সৌম্য সরকার কেবল মাটিতে উপুড় হয়ে বসে পড়লেন। আর কীইবা করার আছে তার? শেষ বলে ৫ রান দরকার, সেই সময়ে যেন দীনেশ কার্তিকের শরীরে রাবণের শক্তি ভর করল! নিচু করে উড়িয়ে মেরেই ছক্কা হাঁকালেন। সাথে সাথে মিলিয়ে গেল বাংলাদেশের আরও একটি শিরোপার স্বপ্ন। গ্যালারিতে তখন কেবলই দুয়োধ্বনি। ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে শ্রীলঙ্কাকে যে ‘নাটকীয়’ আর ঘটনাবহুল ম্যাচে হারিয়েছিল সাকিব আল হাসানের দল, সেই শ্রীলঙ্কানরা গ্যালারি জুড়ে রবিবার কেবলই ভারতের সমর্থক।
৩৫ হাজার ধারণ ক্ষমতার কলোম্বোর প্রেমাদাসা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পুরোটায় যেন রূপ নিয়েছিল লঙ্কা-ভারতীয় সমর্থকে। সেই তোপেও নাকাল হতে হয়েছে বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের। তার মধ্যেও প্রতিটা মিলি সেকেন্ড মুহূর্তে যে উত্তেজনার খেল দেখিয়েছে বাংলাদেশ দল, তা হয়তো শিরোপা জয়ের চেয়েও কম কিছু নয়। অন্তত যেটা হয়েছে, তা কেবলই ভাগ্য। পাঁচ-পাঁচটা ফাইনাল হেরে নির্বাচক, হতাশ এই বাংলাদেশ, অন্যদিকে ভারত? সাকিব-মুশফিকদের এই ম্যাচকে হয়তো আজীবন মনে রাখবে!
আর বাংলাদেশের কাছেও এই ম্যাচ, শুধু হার নয়; গৌরবেরও।
আবারও কান্নাকাটির হল্লাহাটি
হতে পারতো অনেক কিছুই। রোহিত শর্মার ঝড় তোলা ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ আগেই হারতে পারতো। অথবা মনিষ পান্ডে-বিজয় শঙ্করকে উইকেটে রেখে দিয়ে জয়ের পথটায় নিজেদের আসীন করতে পারতো। কোনোটাই হয়নি। সবকিছু শেষ মুহূর্তে গুবলেট করে দিয়েছেন ভারতের উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান দীনেশ কার্তিক। সাকিব আল হাসান, মুস্তাফিজুর রহমান, নাজমুল হাসান অপু নিজেদের কোটা আগেই শেষ করেছিলেন। ১৯তম ওভার তথা ডেথ ওভারে দলের পরীক্ষিত ফাস্ট বোলার রুবেল হোসেনকে আনা হল, ওই এক ওভারেই কুপোকাত বাংলাদেশ। ২২ রান নিলেন দীনেশ কার্তিক! হ্যাঁ, তিনি নিয়েছেন। রুবেল দেননি। কারণ, নিজের আগের ৩ ওভারে তিনি খরচ করেছিলেন মাত্র ১৩ রান! ক্রিকেটের ভাষায়, ‘হিট অফ দ্য মোমেন্ট’ ভর করেছিল কার্তিকের কব্জিতে। অন্যদিকে, মানসিক লড়াইতে প্রতি বাউন্ডারির পরই যেন পিছিয়ে পড়ছিলেন বাংলাদেশের হয়ে টি-টোয়েন্টিতে ২২ ম্যাচে ২৩ উইকেট নেওয়া রুবেল।
শেষ ওভারেও আশা ছাড়েনি বাংলাদেশ। প্রয়োজন ছিল ১২ রান। শেষ বলে, ৫ রান। কার্তিক এই এক বলেই ১৬ কোটির স্বপ্ন মিলিয়ে দিলেন ব্যাটের আঘাতে। ছক্কা হাঁকিয়ে জিতলেন ট্রফি, আর মাঠ জুড়ে বাংলাদেশি ক্রিকেটাররা মিশে গেলেন হতাশার কালো গহ্বরে। সাকিব যেন মানতেই পারছিলেন না। তার নিস্তব্ধ চাহুনি আলোকচিত্রীদের চোখ এড়ায়নি। যেন তার চোখে মুখে স্পষ্ট বক্তব্য, “এভাবেও হারা যায়?”।
মাঠের হতাশা পৌঁছে গেছে ডাগআউটেও। পাশাপাশি বসে ছিলেন নুরুল হাসান সোহান, আবু হায়দার রনি, আবু জায়েদ রাহি আর তাসকিন আহমেদ। রনি নিজের কান্না লুকাতে পারেননি। যেন কলম্বোয় ফিরে এলো ২০১৬ এশিয়া কাপের ফাইনাল। পাকিস্তানের বিপক্ষে জিততে জিততে শিরোপাটা হারিয়েছিল বাংলাদেশ। কেঁদেছিল সবাই। সেই ম্যাচের ব্যবচ্ছেদে অনেক কিছুই এসেছিল। কিন্তু এই ম্যাচে যে দোষী খুঁজে পাওয়া ভার! সবকিছুই যে ভাগ্যের দায়!
পুরো টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ রান করা মুশফিকুর রহিম সোমবার যখন দেশে পৌঁছলেন, বিমানবন্দরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে হতাশা ভরা কণ্ঠে বললেন, “আমরা বোলাররা মিলে ১ রান কিংবা ১ রান কম দিতে পারতাম? কিংবা ব্যাটসম্যানরা যদি আর ১০ রান বেশি করতে পারতাম! এটা দলীয় গেম। একজনের ব্যর্থতা মানে সবার ব্যর্থতা। এত কাছে এসেও ট্রফিটা পেলাম না।”
সবকিছু যেন ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বলে মেনে নিচ্ছেন। রুবেল হোসেনের ২২ রানের ওভার নিয়ে যখন কথা হচ্ছে, এই ফরম্যাটে দেশের সাবেক অধিনায়ক পেছনে দাঁড়াচ্ছেন তার। এটা সত্যি যে ডেথ ওভারে রুবেল হোসেনের বিকল্প পাওয়া দুষ্কর। হয়তো বা রবিবার দিনটাই ছিল বাংলাদেশের বিপক্ষে।
মুশফিকের ভাষায়, “মুস্তাফিজ যে ওই সময়ে মেইডেনসহ এক উইকেট নেবে এটা কেউই বিশ্বাস করেনি। তেমনই রুবেলের ওভারে যে এত রান যাবে সেটাও কেউ বিশ্বাস করেনি। ক্রিকেটে আসলে এটা হয়েই যায়।”
ঝিমিয়ে পড়া থেকে হঠাৎ ক্ষ্যাপাটে বাংলাদেশ
সাকিব আল হাসান নেই, মাশরাফি বিন মর্তুজা নেই। একমাত্র টি-টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট সাব্বির রহমানও ফর্মহীনতায়। সবমিলিয়ে নিদাহাস ট্রফির আগে ঘরের মাঠে এই শ্রীলঙ্কার সামনেই বিপর্যস্ত বাংলাদেশ। দুই টেস্টের একটিতে ড্র, দ্বিতীয়টিতে বাজেভাবে হার। দুই টি-টোয়েন্টিতেই হার। তার পরপরই আবার শ্রীলঙ্কায় উড়তে হল তিন জাতির টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট খেলতে। হাতে পুঁজি বলতে গেলে বছরে মাশরাফি বিন মর্তুজার ‘ফেয়ারওয়েল’ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে লঙ্কানদের হারানোর সুখস্মৃতি।
মিশন শুরু হল ভারতের বিপক্ষে। শুরুতেই হার। টুর্নামেন্টের প্রতিযোগীরা একেকটি দলের সঙ্গে দুটি করে ম্যাচ খেলার সুযোগ পাবে। ভারতের বিপক্ষে দুটি ম্যাচেই হারলো তারা। আর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে মুশফিকুর রহিমের ব্যাটে জিতে গেল বাংলাদেশ! তাতেই পয়েন্ট টেবিলে গড়বড়। ততক্ষণে সাকিব আল হাসান আঙুলের ইনজুরি সামলাতে ব্যস্ত। অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে গেলেন, ব্যাটিংটাও শুরু করলেন। যদিও চিকিৎসকরা জানালেন, খেলাধুলা সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে ফিরতেই সাকিবের সময় লাগবে অন্তত ৯-১০ দিন! সেখানে ম্যাচে ফিরতে আরও বেশি সময়। তারপরও ফাইনালে ওঠার সম্ভাবনা দেখে ঝুঁকি নিল বিসিবি। সাকিবকে খেলতে বলল। দেশের ডাকে সাড়া দিলেন অধিনায়ক। উড়ে গেলেন লঙ্কায়।
বাংলাদেশের এমন হুট করে ভোল বদলে এমনিতেই চাপে ছিল শ্রীলংকা। পরের ম্যাচে সাকিবকে উড়িয়ে আনা দেখে তা যেন রীতিমতো বিষমে পরিণত হল। কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহে মুখ ফুটে বলেই দিলেন, “বাংলাদেশের ভাগ্য ভাল,সাকিবকে পাচ্ছে”।
সেই সাকিবের অধীনেই ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সাকিব দলে আসায় অধিনায়কের জায়গা ছাড়তে হল মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে। কিন্তু তাকে নিয়ে আলোচনায় ঘাটতি পড়েনি একটুও সেই ম্যাচে। বরং সাকিবের সবটুকু আলো কেড়ে নিয়েছিলেন তিনি। একাই ম্যাচ জিতিয়ে হয়ে গিয়েছিলেন ক্রিকেট নামক চলচ্চিত্রের নায়ক। আবারও শ্রীলঙ্কাকে হারালো বাংলাদেশ। একেবারে নিচ থেকে উঠে এলো উপরে। যা কেউ ভাবতেও পারেনি। ফাইনালে জায়গা করে নেওয়ার ম্যাচে ঘটেছিল নাটকীয়তা। উত্তেজনার পারদ ছিল। তাতে কি? ২০ ওভারের ক্রিকেটে এটাই তো মূল রসদ।
সাকিবের ভাষায়, “একটা টি-টোয়েন্টি ম্যাচে এর চেয়ে বেশি কিছু আপনি আশা করবেন না। আবেগ, উত্তেজনা সব ছিল এখানে।”
পরের গল্পটা সবারই জানা।
‘চোকার’ বাংলাদেশ দলের ইতিহাস কিংবা পাঁচবার ফাইনালে হারের যন্ত্রণা
ইতিহাস বলছে, পাঁচবার ফাইনালে জায়গা করেও হেরেছে বাংলাদেশ। যার ফলাফল, শিরোপা দখলের লড়াইয়ের সেরা অবস্থানে গিয়েও ফিরতে হয়েছে। এই ২০১৮ সালেই দু’বার ফাইনাল হেরেছে বাংলাদেশ। দুটিই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজের ফাইনালে লঙ্কানদের বিপক্ষে ৭৯ রানে হারে বাংলাদেশ। ওই ম্যাচেই ফিল্ডিং করতে গিয়ে ইনজুরিতে পড়েছিলেন সাকিব।
এরপর শ্রীলঙ্কায় এই নিদাহাস ট্রফির হার, ভারতের বিপক্ষে। যদিও একই ঘটনা ২০১৬ সালে ঘটেছিল। মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ২০১৬ সালে ভারতের বিপক্ষে টুর্নামেন্টের ফাইনাল ম্যাচ ৮ উইকেটে হারে বাংলাদেশ। এই এশিয়া কাপেই ২০১২ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ২১ রানে হারে নাসির সাকিব আল হাসান-মুশফিকুর রহিমরা। যদিও ফরম্যাটটা সেবার ভিন্ন ছিল। ২০১৬ সালে টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয় টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে, ২০১২ সালে ছিল সেটা ওয়ানডে ফরম্যাট। ২০০৯ সালে আবারও ত্রিদেশীয় সিরিজের দুঃস্মৃতি। জিম্বাবুয়ে ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশ শুরুতেই হেরেছিল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। শেষপর্যন্ত বাংলাদেশ ফাইনালে পৌঁছায়। হারে শ্রীলঙ্কার কাছে।
যতকিছুই হোক, বাংলাদেশ বাংলাদেশই। এই দল প্রতিনিয়ত যে এগোচ্ছে, তার প্রমাণ মেলে এসবের মধ্যে দিয়েই। হতাশা কাটিয়ে একদিন আলোর সূর্য উঠবেই, সেই বিশ্বাস সমর্থকদের সঙ্গে ক্রিকেটাররাও রাখে। তাই তাদেরকে শুভেচ্ছা, অভিনন্দন।
সাকিব যেমনটা পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বলে দিলেন, “একদিন আমরা ট্রফি জয়ী দল হব।”
ফিচার ইমেজ- Getty Images