‘বাংলাদেশ’ আর ‘ফুটবল’, অনেকের কাছেই এটা একটা বেমানান সমন্বয়। তবে সবার কাছে নয়। গুটিকয়েক মানুষ আছেন, যারা বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশ আর ফুটবল শব্দযুগল একদিন খুবই সুন্দর একটা সমন্বয় হয়ে দাঁড়াতে পারবে ভবিষ্যতে। তাদের এই বিশ্বাসের ভিত্তি স্থাপন করে ফেলেছেন মনিকা চাকমা, তার পরিশ্রমের জোরে; জয় করে নিয়েছেন বাঙালিসহ বিশ্ববাসীর মন। অনূর্ধ্ব-১৯ বঙ্গমাতা আন্তর্জাতিক গোল্ডকাপে মনিকার করা গোল ফিফার ‘ফ্যানস ফেভারিট’ ক্যাটেগরির শীর্ষ পাঁচটি গোলে জায়গা করে নিয়েছে।
এ সম্পর্কে মনিকার অনুভূতি জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন,
“আমার বেশ ভালো লাগছে। আমি বেশি আনন্দিত, কারণ ঐ টুর্নামেন্টে এটা আমার প্রথম গোল ছিল।”
গত ৩০ এপ্রিল মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে বঙ্গমাতা আন্তর্জাতিক গোল্ডকাপের সেমিফাইনাল খেলার সময় শেষ গোলটা দেন মিডফিল্ডার মনিকা, এবং ৩-০ গোলে জিতে যায় বাংলাদেশ টিম। কেন মনিকার গোলটা বিশ্ব মাতালো, আসুন জানা যাক।
মনিকা এক ডিফেন্ডারকে গতিতে পেছনে ফেলে বল নিয়ে এগিয়ে যান। এরপর ছয় নম্বর জার্সি পরিহিত আরেক ডিফেন্ডারের মাথার উপর দিয়ে বলটা সুবিধামতো জায়গা করে নেন তিনি। এমন সময় তাকে আটকাতে এগিয়ে আসে প্রতিপক্ষ দলের আরো দু’জন খেলোয়াড়। কিন্তু মনিকা বল হাত ছাড়া হতে দেননি। পেনাল্টি বক্সের বাইরে থেকেই বাম পায়ে জোরালো কিক করেন বলে, প্রতিপক্ষ গোলকিপার গোল ঠেকানোর জন্য বেশ জোরে লাফ দেন। কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হয় না, বল গোলকিপারকে উপেক্ষা করে ঢুকে যায় গোলবারের একেবারে ডানপাশ ঘেঁষে। প্রতিপক্ষের জালে তৃতীয় গোল, ফাইনালে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ।
মনিকার চাকমার বাসা খাগড়াছড়ি জেলার লক্ষ্মীছড়া অঞ্চলে। বাবা বিন্দু কুমার, পেশায় একজন কৃষক; মা রভি মালা, গৃহিণী। ৫ বোনের মধ্যে মনিকা চাকমা সবচেয়ে ছোট। মনিকা ছোট থেকেই এলাকার ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলতেন, যা তার বাবা মোটেও পছন্দ করতেন না। কিন্তু মনিকা তার ভালো লাগার খেলাটা বাদ দিতে পারেননি। বাবার শত চোখ রাঙানো সত্ত্বেও তিনি খেলা চালিয়ে গেছেন। ২০১১ সালে তিনি ময়মনসিংহের হয়ে বঙ্গমাতা প্রাইমারি স্কুল টুর্নামেন্ট নামে জীবনের প্রথম টুর্নামেন্ট খেলেন। তবুও তার বাবার সম্মতি অর্জন করা সম্ভব হয়নি।
২০১২ সালে আবারও বঙ্গমাতা টুর্নামেন্ট খেলার জন্য নির্বাচিত হন তিনি, বেশ ভালো খেলেনও। তখনও বাবা মেয়ের অনবদ্য প্রতিভার কদর করতে চাননি, চোখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু কোচের চোখ এড়ায়নি তার প্রতিভা। মঘাছড়ি প্রাইমারি স্কুলের কোচ, বিরো সেন ঠিকই পরখ করে নেন মনিকাকে। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালে বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ টুর্নামেন্ট বাংলার মেয়ে ফুটবলারদের জন্য বেশ ভালো একটা প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচিতি লাভ করে এবং বরাবরের মতো এবারও মনিকা এই টুর্নামেন্ট খেলার সুযোগ পান তবে এবার নতুন স্কুল, রাঙ্গামাটির মঘাছড়ি প্রাইমারি স্কুল থেকে বঙ্গমাতা টুর্নামেন্টে অংশ গ্রহণ করেন এই দুর্ধর্ষ ফুটবলার। এবারে আর মেয়ের প্রতিভা ঢাকা পড়েনি কঠোর বাবার চোখে। বাবা আর আটকে রাখতে চাননি মনিকাকে, বরং এবার তিনি মেয়ের কৃতিত্বে গর্বে বুক ফুলিয়ে বেড়ান।
এভাবেই বাংলাদেশের ফুটবল জগতে যাত্রা শুরু হয় মনিকার। ২০১৪ সালে রাঙ্গামাটিতে অনূর্ধ্ব-১৪ টিমের একটা ট্রায়াল হয়। সেখানে দুর্দান্ত পারফর্ম্যান্স আর অনবদ্য খেলার কৌশল দিয়ে তিনি জায়গা করে নেন বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৪ টিমে। সেই বছরটা ছিল মনিকার স্বপ্ন পূরণের বছর। খুব অল্প সময়েই মনিকা পরবর্তী অনূর্ধ্ব টিমে খেলার সুযোগ পেয়ে যান এবং বাংলাদেশকে বিশ্বাঙ্গনে তুলে ধরার তার স্বপ্ন একটু একটু করে পূর্ণতা পেতে থাকে। ধীরে ধীরে দেশকে বিশ্ব দরবারে জাহির করার লক্ষ্যে দেশি-বিদেশি নানান টুর্নামেন্ট খেলতে থাকেন তিনি।
২০১৭ সালে এশিয়ান ফুটবল কনফিডারেশন (AFC) কর্তৃক আয়োজিত অনূর্ধ্ব-১৭ চ্যাম্পিয়নশিপ কোয়্যালিফায়ারস টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। মনিকার কল্যাণে এই খেলায় বাংলাদেশ টিম চীনা টাইপে, ইরান, আমেরিকা, কিরগিজস্তান ও সিঙ্গাপুরকে একত্রে ২৬ গোলে হারিয়ে ফাইনালে জাতীয় পতাকা ওড়ানোর সুযোগ করে নেয়। পক্ষান্তরে পুরো টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের বিপক্ষে মাত্র দু’টি গোল হয়।
কিন্তু থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো নামকরা দেশগুলোকে হারিয়ে বাংলাদেশের ভালো করা একটু কঠিন হয়ে পড়েছিল। কারণ প্রতিপক্ষ দলগুলো বিশ্ব ফুটবল র্যাঙ্কিংয়ে সেরা ২০ দলগুলোর মধ্যে ছিল আর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০০।
এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ বেশ কিছু শিক্ষা নিয়ে ছিটকে যায়। কিন্তু মনিকা সবচেয়ে এগিয়ে থাকা টিম অস্ট্রেলিয়াকে (র্যাঙ্কিং ৪) একটি স্মরণীয় গোল দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ টিমের যোগ্যতা, বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তার পারদর্শিতা।
কয়েকমাস পর সাফের (Saff) অনূর্ধ্ব-১৫ খেলায় মনিকা বেশ অভিজ্ঞতার সাথে ফিরে আসেন। গ্রুপ পর্বে ভারত ও নেপালের বিপক্ষে খেলায় দেখান চমক। তার খেলায় অভিভূত হয়ে সাফের বিচারক তাকে সবচেয়ে ভালো ফুটবলার হিসেবে বিবেচনা করেন। মনিকা চাকমার কল্যাণে আমাদের সেই টুর্নামেন্টেরও ফাইনালে পৌঁছানো সম্ভব হতো, কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি।
এ বছর এশিয়ান ফুটবল কনফিডারেশন আয়োজিত অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপ কোয়্যালিফায়ার খেলা থেকেই মনিকা দেখাতে থাকেন তার তেজস্বিতা। তার বদৌলতে টুর্নামেন্টের প্রথম দুই ধাপ খুব সহজেই পার করে ফেলে বাংলাদেশ দল। কর্নার থেকে মন মাতানো গোল করে পহেলা মার্চে মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত হওয়া এশিয়ান ফুটবল কনফিডারেশন আয়োজিত অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপ কোয়্যালিফায়ার খেলায় স্বাগতিক দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশকে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ খেলার সুযোগ করে দেন ‘ম্যাজিক চাকমা’।
নেপালে অনুষ্ঠিত হয় সাউথ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশন আয়োজিত ‘সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ-২০১৯’। সেই টুর্নামেন্টে মঙ্গোলীয়ার বিপক্ষে চোখ ধাঁধানো গোল করে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ ফুটবলের এক নতুন চিত্র অঙ্কন করেন মনিকা। তাঁ এই গোলের জাদু দেখেই ফিফা তাকে ‘ম্যাজিক চাকমা’ উপাধি দেয়।
গোলটি ফিফার দৃষ্টিতে যেভাবে এলো
অনেকের মনেই হয়তো প্রশ্ন জাগছে, হরহামেশা হতে থাকা নিত্যনতুন গোলের মধ্যে খাগড়াছড়ির এই মেয়েটির জাদুকরী গোল কিভাবে ফিফার নজরে পড়লো?
ফিফা প্রতি সপ্তাহে বিশ্বের সকল ফুটবল ফ্যানদেরকেও বলে, তাদের পছন্দের গোলের ছবি এবং ভিডিও পোস্ট করতে, যেন গোলগুলো ফিফার চোখ না এড়ায়। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশী এক ফুটবল ফ্যান তৌসিফ আক্কাস ফিফাকে জাদুকর মনিকার এই গোলের ভিডিওটি পাঠান। এভাবে তারা জানতে পারে মনিকা চাকমার জাদুকরী গোলের ব্যাপারে।
বাংলাদেশী কন্যার এই গোল সম্বন্ধে ফিফা বলে, এই গোলটি গণনাতীত গোলগুলোর একটি।
জাদুকরী গোলের রহস্য জানতে চাওয়া হলে মনিকা বলেন,
“আমি টিমে অনুশীলনের বাইরেও আলাদাভাবে অনুশীলন করি। আমি প্রতিদিন একা একা গোল করা অনুশীলন করি। পোস্টের বাইরে গিয়েও শট করি। আমার কাজ গোল করানো। তবে কখনও কখনও মনে হয়, আমার গোল করাটা জরুরি, তাই বেশি বেশি অনুশীলন করি। বল সুইং করানোর জন্য আমাকে অনেক অনুশীলন করতে হয়। পরিশ্রমের জোরেই মূলত এমন গোল করা সম্ভব হয়েছে।”
মনিকা চাকমার ব্যাপারে তার প্রথম গুরু, বিরু সেন বলেন,
“আমি মনিকার মধ্যে সবসময়ই সম্ভাবনা দেখেছি। ও খুবই পরিশ্রমী একজন খেলোয়ার। আমি ওকে সব সময়ই বলি দৃষ্টি সর্বক্ষণ মাঠে রাখতে এবং সুযোগ বুঝে গোল করতে।”
বহু আলোচিত সেই গোলের পরে মনিকার প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকার নিচের ভিডিওতে দেখতে পাবেন।
মনিকার পরবর্তী লক্ষ্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,
“ভালো খেলতে হবে, আপাতত এটাই ভাবছি। ফাইনালে ভালো করে বাংলাদেশের ফুটবলে এক নতুন অধ্যায় তৈরি করতে চাই। এই জন্য কঠোর পরিশ্রম প্রয়োজন।”