১
গত ম্যাচে স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বকাপের প্রাণ ফিরিয়ে এনেছিল শ্রীলঙ্কা। আফগানিস্তানও ম্যাচের সিংহভাগ সময় ম্যাচের লাগাম নিজেদের কাছে রেখে আসরে টানা দুই ম্যাচে অঘটন ঘটানোর সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত ধোনি, কোহলিদের অভিজ্ঞতার কাছে পরাজিত হয় বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের নিয়ে গড়া আফগানিস্তান দল।
জাসপ্রিত বুমরাহ ৪৯ তম ওভারে মাত্র পাঁচ রান দিলে জয়ের জন্য শেষ ওভারে আফগানিস্তানের প্রয়োজন পড়ে ১৬ রানের। অসাধারণ ব্যাট করতে থাকা মোহাম্মদ নবীকে আটকে রাখার দায়িত্ব পড়ে ভুবেনেশ্বর কুমারের ইনজুরির কারণে একাদশে সুযোগ পাওয়া শামির হাতে। ওভারের প্রথম বলে ইয়র্কার দিতে গিয়ে লো ফুল-টস দিয়ে বসেন শামি। ছন্দে থাকা নবী ভুল করেননি, লং-অন দিয়ে সজোরে হাঁকিয়ে বল সীমানা ছাড়া করে চার রান আদায় করে নেন। শেষ পাঁচ বলে জয়ের জন্য তিন উইকেট হাতে রেখে আফগানদের লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ১২ রানের। ওভারের দ্বিতীয় বলে নবী মিড-উইকেটে খেলে সিঙ্গেল নিতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ অপরপ্রান্তে থাকা উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান ইকরাম আলি খিল ব্যাটে-বলে সংযোগ ঘটাতে ব্যর্থ হচ্ছিলেন।
দ্রুতগতির ফিল্ডার হিসেবে বিরাট কোহলির বেশ সুনাম রয়েছে। তাই তো ইনিংসের শেষদিকে বোলারকে পরামর্শ দেওয়ার দায়িত্ব ধোনির উপর ছেড়ে দিয়ে তিনি বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিং করছিলেন। ধোনি বরাবরের মতো তার পরামর্শে সফল হয়েছিলেন। ধোনির সাথে কথা বলার পর তিন বলে তিন উইকেট শিকার করে ভারতকে ১১ রানের জয় উপহার দেওয়ার পাশাপাশি চেতন শর্মার পর দ্বিতীয় ভারতীয় বোলার হিসেবে বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিক করার গৌরব অর্জন করেন।
২
সাউদাম্পটনে বিশ্বকাপের ২৮ তম ম্যাচে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ভারতীয় অধিনায়ক বিরাট কোহলি। আগের ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বেধড়ক পিটুনি খাওয়া আফগানিস্তানের বোলাররা ভারতের বিপক্ষে শুরু থেকেই দুর্দান্ত বোলিং করেন। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা রোহিত শর্মাকে দুর্দান্তে এক ডেলিভারিতে বোল্ড করে আফগানিস্তানকে প্রথম ব্রেক-থ্রু এনে দিয়েছিলেন মুজিবুর রহমান। রোহিতের বিদায়ের পর ক্রিজে আসেন বিরাট কোহলি। লোকেশ রাহুলকে সাথে নিয়ে দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে ৫৭ রান যোগ করেছিলেন তিনি। দেখে-শুনে ব্যাট করতে থাকা রাহুল ব্যক্তিগত ৩০ রানের মাথায় নবীর বলে রিভার্স-সুইপ করতে গিয়ে শর্ট থার্ড ম্যানে জাজাইয়ের হাতে ধরা পড়ে সাজঘরে ফেরেন।
রাহুলের বিদায়ের পর তৃতীয় উইকেট জুটিতে বিজয় শংকরের সাথে ৫৮ রান যোগ করেছিলেন কোহলি। এই জুটিই ছিল ম্যাচে সর্বোচ্চ রানের জুটি। ৫৮ রানের জুটিতে শংকরের অবদান ছিল ২৯ রান। তিনি ৪১ বলে ২৯ রান করে পার্টটাইম বোলার রহমত শাহর বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়েন। তার বিদায়ের পর কোহলিও বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেননি। নবীর দ্বিতীয় শিকারে পরিণত হয়ে সাজঘরে ফেরেন তিনি। দলের অন্যান্য ব্যাটসম্যানরা আফগান স্পিনারদের বিপক্ষে রান তুলতে হিমশিম খেলেও কোহলি বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে খেলে ৪৮ বলে অর্ধশতক পূর্ণ করার পর ৬৩ বলে ৬৭ রান করেন। ম্যাচে তিনিই একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে বলের সাথে পাল্লা দিয়ে বেশি রান করেছিলেন।
কোহলির বিদায়ের পর ইনিংসের মাঝপথে ধীরগতিতে ব্যাট করতে থাকেন ধোনি এবং কেদার যাদব। এই দুজন ৫৭ রান তুলতে খেলেন ৮৪ বল। ৫২ বলে মাত্র ২৮ রান তোলা ধোনির পরিকল্পনা ছিল স্পিনারদের ওভার শেষ হলে দুই পেসারের উপর আক্রমণ চালাবেন। তার পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করতে দেননি রশিদ খান। ধোনিকে স্ট্যাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলে ৫৭ রানের জুটি ভাঙেন তিনি। ধোনি তার ২৯৩ ইনিংসের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার স্ট্যাম্পড আউট হয়েছেন।
শেষদিকে কেদার যাদবের ৬৮ বলে ৫২ রানের ইনিংসের উপর ভর করে নির্ধারিত ওভার শেষে ভারত ৮ উইকেটে ২২৪ রান করে। ভারতকে অল্প রানে বেঁধে রাখার বড় কৃতিত্ব আফগান স্পিনারদের। পার্টটাইম স্পিনার রহমত শাহর পাঁচ ওভারসহ ম্যাচে আফগানিস্তানের স্পিনাররা ৩৪ ওভার বল করে ১১৯ রান খরচায় ৫ উইকেট শিকার করেন। প্রথম ব্রেক-থ্রু এনে দেওয়া মুজিব তার দশ ওভারে মাত্র ২৬ রান খরচ করেছিলেন। রশিদ খানও গত ম্যাচের দুঃস্বপ্ন ভুলে দশ ওভারে ৩৮ রান দিয়ে ১ উইকেট শিকার করেছিলেন। এছাড়া অভিজ্ঞ স্পিনার মোহাম্মদ নবী নয় ওভারে ৩৩ রান দিয়ে রাহুল এবং কোহলির দুটি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট তুলে নেন।
৩
ভারতের দেওয়া ২২৫ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে শুরু থেকেই সাবধানী ব্যাটিং করতে থাকে আফগান ওপেনাররা। আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান হিসেবে পরিচিত হযরতুল্লাহ জাজাই স্বভাববিরুদ্ধ ব্যাট করে ২৪ বলে ১০ রান করে শামির প্রথম শিকারে পরিণত হয়ে সাজঘরে ফেরেন। এরপর ক্রিজে আসেন আফগানদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান রহমত শাহ। তিনি অধিনায়ক গুলবাদিন নাইবের সাথে ৪৪ রানের জুটি গড়ে দলকে জয়ের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন।
নিজের দ্বিতীয় ওভারে নাইবের কাছে পরপর দুই বলে চার খাওয়া হার্দিক পান্ডিয়াই নাইবকে প্যাভিলিয়নের পথ দেখান। দলীয় ৬৪ রানে নাইব ৪২ বলে ২৭ রান করে ধৈর্য হারিয়ে পান্ডিয়ার বলে বল সীমানা ছাড়া করতে গিয়ে শংকরের হাতে ধরা পড়েন। তার বিদায়ের পর রহমত শাহ এবং হাশমতউল্লাহ শহীদি ভারতের দুই রিস্ট স্পিনার কুলদ্বীপ এবং চাহালকে বেশ ভালোভাবেই সামলেছিলেন। তবে রান তোলার দিক থেকে দুজনই ছিলেন অমনোযোগী। তারা ৪২ রানের জুটি গড়েছিলেন ৭১ বল মোকাবেলা করে।
ধীরগতিতে হলেও আফগানিস্তান জয়ের পথে এগিয়ে যাচ্ছিলো। দুই উইকেট হারিয়ে যখন তাদের সংগ্রহ ১০৬ রান তখনই আঘাত হানেন জাসপ্রিত বুমরাহ। বিশ্বের এক নাম্বার ওয়ানডে বোলার একই ওভারে দুই সেট ব্যাটসম্যান রহমত এবং শহীদির উইকেট তুলে নেন। তাদের বিদায়ের পর দলকে একাই টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন মোহাম্মদ নবী। মাঝখানে তাকে সঙ্গ দিয়েছিলেন নাজিবউল্লাহ জাদ্রান (২১) এবং রশিদ খান (১৪)। জয় থেকে ৩৫ রান দূরে থাকতে রশিদ খান আউট হলে মোহাম্মদ নবী একা বুমরাহ এবং শামির বল সামলাতে পারেননি। তাছাড়া অপর প্রান্তে থাকা ইকরাম আলি খিল ছিলেন বেশ নড়বড়ে।
শেষপর্যন্ত নিজেদের অনভিজ্ঞতা এবং ভারতের অভিজ্ঞতার কাছে হার মেনে যায় আফগানিস্তান। মাত্র ১১ রানের জন্য তারা এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় অঘটন ঘটাতে পারেনি। আফগানিস্তান তাদের প্রথম আট জুটির মধ্যে সাতটি জুটিতে ২০ অধিক রান করেছিল। কিন্তু একটিও ৫০ এর গণ্ডি টপকাতে পারেনি, যার দরুন জয়ের এত কাছে গিয়েও শেষ হাসি হাসা হয়নি তাদের। এর আগেও ভারতের বিপক্ষে জয়ের সুযোগ এসেছিল আফগানদের সামনে। সর্বশেষ এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে টাই করেছিল তারা।
বিশ্বকাপের শুরুতে ধারণা করা হয়েছিল ম্যাচ জমবে রান সংখ্যা তিনশো অতিক্রম করলে। কিন্তু সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছিল টুর্নামেন্টের প্রথমেই। মাঝপথে এসে দেখা যাচ্ছে যে ২৫০ রানের ম্যাচগুলোতেই বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে। গত ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২৩২ রান করেও জয় পেয়েছিল শ্রীলঙ্কা। ভারত বনাম আফগানিস্তানের দু’শো রানের ম্যাচটিও বেশ উপভোগ্য ছিল। আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয়ের মধ্য দিয়ে সেমিফাইনালের পথে এক পা রেখে দিলো ভারত। পাঁচ ম্যাচ শেষে চার জয় নিয়ে পয়েন্ট টেবিলের তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছে তারা। অন্যদিকে টানা ছয় পরাজয়ে টুর্নামেন্ট থেকে প্রথম দল হিসেবে অফিসিয়ালি বিদায় নিলো আফগানিস্তান।