ডর্টমুন্ডের সাবেক খেলোয়াড় নুরি শাহীন, ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় ও উল্লেখযোগ্য সময় কাটিয়েছেন বরুশিয়া ডর্টমুন্ডে। ক্লাবটির একাডেমি থেকে উঠে আসা এই খেলোয়াড়কে যেতে হয়েছে জীবনের নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে। ২০১৭ সালে ডর্টমুন্ডের বাসে বোমা হামলার ভয়ংকর স্মৃতি, ক্লাবটির প্রতি তার ভালোবাসা, ক্লাব ও সমর্থকদের প্রতি তার কৃতজ্ঞতা ও জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপলব্ধির কথা উঠে এসেছে দ্য প্লেয়ার্স ট্রিবিউনকে দেওয়া এক বর্ণনায়। শাহীনের অনন্য সেসব অভিজ্ঞতা পাঠকদের জন্য বাংলায় তুলে ধরা হলো।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের প্রত্যেক বড় ম্যাচের আগে আমি একটা রীতি পালন করি। বাড়ি বা রাস্তা যেখানেই থাকি, দুপুরের খাবারটা দলের হোটেলে খাই এবং এরপর একজন সতীর্থকে সাথে নিয়ে কফি নেই- সাধারণত মার্সেল স্মেলজারের সাথে। এরপর রুমে ফিরে গিয়ে গান বাজাই। চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ি, শুধু নিঃশ্বাস নেই। বুকের ওঠানামাও অনুভব করতে পারি তখন এবং মনে মনে ছবি আঁকি ঠিক কীভাবে ম্যাচটি খেলতে চাই। শুধুমাত্র অল্প কিছু মুহূর্তের জন্য, কিন্তু তা আমার দরকার। এরপরেই স্ত্রীকে ফোন করে নিশ্চিত হয়ে নেই সে ঠিক আছে। তারপর ফোন বন্ধ করে আমি দলের বাসের দিকে রওনা দেই।
এপ্রিল ১১, ২০১৭; যে রাতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে মোনাকোর সাথে খেলার কথা আমাদের, সে রাতেও এই সব কিছুই করেছিলাম।
হোটেল থেকে ডর্টমুন্ডের ওয়েস্টফালেনস্তাডিওন মাত্র কয়েক মিনিটের রাস্তা। পাশে বসে থাকা যে কারও সাথে হালকা আলাপ করার জন্য যথেষ্ট সময়। মার্সেলের পাশে বসে ছিলাম এবং মনে আছে, ঠিক চলতে শুরু করার পরই আমার পাশে থাকা তাক থেকে পানির বোতল চাইছিলেন তিনি। হাত বাড়ানো মাত্রই… ব্যাং! একটি বিস্ফোরণ আমাদের জানালার উপরে ভেঙে পড়লো।
সবকিছু তখন যেন ধীর গতিতে ঘটতে লাগল। কোনো ধারণাই ছিল না কী হচ্ছে। আমার মনে হয়… ভয়ে জমে গিয়েছিলাম। কিন্তু, আমার মন যেন দৌড়াচ্ছিল। মনে হয় দুই সেকেন্ডের মধ্যে পুরো জীবনটা দেখতে পাচ্ছিলাম। মৃত্যুর কথা ভাবছিলাম, বেঁচে থাকার কথাও। এরপর পরিবারের কথা চিন্তা করছিলাম। আমার পাঁচ বছরের ছেলে, এক বছরের মেয়ে এবং স্ত্রীকে যেন দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার পাশে তাদের অনুভব করতে পারছিলাম।
হঠাৎ আমার ঘোর কাটলো এবং বুঝতে পারলাম আমি কোথায়। ঘুরে তাকিয়ে দেখি আমার সহ-খেলোয়াড় মার্ক বার্ত্রাকে। তার হাত থেকে বাজেভাবে রক্ত ঝরছিল। উপরে তার চোখের দিকে তাকালাম। কোনো দিন সেই চোখগুলোর কথা ভুলবো না, অন্ধকার ও ভীতসন্ত্রস্ত চোখ। তার আশেপাশের লোকজন উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু আমি যত জোরে সম্ভব চিৎকার করলাম, “নিচু হয়ে থাকুন, নিচে থাকুন। জানালা থেকে দূরে সরে যান।”
আমাদের কোনো ধারণা ছিল না কী ঘটছিল বা যা হচ্ছিল তা শেষ কি না। বাস ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে চিৎকার করছিলাম, “থামবেন না, দয়া করে থামবেন না। চলতে থাকুন, আমাদের সরে যেতে হবে।”
ভেবেছিলাম হয়তো কেউ বাসে ওঠার চেষ্টা করছিল এবং… আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে।
সবাই স্বাভাবিক হওয়ার পূর্বেই বাসটি রাস্তার আরও কয়েক মিটার এগিয়ে গিয়েছিল এবং বাইরে তখন কেউ ছিল না। আমার কান ভোঁ ভোঁ করছিল। কিন্তু আমি ঠিক ছিলাম, বেঁচে ছিলাম। ফোন চালু করেই মা ও স্ত্রীকে ফোন করে জানিয়েছিলাম যে আমি ঠিক আছি- কিন্তু ঠিক কী ঘটেছে সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই। ফোন রেখে চারদিকে তাকিয়ে দেখি সবাই একদম পাথর হয়ে গিয়েছে। কেউ নড়াচড়া কিংবা কথা বলছে না। বাস থেকে নামার পর আর ফিরে তাকাইনি, চাইছিলাম এটা থেকে দূরে সরে যেতে।
কিছু সময় পর কেউ একটি ফোন এনে দিল, মার্কের স্ত্রী ফোন করেছিল। দলে মার্ক ছাড়া আমিই একমাত্র খেলোয়াড় ছিলাম যে স্প্যানিশ বলতে পারে, তাই আমাকেই বলতে হবে কী ঘটেছে- কমপক্ষে চেষ্টা করতে হবে। তাকে জানালাম যে মার্ক হাসপাতালে পথে এবং আমরা নিশ্চিত নই যে আঘাত কতটা গুরুতর। ওপাশ থেকে কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম, যতদিন বেঁচে আছি সেই শব্দ কোনোদিন ভুলবো না, কোনোদিনও না। মার্কের স্ত্রীর সে সময়ের অবস্থা আমার চরম শত্রুর জন্যও কামনা করতে পারতাম না।
বাস থেকে নেমে কান্না করিনি, আমি ঘোরের মধ্যে ছিলাম। শুধু নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম।
হোটেলে আমরা হেঁটে ফিরেছিলাম এবং এরপর একদম নীরবে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম। কোনো রেডিও, কোনো গান নয়- জানালা নামানো থাকায় রাস্তায় আমার গাড়ির শব্দ ছিল শুধু। ভাগ্যের নির্মম পরীক্ষার পর থেকে শুরু করে, বাস থেকে নেমে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত, প্রায় একঘণ্টা সময় পার হয়েছে। এই সময়ে প্রতি মুহূর্তে আমি একবার করে নিঃশ্বাস নিয়েছি।
রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে, মাত্র কয়েক পা এগিয়েছি। দেখি যে, দরজায় আমার স্ত্রী ও সন্তানেরা দাঁড়িয়ে আছে। থেমে গিয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য তাদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম এবং এরপরই আমি কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম। এমনভাবে আগে কখনই কান্না করিনি। মেয়েকে জড়িয়ে ধরেছিলাম এবং ওকে আদর করছিলাম। ভাবছিলাম, কতটা সৌভাগ্যবান আমি, কতটা ভাগ্যবান, কতটা।
মার্কের কথা মনে পড়ছিল, তিনি এতটা সৌভাগ্যবান ছিলেন না। ঐ রাতেই মার্সেল ও গনজালো কাস্ত্রোর সাথে তাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম। তিনি খুব বাজেভাবে আঘাত পেয়েছিলেন। কিন্তু, সব ঠিক ছিল, তিনি বেঁচে ছিলেন। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
হাসপাতালে থাকার সময়ে, বিশ্রাম কক্ষের টিভিতে দেখলাম কী ঘটেছিল। আমাদের বাসের বাইরে তিনটি বোমা বিস্ফোরিত হয়েছিল, যেগুলো রাস্তার পাশে লুকানো ছিল। আসলে ভাবতে পারছিলাম না, চাইছিলামও না। এরপর যা দেখলাম, তা সারা জীবন মনে থাকবে। টিভিতে আমাদের সমর্থকদের দেখাচ্ছে, ম্যাচটি স্থগিত হওয়ায় মোনাকো সমর্থকদের নিজেদের বাড়িতে স্বাগতম জানাচ্ছে, যারা সে রাতে ডর্টমুন্ডে আটকা পড়েছে। আমাদের সমর্থকরা এমনই, তারা জানে সেদিন যা ঘটেছে তা ফুটবলের চেয়েও বড় কিছু।
ডর্টমুন্ড ভক্তরা এরকমই হয়। আমি জানি, কারণ সারা জীবন ধরে আমিও তাদের একজন।
আমি একজন ফুটবল পাগল মানুষ। ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে রোমানিয়ার হয়ে করা জর্গে হাজির করা গোলটা দেখার পর আমার চোখ আটকে গিয়েছিল। জার্মানির মাইনারঝাগেনে শোয়ার ঘরের দ্বিতল বিছানার নিচেরটায় আমি এবং আমার ভাই উফুক ছিল উপরের বিছানায়। বল ভেতরে যাওয়া মাত্র দুজনই চিৎকার করে উঠেছিলাম। কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই বাবাকে অনেক অনুরোধ করেছি যেন এই টুর্নামেন্টের জন্য টিভিটা আমাদের ঘরে রাখতে দেয়। এরপর থেকে আমি মন ভরে ফুটবল দেখেছি। মনে আছে, ব্রাজিলের শেষ ম্যাচগুলোতে রোমারিও ও বেবেতো বুনো পরিশ্রম করে যাচ্ছে- দুর্দান্ত ছিল। তখনই জানতাম যে, এটি আমার খেলা।
যেখানে বড় হয়েছি, সেখানে হয় আপনি একজন ডর্টমুন্ড ভক্ত, না হয় শালকে ভক্ত, কারণ দুই দলই আমাদের শহরের খুব নিকটে খেলে। ঈশ্বরকে আমি প্রতিদিন ধন্যবাদ জানাই এজন্য যে, যখন আমার সাত বছর বয়স, তখন ডর্টমুন্ড আমাকে তাদের বয়সভিত্তিক দলে খেলার জন্য ডেকেছিল। একই বছরে ডর্টমুন্ড টানা দুটি বুন্দেসলিগা শিরোপা জিতেছিল এবং ক্লাবটির প্রেমে পড়ে যাই আমি।
আমি শুধু চাইছিলাম হলুদ-কালো জার্সিটা গায়ে জড়াতে।
১২ বছর বয়সে ডর্টমুন্ডের একাডেমিতে খেলার জন্য বাড়ি থেকে ৪৫ মিনিট দূরে ডর্টমুন্ডে চলে এসেছিলাম। কিছু ম্যাচে জুনিয়র দলের খেলোয়াড়দের বল বয় হিসেবে সুযোগ দেওয়ার বিশেষ ঐতিহ্য রয়েছে ক্লাবের। আমি যে ম্যাচে সুযোগ পেয়েছিলাম তা কোনো সাধারণ ম্যাচ ছিল না। ম্যাচটি ছিল চ্যাম্পিয়ন্স লিগের, ডর্টমুন্ড বনাম রিয়াল মাদ্রিদ। ঐ বছরের আগের বছরেই রিয়াল মাদ্রিদ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছিল এবং দলটি ছিল গ্যালাক্টিকোস। ফিগো, জিদান, রোনালদো, ক্যাসিয়াস, রবার্তো কার্লোসেদের মতো কিংবদন্তিরা আমাদের মাঠে আসতে যাচ্ছে তখন।
সেই রাতে মাদ্রিদের সুন্দর সাদা জার্সির কথা আমার মনে আছে, সেগুলো ছিল অসাধারণ এবং দুর্দান্ত ফুটবলও খেলেছিল তারা। দ্বিতীয়ার্ধের কোনো এক মুহূর্তে চিন্তা করছিলাম, একদিন ডর্টমুন্ডের হয়ে খেলতে যাচ্ছি। কিন্তু, যেকোনো মূল্যেই হোক, রিয়াল মাদ্রিদেও খেলবো।
ম্যাচ শেষে ডর্টমুন্ড সাধারণত মাঠে কাউকে ঢুকতে দেয় না, বিশেষ করে বল বয়দের। কিন্তু সে রাতে আমি এসবের পরোয়া করিনি। আমার বন্ধুকে বললাম, “ম্যাচ শেষ হতেই আমি ভেতরে যাচ্ছি। জার্সিটা আমাকে দেখতে হবে, ছুঁয়ে দেখতেই হবে। রোনালদোর সাথে আমাকে দেখা করতে হবে।”
আমি ঠিক তা-ই করেছিলাম এবং বিস্ময়কর এক অনুভূতি ছিল। এরপরই, আমি নিজেই নিজেকে অঙ্গীকার করেছিলাম যে, সাইড-লাইনের এই অভিজ্ঞতা মনে রাখবো।
দুই বছর পর, ডর্টমুন্ডের হয়ে আমার বুন্দেসলিগা অভিষেক হয়। তখন ষোল বছরের তরুণ আমি এবং লিগ ইতিহাসের কনিষ্ঠতম খেলোয়াড়। ঘরের মাঠে আমার প্রথম ম্যাচ ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী শালকের বিপক্ষে। ম্যাচ দেখার জন্য ওয়েস্টফালেনস্তাডিওন একটি অসামান্য রোমাঞ্চকর জায়গা। কিন্তু যখন আমরা শালকার বিপক্ষে খেলি তখন তা রোমাঞ্চের চেয়েও বেশি কিছু, সবচেয়ে বড় কারণ হলুদ দেয়াল (দক্ষিণ স্ট্যান্ড)। ব্যাখ্যা করছি। সুটথট্রিবিউন (দক্ষিণ স্ট্যান্ড) ২৫,০০০ এর বেশি দর্শক ধারণ করতে পারে। এটি ঢালু সিঁড়ির মতো এবং পা থেকে মাথা পর্যন্ত হলুদে আচ্ছাদিত দর্শকে ভরা থাকে স্ট্যান্ডটি। এই সমর্থকরা পৃথিবীর সেরা সমর্থক- জানি, সবাই সবসময় এরকমই বলে। কিন্তু, ডর্টমুন্ডের একটি ম্যাচ দেখতে যান, আপনি বুঝতে পারবেন। আপনাকে চাক্ষুষ দেখতে হবে। আমার কাছে এটি অনেকটা মোনালিসার মতো মহান এক শিল্পকর্ম।
ঐদিন, মাঠে যখন নেমেছিলাম, প্রথম যেদিকে তাকিয়েছিলাম সেটি ছিল হলুদ দেয়াল। এমনকি, এখনও এর দিকেই আমি প্রথম তাকাই। মাঠ থেকে আপনি দেখে বুঝতেও পারবেন কোথায় শেষ হয়েছে এটি। যতদূর চোখ যায়, শুধু হলুদ আর হলুদ।
ক্রীড়া জগতের সবচেয়ে অসাধারণ দৃশ্য।
শালকের বিপক্ষে ম্যাচটি আমরা জিততে পারিনি, কিন্তু আমার কাছে তা কোনো ব্যাপার ছিল না। স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি, ডর্টমুন্ডের হয়ে হলুদ দেয়ালের সামনে আমি খেলেছি। ডর্টমুন্ডের হয়ে আরও ছয় বছর খেলেছিলাম, এই সময়ে বরুশিয়ার সাথে আমার আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। জীবনের প্রতি বছরই আমি আরও গভীরভাবে ক্লাবের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলাম। আমার স্ত্রী ও আমি দুজনই সুখী ছিলাম এবং এমন এক শহরে আমাদের পরিবার শুরু করার ব্যাপারে উদগ্রীব ছিলাম যা আমার কাছে ‘বাড়ির’ চেয়েও বেশি কিছু হয়ে গিয়েছিল।
২০১১ সালে বুন্দেসলিগা জয়ের পর, আমার এজেন্টের কাছ থেকে একটি বার্তা পেয়েছিলাম, “নুরি, রিয়াল মাদ্রিদ আপনাকে চায়।”
মজার ব্যাপার হলো, ব্যাপারটি এভাবেই ঘটেছিল, একটি বার্তার মাধ্যমে। ছোটবেলায় যেভাবে আমরা চিন্তা করি, সেরকম কিছু ছিল না।
দল বদলের গুজবে আমার নাম অনেকবার শুনেছিলাম ইতোপূর্বে, কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদের সাথে কখনই তা শোনা যায়নি। এখন, তারা আমাকে চায়। সাদা জার্সি, বার্নাব্যু, ইতিহাস। কয়েক বছর পূর্বের নিজেকে করা সেই অঙ্গীকার আমার মাথায় ছিল। মনের একটা অংশ চাচ্ছিল, না বলে দিতে। ডর্টমুন্ড আমাকে অনেক দিয়েছে। কীভাবে আমি তাদের ছেড়ে চলে যেতে পারি? এমন চিন্তা করা খুবই কঠিন ছিল, ঘুম হচ্ছিল না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার স্ত্রী ও পরিবারের সাথে কথা বলেছিলাম। কিন্তু, সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে, আমাকে কথা বলতে হবে ডর্টমুন্ডের ম্যানেজার ক্লপের সাথে। আমাদের কথোপকথন আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ক্লপ আমাকে বলেছিল, “নুরি, তোমার সিদ্ধান্ত। কিন্তু, যদি তুমি চলে যেতে চাও, অবশ্যই জেনে রাখো, আমি সবসময় তোমার পাশেই থাকব। সবসময়ই আমার বন্ধু তুমি।”
আমি বলেছিলাম, “যদি আমি থেকে যাই, তাহলে জীবনভর আমি মাদ্রিদের জীবনের কথা ভেবে যাব। শরীরটা হয়ত ডর্টমুন্ডে থাকবে, কিন্তু মানসিকভাবে আমি হারিয়ে যাব। এভাবে আমি বাঁচতে পারি না।” তাকে আমি আরও বলেছিলাম যে বাঁচার জন্য একটাই জীবন। জীবনের কোনো একটা সময়ে গিয়ে আক্ষেপ করতে চাই না।
ইয়ুর্গেন বুঝতে পেরেছিল এবং তিনি আমার হৃদয়ের কথাই অনুসরণ করতে বলেছিলেন।
কয়েক ঘণ্টা পর, আমার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলাম। চার মাসের গর্ভবতী স্ত্রী আমার সাথে মাদ্রিদে চলে এসেছিল। অনেকটা নতুন করে শুরু করতে হয়েছিল আমাদের। স্প্যানিশ বলতে পারি, কিন্তু ভিনদেশে গর্ভবতী স্ত্রী নিয়ে জীবন ধারণের ব্যাপারটি আয়ত্ত করতে হয়েছিল। তাছাড়া, মাদ্রিদের সাথে প্রথম প্রশিক্ষণ পর্বেই আমি আঘাত পেয়েছিলাম। স্পেনের জীবনের শুরুটা তেমন একটা ভালো হয়নি।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে, আমাদের সন্তানের জন্ম হয়। সে সুস্থ ছিল। বাবা হওয়ায় আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ। আমাদের সময় দেওয়ার জন্য মা ও শাশুড়ি চলে এসেছিল, তারা আসার পর বুঝতে পেরেছিলাম বাড়ি কতটা মিস করছিলাম। ডর্টমুন্ড শুধু একটি ক্লাব বা শহরই ছিল না, সেখানেই আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরা বাস করত।
যত দ্রুত সম্ভব ইনজুরি থেকে ফিরে আসার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু, মাদ্রিদের মতো ক্লাবে, যারা জিতছিল এবং ভালো খেলছিল, সেখানে দলে আবার জায়গা করে নেওয়া খুবই কঠিন। আমি ছয় মাসের জন্য মাঠের বাইরে ছিলাম এবং যখন ফিরে আসার খুব কাছে, তখন ডর্টমুন্ড আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল যে, আমি ফিরে আসতে চাই কি না। হাল ছেড়ে দেওয়ার জন্য মাদ্রিদে আসিনি। আমার নিজের সেরা ফর্মে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করতে লোনে লিভারপুলে পাঠানো হয়।
ইংল্যান্ডে গিয়ে বাড়ি থেকে আরও দূরে সরে এসেছি মনে হচ্ছিলো। ভালো খেলতে পারছিলাম না। আমার খেলা থেকে কিছু একটা হারিয়ে গিয়েছিল। কী সেটা তা-ও বুঝতে পারছিলাম না। একসময় বুঝতে পারলাম; আমার খেলায় কোনো কিছু অনুপস্থিত নেই, অনুপস্থিতিটা রয়েছে আমার জীবনে। আবারও ডর্টমুন্ড পরিবারের অংশ হতে হবে আমাকে। এই মানুষদের জন্যেই আমি আমার ফুটবলটা খেলতে পারতাম।
আমার এজেন্ট প্রয়োজনীয় কিছু কল করেছিল এবং কয়েক সপ্তাহ পরেই আমি বাড়ির পথে।
ফিরে যাওয়ার পর নিশ্চিত ছিলাম না হলুদ দেয়াল কীভাবে আমাকে গ্রহণ করবে। জানি, যখন চলে গিয়েছিলাম, তারা কষ্ট পেয়েছিল। ফিরে আসার পর, প্রথম ম্যাচে বদলি খেলোয়াড় ছিলাম। সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে মাঠে নামার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম এবং মাঠের নামার ঠিক আগে ইয়ুর্গেন আমাকে ডেকে বলেছিল, “নুরি, চোখ বন্ধ কর। শুনতে পাচ্ছো?”
চোখ বন্ধ করে হলুদ দেয়ালের দিকে ফিরে শুনি, তারা আমার নাম ধরে গান গাইছে।
ইয়ুর্গেন বলেছিল, “আমি সত্যিই ভেবেছিলাম, তারা তোমাকে ঘৃণা করবে।” এটা বলেই ক্লপ তার ক্লাসিক উচ্চস্বরে হাসি শুরু করেছিল। মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে তিনি আমাকে মাঠে ঠেলে দিয়েছিলেন এবং সমর্থকরা যেন উল্লাসে ফেটে পড়ছিল।
ডর্টমুন্ডের সমর্থকদের সাথে আমার যে বন্ধন, তা কখনই ভাংবে না, এখন আমি তা জানি।
এসটে লিবে, যার অর্থ সত্যিকার ভালোবাসা, এবং নিঃশর্ত ভালোবাসা। বরুশিয়ার মূলমন্ত্র এটি, এটিই আমাদের শক্তি।
এই মূলমন্ত্রের শক্তি আমি অনুভব করেছিলাম বোমা হামলার পরের দিনগুলোতে।
ম্যাচটি আমাদের পরের দিনই খেলতে হয়েছিল। আপনাকে বুঝতে হবে, সারা জীবন একটা স্বপ্নই দেখেছি- বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেলা। ইউরোপিয়ান প্রতিটা ম্যাচই আমার কাছে বিশেষ কিছু। ঐ রাতগুলোর জন্যই আমি খেলি। কিন্তু, এই রাতটি ছিল ভিন্ন। ম্যাচের আগে আমি ভালোভাবে চিন্তাও করতে পারছিলাম না। আমার মাথায় শুধু স্ত্রী ও সন্তানদের কথা ঘুরছিল। তারা ঠিক আছে তো? বাড়িতে কি আমাকে তাদের প্রয়োজন? সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছিল।
মাঠের মধ্যদিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ের কথা মনে আছে এবং যা সবসময় করি- হলুদ দেয়ালের দিকে তাকানো। সেই রাতে, আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপার দেখেছিলাম। ভক্তরা বিশাল এক তিফোজি (Tifosi) তৈরি করেছে, যেখানে লেখা- BVB, আমাদের ক্লাবের সংক্ষিপ্ত নাম। স্ট্যান্ডের ঠিক উপর থেকে নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এটি। অসাধারণ। এমনকি এটা দেখার পর কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল যে, সবকিছু আবার ঠিক হয়ে যাবে।
ম্যাচের শুরুতে আমি বেঞ্চে ছিলাম। দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে প্রবেশের পূর্বে, ম্যাচ নিয়ে আর ভাবছিলাম না। শুধু বাড়িতে আমার পরিবারের কাছে ফিরে যেতে চাচ্ছিলাম- আমি চাইছিলাম সব সমর্থকরা বাড়ি ফিরে যাক, যেন তাদের প্রিয়জনদের পাশে থাকতে পারে। খেলা শুরু করার পর মনোযোগ দিতে পেরেছিলাম, কিন্তু তা-ও সব কিছু আগের মতো ছিল না। আমার খেলা সবচেয়ে কঠিন ম্যাচ ছিল এটি।
বাড়ি ফেরার পর, আমার স্ত্রী জিজ্ঞেস করছিল আমি আগের দিনের ঘটনা নিয়ে কথা বলতে চাই কি না। ব্যাপারটি কীভাবে আমার একটি অংশ হয়ে গিয়েছে তা নিয়ে কথা বলেছিলাম। বাসে যা ঘটেছে, তা কোনোদিন আমাকে ছেড়ে যাবে না। এটি আমাকে বদলে দিয়েছে, সামনের দিনগুলোর আমাকেও।
ঐ মুহূর্তের ভয় আমার মনে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে। কিন্তু কেউ ঐ দিনের কথা উল্লেখ করলে ঘটনার পরবর্তী সময়গুলো আমাকে বেশ ভাবায়। যেভাবে আমাদের ক্লাব ও শহর সাড়া দিয়েছিল, তা নিয়ে আমি গর্বিত। হামলার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই, মোনাকো সমর্থকদের স্বাগত জানানো, শহরের সবাই একে অপরের পাশে থাকা এবং স্টেডিয়ামে সমর্থন- সবকিছু সত্যিই অনন্য ছিল।
আমরা ঠিক তা-ই করেছিলাম, যার জন্য আমরা সুপরিচিত। নিঃশর্ত ভালোবাসা।
এসটে লিবে।
ফিচার ইমেজ- theplayerstribune.com