সিম ভালো, স্পিন খারাপ: কেন?

নিজের ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে বাইরের কন্ডিশনে বেশ খাবি খেতে হয়েছিলো বিরাট কোহলিকে; রান যা করছিলেন, সেগুলো না করার মতোই। আর তাতেই তার কপালে সিলমোহর এটে দেওয়া হয়, ‘হোম ট্র্যাক বুলি’! কোহলি সময়ের সঙ্গে নিজের উন্নতি করেছেন, নিজেকে তৈরি করেছেন বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে, ঘরে-বাইরে এখন সমান তালে রান করেন ভারতীয় অধিনায়ক।

দীর্ঘদিন ‘হোম ট্র্যাক বুলি’ খেতাব নিয়ে ঘুরতে হয়েছে কোহলিকে; Image Source : ICC

শুধু কোহলি নন, যেকোনো উঠতি এশিয়ান ব্যাটসম্যান ঘরের মাঠে বা এশিয়ায় ভালো খেললেই তার দিকে ধেয়ে আসে সন্দেহের তীর, আর সেগুলোর মধ্যে সবার সামনে থাকে এই প্রশ্ন, “এশিয়ার বাইরে ভালো খেলতে পারবে তো?” পারলে পারলো, না পারলেই কেল্লাফতে, সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হবে ‘হোম ট্র্যাক বুলি’ খেতাব।

কিন্তু, কখনও কি দেখেছেন কোনো নন-এশিয়ান উঠতি ব্যাটসম্যানকে বলা হচ্ছে, “তা বাপু স্পিন কেমন সামলাও হে? এশিয়ায় খেলতে পারবে কি?” দুর্ভাগ্যজনকভাবে, না। আমাদের কাছে ব্যাটসম্যানশিপের চূড়ান্ত পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে সুইং আর গতি সামলে রান করাকে, কিন্তু স্পিনের ঘূর্ণি যে ক্রিকেটের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। ভুলে যাই, নাকি ইচ্ছা করেই অবজ্ঞা করি?

সব উপমহাদেশীয় ব্যাটসম্যানই অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড কিংবা উইন্ডিজে গিয়ে খাবি খান, ব্যাপারটা তেমন নয়। কেউ কেউ ঠিকই ভালো খেলেন, এবং দিনশেষে দেখা যায় যে তারাই ইতিহাসের অংশ হন। কিন্তু, আমরা মুদ্রার অপর পিঠটা দেখতে ভুলে যাই, নন-এশিয়ান অনেক ব্যাটসম্যানই উপমহাদেশে এসে স্পিনিং পিচে খাবি খান, তাদের তুর্কি নাচন নাচিয়ে ছাড়েন এশিয়ান স্পিনারেরা। গত দশ বছরের টেস্টে পরিসংখ্যান দেখে ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করা যাক।

অপরিচিত কন্ডিশনে অসুবিধায় পড়েন সব দেশের ব্যাটসম্যানই! Image Source : The Statesman

বিরাট কোহলি এশিয়ার বাইরে ম্যাচ খেলেছেন সব মিলিয়ে ৩৬টি, সেখানে ইনিংস ৬৬টি, ১২ শতক আর ৯ অর্ধশতকে রান করেছেন ৩,১০০। এই রান তিনি করেছেন ৪৭.৬৯ গড়ে, যেখানে তার ক্যারিয়ার গড় ৫৩.৮। অর্থাৎ, বিদেশের মাটিতে খুব একটা খারাপ করেননি কোহলি। অজিঙ্কা রাহানের গড় বিদেশে উল্টো গেছে বেড়ে; ক্যারিয়ার গড় যেখানে ৪০.৫, সেখানে এশিয়ার বাইরে তার গড় ৪২.৮৬। এশিয়া আর এশিয়ার বাইরের গড়ের প্রকট পার্থক্যটা দেখা যায় চেতেশ্বর পূজারার ক্ষেত্রে; ক্যারিয়ার গড় ৫১.২ এশিয়ার বাইরে নেমে আসে ৩৫.৮১ এ। পাকিস্তানের এ সময়ে সেরা ব্যাটসম্যান আজহার আলির ক্যারিয়ার গড় যেখানে ৪৩.৩, এশিয়ার বাইরে সেটা কমে হয় ৩৩.৪২। এশিয়ার বাইরে আসাদ শফিকের গড়টাও ৩৮.৯ থেকে নেমে আসে ২৮.৭৯ এ।

অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউসের ক্যারিয়ার গড় যেখানে ৪৪.৮, সেখানে এশিয়ার বাইরে তার গড় কমে আসে ৩৮.৬৫ এ, দীনেশ চান্দিমালের গড় ৪২.৬ থেকে নেমে আসে ৩৪.৯ এ। দিমুথ করুনারত্নের এশিয়ার বাইরে গড় মাত্র ২৮.১১, গোটা ক্যারিয়ারে ৩৬.৬। ব্যতিক্রম বলা যায় কুশাল মেন্ডিসকে, ক্যারিয়ার গড় (৩৭) আর এশিয়ার বাইরের গড়ে (৩৬.৩৩) পার্থক্য সামান্যই। বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কিছুটা অদ্ভুত, সাকিব-তামিম দুজনেরই এশিয়ার বাইরের গড় ক্যারিয়ার গড়ের চেয়ে বেশি। সাকিবের ক্যারিয়ার গড় ৩৯.৬, এশিয়ার বাইরে ৪৫.৮৮; তামিমের যথাক্রমে ৩৭.৮ ও ৩৮.৫৮। তবে, বাংলাদেশ দেশের বাইরে টেস্ট খেলে কালেভদ্রে, তাই ১০ বছরে তামিম খেলেছেন ১২ টেস্ট, সাকিব মাত্র ৯টি!

স্টিভেন স্মিথের ক্যারিয়ার গড় ৬১.৪, অথচ এশিয়ার মাটিতে সেই স্মিথের গড় নেমে আসে ৪৮ এ। ৪৮ অবশ্যই খুব ভালো গড়, কিন্তু মূল বিষয়টি হচ্ছে তার গড় দুটির পার্থক্য ১৩ এর বেশি। স্মিথের স্বদেশী ডেভিড ওয়ার্নারের এশিয়ায় গড় ৩৪.৭, ক্যারিয়ার গড়ের (৪৮.২) সঙ্গে পার্থক্য প্রায় ১৪। অ্যালিস্টার কুক অবশ্য ব্যতিক্রম, ক্যারিয়ার গড় যেখানে ৪৫.৪, সেখানে এশিয়ায় ‘শেফ’ এর গড় ৫৬! জো রুটও প্রায় তার ক্যারিয়ার গড়ের (৪৯.৯) সাথে পাল্লা দিয়েই রান করেছেন এশিয়ায় (৪৬.০৭)। কেন উইলিয়ামসনের ক্যারিয়ার আর এশিয়ায় গড়ের মধ্যেও সামঞ্জস্যতা আছে বেশ, গড় যথাক্রমে ৫১.৪ ও ৫০.৭০। তবে রস টেইলরের এশিয়ার গড় (৩৪.১৩) তার ক্যারিয়ার গড়ের (৪৫.৯) তুলনায় বেশ খারাপ। হাশিম আমলাও কুকের মতোই ব্যতিক্রম, ক্যারিয়ার গড় যেখানে ৪৭.৩, এশিয়ায় তার গড় সেখানে ৫৯.৫২। তবে ডিন এলগার এবং ফাফ ডু প্লেসির এশিয়ায় ট্র্যাক রেকর্ড ভালো নয়, দুজনের ক্যারিয়ার গড় (৪০.৩ ও ৪২.১) এর সাথে এশিয়ায় গড়ের (২৪.২৯ ও ২২.৩৮) বিস্তর ফারাক।

স্রেফ স্মিথ নন, অধিকাংশ নন-এশিয়ান ব্যাটসম্যানের গড় এশিয়ায় কমে আসে! Image Source : Sport360

এশিয়ান এবং নন-এশিয়ান ভাগ করার কারণটা খুবই সাধারণ, এশিয়ার বাইরে সাধারণত পেসারদের জন্য এবং এশিয়ায় স্পিনারদের জন্য সহায়ক উইকেট থাকে। দেখাই যাচ্ছে, নিজেদের পরিচিত কন্ডিশন ছেড়ে অন্যরকম কন্ডিশনে যাওয়ামাত্রই ব্যাটসম্যানদের গড় কমে যাচ্ছে, মাত্র অল্প কয়েকজন ব্যতিক্রম ছাড়া। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, ব্যাটিংয়ের স্ট্যান্ডার্ড মাপার সময় এশিয়ান কন্ডিশনকে স্রেফ উপেক্ষা করা হয়, উপমহাদেশে তো আরও বেশি। এই কথা থেকে আসে আরেকটি কথা, সেটি হচ্ছে পিচের।

দীর্ঘদিন ধরেই ভারত ও শ্রীলংকা ঘরের মাঠে টেস্ট সিরিজে ব্যবহার করছে এমন স্পিনিং উইকেট, যা পঞ্চম দিন দূরের বাপার, তৃতীয় কিংবা দ্বিতীয় দিনেই পিচে ধূলো উড়তে থাকে। ২০১৬ সালের ইংল্যান্ড সিরিজ থেকে এই কৌশল অবলম্বন করা শুরু করেছে বাংলাদেশও, এই পথেই হার মেনেছে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া; ধবলধোলাই হয়েছে উইন্ডিজ। কিন্তু সেই পথেই নাক সিটকাচ্ছেন অনেকে, বিশেষত উইন্ডিজের সাথে চার ফ্রন্টলাইন স্পিনার খেলানোর পর। ক্রিকেট খেলার যে ‘স্পিরিট’, সেটি নাকি বিঘ্নিত হচ্ছে। অথচ, গ্রিন টপ কিংবা ভয়ংকর গতিময় পিচে চার সিমার খেলানো নাকি বৃদ্ধি করে ক্রিকেটের সৌন্দর্য! ব্যাপারটা হচ্ছে, যদি আউটসুইঙ্গারে ব্যাটসম্যান বিট হয়ে পরের বলে কভার ড্রাইভে চার মারেন, সেটি যেমন ক্রিকেটের সৌন্দর্য, তেমনি স্পিনে বিট হয়ে পরের বলে কাট করে মারা চারটাও কোনো অংশে কম সুন্দর নয়। তাহলে আবার ফিরে যেতে হচ্ছে সেই প্রশ্নে, এই রকম অদ্ভুত সমালোচনা কেন? কেন এরকম দ্বিভাব?

শুধু এরকম ঘাসে ঢাকা পিচই কী ব্যাটসম্যানশিপ বিচারের মানদণ্ড? Image Source : Cricket Australia

দিনশেষে ক্রিকেট একটি খেলা, যেখানে জেতাটাই মূল লক্ষ্য। এবং সেখানে খেলার নিয়ম এবং নৈতিক মূল্যবোধের ভেতরে থেকে জেতার জন্য যা করা যায় সবই ঠিক। উইন্ডিজ চাইলেই পেস কোয়ার্ট্রেট নামিয়ে ব্যাটসম্যানদের ক্রমাগত বাউন্সার দিতে পারে, ভারত চাইলেই চার স্পিনার নিয়ে ব্যাটসম্যানদের চোখে সর্ষেফুল দেখাতে পারে। এর সাথে ক্রিকেটের সৌন্দর্য কিংবা স্পিরিটের সম্পর্ক সামান্যই, ক্রিকেট মাঠে কেউ হারতে নামে না। তবে প্রশ্নের উত্তর এখনও আসেনি, কেন এশীয় সবকিছুর ব্যাপারে এত ঔদাসীন্য?

কারণটা খুব সহজ, এশিয়ায় ক্রিকেট খেলা দেশগুলো সবই ছিলো ইংরেজ শাসনাধীন, ক্রিকেটের আগমন এই অঞ্চলে তাদের হাত ধরেই। আর এ সময়ে এ দেশে গড়ে উঠেছে পাশ্চাত্যের সবকিছুকেই বাহবা দেবার একটি প্রবৃত্তি, যা রয়ে গিয়েছে এখনও। এবং ক্রিকেটে উপমহাদেশীয় দেশগুলোর উত্থান বেশ পরে, বাংলাদেশ তো বলতে গেলে এখনও শিশু। শ্রীলংকা সবে কিশোর, ভারত-পাকিস্তান স্রেফ নিজেদের পায়ের নীচের মাটি শক্ত করেছে। এহেন অবস্থায়, এই অঞ্চলের ক্রিকেট সংস্কৃতিকে গুরুত্ব না দেওয়াটাই বরং স্বাভাবিক, আর এজন্যই আমরা সবকিছুর মাপকাঠি হিসেবে ধরে নিয়েছি পাশ্চাত্যের ফাস্ট বোলিং বান্ধব কন্ডিশনকে। আমাদের মধ্যে যে পশ্চিমা সবকিছুকেই ‘নৈবঃচ নৈবঃচ’ করার প্রবণতা, সেই কারণেই এশিয়ান সবকিছুর প্রতি আমাদের অবহেলা।

এরকম স্পিন মাইনফিল্ডেও হয় ব্যাটসম্যানদের ‘অগ্নিপরীক্ষা’! ; Image Source : Cricket Australia

এজন্য যেকোনো উঠতি এশিয়ান ব্যাটসম্যান দেখলেই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, “সে কি এশিয়ার বাইরে ভালো করতে পারবে?” কিন্তু নন-এশিয়ান কারও জন্য আমাদের মাথায় আসে না, “সে কি এশিয়ায় ভালো করতে পারবে?” আমাদের তাই ওয়েলিংটনের বাতাসে মাথা বরাবর ছুটে আসা বাউন্সার ভালো লাগে, কিন্তু চেন্নাইয়ে লেগ স্ট্যাম্পে পিচ করে অফ স্ট্যাম্প ছুঁয়ে যাওয়া ক্লাসিক্যাল অফ স্পিনিং ডেলিভারি নয়। ভারত ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র হয়ে ওঠায় পুরো ক্রিকেট বিশ্ব অবশেষে বুঝতে শুরু করেছে, স্পিন বোলিং বা সেটির সহায়ক উইকেট ক্রিকেটের জন্য কোনো অংশেই কম মূল্যবান নয়। এটাই সময় আমাদেরও বোঝার, ক্রিকেটটা স্রেফ পাশ্চাত্যের না, প্রাচ্যেরও। সুতরাং এখানে মাপকাঠি স্রেফ পশ্চিম নয়, পূর্বও।

কারণ, পূর্ব-পশ্চিম মিলেই বিশ্ব হয়, স্রেফ একটি দিয়ে হয় একটি অসম্পূর্ণ নকশা।

This Bangla article speaks about the weird fact of considering only seam friendly pitches as an acid test of batsmans, where both spinning and seaming tracks should be considered. 

Feature Image : Cricket Australia

Related Articles

Exit mobile version