স্পাইডারম্যানের ভারতীয় সংস্করণে ভয়েস দিতে গিয়ে শুবমান গিল বলছিলেন, “আই ফিল সুপার-হিউম্যান”– এটুকু দেখে বা শুনে আমরা দর্শকেরা মিটমিট করে হেসে হয়তো ভাবতে পারি, কথাটা ভুল বলেননি শুবমান।
ভারতীয় ক্রিকেটার শুবমান গিল। কিছুদিন আগে ভারতীয় স্পাইডার-ম্যান (পবিত্র প্রভাকর) চরিত্রে ভয়েস ওভার দিয়েছেন, হিন্দি এবং তার নিজের অঞ্চল পাঞ্জাবের ভাষায়। সেসময় নেট দুনিয়ায় সাড়া ফেলেছেন, কুড়িয়েছেন প্রশংসা। তখন নিজেকে সুপার-হিউম্যান মনে করা এবং তার এখনকার মাঠের খেলা- দুটিতে যেন সমন্বয় ঘটছে।
গত আইপিএলে ১৭ ইনিংসে রান করেছেন ৮৯০, এভারেজ ৫৯.৩৩, এখন আছেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় প্রথম স্থানে। ফাইনালে যাবার লড়াইয়ে মুম্বাইয়ের সাথে ম্যাচ খেলতে নামার আগে প্রথমে থাকা ফ্যাফ ডু প্লেসি থেকে দূরত্ব ছিল মাত্র ৮ রানের। প্রথম ইনিংসে গুজরাটের হয়ে ব্যাট করতে নেমে ১২৯ রানের অভাবনীয় ইনিংস খেলে নিজেকে নিয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে, দলও পেয়েছে জয়। সর্বোচ্চ রান, সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান, ব্যাট দিয়ে আসা সব অর্জনই যেন নিজের করে নিয়েছেন পাঞ্জাবের ফাজিলকাতে জন্ম নেওয়া ২৩ বছরের এই তরুণ।
নিজেকে কোন চূড়ায় দেখার স্বপ্ন বুনছেন শুবমান, তিনিই জানেন। সেই চূড়া থেকে নিজের দূরত্ব ক্রমশই কমিয়ে আনছেন তিনি। শুধুমাত্র ২০২৩ সালের চলমান পরিসংখ্যান বলে, আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন ২৪টি। সেই ২৪টি ম্যাচে তার ব্যাট থেকে রান এসেছে ১,১৮৫, যেখানে এভারেজ দাঁড়াচ্ছে ৪৯.৩৮। ভারতীয়দের মধ্যে এই বছরে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রহের তালিকায় আছেন এই ডানহাতি ব্যাটার।
ফিরি ভারত-পাকিস্তানের সীমান্ত ঘেঁষা এক গ্রামে। তেহসিল, জালালাবাদ। পাঞ্জাবের ফাজিলকা জেলায় অবস্থিত এই গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত কৃষক পরিবারে শুবমান গিলের জন্ম। শুবমান গিলের বাবার ছিল কৃষি ফার্ম। গিলের দাদাও কৃষির সাথে জড়িত ছিলেন। সীমান্ত ঘেঁষা ঐ গ্রামে কৃষিই ছিল প্রধান পেশা। সেখানকার লোকজন সেই পেশার সাথে জড়িত থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক বৈকি। যার গল্প বলছি, তার পরিবারও তাই।
শুবমানের বেড়ে ওঠার কালে তার বাবা আবিষ্কার করেন, ছেলে ক্রিকেট পছন্দ করে। শুধু যে পছন্দ করে, তা নয় – এর বাইরে তেমন কিছু সে ভাবেও না। শুবমানের বাবা বলেন,
“যখন তার তিন বছর বয়স, সে শুধু ক্রিকেটই খেলত। তার বয়সী বাচ্চারা সাধারণত খেলনা নিয়ে খেলে, সে এসবের জন্য কখনোই জিজ্ঞেস করতো না। তার শুধু ছিল ব্যাট আর বল। সে ঘুমাতে যেত ব্যাট-বল নিয়ে।”
ছেলের এই আগ্রহে বাবার আগ্রহ বাড়ে। একসময় গিয়ে নিজের ফার্মে টার্ফ বিছিয়ে দেন। নিজেকে কি আর ধরে রাখা যায়! প্র্যাক্টিস শুরু করেন শুবমান। জানা যায়, ছোট্ট শুবমানের চেয়ে বয়সে অনেক বড় ছেলেরা এসে তাকে বল করত। শুবমানের বাবা লক্ষ্মীন্দর সিং তাদের বলতেন, তার ছেলের উইকেট নিতে পারলে ১০০ রুপি করে বখশিস পাবে তারা।
ভারতের সাবেক বামহাতি মিডিয়াম ফাস্ট বোলার ‘কারসান ঘাভরি’, প্রথম শুবমান গিলকে দেখে গিলের বাবাকে বলেন যে তার ছেলে ‘স্পেশাল ট্যালেন্ট’, তাকে যত্ন নিতে হবে সঠিকভাবে। মাঠে খেলতে থাকা গিল ঘাভরিকে এমনভাবে আকর্ষণ করে, পরদিন গিলকে যেন পাঞ্জাব ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের নেটে পাঠানো হয়, তা লক্ষ্মীন্দর সিংকে ভালোভাবে বলে যান তিনি।
পরদিন গিল ঘাভরির কথামতো নেটে যায় ব্যাট করতে। ১২ বছরের কিশোর গিল। ১৮-১৯ বছরের বোলারদের সামনে ব্যাট করতে থাকে। ঘাভরি দেখে, সে জানে- গিল এরকমই, ও পারে। ঘাভরি বলছিলেন, “সে ছিল দারুণ। একজন ১২ বছরের ছেলে সোজা ব্যাটে খেলছে, পেস দেখেও ভয় পাচ্ছিল না। বোলাররা তাকে বাউন্সার দিচ্ছিল, কিন্তু সে একদমই ভীতু ছিল না।” ঘাভরির ধারণা, গিল প্র্যাক্টিস করত সিমেন্ট উইকেটে, যা তাকে আরো ভয়ডরহীন করেছে।
এরপর শুবমান গিলের ঠিকানা হয় পাঞ্জাব ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন একাডেমি। যা মোহালিতে অবস্থিত। গিল শুধু নিজের কাজটুকু করে গেছেন, একে একে অনূর্ধ্ব-১৪, ১৬ সকল ধাপ পার করে অনূর্ধ্ব-১৯ দলেও ডাক পেয়ে যান খুব তাড়াতাড়িই। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত যুবাদের বিশ্বকাপে ভারতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সহ-অধিনায়কের দায়িত্বটাও পড়ে গিলের কাঁধেই।
গিলের যখন পাঞ্জাবের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৬ অভিষেক ঘটে, সেই অভিষেক ম্যাচেই পান ডাবল সেঞ্চুরির দেখা। শুধু তাই না, ২০১৪ সালে পাঞ্জাবের আন্তঃজেলা টুর্নামেন্টে হাঁকান ট্রিপল সেঞ্চুরি। লিস্ট-এ ক্রিকেটে আসতে সময় লাগেনি তার। বিজয় হাজারে ট্রফি, রঞ্জি ট্রফির মতো গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্টগুলি খেলে ফেলেন ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে।
তাই এতসব অর্জন যখন তাকে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দলের সহ-অধিনায়ক বানালো, গিল হয়তো ভাবলেন, নিজেকে জাতীয় দলের দরজায় নিয়ে যাবার সবচেয়ে ভালো সুযোগ বোধহয় চলে এলো। নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হওয়া সেই যুবা বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় ভারত। আর সহ- অধিনায়ক শুবমান গিল? তিনি টুর্নামেন্টজুড়ে ৩৭২টি রান সংগ্রহ করে পান টুর্নামেন্টসেরার পুরস্কার। পাকিস্তানের সাথে সেমিফাইনালে ১০২ রানের অপরাজিত ইনিংস, যা ভারতীয় দলকে ফাইনালে নিতে সাহায্য করে- তা গিলকে আরো আলাদাভাবে চেনায়।
লাল বলের ক্রিকেটে শুবমান গিল ওয়ান অব দ্য বেস্ট নক বলেন কোন ইনিংসকে, তা কি জানেন? এক আনঅফিশিয়াল টেস্ট ম্যাচ। ভারতীয় এ দলের হয়ে খেলা এক ডাবল হান্ড্রেড, যা ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ এ দলের বিপক্ষে – যে দলে খুব ভাল কিছু ফাস্ট বোলার ছিল। ২০১৯ এর সেই ক্যারিবিয়ান সফর গিলের কাছে স্পেশাল। প্রথম ইনিংসে শূন্য করে ফেরার পর দ্বিতীয় ইনিংসে ডাবল হান্ড্রেড, লাল বলের ক্রিকেটে, ক্যারিবিয়ান দ্বীপে, ফাস্ট বোলারদেরকে এতটা সামলে – স্পেশাল তো হবেই!
গিলের কোচ রাহুল স্যার তাকে বলেছিলেন, যাই আসুক, তুমি তোমার বেসিক বদলাবে না – যেটা তোমাকে এই অবধি পৌঁছাতে সাহায্য করল। গিল বলেন, আমি সবসময়ই এ কথা মাথায় রাখি।
শুবমান গিল এখন উড়ছেন। ২০১৮-তে কেকেআর দলে ডাক পান। তারপরের বছর ২০১৯ সালে একদিনের ক্রিকেটে আন্তর্জাতিক অভিষেক ঘটে। তারপরের বছর ডাক পান টেস্ট দলে। আর এবছর বিশ ওভারের ক্রিকেটে। কিছুটা ধারাবাহিকতার অভাব ছিল বটে, কিন্তু কাটিয়ে উঠেছেন। তিন সংস্করণ মিলিয়ে ম্যাচ খেলেছেন মাত্র ৫২টি। ব্যাট করেছেন ৬৭ ইনিংসে, যেখানে এভারেজ ৪৪.২০, সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন ৭টি, হাফ-সেঞ্চুরি ১০টি। মোট রান ২৬০৮। সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটি ছিল এ বছরই। তার অভিষিক্ত বিপক্ষ দল নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এক দিনের ক্রিকেটে ২০৮ রান করে অপরাজিত থাকবার দারুণ রেকর্ডটি করে বসেন, যা তাকে পঞ্চাশ ওভারের সংস্করণে সবচেয়ে কম বয়সী ক্রিকেটার হিসেবে ডাবল সেঞ্চুরিয়ানের সম্মানে সম্মানিত করে তোলে। মাত্র যে ১৯৯৯ এর ৮ সেপ্টেম্বরে জন্ম নিয়েছেন এই ক্রিকেটার।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট ডেব্যু হওয়াটা গিল দেখেন স্বপ্নের মতো। যখন ছোট ছিলেন, ভোর ৪-৫ টায় উঠে অস্ট্রেলিয়ায় হওয়া টেস্ট ম্যাচগুলি দেখতেন। এখন মানুষ তার খেলা দেখছে একই সময়ে উঠে। গিল মনে করেন, এটা তার জন্য এক অবাস্তব অনুভূতি তৈরি করে। গিল সবসময় অস্ট্রেলিয়ায় ম্যাচ খেলতে চাইত। এ বছরই ভারতের মাটিতে হওয়া টেস্ট ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হাঁকান সেঞ্চুরি, খেলেন ১২৮ রানের এক ইনিংস। সাদা বলের ক্রিকেটে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছেন। গত মার্চে আহমেদাবাদে করা শতক দিয়ে হয়তো লাল বলের নিশান উড়ানোর বার্তাও দিতে চাইলেন গিল।
মাথা এত ঠান্ডা রেখে ব্যাটের ফুল ফেস ব্যবহার করে যেসব শট শুবমান গিল খেলছেন ইদানিং, তা দেখে আবারও তাকে তারই মুখে বলা ‘সুপার-হিউম্যান’ বা ‘অতিমানব’ হিসেবেই আখ্যা দিতে হয় কি না, ভেবে দেখা যায়। অর্থোডক্স ব্যাটিং স্টাইল, অনেক পরে ব্যাট চালানো – যেন বোলারের বল সকল ম্যাজিক শেষে এসে থিতু হয় শুবমানের ব্যাটে। আর শুবমান তা চালিয়ে দেন কখনো স্ট্রেইট, কখনো কভার, কখনো পয়েন্ট বা খেলেন তার প্রিয় শট পুল; আর পাঠিয়ে দেন স্কয়ার লেগ থেকে কাউ-কর্নার পর্যন্ত।
বাউন্ডারি আর ওভার বাউন্ডারির ছড়াছড়িতে শুবমান গিল শতক হাঁকান হায়দরাবাদের সাথে, শতক হাঁকান আরসিবির সাথে; থামতে চান না বলে শতক হাঁকিয়ে দেন শতকের শতক করা শচীনের দল মুম্বাইয়ের সাথেও।
শুবমান গিলের এই পথ যদি এমনই হয়, যে পথে তাকালে আকাশ মাধওয়ালের করা বলগুলি ফ্লিক-পুল-স্ট্রং রিস্ট ফ্লিকে আকাশ ছাড়িয়ে বাউন্ডারির সীমানা ছেড়ে যায়, তবে তো গিলকে নিয়ে স্বপ্নের নকশীকাঁথা বোনাই যায়, তাই নয় কি?