কোহলি বনাম স্মিথ: অসাধারণ থেকে অবিশ্বাস্য

গ্যাবায় অ্যাশেজের প্রথম টেস্টে ব্রড-অ্যান্ডারসনদের বোলিং তোপের মুখে পড়ে অস্ট্রেলিয়ার টপ অর্ডার সাজঘরে ফেরত যাওয়ার একাই দলের হাল ধরেন অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথ। শন মার্শ, প্যাট কামিন্সের সাথে জুটি গড়ে ইংল্যান্ডের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ান তিনি। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জেমস অ্যান্ডারসন, স্টুয়ার্ট ব্রড, জ্যাক বল এবং ক্রিস ওকসদের শরীর বরাবর বাউন্সারগুলো শক্ত মনোবল ও দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা করেন। শেষপর্যন্ত অপরাজিত থেকে ৩২৬ বলে ১৪টি চারের মারে ১৪১* রান করেন। ক্রিজে ছিলেন ৫১২ মিনিট। গ্যাবায় স্টিভ স্মিথ ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংসটি না খেললে ম্যাচের ফলাফল অন্যরকম হতে পারতো। বোলার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করা স্টিভ স্মিথ ৫৭টি টেস্টে ৬১.২৩ ব্যাটিং গড়ে ৫,৫১১ রান করেছেন। শতক এবং অর্ধশতকের সংখ্যা সমান ২১টি! আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে ৫৭ ম্যাচের পর সবচেয়ে বেশি ব্যাটিং গড় এবং রান স্টিভ স্মিথের দখলে।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শতক হাঁকানোর পর উচ্ছ্বসিত স্টিভ স্মিথ; Image Source – Saeed Khan

অন্যদিকে ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলি নিজের অবিশ্বাস্য ফর্ম বজায় রেখে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে নাগপুর টেস্টে ক্যারিয়ারের ৫ম ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকালেন। পরিসংখ্যানে লেখা থাকবে স্টিভ স্মিথ শতক এবং বিরাট কোহলি দ্বিশতক হাঁকিয়েছেন। স্টিভ স্মিথ যেখানে শক্তিশালী বোলিং লাইনআপ ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে রান করেছেন, সেখানে বিরাট কোহলি তুলনামূলক দুর্বল বোলিং লাইনআপ এবং ব্যাটিং সহায়ক পিচে দ্বিশতক হাঁকিয়েছেন। দুজনেই তাদের অসাধারণ ব্যাটিংয়ের দরুন ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেছিলেন। অধিনায়ক হিসেবে দুজনেই এ নিয়ে চতুর্থবারের মতো ম্যাচ সেরার পুরস্কার বাগিয়ে নিয়েছেন।

১. স্টিভ স্মিথ এবং বিরাট কোহলি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের পর থেকে দুর্দান্ত পারফরমেন্স করে যাচ্ছিলেন। অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়ার পর দুজনেই হয়ে উঠলেন ভয়ংকর। দুজনে প্রায় একইসাথে অধিনায়কের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ২০১৪-১৫ মৌসুমে ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়ার সিরিজে দু’জনের অধিনায়ক হিসাবে অভিষেক ঘটে। অধিনায়ক হিসেবে স্টিভ স্মিথ নিজের অভিষেক ইনিংসে ১৩৩ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। বিরাট কোহলি খেলেছিলেন ১১৫ রানের ইনিংস। বিরাট কোহলি অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়ার পর একাধারে তিন ইনিংসে শতক পূর্ণ করেন। অন্যদিকে স্টিভ স্মিথ একাধারে তিন টেস্টে শতক হাঁকিয়েছিলেন। দুজনেই আর থামেননি। অধিনায়কের দায়িত্ব পেয়ে একের পর এক দুর্দান্ত ইনিংস খেলে যাচ্ছেন।

স্টিভ স্মিথ এবং বিরাট কোহলি; Image Source – Cricket.com.au

অধিনায়ক স্টিভ স্মিথ এখন পর্যন্ত ২৭ টেস্টে ১৩টি শতক এবং দশটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৭২.৪৬ ব্যাটিং গড়ে ২,৯৭১ রান করেছেন। বিরাট কোহলি ৩১ টেস্টে ১২টি শতক এবং ৪টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৬৩.৯৩ ব্যাটিং গড়ে ২,৮৭৭ রান করেছেন। টেস্ট ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত ১৩৭ জন অধিনায়ক পাঁচ শতাধিক রান করেছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যাটিং গড়ের তালিকার শীর্ষ পাঁচে আছেন স্টিভ স্মিথ এবং বিরাট কোহলি। কেন উইলিয়ামসনও আছেন এই তালিকায়।

অধিনায়ক হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ব্যাটিং গড় (কমপক্ষে ৫০০ রান)

২০১৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ১,০০০ রান করা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যাটিং গড় বিরাট কোহলির। দ্বিতীয় স্থানে আছেন স্টিভ স্মিথ। বিরাট কোহলি ৩২ ইনিংসে আটটি শতক এবং দু’টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৭০.৭৫ ব্যাটিং গড়ে ১,৯৮১ রান করেছেন। স্টিভ স্মিথ ৩৩ ইনিংসে আটটি শতক এবং সাতটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৬৮.৬০ ব্যাটিং গড়ে ১,৯২১ রান করেছেন।

অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়ার পর অনেক ব্যাটসম্যান বাড়তি চাপের কারণে তুলনামূলক কম গড়ে রান করেন। কিন্তু এই দুজন ভালোভাবেই অধিনায়কত্ব উপভোগ করছেন।

২. শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে নাগপুর টেস্টে ২৬৭ বলে ১৭টি চার এবং ২টি ছয়ের মারে ২১৩ রানের ইনিংসের মধ্য দিয়ে চলতি বছরে টেস্ট ক্রিকেটে নিজের চতুর্থ শতক হাঁকিয়েছেন বিরাট কোহলি। এছাড়া চলতি বছরে ছয়টি ওডিআই শতক হাঁকিয়েছেন তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে চলতি বছরে বিরাট কোহলি মোট দশটি শতক হাঁকিয়েছেন। অধিনায়ক হিসেবে এক পঞ্জিকাবর্ষে সবচেয়ে বেশি শতক হাঁকানোর রেকর্ড এখন বিরাট কোহলির দখলে।

নাগপুর টেস্টে শতক হাঁকানোর বিরাট কোহলি; Image Source – BCCI

অধিনায়ক হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এক পঞ্জিকাবর্ষে সবচেয়ে বেশি শতক

 

এছাড়া অধিনায়ক হিসেবে মাহেলা জয়াবর্ধনে ২০০৭ সালে সাতটি, গ্রায়েম স্মিথ ২০০৮ সালে সাতটি এবং স্টিভ স্মিথ ২০১৬ সালে সাতটি শতক হাঁকিয়েছেন। টেস্ট ক্রিকেটে অধিনায়ক হিসেবে বিরাট কোহলি ১২টি শতক হাঁকিয়েছেন। যার মধ্যে পাঁচটি দ্বিশতক, সবকটি হাঁকিয়েছেন অধিনায়ক হিসেবে। ২০১৬ এর আগে বিরাট কোহলির ঝুলিতে একটিও দ্বিশতক ছিলো না। বর্তমানে তার নামের পাশে পাঁচটি ২০০ রানের ইনিংস। বাংলাদেশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কা, ইংল্যান্ড এবং নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তিনি এই পাঁচটি ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন। অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকানোর তালিকায় বিরাট কোহলি এখন ব্রায়ান লারার সাথে যৌথভাবে প্রথম স্থানে অবস্থান করছেন। ডন ব্রাডম্যান, মাইকেল ক্লার্ক এবং গ্রায়েম স্মিথ চারটি ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন।

৩. ভারতের সাবেক অধিনায়ক সুনীল গাভাস্কার ৪৭টি টেস্ট নেতৃত্ব দিয়ে ১১টি শতক হাঁকিয়েছেন। এতদিন এই কিংবদন্তী ব্যাটসম্যানই ভারতের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি শতকের মালিক ছিলেন। বিরাট কোহলি মাত্র ৩১ টেস্টে ১২টি শতক হাঁকিয়ে বর্তমানে ভারতের অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি শতকের মালিক তিনি।

বিরাট কোহলি ; Image Source – Newindianexpress.com

ওডিআইতে অধিনায়ক হিসেবে বিরাট কোহলি ৪০ ইনিংসে দশটি শতক হাঁকিয়েছেন। তার উপরে আছেন শুধুমাত্র সৌরভ গাঙ্গুলী। তিনি ১৪২ ইনিংসে ১১টি শতক হাঁকিয়েছিলেন। বিরাট কোহলি যে গতিতে এগোচ্ছেন, খুব শীঘ্রই তিনি সৌরভ গাঙ্গুলীকেও টপকে যাবেন।

৪. বিরাট কোহলি উইকেটে সেট হয়ে গেলে লম্বা ইনিংস খেলতে পছন্দ করেন। বয়সের সাথে সাথে তার রানের ক্ষুধাও বাড়ছে। উইকেটে সেট হয়ে গেলে অর্ধশতক করেই ক্ষান্ত হন না। সেটিকে বড় সংগ্রহে পরিণত করেন। চলতি বছরে যেমন ১০টি শতক হাঁকিয়েছেন, তেমনি পাঁচবার শূন্য রানে সাজঘরে ফিরেছেন। টেস্ট ক্রিকেটে ১৮জন অধিনায়ক দশের অধিক শতক হাঁকিয়েছেন। এর মধ্য বিরাট কোহলির বড় ইনিংস খেলার প্রবণতা বেশি। পরিসংখ্যান তা-ই বলে। এখন পর্যন্ত বিরাট কোহলি ষোলবার ৫০+ রানের ইনিংস খেলেছেন। এর মধ্যে শতকরা ৭৫% ইনিংসকে শতকে রূপান্তর করেছেন। কিংবদন্তী ব্যাটসম্যান ডন ব্রাডম্যানও এ তালিকায় বিরাট কোহলির চেয়ে পিছিয়ে আছেন। ডন ব্রাডম্যান তার ২১টি ৫০+ রানের ইনিংসের মধ্যে ১৪টি শতকে পরিণত করেছিলেন।

২৮ বছর বয়সী স্টিভ স্মিথ এবং ২৯ বছর বয়সী বিরাট কোহলি ক্যারিয়ার শেষে আরও অনেক রেকর্ডের মালিক হবেন যে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ফিচার ইমেজ – Cricspirit.com

Related Articles

Exit mobile version