৯০ মিনিট পেরিয়ে অতিরিক্ত চার মিনিটের শেষ মিনিট চলছে। স্নাইডারের ডান পায়ের ফ্লিকে আর্জেন্টিনার ডি-বক্সে বিপদজনক জায়গায় বল পেয়ে গেলেন আরিয়েন রোবেন। নেদারল্যান্ডের টানা দুই বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলার সামনে বাধা হয়ে তখন ৫ ফুট দূরে থাকা আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক সার্জিও রোমেরো। কিন্তু তড়িৎগতিতে পিছন থেকে এক দুর্দান্ত ট্যাকলে আর্জেন্টিনাকে বাঁচিয়ে দিলেন ট্যাকলমাস্টার হাভিয়ের মাচেরানো। পরবর্তীতে ডাচদের টাইব্রেকারে হারিয়ে ফাইনাল ও খেলে আলবিসেলেস্তে বাহিনী। টুর্নামেন্টসেরা হয়েছিলেন আর্জেন্টাইন লিওনেল মেসি কিংবা আর্জেন্টিনার অধিনায়কের বাহুবন্ধনীও ছিলো তার হাতে। কিন্তু একজন আর্মব্যান্ডবিহীন ক্যাপ্টেন মাচেরানো ছাড়া আর্জেন্টিনা কি মারাকানার ফাইনালে আদৌ খেলতে পারত?
এই জায়গাটিতেই আর্জেন্টাইনরা স্বার্থপর। ফরোয়ার্ড কিংবা মিডফিল্ডার বন্দনায় মেতে উঠলেও অন্য খেলোয়াড়রা আন্ডাররেটেডই থেকে যান সবসময়। প্রতিভা তৈরিতে আর্জেন্টিনা সবসময়ই শীর্ষস্থানীয় দেশ। আজকের মেসি-দিবালা থেকে শুরু করে ম্যারাডোনা, বাতিস্তুতা, রিকেলমেসহ আরো বহু প্রতিভার জন্ম এই ল্যাটিন দেশ থেকে। অথচ এদের পাশাপাশি সেখানে জন্ম নিয়েছেন দিয়েগো সিমিওনে, সার্জিও বাতিস্তা কিংবা মাচেরানোর মতো খেলোয়াড়রাও। যাদের অবদান কম নয়, বরং কিছুক্ষেত্রে বেশিই। মাচেরানো ছাড়া ২৪ বছর পর আর্জেন্টিনার ফাইনাল খেলা কি সম্ভব হতো? কিংবা ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জয়ে তরুণ সার্জিও বাতিস্তার অবদান কয়জন মনে রেখেছে? এমনকি আর্জেন্টিনার জেতা সর্বশেষ শিরোপা ১৯৯৩ কোপা আমেরিকা জয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন পাঁচ নাম্বার জার্সিতে খেলা দিয়েগো সিমিওনে।
পাঁচ নাম্বার জার্সিতে খেলা এই আর্জেন্টাইনরাই বারবার ভিত্তি গড়ে দিয়েছে আর্জেন্টিনার। যদিও মাচেরানো আর্জেন্টিনায় খেলেছেন ১৪ নাম্বার জার্সি পড়ে। রিভারপ্লেট থেকে উঠে আসায় বোকা জুনিয়র্সের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে ৫ নাম্বার জার্সিটি পড়েননি মাচেরানো। সাধারণত বোকা জুনিয়র্সের খেলোয়াড়েরা জাতীয় দলে ৫ নাম্বার জার্সি পড়ে থাকেন। একই কারনে অনেক খেলোয়াড়ই ৫ নাম্বার জার্সিটি না পড়ে ১৪ নাম্বার জার্সি বেছে নিয়েছিলেন। তবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যগতভাবে তারা একই দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন আর্জেন্টিনার হয়ে। মাচেরানো ১৪ নাম্বার জার্সি পড়লেও এই সময়টুকুতে মাচেরানোরকে ৫ নাম্বার জার্সি পড়েই সঙ্গ দিয়েছেন লুকাস বিলিয়া। এই দুইজন মিলেই আর্জেন্টিনার রক্ষণদূর্গকে করেছেন আরো শক্তিশালী। টানা তিন ফাইনালে হারলেও এই তিন ম্যাচের ৩৬০ মিনিটে আর্জেন্টিনা হজম করেছে মাত্র একটি গোল। বিশ্বকাপ ফাইনালে করা মারিও গোৎজের ১১৪ মিনিটের সেই গোলটি। নিজেদের কাজ ঠিকঠাকভাবে করেও শিরোপার দেখা তারা পাননি স্ট্রাইকারদের শিশুসুলভ মিস আর ব্যর্থতার জন্যই।
আর্জেন্টিনার ট্র্যাডিশনাল ট্যাকটিকসে দুইজন ডিফেন্সিভ ঘরানার মিডফিল্ডারের সাথে সবসময়ই তিনজন মিডফিল্ডার খেলে এসেছে। আর এই তিনজনের মাঝেই পাঁচ নাম্বার জার্সির দায়িত্বও ছিল বেশি। পুরো খেলার তাল ও লয় ঠিক করতেন তারাই। পজেশন ধরে রাখাই ল্যাটিন আমেরিকান ফুটবলশৈলী। আর এক্ষেত্রে ৫ নাম্বার খেলোয়াড়টিকে পুরো মাঠজুড়ে বল ভাগ করে দেওয়া কিংবা নিচ থেকে আক্রমণ তৈরিতে বিরাট ভূমিকা পালন করতে হয়। অনেকটা ডায়মন্ড আকৃতির ৪-৪-২ হয়ে যাওয়া ফর্মেশনে গুরুদায়িত্ব বর্তায় মাঝের খেলোয়াড়টির উপরেই। আর সেহেতু সামনের তিন মিডফিল্ডার মূলত আক্রমনেই মনোযোগ দিতে সক্ষম হয়। আর এই পজিশনে আর্জেন্টিনার তৈরি করা খেলোয়াড়ের সংখ্যা নেহায়েতই কম নয়। এলিস মরিনো, ফার্নান্দো রেডোন্ডো, ফার্নান্দো গাগো, অ্যান্তোনিও র্যাটিন, দিয়েগো সিমিওনে, এস্তেবান ক্যাম্বিয়াসো, হাভিয়ের মাচেরানো, লুকাস বিলিয়া, মাতিয়াস আলমেইদা কিংবা হালের লিয়ান্দ্রো প্যারেদেস।
এইসব খেলোয়াড়দের সামর্থ্য নিয়ে কখনোই সংশয় ছিল না। এদের ক্লাবের দিকে তাকালেই আপনি টের পাবেন তা। গাগো ও রেডোন্ডো খেলেছেন রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে। সিমিওনেও মাঠ মাতিয়েছেন অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ, সেভিয়া ও ইন্টার মিলানের হয়ে। মাচেরানোর লিভারপুল, বার্সেলোনা কিংবা বিলিয়ার লাৎসিও, এসি মিলান কিংবা ক্যাম্বিয়াসোর রিয়াল মাদ্রিদ ও ইন্টার মিলানই বলে দেয় ক্লাবের হয়ে তাদের পারফরম্যান্স। রেডোন্ডো রিয়াল মাদ্রিদের এক্স-ফ্যাক্টর ছিলেন। যার কারণে তার বিদায়ে ২০০০ সালে ৫০ মিলিয়ন খরচ করে রিয়াল মাদ্রিদ দলে ভেড়ায় ম্যাকলেলে ও ফ্লাভিও কনসেইকাওকে। সেই শূন্যস্থান পূরন করার সুবাদেই পরবর্তীতে ‘ম্যাকলেলে রোল’ শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে উঠে। আদতে তা হওয়া উচিৎ ছিল ‘রেডোন্ডো রোল’।
ল্যাটিন আমেরিকান ফুটবলার হওয়াতে ট্যাকটিকালি ডিফেন্সিভ ঘরানার হলেও তাদের ছিলো বিচক্ষণতা। কারন ল্যাটিন ফুটবলারদের ভেতর সহজাত ড্রিবলিং এর ব্যাপারটি থাকে একেবারে ছোটো থেকেই। তাই অন্যান্য ইউরোপিয়ান ডিএম থেকে তারা বেশ আলাদা। মাচেরানো বিখ্যাত ছিলেন তার ট্যাকল ও লেগে থাকার জিদের জন্য। বার্সেলোনায় থাকার সময় খুব কম সময়ই প্রতিপক্ষের ফাইনাল থার্ডে দেখা গিয়েছে মাচেরানোকে। তবে লিভারপুলের সময়কালে মাচেরানো বল রিকভার করে আক্রমণ তৈরি করতেও পটু ছিলেন। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে বল হারিয়ে তা রিকভার করে টেনে নিয়ে অ্যাসিস্ট করেছিলেন রায়ান বাবেলকে, যার জন্য ২-১ গোলে সেবার বিখ্যাত এক জয় পেয়েছিল অল-রেডরা। আর মাচেরানোর সেই দৌড় মনে করিয়ে দেয়, কীভাবে আর্জেন্টাইনরা এই রোলটি খেলে থাকে; সংকল্প, শ্রেষ্ঠত্ব ও আবেগ দিয়ে।
তবে সবার তুলনায় ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা নিয়ে এসেছিলেন ফার্নান্দো রেডোন্ডো। রিয়াল মাদ্রিদের সর্বকালের সেরা বিদেশি একাদশেও জায়গা করে নিয়েছেন এই আর্জেন্টাইন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগ ম্যাচে ব্যাকফ্লিকে রাউলকে করা অ্যাসিস্টেই বোঝা যায়, বলের উপর তার নিয়ন্ত্রণ। আরেক ইন্টার ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার এস্তেবান ক্যাম্বিয়াসোও ছিলেন একই ঘরানার। বলের উপর দুর্দান্ত নিয়ন্ত্রণই এদের সবার মূল হাতিয়ার ২০০৬ বিশ্বকাপে সার্বিয়ার সাথে ২৬ পাসের করা গোলটির আগে স্যাভিওলাকে দেওয়া পাসটি আপনি শুধু বিশ্বমানের কোনো ফরোয়ার্ড থেকেই আশা করতে পারবেন। তাই আর্জেন্টিনার একেকজন হোল্ডিং মিডফিল্ডাররাও ছিলেন ম্যাজিশিয়ান।
২০০৬ বিশ্বকাপের আর্জেন্টাইন স্কোয়াডকে ধরা হয় বিগত দুই দশকের সবচেয়ে পরিপূর্ণ দল। সেই দলে রিকেলমে, স্যাভিওলা, আইমার, ক্রেসপো, তেভেজ কিংবা তরুণ মেসি থাকলেও দলের ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করেছিলেন মাচেরানো ও ক্যাম্বিয়াসো। ক্যাম্বিয়াসোর বিদায়ের পর সেই জায়গায় এসেছেন লুকাস বিলিয়া। তবে ২০০৬ সালে যেমন একই সাথে ফিজিক্যালি শক্ত ও বিচক্ষণ দুই তরুণ পেয়েছিল আর্জেন্টিনা; সেটি আর পরবর্তীতে একই সাথে আর পেয়ে হওয়া ওঠেনি। তবে বর্তমানে স্কালোনির দলের দিকে তাকিয়ে আবার আশাবাদী হয়ে উঠতে পারে আর্জেন্টাইন ও আলবিসেলেস্তে সমর্থকেরা।
বর্তমান দলের দিকে তাকালেও দেখা যায় যে, এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে প্রস্তুত লিয়ান্দ্রো প্যারেদেস আর রদ্রিগো ডি পল। ফার্নান্দো রেডোন্ডোকে ধরা হয়ে থাকে আর্জেন্টিনার ৫ নাম্বার জার্সি পড়া সবচেয়ে প্রতিভাবান খেলোয়াড়। সেই রেডোন্ডোই সম্প্রতি বলেছেন, প্যারেদেস বর্তমান দলে এই জার্সি পড়তে প্রস্তুত। তবে এই পজিশনে আর্জেন্টিনার প্রতিভার সংকট কখনোই হয়নি। এদের ছাড়াও আয়াক্সের লিসান্দ্রো মার্টিনেজ কিংবা রিভারপ্লেটের এজেকুয়েল প্যালাসিওস চোখ কেড়ে নিয়েছেন বড় বড় ক্লাবগুলোর। লুকাস রোমেরোকেও ধরা হয় দিয়েগো সিমিওনের তরুণ ভার্সন হিসেবে। ২০০৬-এর মতো মাঝমাঠে আবার স্থিতি আনতে তারা সক্ষম হবে কি না, তা সময়েই বলে দিবে।
৫ নাম্বার ও ১০ নাম্বার জার্সি। এই দুই পজিশনের সাথে আলবিসেলেস্তেদের সখ্যতা অনেক পুরনো। এই দুই ধরণের খেলোয়াড়দের সংকট কখনো পড়েনি আর্জেন্টিনায়। তবে ১০ নাম্বার থেকে ৫ নাম্বাররা ব্রাত্য থেকেছেন বেশিরভাগ সময়েই। মাচেরানোর চেয়ে লিওনেল মেসি পেয়েছেন বেশি ভালবাসা; একই কথা প্রযোজ্য সিমিওনে এবং বাতিস্তুতার ক্ষেত্রেও। কিন্তু দলের সাফল্যে কিছু কিছু জায়গায় এরা ছাড়িয়ে গেছেন সামনেরজনকেও। নীরবে-নিভৃতে পিছনে খেলে যাওয়া এই খেলোয়াড়দের প্রতি মোহাবিষ্টতা ও আচ্ছন্নতা রয়েছে আর্জেন্টাইনদের। তরুণ এই প্রতিভাবানদের হাত ধরে কোনো বড় শিরোপা জিতলে হয়তো ভালবাসার বহিঃপ্রকাশও দেখা যাবে নিকট ভবিষ্যতে।
খেলাধুলার চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
ফুটবল নিয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ