প্রতিটি ফুটবল লিগেই এমন কিছু ম্যাচ থাকে। ইতালিতে যেমন ইন্টার মিলান-এসি মিলান, ইংল্যান্ডে যেমন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-লিভারপুল, বাংলাদেশে যেমন আবাহনী-মোহামেডান, ঠিক তেমনই স্পেনে রিয়াল মাদ্রিদ-বার্সেলোনা। এই ধরণের ম্যাচগুলোতে দুর্বল-সবল দল বলে কোনো কথা থাকে না, খুব বাজে অবস্থানে থেকেও শক্তিশালী দলকে হারিয়ে দেবার প্রচুর উদাহরণ রয়েছে এই ম্যাচগুলোতে। ম্যাচগুলোতে শুধু খেলোয়াড়ি আবহই বিরাজ করে না, একই সাথে ক্লাবের আত্মসম্মান কিংবা ঐতিহ্যও জড়িত থাকে।
তবে এতগুলো প্রতিযোগিতাপূর্ণ ম্যাচের মাঝেও বার্সা বনাম রিয়ালকে একটু আলাদা উচ্চতায় রাখা হয়ে থাকে। অনেক আগে থেকেই এই দু’টো দলের মাঝে প্রতিযোগিতা অনেক তীব্র। সেই আলফ্রেডো ডি স্টেফানোকে দলে টানা নিয়ে দুই দলের মাঝে যে তিক্ততা শুরু হয়েছিলো, সেটার রেশ পরবর্তীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরিণত হয়েছে। এত যুগ পরেও দু’টি দল যখন পরস্পরের মুখোমুখি হয়, তখন কেউ কাউকে বিন্দুমাত্রও ছাড় দিতে চায় না। বিশ্বের সেরা দু’টি দলের ফ্যান এবং নিরপেক্ষ দর্শকরাও তাই ম্যাচটার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। ২০০৭ সালের ১০ মার্চেও তাই পুরো বিশ্ব তাকিয়ে ছিল এমন আগ্রহ নিয়ে। আগের ক্লাসিকোটাতেও বার্সেলোনা হেরে যাওয়ায় এই ম্যাচটা ছিল বার্সার জন্য অনেকটা প্রতিশোধ নেবার মতো। নিজেদের মাঠে সেই প্রতিশোধ নেবার প্রত্যয় নিয়েই মাঠে নামে তারা।
কিন্তু ম্যাচের ৫ম মিনিটেই বার্সেলোনা হোঁচট খায়। মাঠের বাঁ প্রান্ত থেকে হিগুয়েইন ক্রস করেন রাউলকে লক্ষ্য করে, কিন্তু বার্সা ডিফেন্ডারের গায়ে বাধা পেয়ে বলটা চলে যায় ডি বক্সের বাইরে থাকা রুড ফন নিস্টলরয়ের পায়ে। নিস্টলরয় সেই সময়ের ক্লিনিক্যাল ফিনিশারদের একজন। বলটা পায়ে পেয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি। পোস্টের ডান প্রান্ত দিয়ে সুন্দর প্লেসমেন্ট করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিলেন।
তবে মাদ্রিদ খুব বেশি সময় লিডটা ধরে রাখতে পারেনি। মাত্র ৫ মিনিট পরই মাদ্রিদের ডি বক্সের বাইরে একটা জটলায় ডেকোর কাছ থেকে বল পান ইতো, বল পেয়েই পাস দেন ডান পাশে ফাঁকায় থাকা ১৯ বছরের মেসিকে। ইকার ক্যাসিয়াসকে ওয়ান টু ওয়ানে পরাস্ত করতে বিন্দুমাত্র সমস্যাও হয়নি তরুণ মেসির, ম্যাচের স্কোর ১-১। কিন্তু মাত্র ২ মিনিট পরই মাদ্রিদ আবার এগিয়ে যায়। ডি বক্সে ফাউল করার জন্য মাদ্রিদ পেনাল্টি পায়, পেনাল্টি থেকে স্কোর করে দলকে আবারও ২-১ গোলের লিড পাইয়ে দেন নিস্টলরয়। বার্সার অলিগুয়ের হলুদ কার্ড খান ফাউল করার জন্য।
কিছুক্ষণের মাঝেই আবারও বার্সাকে ম্যাচে ফেরান মেসি। বাম প্রান্ত থেকে সুন্দরভাবে বলটা নিয়ে বক্সে ঢুকে শট নিয়েছিলেন রোনালদিনহো। ক্যাসিয়াস বলটা আটকে দিলেও বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বলটা চলে যায় মেসির পায়ে। মাথা ঠান্ডা রেখে ফাঁকা পোস্টে গোল করে দলকে আবারও ম্যাচে ফেরান মেসি। তখন ম্যাচের ২৭তম মিনিট।
২-২ থাকা অবস্থায় যেকোনো দলেরই ম্যাচ জেতার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু ৪৩তম মিনিটে সম্ভাবনার দিক থেকে বার্সেলোনা কিছুটা পিছিয়ে যায় অলিগুয়েরের দ্বিতীয় হলুদ কার্ড খেয়ে মাঠের বাইরে চলে যাওয়ার কারণে। বার্সালোনা ১০ জনের দলে পরিণত হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই রিয়ালের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
সম্ভাবনাটাকে সঠিক করার পথে রিয়াল আরেকটু এগিয়ে যায় ম্যাচের ৭৪তম মিনিটে। গুতির ফ্রি কিক থেকে হেডে গোল করে মাদ্রিদকে আবারও এগিয়ে দেন রামোস। বাকি ১৬ মিনিটে ১০ জনের দল নিয়ে মাদ্রিদের মতো দলের বিপক্ষে ম্যাচে ফিরে আসার কল্পনা করাটাও কিছুটা বিলাসিতাই বটে। তবে ৮৭তম মিনিটে সেই কাজটাই করে ফেললেন মেসি। রেকর্ড যদিও বলছে, অ্যাসিস্টটা রোনালদিনহোর কাছ থেকে আসা। তবে সত্যি কথা হচ্ছে, শেষ গোলটার মালিকানাটা একমাত্র মেসিরই। শুধুমাত্র গোলের আগের পাসটা অ্যাসিস্ট হিসেবে গণ্য হয় বলে তাতে রোনালদিনহো জড়িয়ে রয়েছেন। নয়তো বলটা পায়ে নিয়ে দুই ডিফেন্ডারকে ছিটকে ফেলে দিয়ে সামনে আরেক ডিফেন্ডারের বাঁধা পেরিয়ে গোলকিপারকে চমকে গোল পোস্টে বল পাঠানোর পুরো কৃতিত্বটা মেসিকে দিলেও সেটা দোষের হবে না।
তিন বার পিছিয়ে পড়ে, শেষ ৪৫ মিনিট ১০ জনের দলে পরিণত হবার পরও মাদ্রিদের মতো দলকে জিততে দেয়নি লিওনেল মেসি নামক ১৯ বছরের সেই তরুণটিই। ক্যারিয়ারের সেটাই প্রথম হ্যাটট্রিক। তবে তখন পর্যন্ত হয়তো মাদ্রিদ ম্যানেজম্যান্ট বুঝতে পারেনি, আগামী দশকটা মেসি নামের এই ধাঁধার কাছেই আটকে যাবে তাদের সব পরিকল্পনা।
অন্য কোনো ফুটবল বিশেষজ্ঞও কি বুঝতে পেরেছিলেন?
বোঝা সম্ভব ছিল না, বুঝতে না পারাটা কোঞও ফুটবল বিশেষজ্ঞদের ভুলও ছিল না। কারণ ইতিহাসে এমন কোঞও খেলোয়াড়ের দেখা তো এর আগে কখনোই তারা পাননি। তারাই বা কীভাবে এটা অনুমান করবেন? কেউ কি ভাবতে পেরেছিলেন, পরের ১২ বছরের মাথায় এই ক্ষুদে জাদুকরটা তার ক্যারিয়ারের ৫০তম হ্যাটট্রিকটা করে ফেলবেন?
মাঠে গোল করার মূল দায়িত্বটা কার থাকে? নিঃসন্দেহে একজন স্ট্রাইকারের। মেসি কি একজন স্ট্রাইকার?
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে নিঃসন্দেহে আপনি ছোটখাটো একটা হোঁচট খাবেন। এক বছরে সবচেয়ে বেশি গোল (৯১) করার রেকর্ডধারী খেলোয়াড়কে স্কোরার না বলাটাই তো পাগলামি। শুধু তাই নয়, একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে জিতেছেন ৫টি গোল্ডেন শ্যু।
একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে স্প্যানিশ লিগে করেছেন ৪০০টি গোল। এছাড়া চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতাও হয়েছেন ৫ বার।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, একই সাথে তিনি IFFHS এর প্লেমেকার অ্যাওয়ার্ডও জিতেছেন টানা তিন বছর (২০১৫-১৭)। ২০০৬ সাল থেকে চালু হওয়া এই পুরস্কার জিতেছেন জিদান, জাভি (৪ বার), ইনিয়েস্তা (২ বার), টনি ক্রুস এবং মদ্রিচ। খেলোয়াড়গুলোর নাম দেখেই আন্দাজ করতে পারছেন, তারা সবাই মধ্যমাঠের কারিগর ছিলেন। সেখানে মেসির মতো একজন খেলোয়াড় যখন প্লেমেকারের অ্যাওয়ার্ডও জিতে যান, তখন ভাবতেই হয়, তিনি আসলে স্ট্রাইকার নাকি প্লেমেকার?
ফুটবল মাঠে প্রতিটি খেলোয়াড়েরই নির্দিষ্ট ভুমিকা থাকে। কেউ গোল করার দায়িত্বে থাকেন, কেউ বা গোল আটকানোর, কিংবা কেউ গোল তৈরি করার। ইতিহাসে খুব অল্প কিছু খেলোয়াড়ই আছেন, যারা কিনা বিভিন্ন ভূমিকায় নিজেকে মানিয়ে নিতে পারতেন। তবে লিওনেল মেসি সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি কিনা দিনের পর দিন একই সাথে দুইটি ভূমিকা পালন করেছেন, গোলের সুযোগ সৃষ্টি করার পাশাপাশি গোল করে চলা। তিনিই ইতিহাসের একমাত্র ফুটবলার, যিনি একই বছর প্লেমেকারের অ্যাওয়ার্ডের পাশাপাশি ‘গোল্ডেন শ্যু’ পুরস্কারও জিতেছেন (২০১৭)। লা লিগার সবচেয়ে বেশি গোল করার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি অ্যাসিস্ট (১৫৭) করার রেকর্ডও তার।
অবিশ্বাস্য একটা কীর্তি।
এত সব অবিশ্বাস্য কীর্তির কাছে ৫০তম হ্যাটট্রিকের বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ কীর্তি মনে না হলেও আপনাকে দোষ দেওয়া যাবে না। তবে সত্য কথা হচ্ছে, কীর্তিটা আসলে অবিশ্বাস্যই। এখনো খেলছেন, এমন খেলোয়াড়দের মাঝে কেবল ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর হ্যাটট্রিকই তার চেয়ে বেশি; তবে সেটা ১৫১টি কম ম্যাচ খেলে মাত্র ১টি কম।
চ্যাম্পিয়নস লিগে করেছেন ৮টি হ্যাটট্রিক (সর্বোচ্চ), এর মাঝে নকআউট স্টেজে ২টি। ২০১২ সালে বেয়ার লেভারকুসেনের বিপক্ষে ৫ গোল করলেও এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল ২০১০ সালে আর্সেনালের বিপক্ষে করা হ্যাটট্রিকটা। কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগে আর্সেনালের মাঠে ২-২ গোলে ড্র-এর পর ঘরের মাঠে ১৮তম মিনিটেই পিছিয়ে যায় বার্সা। সেখান থেকে পরপর ৪টি গোল করে আর্সেন ওয়েঙ্গারকে বিস্মিত করে দিয়ে দলকে পরের পর্বে নিয়ে যান মেসি।
জাতীয় দল আর্জেন্টিনার হয়েও ৬টি হ্যাটট্রিক রয়েছে মেসির। এর মাঝে একটি হচ্ছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের বিপক্ষে। মেসিই বিশ্বের একমাত্র খেলোয়াড়, যার কিনা ক্লাবের হয়ে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে এবং জাতীয় দলের হয়ে ব্রাজিলের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করার কৃতিত্ব রয়েছে। তবে ব্রাজিলের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করলেও আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে মেসির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হ্যাটট্রিক বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে ইকুয়েডরের বিপক্ষে।
বিশ্বকাপে সুযোগ পেতে হলে জিততেই হবে, এমন সমীকরণ সামনে নিয়ে ইকুয়েডরের মাঠে নেমে প্রথম মিনিটেই গোল খেয়ে পিছিয়ে পড়ে আর্জেন্টিনা। কিন্তু ১২তম, ২০তম আর ৬২তম মিনিটে গোল করে মোটামুটি এক হাতেই দলকে বিশ্বকাপে নিয়ে যান মেসি।
মজার বিষয় হচ্ছে মেসি চাইলেই তার হ্যাটট্রিক সংখ্যা আরো বাড়ানোর সুযোগ নিতে পারতেন। ২০১৫ সালের একটা লা লিগার ম্যাচে ৮৫তম মিনিটে পেনাল্টি পায় বার্সা। দল ততক্ষণে ৬টি গোল দিয়ে ফেলেছে, মেসি নিজে করেছেন জোড়া গোল। কিন্তু নিজে পেনাল্টি না নিয়ে সেটা তুলে দিলেন নেইমারকে। আর কিছুদিন পরই ছিল বায়ার্নের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনাল। নেইমারের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্যেই পেনাল্টি নিজে নেননি মেসি। শুধু সেবারই নয়, ২০১৮ সালে উয়েস্কার বিপক্ষে লা লিগার ম্যাচেও নিজে পেনাল্টি না নিয়ে বল তুলে দেন সুয়ারেজের হাতে। অথচ ৮-২ গোলে জেতা ম্যাচের ৯২তম মিনিটে পাওয়া পেনাল্টিটা মেসির নিজের নেওয়াটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সতীর্থের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য তার এই আত্মত্যাগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
ঠিক এমনই আরেকটা প্রশংসার কাজ মেসি করলেন তার ৫০তম হ্যাটট্রিকটার দিনে। সেভিয়ার বিপক্ষে লা লিগার ম্যাচটাতে ২ বার পিছিয়ে পড়েও ৪-২ গোলের জয় পায় বার্সেলোনা। মজার বিষয় হচ্ছে, এই ৪ গোলের ৩টিই মেসির, আর বাকিটাও মেসিরই অ্যাসিস্টে।
একই দিনে ৬৫০ টি গোলের মাইলফলকও স্পর্শ করেন মেসি। বয়স ৩১ পেরিয়েছে, কিন্তু খেলোয়াড়ি পারফর্মেন্সে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। এই মৌসুমেও ইউরোপের টপ ৫ লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং সর্বোচ্চ এসিস্টদাতা মেসি। দিনে দিনে যেন আরো পরিণত হচ্ছেন, ক্যারিয়ার শেষে গোল সংখ্যা আর হ্যাটট্রিক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটাই ভাববার বিষয়।
তবে মেসিকে বিশ্লেষণ করতে গেলে পেপ গার্দিওলার একটা কথাই মাথায় রাখা শ্রেয়,
‘তাকে নিয়ে লিখতে যাও না, তাকে বর্ণনাও করতে যেও না। শুধু তাকে দেখে যাও আর উপভোগ করো।’
সত্যিই, ফুটবলের জাদুকর মাঠে যা করার করতে থাকুক। খেলতে থাকা মেসিকে বিশ্লেষণ করে সময় নষ্ট করার প্রয়োজন কি? তার চেয়ে বরং উপভোগই করা যাক, বিশ্লেষণটা নাহয় তার অবসরে চলে যাবার পরেই করা যাবে।