বাংলাদেশ ক্রিকেটের উত্থানকে কয়েক ভাগে ভাগ করা সম্ভব। একেবারে শুরুর সময় থেকে শুরু করে, ১৯৯৯ সালে আইসিসি ট্রফি জয়, তারপর টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া। সেখান থেকে আবার এক রকম অন্ধকারে ডুবে যাওয়া। আবারও উঠে দাঁড়ানো ২০০৭ সাল পর্যন্ত। এভাবেই নানান প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এখনও আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন সত্যির পথে এগোচ্ছে এই বাংলাদেশ।
সেক্ষেত্রে সেই গর্ডন গ্রিনিজ থেকে শুরু করে কদিন আগে ‘সাবেক’ বনে যাওয়া চান্দিকা হাতুরুসিংহে; সব কোচের অবদান আছে আজকের পর্যায়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে নিয়ে আসার। একেক কোচ যেন একেকটা মন্ত্র ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা-সাকিব আল হাসানদের মনে। সেগুলোকেই পুঁজি করে আজ বাংলাদেশ ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া-ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকার মতো শক্তিশালী দলগুলোর বিপক্ষে হার হামেশা জয় তুলে নিচ্ছে। কোচদের অবদান যেন ভোলার নয়, তেমনই কিছু কোচের কথা ভোলাও অসম্ভব।
হ্যাঁ, নেতিবাচক অর্থেও কিছু কোচ আমাদের মনে ঠাই করে নিয়েছেন তাদের অদক্ষতা কিংবা দলকে আরও খারাপ অবস্থা ঠেলে দেওয়ার কারণে। যারা সুফল এনেছেন তাদেরকে তো মনে রাখতেই হবে। সবাই হয়তো হাতুরুসিংহের মতো শক্তিশালী বাংলাদেশকে পাননি। বরং শক্তিশালী বানিয়ে গেছেন। তার মধ্যে অন্যতম ডেভ হোয়াটমোর, যার হাত ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের নতুন পদচারণা শুরু করেছিল বাংলাদেশ, যার নেতৃত্বে সাকিব-তামিমদের আজকের শীর্ষ অবস্থানে আসা। তার মন্ত্রে বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশকে নতুনভাবে চিনেছে সবাই। তিনি অস্ট্রেলিয়ার ডেভ হোয়াটমোর। বাংলাদেশ দলে কাজ করেছেন ২০০৩-০৭ সাল পর্যন্ত, তৈরি করে গেছেন প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।
১
ততদিনে এডি বারলো বাংলাদেশ ছেড়েছেন অসুস্থতার কারণে। ট্রেভর চ্যাপেল, মহসীন কামালরা কিছুই করতে পারলেন না খালেদ মাহমুদ সুজন, হাবিবুল বাশার সুমনদের জন্য। উল্টো আরও পথ হারিয়েছে লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। মাত্র টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া একটি দল ৩ বছরে পা রেখেছে। কিন্তু টেস্ট তো দূরে থাক, ওয়ানডেতেই ধারাবাহিক হারের কারণে দুনিয়া জুড়ে বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস কেড়ে নেওয়ার দাবি উঠল। সমর্থকদের মধ্যেও ‘সব গেল, সব গেল’ রব। এমন সময় রবিন হুডের মতো ডেভ হোয়াটমোরের বাংলাদেশে আসা। ততদিনে তিনি বিশ্ব ক্রিকেটে সুপরিচিত, জনপ্রিয় একটি নাম। কারণ তার হাতেই ১৯৯৬ সালে শ্রীলঙ্কা বিশ্বকাপের শিরোপা জেতে।
সেই ডেভের অধীনে ক্রিকেটাররাও হয়তো শুরুতে ভাবতে পারেননি যে ভালো কিছু হতে পারে। কারণ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হারের স্বাদ নিতে নিতে মনটাই বোধ হয় বিস্বাদ হয়ে গিয়েছিল সুজনদের। বাংলাদেশে এলেন হোয়াটমোর। বলে দিলেন, ক্রিকেটারদের মধ্যে জয়ের অভ্যেস গড়তে এসেছেন তিনি। শ্রীলঙ্কা থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন। বলে রাখা ভালো, তিনি অস্ট্রেলিয়ান হলেও শ্রীলঙ্কান বংশোদ্ভূত। শৈশবটাও কেটেছে সেখানেই। বাংলাদেশের কোচ হয়ে দায়িত্ব নিতে এসেছিলেন শ্রীলঙ্কা হয়েই। ঢাকার বিমানে ওঠার আগে কলোম্বোয় বসে বলেছিলেন, “আমার মনে হয় আমার কিছু একটা দেওয়ার আছে (বাংলাদেশকে)। আমি আমার শতভাগ দিতে চাই। অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ নিতে যাচ্ছি আমি। সবচেয়ে বড় কথা, চ্যালেঞ্জ নিতে আমি ভালোবাসি।”
আগে থেকেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দল সম্পর্কে পড়াশোনা করে নিয়েছিলেন। তাই তো দলে যে কিছু হিরে-মানিক আছে, তা উপলব্ধি করেছিলেন। সেটা নিয়েও বলেছিলেন, “দলে দারুণ কিছু মেধাবী সদস্য আছে। আমি মনে করি আগে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। আমি গিয়ে সেটাই আগে করতে চাই।”
২
বাংলাদেশে এলেন হোয়াটমোর। ততদিনে বাংলাদেশ টানা ৪০ ম্যাচ হেরেছে। এককথায় লজ্জার রেকর্ড। সেখানে ডেভের মতো একজন হাইপারফরম্যান্স কোচ এসে কতটা সুবিধা করবেন তা নিয়েও বিশ্ব গণমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়েছিল। কিন্তু এই আধা অস্ট্রেলিয়ান-আধা শ্রীলঙ্কান তাল হারালেন না। সামলাতে থাকলেন ধীরে-সুস্থে।
মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের দায়িত্বে তার প্রথম মিশন ছিলো নিজের দেশ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। দুটি টেস্ট ছিল। দুটিতেই হেরেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু দ্বিতীয় টেস্টে দারুণ লড়াই করেছিল ছেলেরা। ওয়ানডেতেও স্টিভ ওয়াহ-অ্যাডাম গিলক্রিস্টদের সেই দলকে খানিকটা হলেও বিপদে ফেলেছিল। তারপর মুলতানে পাকিস্তানের বিপক্ষে জিততে জিততে হেরে গেল সুজনের দল। কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছেড়েছিলেন বর্তমানে জাতীয় দলের এই ম্যানেজার। রশিদ লতিফের প্রতারণা আর ইনজামাম-উল-হকের সেঞ্চুরিটা না হলে জয় পেতো বাংলাদেশই।
শেষপর্যন্ত ২০০৪ সালে এসে প্রথম জয়ের দেখা পেল বাংলাদেশ। টানা ৪৭টি ম্যাচ হারের পর জিম্বাবুয়ে যেন প্রতিপক্ষ নয়, আশীর্বাদ হয়েছিল। হারারেতে ওই জয় ছিল টেস্ট স্ট্যাটাসের পর বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রথম জয়।
তারপর থেকে জয়-পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে হেঁটেছে বাংলাদেশ। তার সময়ে দলে জায়গা পেয়েছেন তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসানরা। মানজারুল ইসলাম রানা ছিলেন প্রিয় ছাত্র। মাশরাফি বিন মুর্তজাও তাই। নিজের রণ পরিকল্পনার মধ্যে অন্যতম দুটির একটি ছিল বাঁহাতি ক্রিকেটারদের বেশি সুযোগ দেওয়া ও অলরাউন্ডার নেওয়া। সে কারণেই ২০০৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলে বাঁহাতি ক্রিকেটারদের প্রাধান্য দেখা গেছে।
তার অন্যতম আবিষ্কার ছিল আফতাব আহমেদ। রানাকে নিজের ছায়ায় আগলে রেখেছিলেন রানার মৃত্যুর আগপর্যন্ত। ডেভ হোয়াটমোরের সময়ে বাংলাদেশে প্রথম হাই পারফরম্যান্স ইউনিট (এইচপি) শুরু হয়। সেখান থেকে জাতীয় দলে ডাক পাওয়া প্রথম ক্রিকেটার ছিলেন শাহরিয়ার নাফীস। খালেদ মাসুদ পাইলটের মতো অভিজ্ঞ উইকেটরক্ষককে সরিয়ে কিশোর মুশফিকুর রহিমকে সুযোগ করে নেওয়ার ‘ঝুঁকি’ নিয়েছিলেন তিনি। হয়তো আজকের বাংলাদেশ দল টের পাচ্ছে, হোয়াটমোরের ভাবনাটা একেবারে বিফলে যায়নি। মুশফিক এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হয়ে উঠেছেন। সঙ্গে উইকেটের পিছনে দায়িত্বটা ভালোভাবেই পার করছেন।
৩
২০০৫-২০০৬; এই সময়ে হোয়াটমোর বাংলাদেশকে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম জয় এনে দিয়েছেন। সেই ম্যাচে মোহাম্মদ আশরাফুলের সেঞ্চুরি হয়তো এখনও সুস্বাদু খাবারের মতোই সমর্থকদের মুখে লেগে আছে। ফতুল্লায় অজিদের বিপক্ষে টেস্টেও রিকি পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়াকে প্রায় ধরাশায়ী করে ফেলেছিল হাবিবুল বাশার সুমন-মোহাম্মদ রফিকরা।
সাদা পোশাকের টেস্টের স্ট্যাটাস পাওয়ার সাত বছরের মাথায় ২০০৬ সালে এই ফরম্যাটে জয় পায় বাংলাদেশ। জিম্বাবুয়েকে টেস্টে হারায় তারা। সেদিন থেকে টেস্টের ব্যর্থতা একটু একটু করে কমতে থাকে, ছোট হতে থাকে সমালোচনার মোমবাতি।
হোয়াটমোর চলে যান ২০০৭ সালে। ওই বছরেই উইন্ডিজে বিশ্বকাপ খেলে বাংলাদেশ। হালে হেসেখেলে অনেক শক্ত দলকেই বাংলাদেশ হারাচ্ছে। কিন্তু ওই বিশ্বকাপ যেন বাংলাদেশকে শক্তিশালী দল হওয়ার প্রথম দরজা হয়েছিল। সেবার বাংলাদেশ প্রথম রাউণ্ডে ভারতকে হারায়। প্রথমবারের মতো নিশ্চিত করে সুপার সিক্স। সেখানে গিয়ে হারায় দক্ষিণ আফ্রিকাকে। যদিও আয়ারল্যান্ডের কাছে হেরে সেই উৎসবে বাংলাদেশ দল নিজেরাই ভাটা ফেলেছিল।
ওই বছরেই বিদায় নেন ডেভ হোয়াটমোর। তাকে অনেক বলে কয়ে একটি সিরিজ রাখা গিয়েছিল। কিন্তু তারপর আর থাকতে চাননি। বাংলাদেশের পর পাকিস্তান ও জিম্বাবুয়ের হয়ে কাজ করেছেন। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) কলকাতা নাইট রাইডার্সেরও কোচ ছিলেন তিনি।
কিন্তু এই লোকটির মাথায় হুট করেই ক্ষিদে চাপল, তৃণমূল ক্রিকেটারদের নিয়ে কাজ করবেন। যেই ভাবা, সেই কাজ। ২০১৭ সাল থেকে ভারতের রঞ্জি ট্রফির দল কেরালার সঙ্গে মাস ছয়েক কাজ করেছেন। কোচিতে নিজের ফাউন্ডেশনের সঙ্গে কাজ করছেন।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছেড়ে আসার প্রসঙ্গে হোয়াটমোর বলেছেন, “২৩ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে কাজ করার পর আমার মনে হয়েছে এই অধ্যায়টা শেষ করার সময় হয়েছে। এখন আমার ক্রিকেটের উন্নয়নে কাজ করা উচিত।”
ডেভের বয়স এখন ৬৪ বছর। বাংলাদেশের মতো অনেক দলকে তিনি পথ দেখিয়েছেন। আমৃত্যু হয়তো সেই ডেভের হাতে পথ দেখবে আরও অনেক দল, শত শত ক্রিকেটার।
ফিচার ইমেজ- Scroll.in