্ধা করাটাই ব্যাপার।
Featured Image Credit : Associated Press