সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান ডন ব্রাডম্যানের চোখে দেখা বাঁহাতি সেরা দুই ব্যাটসম্যানদের মধ্যে একজন গ্রায়েম পোলক, অন্যজন গ্যারি সোবার্স। গ্যারি সোবার্স ক্যারিবিয়ানদের দুটি শিরোপা এনে দিতে পারলেও গ্রায়েম পোলকের সেরকম কোনো সুযোগই তৈরি হয়নি। প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট শুরু করার আগেই ক্রিকেটের প্রতি তার ধৃষ্টতা ছিলো চোখে পড়ার মতো। মাত্র ৯ বছর বয়সেই স্কুল ক্রিকেটে প্রতিপক্ষের ১০ উইকেট নেওয়ার সাথে সাথে ব্যাট হাতে নিয়েছিলেন ১১৭ রান! আর মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রথমশ্রেণীর ক্রিকেটে শতক! এরই নাম গ্রায়েম পোলক! সবচেয়ে কম বয়সী ক্রিকেটার হিসাবে প্রথমশ্রেণীর ক্রিকেটে শতক হাঁকানো ক্রিকেটারের তালিকায় যার নাম ছিলো প্রায় ৩০ বছর।
মাত্র ২০ বছর বয়সেই প্রতিভাবান এই ক্রিকেটারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়। কিন্তু ৬ বছরের বেশি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে পারলেন না। ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা জুড়েই তার দেশ সাউথ আফ্রিকার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিষেধাজ্ঞা ছিলো। কিন্তু অসাধারণ থেকে জীবন্ত কিংবদন্তি হতে তার ঐ ৬ বছরই যথেষ্ট ছিলো।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে না পারার দায়টা তৎকালীন দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারকে চোখ বুজেই দিতে পারতেন। ১৯৭০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের বর্ণবাদ নীতির কারণে আইসিসি তাদেরকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করে দেয়। দলটি শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গ রাষ্ট্র হিসেবে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধেই খেলবে – দক্ষিণ আফ্রিকান সরকারের এ ঘোষণার বিরুদ্ধে আইসিসি এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।
উল্লেখ্য যে তৎকালীন দক্ষিণ আফ্রিকার ‘সাদা সরকার’ কোনো কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটারকে দলে সুযোগ দিতো না। শুধুমাত্র গায়ের রঙের জন্য অনেক প্রতিভাবান ক্রিকেটার কখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে পারেনি। ঘটনার সূত্রপাত হয় কালোদের লীগ ওয়েস্ট প্রভিন্সের কোনো ক্রিকেটার সাউথ আফ্রিকা জাতীয় দলে সুযোগ না পাওয়ার মধ্য দিয়ে। ঐ লীগে বেশ কয়জন প্রতিভাবান ক্রিকেটার শুধু কালো বলে কখনো শিরোনামেই আসতো না। তারা ঐ লীগ খেলতো শুধুমাত্র কালো বলে, কালোদের জন্য আলাদা লীগ হতো। পর্যাপ্ত মাঠ দেওয়া হতোনা, মাঠে প্রবেশের ক্ষেত্রেও ছিলো বিধিনিষেধ। শুধুমাত্র কালো না, অশ্বেতাঙ্গ কোনো ক্রিকেটারই প্রথমশ্রেণীর ম্যাচ খেলতে পারতো না।
কেপটাউনে জন্মগ্রহণ করা বেসিল লুইস ডি’অলিভেইরার জাতীয় দলে সুযোগ না পাওয়ার মধ্য দিয়ে সমস্যাটা আরো প্রকট হয়। অলিভেইরা সে সময়ে অল আউট অ্যাটাক ব্যাটিংয়ের পথপদর্শক ছিলেন। কালোদের ক্রিকেটে ওয়েস্ট প্রভিন্সের হয়ে নিয়মিত রান পাচ্ছিলেন অলিভেইরা। ঐ লীগে তার ৮২ টি শতকের কথা কখনো কোনো পত্রিকায়ও আসেনি। তার এসব কীর্তি ক্রিকেট বিশ্ব তো দূরের কথা তার নিজের দেশের মানুষও জানতো না।
১৯৫৬-৫৭ মৌসুমে দক্ষিন আফ্রিকান ‘কালো’ জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে তিনি কেনিয়া আর পূর্ব আফ্রিকা সফর করলেন। জিতলেন সব কয়টি সিরিজ। প্রতিপক্ষ দলের অনেকেই ছিলেন প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটার। ১৩৯, ৫৬, ৪৮, ৯৬, ৩ এবং ৫০ এই ছিল তার প্রতিপক্ষ দলের বিরুদ্ধে ছয় ইনিংসে রান! সাথে যোগ করুন ১১.৯২ গড়ে মিডিয়াম পেসে নেয়া ২৫ উইকেট। হার্ডহিটার ব্যাটসম্যান থেকে অলিভেইরা হয়ে উঠলেন পুরোদস্তুর অলরাউন্ডার। কিন্তু অশ্বেতাঙ্গ বলে তাকে জাতীয় দল তো দূরে থাক প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটও খেলতে দেওয়া হয়নি।
নাইরোবিতে খেলা তার ১৩৯ রানের ইনিংস দেখে প্রত্যক্ষদর্শী অনেক সাংবাদিক তাকে গ্রেট ওয়ালি হ্যামন্ডের সাথে তুলনা করেন। শুধুমাত্র কালো বলে তাকে খেলতে দেওয়া হয়নি এমনটা তখন জোরালেভাবে আলোচনা হচ্ছিলো।
১৯৬০ সালের পর অলিভেইরা দেশত্যাগ করে পাড়ি জমানও ইংল্যান্ডে, সেখানে ১৯৬৪ সালে উইস্টারশায়ারের হয়ে এবং ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলা শুরু করেন। ইংল্যান্ডের হয়ে তিনি ৪৪ টেস্টে ৪০.০৬ ব্যাটিং গড়ে ২৪৮৪ রান এবং ৪৭ টি উইকেট শিকার করেন।
উইস্টারশায়ারেও ব্যাটে এবং বলে সমান তালে পারফর্ম করেছিলেন ক্যারিয়ার জুড়ে। প্রথমশ্রেণীর ক্রিকেটে ৩৬৭ ম্যাচে ৪৫ টি শতক এবং ১০১ টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪০.২৬ ব্যাটিং গড়ে ১৯,৪৯০ রান করেছেন। বল হাতেও ছিলেন অনবদ্য, ৫৫১ উইকেট শিকার করেছিলেন প্রথমশ্রেণীর ক্রিকেটে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ আইন ক্রমশ আরো কঠোর হতে থাকে, ‘৭০’ সনের আগে আরো কয়েকজন প্রতিভাবান ক্রিকেটার কালো বলে জাতীয় দলে সুযোগ পায়নি। তাদের এসব নির্লজ্জ আইন এবং অমানুষিক আচার আচরণে আইসিসি বাধ্য হয়েই তাদেরকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে।
প্রায় ২২ বছর পর নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা ভারতের বিপক্ষে কলকাতায় একটি একদিনের ম্যাচ দিয়ে ক্রিকেটে ফিরলেও ততদিনে সাদা ক্রিকেটার গ্রায়েম পোলক, ব্যারি রিচার্ডস, মাইক প্রোক্টরের মতো প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়। এবং রবিন স্মিথ, অ্যালান লাম্বের মতো উদীয়মান ক্রিকেটাররাও অভিবাসিত হয়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান এবং কেপলার ওয়েসলেস অস্ট্রেলিয়ায় নিজের ক্যারিয়ার শুরু করেন।
পোলকের কথায় আসি আবার। মাত্র ২৩ টেস্টের ক্যারিয়ারেই নিজেকে সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানের তালিকায় নিয়ে গেছেন এই কিংবদন্তী। সবদিক বিবেচনা করে আইসিসি তাকে ২০০৯ সালে ক্রিকেটের “হল অব ফেইমেরর” তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।
পোলক নিজের প্রথম ৮ টেস্টে ৪০.৩০ ব্যাটিং গড়ে ৫২৪ রান করলেও শেষ ১৫ টেস্টে ১৫ টি অর্ধশতাধিক রানের ইনিংসের সাহায্যে ৭২.১৬ ব্যাটিং গড়ে ১৭৩২ রান করেন। আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে এখনো সবচেয়ে বেশি ব্যাটিং গড়ে রান করা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় ৬০.৯৭ ব্যাটিং গড়ে রান করে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছেন।
নিজের ক্ষুদ্র ক্যারিয়ারে পরিসংখ্যানের দিক দিয়েও অনেক নামকরা ব্যাটসম্যানদের চেয়ে এগিয়ে আছে গ্রায়েম পোলক।
ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা নাম্বার চার ব্যাটসম্যানদের তালিকায় এভারটন উইক্সের পরেই তার নাম উচ্চারিত হয়, যদিও এই পজিশনে ভারতীয় ক্রিকেট ঈশ্বর শচীন টেন্ডুলকার ব্যাট করতেন। আর পোলক চারে ব্যাট করে ৩৭ ইনিংসে ৬২.৫৭ ব্যাটিং গড়ে ২০৬৫ রান করেন।
নিজের শেষ টেস্ট সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তার ক্যারিয়ার সেরা ২৭৪ রানের ইনিংসের সুবাদে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয় পায় দক্ষিণ আফ্রিকা। দক্ষিণ আফ্রিকার জয়ী ম্যাচগুলোতেও ছিলেন অনবদ্য। নিজের ২৩ ম্যাচের টেস্ট ক্যারিয়ারে ৯ ম্যাচে জয় এনে দেন নিজ দেশকে। সেই ৯ ম্যাচে পোলক ৮৪.১৪ ব্যাটিং গড়ে ১১১৮ রান করেন।
পোলক সরকারের বর্ণবাদের নীতির কারণে ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটা সময়ই ট্রান্সবালের হয়ে খেলে কাটিয়ে দেন। ১৯৮৭ সালে ক্রিকেট থেকে বিদায় নেওয়ার আগে ২৬২ টি প্রথমশ্রেণীর ম্যাচে ৫৪.৬৭ ব্যাটিং গড়ে ২০৯৪০ রান করেন ৬৪ টি শতক এবং ৯৯ টি অর্ধশতকের সাহায্যে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সীমিত ওভারের ম্যাচ খেলার ভাগ্য না হলেও ঘরোয়ালীগে ১১৮ টি লিস্ট-এ ম্যাচে ৫০.০৬ ব্যাটিং গড়ে ৪৬৫৬ রান করেছেন।
গ্রায়েম পোলকের বংশেই ক্রিকেটের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে, অপার প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও নিজে দেশকে তেমন কিছু দিতে না পারলেও তার ভাতিজা শন পোলকের কীর্তি অনেকেই জানেন। শন পোলক সাউথ আফ্রিকার হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৮২৯ উইকেট এবং ৭৩৮৬ রানের মালিক। আর তার ক্রিকেটের হাতে-খড়ি হয়েছে পারিবারিকভাবেই। চাচার অতৃপ্ত আত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পেয়েছে তার পারফরমেন্সে।
বর্ণবাদের কারণে নিজের ক্যারিয়ার ধ্বংস হলেও ভাতিজা শন পোলকের ক্যারিয়ারের কোনো ক্ষতি হয়নি। অন্যান্য তরুণ ক্রিকেটারের মতো বিভিন্ন দেশের হয়ে না খেলে নিজ দেশের হয়ে খেলার জন্যই নিজেকে গড়ে তুলেন পোলক বংশের শেষ কর্ণধার। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা যখন ক্রিকেটে ফিরেন তার তিন বছর পরেই জাতীয় দলে তার অভিষেক হয়।
ক্যারিয়ার শেষে নিজেকে ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা বোলিং অলরাউন্ডারের তালিকায় উপরের দিকেই রেখেছেন।
রক্তে ক্রিকেট থাকা গ্রায়েম পোলকের বাবা, চাচা, ভাই, ২ চাচাতো ভাই, ২ ছেলে এবং ভাতিজা শন পোলকও প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট খেলেছেন।
গ্রায়েম পোলকের মতো মাইক প্রোক্টরও ছিলেন বেশ প্রতিভাবান ক্রিকেটার। ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হওয়ার সব যোগ্যতাই তার মধ্যে ছিলো। ১৯৬৭ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু করা প্রোক্টরের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা নিষিদ্ধ হওয়ার সাথেই। টেস্ট ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নিজের ৭ ম্যাচের সবকটি খেলে ৪১ উইকেটের পাশাপাশি ২৫.১১ ব্যাটিং গড়ে ২২৬ রান করেছিলেন। এরপর ক্যারিয়ারের বাকিটা সময় রোডেশিয়া, গ্লোস্টারশায়ার, নাটাল, ওয়েস্টার্ন প্রভিন্স, ওরেঞ্জ ফ্রি স্টেইটের হয়ে খেলে কাটিয়ে দেন। দক্ষিণ আফ্রিকা যখন নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তন করে তার কয়েকবছর আগে ক্রিকেটকে বিদায় জানান প্রোক্টর।
প্রোক্টর কতটা ভয়ংকর অলরাউন্ডার ছিলেন তা তার প্রথমশ্রেণী এবং লিস্ট-এ ক্রিকেটের পারফরমেন্সের উপর চোখ রাখলেই বুঝা যায়। প্রোক্টর ৪০১ টি প্রথমশ্রেণীর ম্যাচে ৪৮ টি শতক এবং ১০৯ টি অর্ধশতকের সাহায্যে ২১,৯৩৬ রান করার পাশাপাশি বল হাতে নিয়েছেন ১৪১৭ উইকেট। লিস্ট-এ ক্রিকেটেও ২৭১ ম্যাচে ৬৬২৪ রান করার পাশাপাশি তার পেইসে পরাস্ত করেছেন ৩৪৪ জন ব্যাটসম্যানকে।
বর্ণবাদের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠলেও দক্ষিণ আফ্রিকায় এখনো বর্ণবাদের নীতি জারি আছে। এখন স্কুল ক্রিকেটে বাধ্যতামূলক কালো ক্রিকেটার দলে নিতে হয়, এতে করে অনেক সাদা ক্রিকেটার প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও খেলার সুযোগ পাচ্ছে না। যার ফলস্বরূপ এখনো অনেক প্রতিভাবান ক্রিকেটার শুধুমাত্র গায়ের রঙের জন্য নিজ দেশের হয়ে খেলতে পারছেন না এবং অন্য দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। কেভিন পিটারসেন, জেনিংস, জেসন রয়দের মতো অনেক প্রতিভাবান ক্রিকেটার ইংল্যান্ডের হয়ে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়েছেন।
কথায় আছে ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা, কিন্তু যুগে যুগে দক্ষিণ আফ্রিকান সরকার ক্রিকেটকে গায়ের রঙে বিবেচনা করছে।
কিন্তু দেশের হয়ে সাদা ডেইল স্টেইন, ডি ভিলিয়ার্স, ডোনাল্ড, ক্যালিস, স্মিথ, ক্রোনিয়ে, কারস্টেনদের পাশাপাশি কালো মাখাইয়া এনটিনি, কাগিসো রাবাদা, হাশিম আমলা, অ্যাশওয়েল প্রিন্স, ভেরনন ফিল্যান্ডার, ডুমিনিরা নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়েই খেলছেন। আজ এ পর্যন্তই। বিশ্ব ক্রিকেট ইতিহাস নিয়ে কথা হবে আরেকদিন। ভালো থাকবেন।