হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। সেয়ানে সেয়ান। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা কয় না। যেই মনে হচ্ছে একটি দলের বাজিমাৎ হবে, সঙ্গে সঙ্গে অপর দলটি উলটে দিচ্ছে পাশার দান। সব হিসেব-নিকেশ মুহূর্তেই বদলে যায়। যখনই কোনো একটি দলকে নিতান্ত যাচ্ছেতাই মনে হয়, ঠিক তখনই দলটি উদ্ভাসিত হয় সামর্থ্যের সবটা মেলে। নিংড়ে দিয়ে নিজেদের, প্রমাণ রাখে তাদের ঝেড়ে ফেলার সময় হয়নি এখনো। প্রত্যেকটি টেস্ট, প্রতিটি মুহূর্ত ছড়িয়েছে উত্তেজনা। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দল দু’টি লড়াই করে গেছে। কেউ কাউকে তিল পরিমাণ দেয়নি ছাড়। স্মরণকালের সবচেয়ে উত্তেজনাকর ও রোমাঞ্চপূর্ণ সিরিজ শেষে ক্রিকেট-জনতার নতুন করে উপলব্ধি হয়েছে, টেস্ট ক্রিকেটের অনিশ্চয়তার অনন্য সৌন্দর্য্য।
সেই সৌন্দর্য্যের স্ন্যাপশট-স্বরূপ আমাদের এই আয়োজন। এবারের বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফির চারটি টেস্টকে শব্দগুচ্ছে বন্দী করে চারটি অধ্যায় ও তিনটি পর্বের সমন্বয়ে সাজানো আমাদের এই উপস্থাপনা। আজ থাকছে প্রথম অধ্যায়।
প্রস্তাবনা
মধ্য ডিসেম্বরের অস্ট্রেলিয়া, বেড়ানোর জন্য উৎকৃষ্ট সময় ও স্থান। তবে কেভিন রবার্টসের অবকাশযাপনের অবসর নেই, বড্ড ব্যস্ত তিনি, এবং এই মুহূর্তে কিছুটা তৃপ্তও। কাজটাকে যত কঠিন ও অসম্ভব ভেবেছিলেন, ততটা হয়নি। শেষ পর্যন্ত সবকিছু ভালোয় ভালোয় যদি চুকিয়ে ফেলা যায়, তাহলে তো হলোই। তিনি ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রধান কর্তা। মাসকয়েক আগেও পাহাড়-সমান চিন্তায় কী করবেন, কূল খুঁজে পাননি। ঘনিয়ে আসছে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট মৌসুম, মনোরম গ্রীষ্মকাল, অথচ মাঠে ক্রিকেট থাকবে কি না, তা-ই নিশ্চিত নয়! মেইল চালাচালি, ফোনালাপ, আরো কত দূতিয়ালি! সবশেষে নিশ্চিত হয়েছে পূর্ণাঙ্গ সফরে পূর্ণ শক্তির ভারতীয় ক্রিকেট দলের অস্ট্রেলিয়ার আতিথ্যগ্রহণ।
স্বস্তির চিহ্ন সৌরভ গাঙ্গুলির চোখেমুখেও। নানান আলাপ-আলোচনার পর, আগস্ট মাসের দিনদশেকের ব্যবধানে দু’টি বড় সিদ্ধান্ত নিতে হলো তাকে। কত সমালোচনা, কত বিদ্রুপ, প্রশংসাও ছিল কত! স্বদেশের সরকার, মধ্যপ্রাচ্যের ক্রিকেট কর্তা, অস্ট্রেলিয়ার জাঁদরেল ক্রিকেট-দূত… কম হ্যাপা সামলাতে হয়নি!
আইপিএল আয়োজনের রূপরেখা ঘোষণার ঠিক দশদিন পর ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বময় কর্তা জানান, তার দল অস্ট্রেলিয়া সফরের মাধ্যমে দুর্দিনের বাধা পেরিয়ে ফিরবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। শরীর এখন সেই জুলাই-আগস্টের মাত্রাতিরিক্ত ধকলের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছে, শারীরিক অসুস্থতা টের পাচ্ছেন, তবুও স্বস্তি যে দল অস্ট্রেলিয়ায় মন্দ করছে না। ওডিআই সিরিজ হারলেও টি-টোয়েন্টি সিরিজ জিতে নিয়েছে ভারত। এবার শ্বেত পোশাকের বনেদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা আসন্ন। সৌরভের চোখে ধূসর অতীতের স্মৃতি রঙিন হয়ে ধরা দেয়। তার নেতৃত্বে স্টিভ ওয়াহর বিদায়ী সিরিজে কি অসাধারণ ক্রিকেটই না হয়েছিল! চুলোয় যাক ওডিআই আর টি-টোয়েন্টি, সত্যিকার লড়াই হবে এবার। পৌরুষের লড়াই, অহংয়ের লড়াই। টেস্ট ক্রিকেটের আদি ও অকৃত্রিম আনন্দদায়ী এক লড়াই।
প্রথম অধ্যায়
১৭ই ডিসেম্বরের বাংলাদেশ। শীতের সকালে চোখে অল্প ঘুম নিয়ে এক ক্রিকেট দর্শক টিভির সম্মুখে উপস্থিত। সূর্য মোটে উঠি উঠি করছে। ফজর নামায সেরে বিছানার বদলে ক্রিকেট বেছে নিয়েছে সে। টিভিতে চোখ পড়তেই মনে পড়ে, ধুস! এটা তো গোলাপি বলের ডে-নাইট টেস্ট। সেই দশটায় শুরু হবে। বিছানার দিকে যেতে যেতে ভাবে, তবে কি আগামী জীবনে গোলাপি বল এমন ক্রিকেট ভোরগুলি মুছে দেবে জীবন থেকে?
এক.
দিবারাত্রির ক্রিকেট আয়োজনে ময়েশ্চারের সুবিধা নিয়ে দিনের প্রথম প্রহরে পেসারদের দাপট প্রদর্শনের সুযোগ নেই। যতক্ষণে ম্যাচের সূচনা, ততক্ষণে মধ্যাহ্নের সূর্য স্বমহিমায় ভাস্বর। তারপরও অস্ট্রেলিয়ান সুদর্শন ত্রিমূর্তি আতঙ্ক ছড়ায় ভারতের ব্যাটিংয়ে। অস্ট্রেলিয়ার দুর্দিনে অহঙ্কারের ধন, দুঃসময়ের ভরসা এই পেসত্রয়ী। যেকোনো পরিবেশে প্রতিপক্ষের স্বস্তি বিনাশে সিদ্ধহস্ত। ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বাধিনায়ক পিতৃত্বের স্বাদ পেতে মরিয়া, সবুজ মাঠে জয়ের জন্য যতটা মরিয়া হন — হয়তো বা তার চেয়েও বেশি। কর্তামহলে মঞ্জুর হয়েছে তার ছুটি। তাই প্রথম টেস্টের পর থাকবেন না তিনি। তার অনাগত সন্তানের মায়ের পাশে থাকা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেই নিয়ে জল কম ঘোলা হয়নি। ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের মতো কেউ কেউ সুযোগ মতো ‘পরিবার আগে না দেশ আগে’ জুড়ে দিয়েছেন অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক। ভারতীয় ক্রিকেট সম্পূর্ণ মনোযোগ অ্যাডিলেইড ওভালেই রাখতে চায়, কোনো বিতর্কে নয়।
‘১৭-র বিরাট কোহলিকে ভুলে গেছে সবাই, যিনি মধ্যরাতে পিতার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে পরদিন রঞ্জি ট্রফিতে কর্ণাটকের বিপক্ষে দিল্লীর হয়ে খেলেছিলেন ২৩৮ বলে ৯০ রানের ম্যাচবাঁচানো ইনিংস। বিকেলে ফিরে গিয়ে কাঁধে নিয়েছিলেন পিতার শব।
অ্যাডিলেইডে টস-ভাগ্য বিরাটের পক্ষে। বিরাট টস জেতার পর হারেননি কোনো টেস্ট। ২১ টেস্টে জয়ের সঙ্গে পেয়েছেন চারটি ড্র। ইংল্যান্ড সফরে পাঁচ টেস্টের চারটিতেই হারতে হয়েছিল, কোনোটিরই টস জেতেননি। সে বছরেরই শুরুর দিকে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে দু’টি টেস্ট হারতে হয়েছিল টসভাগ্য বিরূপ থাকায়। ২০১৮-এর দু’টি বড় (দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইংল্যান্ড) অভিযাত্রায় টসভাগ্য যদি পক্ষে পেতেন, তাহলে সিরিজের ফলগুলি ভারতের জন্য ১-২ বা ১-৪ হতো কি না, তা নিয়ে সন্দিহান অনেকেই। সে বছরেরই শেষে অস্ট্রেলিয়ায় যাত্রা করে ভারত। ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জিতলেও যে টেস্টটিতে পরাজিত হতে হয়, তাতে টস-ভাগ্য পক্ষে ছিল না বিরাটের। গত বছরের শুরুর দিকে যে নিউ জিল্যান্ডেও তথৈবচ হলো, সেখানেও টস-পর্বে হাসেননি কোহলি।
প্রথমেই টস-হাসি হেসে বিরাটের মুখে বিরাট হাসি। যাক বাবা, শুরু তো ভালো হলো। সিরিজের সূচনাটা সুন্দর করে দিয়ে যেতে চান তিনি, মোমেন্টাম পেয়ে গেলে দলের সেরা পারফরমার ও নেতা না থাকলেও উতরে যাওয়া সম্ভব হবে হয়তো। সর্বশেষ যেবার প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ার মাঠে উড়লো ভারতের বিজয়ী-তেরঙা, তখনো শুরুটা সুন্দর হয়েছিল। সেবার অস্ট্রেলিয়ার সেরা-রত্নদ্বয় স্মিথ-ওয়ার্নার ছিলেন না, আরেক রান মেশিন ল্যাবুশেনকে তখনো চেনা হয়নি, অস্ট্রেলীয় দলপতি টিম পেইনও তখন অপরিণত। সেই সুযোগে অস্ট্রেলিয়ার মাঠে অস্ট্রেলিয়া বিপক্ষে ছড়ি ঘুরানোর সুযোগ পায় ভারত। অস্ট্রেলিয়া এবার দেখে নিতে চায়, নিতে চায় প্রতিশোধ। ভারত চায় ‘বোর্ডার-গাভাস্কার’ নামাঙ্কিত বিজয়-স্মারক কেবলমাত্র ভারতেই যেন থাকে।
দুই.
ভারতে সাধু-পুরুষের অভাব নেই, আবার অসাধুর সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু ক্রিকেটের মধ্যমঞ্চে ভারত উপহার দিয়েছে একজন সত্যিকার সাধক-পুরুষ। তার ডাক নাম — চে। কিন্তু চে গুয়েভারার মতো বিপ্লবী বা বিদ্রোহী নন, সংযমী ও সাধক পুরুষ। চেতেশ্বর পুজারা — ক্রিকেট সাধকের সমার্থকে পরিণত হয়েছেন যিনি। নির্লোভ সন্ন্যাসব্রত নিয়েছেন যেন। অর্থের অবারিত প্রলোভনে বেদম পেটানোর হিড়িকে সম্পূর্ণ ভিন্নরকম একজন। যিনি বিদ্রুপ-দুয়ো অকপটে গায়ে মাখতে পারেন, তবে নিজের উইকেট কিছুতেই বিলিয়ে দেয়ার বিলাসিতা করতে পারেন না। গত অস্ট্রেলিয়া সফরেই রেকর্ড ১,২৫৮ বল খেলেছিলেন তিনি, যেখানে তিনি দ্বিতীয় ও তৃতীয়তে ঠেলে দিয়েছিলেন হার্বার্ট সাটক্লিফ (১,২৩৭) ও রাহুল দ্রাবিড় (১,২০৩) এর কিংবদন্তীদের। প্রতিপক্ষ মুখ গোমড়া করে অভিযোগ জানালে দোষ দেয়ার উপায় নেই — কেন বাপু, ক্রিকেট মাঠে ব্যাটসম্যান না পাঠিয়ে সাধু-সন্ত পাঠাও কেন!
তিনি উইকেটে থাকেন ধ্যানী কোনো ঋষির মতো, জপ করছেন যেন! এখানেও অস্ট্রেলিয়ার দুর্ধর্ষ পেস-ব্যাটারির বন্য আক্রমণ সামলে নেন অনায়াস দক্ষতায়। ম্যাচের প্রথম মিনিটেই উইকেট খোয়ানো ভারতকে দেন প্রায় পৌনে চার ঘন্টার নির্ভরতা। ভিনদেশ ও আবহে আবাদ করেন স্বদেশী ব্যাটসম্যানদের জন্য অনুকূল এক পরিবেশ, যেখানে দাঁড়িয়ে বিরাট কোহলি ও আজিঙ্কা রাহানে ভারতকে স্বপ্নমুখর ও স্মৃতিকাতর করে তোলেন। বছরছয়েক আগে মেলবোর্নের বাইশ গজে এই দু’জনের ব্যাটে জন্ম নিয়েছিল ২৬২ রানের ক্ল্যাসিক এক পার্টনারশিপ। তখনও ধোনির মহাভারত থেকে দায়িত্ব বুঝে নেননি বিরাট; নিজেকে সবে মেলে ধরতে শুরু করেছেন। রাহানেও কেবলই তরুণ প্রতিভা, হননি নির্ভরতার প্রতীক। সময়ের ফেরে বিরাট হয়ে উঠেছেন ভারতের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দাপুটে অধিনায়ক, এবং আজিঙ্কা তার যোগ্য সহকারী। পুজারার ব্যাটে যদি সংযমের অবাক সম্মোহন জাগে, তবে কোহলি-রাহানের ব্যাটে জাগে যেন শৈল্পিকতার অমোঘ আকর্ষণ। এই দু’জনের জুটি জমে যখন ক্ষীর, সেই সময় ঘটল অঘটন। দু’জনের এত বোঝাপড়া, পরস্পরের প্রতি এত আস্থা ও নির্ভরতা, কাজে এলো না কিছুই। রানআউট হয়ে ফিরলেন কোহলি, সঙ্গে ৭৪ রান। মিনিট কয়েক পর ফিরলেন রাহানেও। মড়ক লাগল ইনিংসে। দ্বিতীয় নতুন বল নিয়ে স্টার্ক-হ্যাজলউড হয়ে উঠলেন ভয়ঙ্কর। প্রথম দিন শেষে ২৩৩ রানের পাশে ছয় উইকেট দেখালেও স্বস্তিহীন হয়ে রইলো ভারত।
তিন.
স্টার্ক-হ্যাজেলউড-কামিন্স — অস্ট্রেলিয়ার সুদর্শন ত্রিমূর্তি। দুর্ধর্ষ ও আনপ্লেয়েবল। গতি-নিয়ন্ত্রণ-শৃঙ্খলার মিশ্রণে পরিশীলিত আক্রমণ। স্পিনের মায়াবী বিভ্রম বিছিয়ে আছেন অদম্য ও অক্লান্ত নাথান লায়ন। অস্ট্রেলিয়ার মাঠে এই বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে লড়াইয়ে সাফল্যের পূর্বশর্ত সম্ভব সর্বোচ্চ খুঁতহীন হতে হবে। যেন জমিয়ে রাখা তারুণ্য উগরে দিতে ব্যাকুল। টানা দেড়শ’ কিমির গোলা ছুঁড়ে যান মিচেল স্টার্ক, কামিন্স ব্যাটসম্যানের নাভিঃশ্বাস তুলে ছাড়েন, হ্যাজলউড যেন পরীক্ষা নেন — বাছাধন কতক্ষণ ধৈর্য্য রাখতে পারো দেখি! ক্ষুধার্ত নেকড়ের ন্যায় গিলে খেতে মুখিয়ে থাকেন তারা। সামান্যতম মনোযোগের নড়চড়েই ঘাড়ে চেপে বসতে পারদর্শী তারা। আর যদি তেমন সুযোগ পাওয়া না যায়, তবে বাধ্য করবেন ঘাড়টা পেতে দিতে। অস্ট্রেলিয়ার বোলিং আক্রমণ সময়ের অন্যতম সেরা, অন্যতম সমৃদ্ধ, এবং বিধ্বংসী।
একটু সুযোগেই যে সাজানো সংসার ওরা তছনছ করে দিতে পারে, তার প্রমাণ ভারতের স্কোর ১৮৮/৩ থেকে মাত্র ১৭ ওভারের ব্যবধানে ২৪৪-এ শেষ। ভারতের হঠাৎ যেন উপলব্ধি হয়, তার ‘লোয়ার অর্ডার’ বলতে কিচ্ছু নেই, পাঁচ উইকেটের পর থেকে পুরোটাই লেজ!
অথচ অস্ট্রেলিয়া দুরন্ত লড়াইটা উপহার দিল ‘লেজ’ দিয়েই। ১১১ রানে ৭ উইকেট হারিয়েও টিম পেইনের অধিনায়কোচিত ইনিংসে স্কোরটা টেনে নেয় প্রায় দুইশ’র কোটায়। টিম পেইন নাকি ‘অধিনায়ক’ কোটার খেলোয়াড়। যে অস্ট্রেলিয়ার একাদশ বাছাইয়ের নীতিই ছিল সেরা এগারোজন দিয়ে গড়া হবে দল, তারপর একজন নির্বাচিত হবেন দলের নেতা, সেই অস্ট্রেলিয়া এখন প্রথমে টিম পেইনকে অধিনায়ক নির্বাচন করে তারপর বাকি দশজন। অস্ট্রেলিয়ার এই একাদশ নির্বাচন প্রক্রিয়া তার ক্রিকেট সংস্কৃতির অধঃপতন, নাকি আদতেই অনন্যোপায় তারা — তা অবশ্য ভিন্ন আলোচনা।
টিম পেইন সমালোচকদের চোখে যেন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, দেখো, পারি আমিও। ৯৯ বলে হার না মানা ৭৩ রানের ‘প্রাইসলেস’ ইনিংস। অস্ট্রেলিয়ার স্কোর পৌঁছে ১৯১ পর্যন্ত। ভারতের লিড ৫৩, তবুও অস্বস্তিতে বিরাটের দল, লিড আরো বেশিই হওয়া উচিৎ ছিল। বুমরাহ-যাদব-শামি — ভারত বহু আদর ও যত্নআত্তি দিয়ে এই পেস ইউনিট গড়ে তুলেছে। ফাস্ট বোলারের পেছনে বিনিয়োগ করেছে অকাতরে। কোনো কোনো বোলারের জন্য নির্ধারিত করে দিয়েছে লালচে বল, কারো জন্য নিষিদ্ধ করেছে স্বদেশের মাঠ। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা ও শ্রমের পর এমন দাপটে পেস ইউনিটের মালিকানা পেয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট দল। প্রয়োজনের সময় সেই পেসারদের না পাওয়ার চেয়ে দুঃখ ও দুর্ভাগ্য আর হয় না। ইশান্ত শর্মাকে ভারত হারিয়েছে আগেই, এই টেস্টের পর তারা হারাবে শামি আহমেদকেও।
চার.
দুঃস্বপ্ন কতটা দুঃসহ ও বীভৎস হতে পারে? ঘুম ভেঙেও বিশ্রী স্বপ্নের রেশ থাকা, দরদর করে ঝরে পড়া ঘাম, শরীর জুড়ে কাঁপুনি কিংবা প্রায় কয়েকদিন যাবৎ তাড়া খাওয়া পশুর মতো তটস্থ অনুভূতি…! ভারতের অবস্থা হয় তার চেয়েও বাজে। সুদূরতম কল্পনাতেও এমন কিছুর অস্তিত্ব টের পায় না মানুষ। এতটা নির্দয় ও বর্বর হওয়ার উপায় নেই জনতার। কোনো লেখক হতে পারেন না এত নিষ্ঠুর গল্পকার। কিন্তু সত্যিটা সবসময় হার মানায় গল্পকে, যাবতীয় অনুমান ও ধারণাকে।
শেক্সপিয়র তো বলেছেনই, ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন।
৫৩ রানে এগিয়ে থাকা ভারত আড়মোড়া ভেঙে নামে তৃতীয় দিন মধ্যাহ্নে। দ্বিতীয় দিনের সূচনায় ভারত ব্যাটিংয়ে ছিল, দিনশেষেও ভারত। মাঝের ৭২ ওভারে গুটিয়ে গেছে অস্ট্রেলিয়া। বড় বড় নাম লাইনআপে। চতুর্থ ইনিংসের চ্যালেঞ্জ সামলাতে হবে অস্ট্রেলিয়ার নড়েবড়ে মিডল অর্ডারকে। স্কোরবোর্ডে খুব হৃষ্টপুষ্ট না হলেও পুষ্টিগুণ সম্পন্ন স্কোর জমা দেয়া গেলেই কেল্লাফতে। এগিয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ভারতের। রবি অশ্বিন টেস্টের প্রথম ভাগেই দেখিয়েছেন, এ্যাদ্দিনে হাত কেমন মশকো করেছেন!
জশ হ্যাজলউড দৃশ্যপটে আবির্ভূত হওয়ার পূর্বে ‘নৈশ প্রহরী’ জশপ্রিত বুমরাহ দুপুর ওয়াক্তে জানিয়ে দিলেন তার আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই এইবেলা, প্যাট কামিন্সের শিকারে পরিণত হয়ে গোলাপী বলটা নেড়েচেড়ে দেখতে প্যাভিলিয়নে ফিরলেন তিনি। পুজারা নামের দেয়ালও ধ্বসে পড়ল সেই কামিন্সের গোলায়। হ্যাজলউড ফিরতেই মায়াঙ্ক-রাহানে কুপোকাত। কামিন্সের পাতা ফাঁদে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পা দিলেন ভারত-দলনায়ক, ১৯ রানে শীর্ষ ছয় হারিয়ে অতিথি দল তখন আব্রু-রক্ষার সরঞ্জাম খুঁজতে ব্যস্ত। অস্ট্রেলিয়া আপ্যায়নে লবডঙ্কা, কোনো সম্মান ও সৌজন্যতার ধার ধারে না। টপাটপ উইকেট তুলে নিয়ে অতিথি দলের ইজ্জত ধূলোয় মিশিয়ে দিতে চায়। শামির অপারগতায় ৩৬/৯ এ থামে ভারত। ইতিহাসের সর্বনিম্ম স্কোর। তার আগে সেই ১৯৭৪ সনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লর্ডসে ৪২ রানেই সদলবলে আত্মসমর্পণের ইতিহাস রচনা করেছিল। অজিত ওয়াদেকারের নেতৃত্বে ভারত দেশের বাইরে প্রথম সিরিজ জয়ের ইতিহাস লিখেছিল, সেই তারই নেতৃত্বে রচিত হয় ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম লজ্জাজনক এক অধায়।
যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। বিরাটের নেতৃত্বে ভারতীয় ক্রিকেটের কত কত অর্জন, অথচ সেই তিনিই ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে দুঃখজনক এক অধ্যায়ে মিছিলের কান্ডারী। সময় পক্ষ বদলায়, ইতিহাস দেখায় অভিনবত্ব।
হ্যাজলউডের চক্ষু-ছানাবড়া করা এক স্পেল। মাত্র ২৫ বলেই ফাইফার লাভ, ইতিহাসের অন্যতম দ্রুততম। স্টুয়ার্ট ব্রড অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই ১৯ বলে পাঁচ উইকেট পেয়েছিলেন, সেবার অস্ট্রেলিয়া ৬০ পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিল। এদিন সে সুযোগটাও পায়নি ভারত। কামিন্সের ঝুলিতে চারটি, শামি অসুস্থ না হলে হয়তো ফাইফার পূর্ণ হতো তারও। কামিন্স সুন্দর, হ্যাজলউড সুন্দর; উঁহু, দেখতে-শুনতে নয়, বোলিং সৌন্দর্য্যে!
৯৩ রানের লক্ষ্যটার নাগালে পেতে বেগ পাওয়ার কারণ ঘটে না অস্ট্রেলিয়ার। মাত্র দুই উইকেট খুঁইয়েই লক্ষ্যে পৌঁছে যায় অস্ট্রেলিয়া। মিশন কমপ্লিট হয়নি, তবে প্রথম পদক্ষেপ সাকসেসফুল। তৃপ্তির হাসি ফোটে অস্ট্রেলিয়ার মুখে। সর্বত্র পেইনের স্তুতি। বোঝা যায় অপরাজিত ‘৭৩’ রানের ইনিংসটা কত মহামূল্যবান ছিল!
****
এই সেই অ্যাডিলেইড — যেখানে রাহুল দ্রাবিড়ের ব্যাটে ভর দিয়ে সিরিজে সমতা ফিরিয়ে ছিল ভারত। স্টিভ ওয়াহর বিদায়ী সিরিজে অবাধ্য ও অদম্য অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাদেরই চেনা পরিবেশে, তাদেরই স্বজাতির সম্মুখে প্রবল দাপটে এগিয়ে গিয়েছিল সৌরভের ‘টিম ইন্ডিয়া’। লক্ষ্মণ-দ্রাবিড়ের ব্যাটে ৩০৩ রানের মহাকাব্য, ৮৫ রানে নেই চার উইকেট, সেই ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে অমন বখাটেপনা… অবিশ্বাস্য, স্রেফ অবিশ্বাস্য। সেই অ্যাডিলেইড — যেখানে বিরাট কোহলির প্রথম নেতৃত্বের প্রহরে উভয় ইনিংসে সেঞ্চুরির বিরল কৃতিত্বের জন্ম হয়েছিল। চতুর্থ ইনিংসে ১৭৫ বলে ১৪১ রানের মাস্টারক্লাস বেরিয়েছিল ভিরাট ‘দ্য মাস্টার’ কোহলির ব্যাট হতে। আর এই পর্বে… কী লজ্জা, কী লজ্জা!
ভারতজুড়ে ক্ষোভের আগুন। এত বড় পৃথিবী হঠাৎ হয়ে পড়েছে সঙ্কীর্ণ, চারদিকে ‘হায় হায়’ রব; যেন শেষ হয়ে গেছে ভারতীয় ক্রিকেট। নেতা নেই, ধ্বসে গেছে তিলে তিলে গড়ে তোলা ইমারত, অপদস্থতার চূড়ান্ত হয়ে লুপ্ত হয়ে গেছে লজ্জা নিবারণের শেষ সম্বল। চারদিক থেকে ধেয়ে আসছে ধিক্কার, দুয়ো, বিদ্রুপ, ঠা ঠা করে গলা ফাটানো অট্টহাসি। যদি মাটিকে দু’ভাগ করে দেয়া যেত, তাহলে ভারতের কেউ কেউ হয়তো মাটি ফুঁড়ে কয়েকদিনের জন্য মুখ লুকিয়ে বাঁচার আশ্রয় খুঁজত!
এটাই টেস্ট ক্রিকেট। বোঝা যায় না, কী হবে কখন। মুহূর্তেই সব উলট-পালট। আড়াই দিনেই ম্যাচের পরিসমাপ্তি, ৩৬ রানেই ভারতের বন্ধ হওয়া দম — কোনো পাঁড় অস্ট্রেলীয় সমর্থকের সুন্দরতম সুখ কল্পনাতেও ঠাঁই পায়নি, ঠাঁই পায় না। মানুষ কল্পনাও করতে পারে না কোন প্রহরে কেমন রোমাঞ্চ অপেক্ষায়। ক্ষণে ক্ষণে বদলায় রঙ, বেলায় বেলায় পালটায় ভোল। টেস্ট ক্রিকেট বুঝি সদ্য কৈশোরে পড়া কিশোরী — খানিক বাদে বাদে সাজ পাল্টে পাল্টে আয়নার সম্মুখে উপস্থাপন করে নিজেকে। বুঝি-বা বুঝতে চায় — কেমন লাগছে নিজেকে!
অনিশ্চিত রোমাঞ্চ ভরপুর উঠা-নামা আলপনা
ঠাঁটিয়ে দেয় চক্ষু, মুহূর্তে বুমেরাং সব পরিকল্পনা।
কে বা এগোলো, কে বা পেছোলো, ওসব ছাড়ো
সময়ের হুটহাট প্রান্ত বদল স্রেফ উপভোগ করো;
নাম না জানা হরেক রঙের আচমকা উপস্থিতি—
সরগরম সবুজ মাঠ; টেস্ট ক্রিকেট, ইউ বিউটি!