বছর ঘুরে যখন গ্রীষ্ম আসে, ইংল্যান্ডের আকাশজুড়ে নামে নীলচে রঙের চাদর। হেসে উঠে প্রকৃতি। ডালে ডালে ফুল ফোটে, গাছে গাছে সবুজ রঙের মেলা। নরম মোলায়েম কার্পেটের মতো ঘন সবুজ ঘাসে দেবে যায় পা। কমে আসে শীতের প্রকোপ। উপভোগ্য উষ্মাগম। আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায় প্রাণে প্রাণে, গানে গানে মুখর হয়ে উঠে জনপদ। সেই আনন্দময় জনপদ আরো রঙিন, আরো বর্ণিল হয় ক্রিকেট বসন্তের আয়োজনে ধন্য হলে।
বর্ণে-গন্ধে-রঙে-বৈচিত্র্যে-রূপ-রস-মাধুর্যে ভরপুর আয়োজন। কালো-সাদা-বাদামী, নানান বর্ণের মানুষ। নানান ভাষার নানান অঞ্চলের মানুষজন ক্রিকেটের সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আয়োজনে অংশ নিতে উপস্থিত। সময়টা চমৎকার। মাঝে মাঝে বৃষ্টি নামে, মিঠা রোদ, হিমেল হাওয়া। ছুটি কাটানোর জন্য অতি উত্তম। ব্যাগ কাঁধে স্বদেশ সমর্থনে অনেকেই হাজির। গলা ফাটানো হবে প্রিয় দলের জন্য, প্রিয় ক্রিকেটারের জন্য হবে চিৎকার। কত পুরনো মানুষজন, ক্রিকেট থেকে অবসরে গেছেন যারা, আমন্ত্রিত সেরকম মানুষও। ক্রিকেট কাননের নানান ফুল বহু-রঙা হয়ে ফোটে। মেলে পাপড়ি, ছড়ায় সুবাস, কাড়ে মনোযোগ।
ক্রিকেটের সবচেয়ে পুরাতন ও বনেদী ক্রিকেট মওসুম—ইংলিশ গ্রীষ্ম; বিশ্ব আসরের আয়োজক। তারও আগে চারবার ক্রিকেট বসন্তের আসর বসেছে, তখনো রঙে রঙে রঙিন হয়েছে মনোরম বিলেতি গ্রীষ্ম। তবে এবার বিশ্বকাপ ফিরেছে কুড়ি বছর বাদে। সাদরে বরণ করতে প্রস্তুতির কমতি নেই আয়োজকদের। বিশ্বকাপের পরপরই সবচেয়ে পুরনো ও ঝাঁঝালো প্রতিদ্বন্দ্বিতার অ্যাশেজ। ইংলিশ গ্রীষ্মে ক্রিকেট বসন্তের ভরা জোয়ার। সেই জোয়ারের উচ্ছ্বাসে ও আনন্দে ভাসার আমন্ত্রণ জানিয়ে নিমন্ত্রণ পত্র বিলাতে ব্যস্ত ইংলিশ ক্রিকেট; আর আমন্ত্রিত অতিথির সমাগম অপেক্ষায় হাজার বছরের পুরনো বিলেতি গ্রীষ্ম।
১.
বিলেতি গ্রীষ্মের রকমসকম আলাদা। ব্যাটসম্যানশিপের জন্য চূড়ান্ত পরীক্ষা যেমন নেবে, বোলারদেরও রাখতে হবে দক্ষতার সর্বোত্তম প্রমাণ। তুমি যদি গড়পড়তা হও, সাধারণ হও, তবে ‘ফ্লুক’ একবার হতে পারে, কিন্তু পরেরবার রক্ষে নেই তোমার। বোলার হলে ব্যাটসম্যানরা পিটিয়ে ছাল তুলে নেবে তোমার। আর যদি ব্যাটসম্যান হও, বোলাররা তোমাকে ‘নবীশ’ বানিয়ে ছাড়বে। প্রতিভাদের এখানে বরণ করা হয় সাদরে, দেয়া হয় সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান। আর ব্যর্থতার জন্য রয়েছে সমালোচনার খাপখোলা তলোয়ার, একদম ফালা ফালা করে তা।
শতবর্ষী এই বনেদী গ্রীষ্ম কতশত প্রতিভায় ধন্য হয়েছে কত কতবার! এক গ্রীষ্মে ব্র্যাডম্যান নামক ফুলের রঙ-রূপ-সৌরভ এমনই ছড়ালো যে, ইংলিশ ক্রিকেট বাধ্য হলো পরেরবার হ্যারল্ড লারউড এবং উইলিয়াম ভোস নামের দুই দৈত্যকায় মানব লেলিয়ে দিয়ে ‘বডিলাইন’ আক্রমণ দিয়ে অ্যাশেজ পুনরোদ্ধার অভিযানে যেতে। অথবা তারও আগে, যখন স্পফোর্থ গুড়িয়ে দিলেন ইংলিশ ক্রিকেট। লেখা হলো সেই অমর বিষাদগাঁথা।
মৃত্যু হয়েছে ইংলিশ ক্রিকেটের। শবটা দাহ করে ‘ছাই’ নেয়া হবে অস্ট্রেলিয়ায়।
এক গ্রীষ্মে আল্ফ ভ্যালেন্টাইন ও সনি রামাধিন লিখলেন কালো মানুষদের বিজয়ের মহাকাব্য। লর্ডসের সবুজ বুকে ঠাঁটবাট ধরে রাখা টাই-কোট পরা সাহেবদের সামনেই উন্মত্ত উল্লাস প্রকাশ করলো ক্যারিবীয় ক্রিকেট অনুরাগীরা। জিম লেকার ১৯/৯০ এর অবিশ্বাস্য ফিগারের মালিক হলেন এক গ্রীষ্মে, বোথামের কাঁধে চড়ে ইংল্যান্ডের হেডিংলি রূপকথা হলো একবার। উইন্ডিজ ক্রিকেটের সম্রাট ক্লাইভ লয়েড ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলেন, উঁচিয়ে ধরলেন বিশ্বজয়ের ট্রফি; একবার নয়, পরপর দুইবার। কপিল দেবের ভারত সবাইকে অবাক করে লিখলো অনিন্দ্য সুন্দর অনিশ্চয়তার মহাগৌরবময় ইতিহাস। লর্ডসের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দু’হাতে তুলে ধরলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ হওয়ার প্রমাণ।
পাকিস্তানের দুই ‘ডব্লিউ’র অবাক রূপকথা রচিত হলো, বিশ্ব দেখলো রিভার্স সুইং শিল্পের সুনিপুণ ব্যবহার। শেন ওয়ার্ন নামের এক ম্যাজিশিয়ান করলেন শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম বল। অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা জন্ম দিলো ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একদিনের ম্যাচ, স্টিভ ওয়াহ’র পাথুরে মুখে হাসি, অস্ট্রেলিয়ার গলায় বিজয়মাল্য। ১৮ বছর পর ইংল্যান্ডের অ্যাশেজ পুনরোদ্ধার, ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিরিজ, ‘ক্ল্যাসিক’ মর্যাদা নিশ্চিত হয়ে গেছে যেটির। এক বঙ্গসন্তান বলেকয়ে লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম তুললেন একবার, পরপর দাপুটে দুই সেঞ্চুরিতে গ্রীষ্মটা করে নিলেন নিজের। ইতিহাসের দু’হাজারতম টেস্ট আয়োজিত হলো… কতশত কীর্তি ও গৌরব বুকে নিয়ে ফিরে ফিরে আসে ইংলিশ গ্রীষ্ম!
ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে আবেদনময়, শ্রেষ্ঠ ও উপভোগ্য ক্রিকেট মৌসুম।
২.
পঞ্চমবারের মতো বিশ্ব আসরের আয়োজক ইংল্যান্ড। ক্রিকেট বিশ্বকাপের যেন আঁতুড়ঘরে ফেরা। আফ্রিকা-উইন্ডিজ-এশিয়া-অস্ট্রেলিয়া হয়ে বিশ্বকাপ ফেরা ইউরোপে, ইংল্যান্ডে। শুরুর আগেই বিবর্ণ বিশ্ব-আয়োজন, ১০ দলের ‘তামাশাপূর্ণ’ বিশ্বকাপ! আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড সুবাস পায় বিশ্বকাপের, অথচ উপস্থিতি নেই। যেন বিরিয়ানি আয়োজন চলছে, বিশাল খানাপিনার ব্যবস্থা, দূর-দূরান্তের বহু লোক দাওয়াত পেয়েছে, কিন্তু প্রতিবেশীকেই বলা হয়নি! দুঃখজনক। আইরিশ ক্রিকেটের হাহাকার, স্কটিশ ক্রিকেটের দীর্ঘশ্বাস, ডাচ ক্রিকেটের ফোঁস ফোঁস বা হিসহিস কান পাতলেই বুঝি শোনা যাবে।
তবে মাঠের ক্রিকেটে শুরুর ঝিমুনি কেটে যায় দ্রুতই, বাংলাদেশ ক্রিকেট জানান দেয়, শুধু অংশ নিতেই আসিনি এবার — পরাভূত দক্ষিণ আফ্রিকা! ‘অননুমেয়’ পাকিস্তানের ‘অননুমেয়’ চিত্রনাট্যে তছনছ ইংল্যান্ডের সাজানো সংসার। অস্ট্রেলিয়ার দাপট ও শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার মিশনে শুভ সূচনা, ভারতের দেরিতে শুরু হলেও কক্ষপথ ঠিকঠাক। নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেট নিশ্চিন্ত, একজন ক্ষুরধার মস্তিষ্কের মালিক আছেন কাণ্ডারি হিসেবে।
সময়ের সাথে প্রকট দক্ষিণ আফ্রিকার ছন্নছাড়া ও বেহাল অবস্থা। শ্রীলংকা ক্রিকেটের আচমকা সিংহের হুঙ্কার। আফগান ক্রিকেটের রূপকথা হতে হতেও হয় না। বাংলাদেশ ক্রিকেটে ‘কী একটা মিসিং’ যেন! পাকিস্তান ক্রিকেট ‘৯২ বিশ্বকাপের পুনরাবৃত্তির চেষ্টায় যেন ব্যস্ত। উইন্ডিজ ক্রিকেট এই ওড়ে, এই নামে, বোঝা যায় না।
লড়াইটা শেষ পর্যন্ত প্রথম চারেরই রয়ে যায়। গৌরবময় অনিশ্চয়তার সৌন্দর্য্য পেখম মেলতে মেলতেও গুটিয়ে নেয় আবার। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউ জিল্যান্ড ও ভারত। সময়ের সেরা চার ক্রিকেট শক্তিই শ্রেষ্ঠত্বের শেষ দুই লড়াইয়ের যোগ্য বিবেচিত। নানান প্রশ্ন ও নতুন করে শুরুর প্রত্যাশা সঙ্গী করে ঘরে ফিরে বাকি ছয় দল।
৩.
নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটে ভাগ্যের অবারিত ছোঁয়া কেন? নাকি ভাগ্য সাহসী ও দক্ষদের সঙ্গেই যায়? মুশফিকুর রহিম যদি আগ বাড়িয়ে স্ট্যাম্প না ভাঙতেন, ম্যাচটা কি জেতে নিউ জিল্যান্ড? বা উইন্ডিজের সঙ্গে শেষদিকের লড়াইয়ে একটু এদিক-সেদিক হলে? দক্ষিন আফ্রিকার সঙ্গে ম্যাচটা অন্যরকম হতেও তো পারতো!
বরফ-শীতল মগজ নিয়ে উইলিয়ামসন তখনো যেকোনো মুশকিল পাড়ি দেয়ার ক্ষমতা রাখতেন নিশ্চয়! ভারতের সঙ্গে সেমিফাইনালে যেমনটা পাড়ি দিয়েছিলেন, ধ্যানী কোনো ঋষির মতো নিঃসীম মনোযোগে ম্যাচ পড়েন তিনি, বিচার করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন। যা অধিকাংশ সময় পক্ষে যায় তার।
৪৮তম ওভার স্ট্রাইক বোলার বোল্টের হাতে তুলে দেয়া, যা কি না নির্ধারিত কোটায় তার শেষ ওভার। এবং সেই ওভারেই বিপজ্জনক রবীন্দ্র জাদেজাকে তুলে নেয়া, শুধুই ‘ভাগ্য’? মার্টিন গাপটিলের সরাসরি থ্রোতে জল ঢেলে দেয়া শত কোটির স্বপ্নে, ধোনির রানআউট… ভাগ্যের ছোঁয়া আছে বলা যায়, তবে তার আগে ধারাবাহিক চাপ সৃষ্টি ও যোগ্য ক্রিকেটারটিকে ঠিক জায়গায় পাঠানোর কৃতিত্বও নিশ্চয়ই অধিনায়কের উপর বর্তায়। এবং পুরোপুরি ‘ভাগ্য’ বলা হয়তো অবিচারও হয়ে যায় দলটির প্রতি।
সাদা চোখে ও আগের বছরগুলোর ধারাবাহিকতা বিবেচনায় অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের পার্থক্য আছে অনেকটা। কিন্তু বিশ্বকাপে হলুদ জার্সির অঙ্গভঙ্গী ও আচার-আচরণ সম্পূর্ণ বদলে যায়। যেমনটা গ্রুপপর্বেই ইংল্যান্ডকে উড়িয়ে দিয়ে জানান দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু সেমিফাইনালে সেই চিরচেনা ও উত্তুঙ্গ আত্মবিশ্বাসী ইংল্যান্ড। গ্রুপপর্বে পরাজয়ের প্রতিশোধ যতটা সম্ভব কঠিনাকারে তো নিলোই, ফাইনালের জন্যেও বার্তা পেলো নিউ জিল্যান্ড।
৪.
ইয়ান স্মিথ ও নাসের হুসেইন ধারাবিবরণী দিয়ে পরিবেশটা সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেন। ইয়ান স্মিথের কণ্ঠে উত্তেজনা ও ক্রিকেটীয় আবেদন মিলেমিশে একাকার —
সেভেন উইকস অফ ক্রিকেট। ফোরটি এইট গেমস, ওয়ান বল, হিয়ার’স বোল্ট… দে আর গনা পুশ, আর উই ইন ফর অ্যা সুপার ওভার? দে হ্যাভ গট টু গো কুইক, দে গট টু গো কুইক। আউট… আই অ্যাম শিউর, হি ইজ আউট! উই আর গোয়িং টু আ সুপার ওভার!
নাসের হুসেইন পাশ থেকে তীব্র অবিশ্বাস ঠোঁটে পুরে বলে যান —
ইউ আর কিডিং মি, ইউ আর কিডিং মি! আনবিলিভেবল। আফটার সেভেন উইকস, উই আর নট ডান ইয়েট!
আহ, ক্রিকেট! অবিশ্বাস্য। স্রেফ অবিশ্বাস্য। ক্রিকেটের ইতিহাসে এমন ম্যাচ হয়নি, শতাব্দীর তো বটেই, ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসেরই শ্রেষ্ঠতম ম্যাচ। ক্রিকেটের সর্বোচ্চ আয়োজনের চূড়ান্ত লড়াই। স্নায়ু, দক্ষতা ও মানসিক স্থিতির চূড়ান্ত প্রমাণ দেয়ার মঞ্চ। স্বদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় পালক জুড়ে দেয়ার উপলক্ষ। সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে দু’টি দল উজার করে দিলো নিজেদের, স্টোকসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়লেন বোল্ট। কেন উইলিয়ামসন তার নেতৃত্বের মুন্সিয়ানা ও মগজের সর্বোচ্চ ব্যবহারে মাৎ করলেন শ্রেষ্ঠতম মঞ্চ, তবু বিজয়ের শেষ হাসি ইংলিশ দলপতি ‘আইরিশ’ ইয়ান মরগানের মুখেই।
ইয়ান স্মিথ মাথায় হাত দেন, বসে পড়েন, দাঁড়িয়ে যান আবার। তার অনুভূতি, তার অবিশ্বাস ঠিক কীভাবে বোঝালে ঠিকঠাক উঠে আসবে, বুঝতে পারেন না তিনি। গমগম কণ্ঠে বলেন,
ইউ ক্যান নট রাইট আ স্ক্রিপ্ট লাইক দিস!
একশো ওভারের ক্রিকেট শেষে এক ওভারের সুপার ওভার। এবং সেখানেও টাই! চরম কল্পনাপ্রবণ কোনো ক্রিকেট রোমান্টিকের পক্ষেও কি সম্ভব? অথবা ম্যাচ পাতানো বাজিকররা, যারা ক্রিকেটের অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন বলে জনমনে ধারণা আজকাল, তারাও কি পারবেন অমন অলৌকিক ম্যাচের চিত্রনাট্য বলে দিতে বা লিখে দিতে?
নাসের হুসেইনের ধারাভাষ্যটা চমৎকার মানিয়ে গেল,
হান্ড্রেড ওভার’স অফ ক্রিকেট, অ্যান্ড ইউ ক্যান নট স্প্লিট দিজ টিমস!
স্টোকস ঝুঁকি নিতে চান, পুশ করে ‘দুই’ নিতে চান। একইভাবে সুপার ওভারে গাপটিলও হাঁটেন একই পথে। রানআউট হন দু’জনই। প্রায় অর্ধশত দিনের শেষ দিনে এসে প্রায় সাড়ে আট ঘন্টার চূড়ান্ত পরিবেশনা শেষেও পরিষ্কার ব্যবধানে জয়ী হয় না কেউই!
This is the moment: it’s Archer to Guptill. Two to win. Guptill’s going to push for two. They’ve got to go. It’s … the throw’s got to go to the keeper’s end! HE’S GOT IT! England have won the World Cup by the barest of margins. By the barest of all margins. Absolute ecstasy for England, agony, agony for New Zealand…
ইয়ান স্মিথের মতো করে আর কেউ বলতে পারতো না নিশ্চয়ই?
ইয়ান স্মিথ ক্রিকেট ক্যারিয়ারে নয়ে নেমে ১৭৩ রানের অবিশ্বাস্য ইনিংস খেলেছিলেন, যা এখনো নয় নাম্বারে নেমে সেরা ইনিংস। তবে সেই অবিশ্বাস্য ক্রিকেটও যেন নেহায়েৎ শিশু এদিনের অবিশ্বাস্য ক্রিকেটের তুলনায়। ক্রিকেট অনিশ্চয়তার সৌন্দর্য্য যেন তার রূপ-লাবণ্য ছড়িয়ে দিয়েছিল সমস্ত পেখম মেলে। অসম্ভব ক্রিকেট অবাক মাধুর্য্যে, পরিপূর্ণ সুবাস-সৌরভে, অপরূপ মহিমায় অলৌকিকতার আসর জমিয়েছিল লৌকিক জনপদে।
ক্রিকেট গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা। সৌন্দর্য্য ও অনিশ্চয়তায় ক্রিকেট এত স্পষ্ট ও সত্যি হয়েছে আর কবে?
বোল্টের ক্যাচটা যদি ঠিকঠাক হতো? স্টোকসের ব্যাটে লেগে গাপটিলের থ্রো-টা চার না হতো যদি? এক ইঞ্চির এদিক-সেদিক, দু-এক সেকেন্ডের এদিক-সেদিক, লাস্ট বলে নিশামের থ্রোটা ঠিকঠাক না হলে? বোল্ট যদি গড়মিল করতেন? অথবা বাটলার যদি আগ বাড়িয়ে না ধরতেন বলটা?
আহ, ক্রিকেট! শেষ হইয়াও হয় না শেষ।
হাজারবর্ষী বিলেতি গ্রীষ্মের শতবর্ষী ইংলিশ ক্রিকেট মৌসুম সাক্ষী হয় এক অবাক ক্রিকেট বসন্তের!
নান্দনিকতার চূড়ান্ত উৎকর্ষ, সৃষ্টিশীল উচ্ছ্বাসের পরমানন্দ, অবিশ্বাস্য অনুভূতির সুতীব্র যোগান, অবাক ক্রিকেটের অসম্ভব উপস্থাপনা — তারপরও, হ্যাঁ, তারপরও কী ভীষণ হাহাকার!
৫.
ক্রিকেট বসন্ত অপরূপ সাজে সাজবে বলে বেছে নিয়েছিল সেবারের বিলেতি গ্রীষ্ম। মাসকয়েক আগের লর্ডসে মঞ্চায়িত অবিশ্বাস্য পরিবেশনা শেষে, ক্রিকেট তার রঙ-রূপ-সৌন্দর্য্য নিয়ে আবার হাজির হেডিংলির আকাশ-তলে। ক্রিকেটের প্রাচীন দ্বৈরথ, সবচেয়ে ঝাঁঝালো প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সম্মান ও শৌর্যের অন্যতম পোষাকি লড়াই — দ্য অ্যাশেজ। প্রথম টেস্টে হেরে গেছে ইংল্যান্ড, দ্বিতীয় টেস্ট ড্র, তৃতীয় টেস্টেও পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে ইংল্যান্ড। অ্যাশেজ আর ইংল্যান্ডে ফিরছে না তাহলে?
একজন বেন স্টোকস দাঁড়িয়ে গেলেন গোঁয়ারের মতো। দশম উইকেটে জ্যাক লীচকে সঙ্গে নিয়ে গড়লেন ৬২ বলে ৭৬ রানের অলৌকিক এক পার্টনারশিপ, যাতে ‘অলৌকিক’ স্টোকসের ৪৫ বলে ৭৪ এর সঙ্গে ‘লৌকিক’ জ্যাক লীচ জুড়লেন ১৭ বলে ১!
ক্রিকেটে অসম্ভব প্রত্যাবর্তন ঘটে কত! অসাধারণ ইনিংসের পাশাপাশি অসম্ভব জুটি হয় কত! অনন্য স্পেলে গুড়িয়ে যায় কত নিশ্চিত জয়! কিন্তু তাই বলে মাস কয়েকের মধ্যে পরপর এমন কাণ্ড? ক্রিকেট অনিশ্চয়তার সৌন্দর্য্যের হরদম এমন লুটিয়ে পড়া! স্নায়ু ও হৃৎপিণ্ডের চরমতম পরীক্ষা নিয়ে চক্ষু ছানাবড়া করে দেওয়া গল্পের জন্ম দেয়া এক মৌসুমে, এতবার? এমন প্রাণ প্রায় বেরিয়ে যাওয়ার মতো করে?
মানছি, ক্রিকেট সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি ইংলিশ গ্রীষ্ম। তাই বলে সৌন্দর্য্যের এমন চোখ-ধাঁধানো মঞ্চায়ন ও পরিবেশনা! জো উইলসন ক্লিয়ার লেগ বিফোর দেবেন না, অস্ট্রেলিয়া হারিয়ে ফেলবে তাদের রিভিউ। নাথান লায়ন মিস করবেন সহজতম রান আউট। স্টোকস মেলে বসবেন অদ্ভূত সব শটের পসরা, তার উপর ভর করবে পরজাগতিক কিছু! অবিশ্বাস্য, স্রেফ অবিশ্বাস্য।
ইয়ান স্মিথের মতোই বলতে হয়, ইউ ক্যান নট রাইট আ স্ক্রিপ্ট লাইক দিস!
বিলেতি গ্রীষ্মের অবাক ক্রিকেট বসন্তের আরো একটি অনিন্দ্য সুন্দর উপস্থাপনা হয়ে ইতিহাস হয় হেডিংলি, এবং বেন স্টোকস। অবশ্যই অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডও।
৬.
গ্রীষ্মটা বিদায় নেবে নেবে করছে। কত রঙ-বেরঙ উপহার দিয়েছে এই ক’মাস! দেখা হয়েছে স্টিভ স্মিথের ফিরে আসা; বিদ্রুপ-দুয়ো কীভাবে বদলে যায় সম্মান ও করতালিতে, দেখা হয়েছে তাও। ক্রিকেট কাননের নানা ফুল কেমন করে অপরূপ রূপ হয়ে ফোটে, কেড়ে নেয় সমস্ত মনোযোগ, তা-ও অদেখা নেই। অবিশ্বাসে চক্ষু ছানাবড়া বা রসগোল্লাও হয়েছে। তাই গ্রীষ্মের শেষটাতেও থাকলো কড়া রঙের প্রলেপ। অবাক বসন্তের পরিসমাপ্তিটাও হলো অবিশ্বাস্য।
টি-টোয়েন্টি ব্লাস্ট, ইংল্যান্ডের ঘরোয়া টি-টোয়েন্টির আসর — শেষের মঞ্চে জমিয়ে রেখেছিল তাই অবিশ্বাসের সব রঙ। নটিংহ্যামশায়ার বনাম উস্টারশায়ার সেমিফাইনাল। ৮ উইকেট হাতে নিয়ে নটসের ১২ বলে দরকার ১১ রান। উস্টারশায়ারের ট্রফি ধরে রাখা আর হবে না যখন নিশ্চিত, ঠিক তখনই ঘোমটা ছেড়ে অবাক বসন্তের অনিশ্চিত সৌন্দর্য্যমণ্ডিত ক্রিকেট নেমে এলো এজবাস্টনের সবুজ উদ্যানে। সময়টা, গ্রীষ্মটা, মওসুমটা – যেন কোনো মরণপণ শপথে বাঁধা, নাটকীয়তা ও রোমাঞ্চের সর্বোচ্চটা দেখিয়েই ছাড়বে!
সবাইকে হতবাক করে দিয়ে ম্যাচটা হেরে গেল নটস। ওয়েইন পারনেলের আগের ওভারেই কিপারের মাথার উপর দিয়ে অদ্ভূত শটে বাউন্ডারি ছাড়া করা বেন ডাকেট পারলেন না কিছুই করতে। ১ বলে ২ রান দরকার, পারনেলের বলটা ব্যাটেই লাগাতে পারেন না ডাকেট। উইকেটকিপারের বিশ্বস্ত হাতে জমা পড়ে বল। নড়ারই সুযোগ নেই। ‘১’ রানে জিতে উস্টারশায়ার পৌছে যায় ফাইনালে।
এসেক্সের সঙ্গে সেখানেও আরেক নাটক। ২ বলে দরকার ৬, এসেক্সের অধিনায়ক হারমার ঠিক বোলারের মাথার উপর দিয়ে মেরে দিলেন চার। লক্ষ্যটা তখন ১ বলে ২!
ওহ, আবার? গ্রীষ্মটায় ক’বার হলো এমন?
চারপাশের ঘিরে থাকা ফিল্ডারের ফাঁক গলে পয়েন্টের পাশ দিয়ে বলটা গলিয়ে দেন হারমার। এসেক্সের শোকেসে ওঠে টি-টোয়েন্টি ব্লাস্টের ট্রফি। তার আগে গ্রীষ্মটা তুলি হাতে বসন্তের শেষ রঙটাও টেনে যায় অপরুপ আঙিকে। আরো একবার ক্রিকেট অনিশ্চয়তায় মুগ্ধ হয়ে বিমোহিত হয় ক্রিকেট অনুরাগী, ছেলে-বুড়ো সবাই।
৭.
বছর বছর ফিরে ফিরে আসে গ্রীষ্ম। ক্রিকেট মৌসুমও আয়োজিত হয় প্রতিবার। হবে আবার, পরের বছর, তার পরের বছর, এভাবে ক্রিকেট বা পৃথিবীর অনিঃশেষ পর্যন্ত। ক্রিকেট সৌন্দর্যের ফুটবে ফুল, বিমুগ্ধ চোখ গিলবে নেশাগ্রস্থের মতো, ক্রিকেট অনুরাগীর মনে বান ডাকবে বসন্তের। নতুন বছরে নতুন ক্রিকেট, নব নব ঘটনা বা কীর্তি, আচানক সৌন্দর্যের সমাহার, স্মৃতির খাতায় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উলটে বহু নিচে চাপা পড়বে হয়তো চাক্ষুষ করা অবিশ্বাস্য চিত্তাকর্ষক ক্রিকেটের এক গ্রীষ্মের অবাক বসন্ত।
তারপরও, বহু বছর বাদে নিশ্চিত জমবে গল্পের আসর। স্মৃতির ধুলো সরিয়ে টানা হবে এই পাতা, এবং ঘোর ঘোর চোখে স্মৃতিচারণ হবে— সেই যে এক গ্রীষ্মে ধরণীর বুকে নেমেছিল অবাক ক্রিকেট বসন্ত!