আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিল রিও অলিম্পিকের বিদায়বেলায়। তারপরেও উৎসব থেমে থাকেনি ঐতিহাসিক মারাকানা স্টেডিয়ামে। প্রায় সাত বছরের পরিকল্পনার পর ১৭ দিনের বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রিয়াযজ্ঞের আয়োজন করে শেষটাও রঙ আর আলোর ফুলঝুরিতে সাজিয়ে রেখেছিল ব্রাজিল। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট মঞ্চে উঠে দৃঢ়কন্ঠেই ঘোষণা দিয়েছিলেন,
ইতিহাস একসময় কথা বলবে আগের রিও ডি জেনেইরো, এবং অলিম্পিক গেমসের কারণে বদলে গিয়ে আরো ভালো শহরে পরিণত হওয়া রিও ডি জেনেইরো সম্পর্কে।
কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে এর পুরো উল্টোটা! রিও ডি জেনেইরোর জন্যে দুঃস্বপ্ন হয়ে আসে এই অলিম্পিক।
২০০৯ সালে প্রথম দক্ষিণ আমেরিকার শহর হিসেবে অলিম্পিক আয়োজনের সূযোগ পাওয়ার পর ব্রাজিলিয়ানরা ভেবেছিল, এই অলিম্পিকের ফলে রিওতে বাড়বে পর্যটকদের সংখ্যা, বাড়বে কর্মসংস্থান, হবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বাড়বে জীবনযাত্রার মান। কিন্তু এত বড় মাপের আন্তর্জাতিক আসর আয়োজন করতে গিয়ে যা ছিল তা-ও খুইয়ে বসে শহরটি।
ব্রাজিলের সেসময়ের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অলিম্পিক ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়ায়। অলিম্পিকের আয়োজনের জন্য রিও অলিম্পিক কমিটির প্রাথমিক বাজেট ছিল ১৪ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু অলিম্পিক শিখা নিভে যাওয়ার পর মোট ব্যয়ের পরিমাণ গিয়ে ঠেকে ২০ বিলিয়ন ডলারে! ওদিকে অলিম্পিক শেষ হবার এক বছরের মধ্যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত ভেন্যুগুলো পরিণত হয় সিনেমায় দেখানো অ্যাপোক্যালিপ্টিক পৃথিবীতে। আর রিওর কাঁধে চাপে বিশাল অংকের ঋণের বোঝা।
তবে অলিম্পিক আয়োজন করে দুর্দশার শিকার কেবল রিও নয়, তালিকাটা বেশ বড়। কারণ যতই দিন যাচ্ছে, অলিম্পিক আয়োজন ততই ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে।
একেবারে প্রথম অলিম্পিক, মানে ১৮৯৬ সালে গ্রীসে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে মাত্র ১২টি দেশ থেকে ২৮০ জন অ্যাথলেট ৪৩টি ইভেন্টে অংশ নেন। তাদের মধ্যে কোনো নারী অ্যাথলেট ছিল না, কোনো কৃষ্ণাঙ্গ অ্যাথলেটও ছিল না। প্যারিসে অনুষ্ঠিত হওয়া এরপরের আসরেই ২৬টি দেশ থেকে ৯৬টি ইভেন্টে অংশ নেন ১,২২৬ জন অ্যাথলেট। এভাবে প্রতি আসরেই বাড়ছে মোট ইভেন্টের সংখ্যা, এবং অ্যাথলেটদের সংখ্যা। যদি আমরা ২০২০ টোকিও অলিম্পিকের দিকে তাকাই, যেখানে মোট অংশগ্রহণকারী দেশ ২০৪, মোট অ্যাথলেট সংখ্যা ১১ হাজারের বেশি, এবং মোট ইভেন্ট ছিল ৩৩৯টি। সুতরাং সাদাসিধেভাবে শুরু হওয়া অলিম্পিক এখন বিশাল পরিসরের সত্যিকার অর্থের একটি আন্তর্জাতিক আসর।
আয়োজক শহরের মনোযোগ কেবল অলিম্পিকের সবগুলো ইভেন্ট আয়োজনের দিকে থাকে না। বিশ্ববাসীর সামনে নিজেদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি তুলে ধরার সাথে জাতীয় মর্যাদা রক্ষা তখন অনেক বেশি প্রাধান্য পায়। তাই জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধনী এবং সমাপনী অনুষ্ঠান আয়োজনের পাশাপাশি হিরিক পড়ে যায় এমন সব ব্যয়বহুল স্থাপনা নির্মাণের, অলিম্পিক শেষ হবার পর যার তেমন কোনো ব্যবহারই থাকে না।
এই চর্চা প্রথমদিকের আসরগুলোতে দেখা যায়নি। ছোট পরিসরের সেই আসরগুলো আয়োজিত হতো সরকারি তহবিলের অর্থ থেকে। ইউরোপ-আমেরিকার সেসব শহর, যারা অর্থনৈতিকভাবে সামর্থ্যবান, এবং যাদের ইতিমধ্যেই আয়োজন করার মতো অবকাঠামো আছে, তারাই এগিয়ে আসত।
কিন্তু ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিকের পর তাতে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। কারণ, সেই আসরেই প্রথমবারের মতো বার্লিন এবং পটসডামের ৫০ হাজার মানুষ স্টেডিয়ামে না গিয়েও ২৫টি হলে অলিম্পিক গেমস দেখার সুযোগ পায়। ১৯৪৮ লন্ডন অলিম্পিকে বাসায় বসে অলিম্পিক উপভোগ করে ৫০ লক্ষেরও বেশি মানুষ। ১৯৬০ রোম অলিম্পিকে প্রথমবারের মতো সরাসরি সম্প্রচার করা হয় ইউরোপের বেশ কিছু দেশে। আর স্যাটেলাইটের বদৌলতে ১৯৬৪ সালের টোকিও অলিম্পিক সরাসরি সম্প্রচারিত হয় গোটা বিশ্বজুড়েই।
টেলিযোগাযোগের এই প্রসারের ফলে দুটি বিষয় ঘটে- একদিকে টেলিভিশন সম্প্রচারস্বত্ত্ব বিক্রির ফলে আয়োজক শহরের হাতে বেশ বড় অংকের অর্থ আসে, এবং অন্যদিকে টিভির মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে নিজেদের জাতীয় মর্যাদা এবং শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা, রঙ-বেরঙের প্রদর্শনীর কারণে খরচের তালিকা বড় হতে থাকে।
১৯৬০ সালের পর থেকেই গ্রীষ্মকালীন বা শীতকালীন যতগুলো আসর হয়েছে, সেসবের সবগুলোতেই (কেবল ১৯৮৪ লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিক বাদে) মোট ব্যয় ছাড়িয়েছে প্রাথমিক বাজেট। তখন এই বিশাল অর্থব্যয়ের কথা মাথায় রেখে বেশিরভাগ দেশই আগ্রহ হারাতে থাকে। এদের মধ্যে কলোরাডোর ডেনভার প্রথম এবং একমাত্র শহর হিসেবে অলিম্পিক বিডে জয়ী হয়েও দুই বছরের মাথায় অলিম্পিক আয়োজনে অস্বীকৃতি জানায়। শহরের বাসিন্দারা গণভোটের মাধ্যমে ১৯৭৬ শীতকালীন অলিম্পিক প্রত্যাখান করে মূলত অতিরিক্ত খরচের বিষয় মাথায় রেখে, এবং তাদের শঙ্কা ছিল, এটি তাদের পরিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে।
এদিকে বাজেট পার করানো আসরের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ১৯৭৬ সালের মন্ট্রিয়ল অলিম্পিক। তাদের প্রাথমিক বাজেট ছিল ১২০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতি, ভয়াবহ আবহাওয়া, শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে নির্মাণকাজে দেরি হওয়া, স্টিলের দাম বৃদ্ধি পাওয়া, নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কারণে তাদের খরচ হয় ২.৬ বিলিয়নেরও বেশি! যার মধ্যে শুধু ফরাসি স্থপতি রজার টালিবার্টের ডিজাইন করা বিখ্যাত ‘Big O’ স্টেডিয়াম নির্মাণেই তাদের খরচ হয় ৭৭০ মিলিয়ন ডলার! তখনকার মাত্র ১০ লক্ষ জনসংখ্যার সেই শহর চাপা পড়ে ১.৬ বিলিয়ন ডলারের বিশাল ঋণের বোঝায়, যা তাদের পরিশোধ করতে সময় লাগে ৩০ বছর!
মন্ট্রিয়লের এই দুর্দশা দেখে ১৯৭৯ সালে লস অ্যাঞ্জেলস বাদে আর কোনো শহরই ১৯৮৪ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজনের জন্য বিডে অংশগ্রহণ করেনি। একমাত্র শহর হওয়ায় তারা বিভিন্ন শর্ত নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আইওসি (ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি)-এর সাথে মধ্যস্থতায় আসে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অলিম্পিক আয়োজনের জন্য যে অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজন হয়, তার বেশিরভাগ আগে থেকেই লস অ্যাঞ্জেলসে ছিল। মোট ২৯টি ভেন্যুর মধ্যে তাদের নির্মাণ করতে হয় মাত্র ছয়টি, যার মধ্যে তিনটি ছিল অস্থায়ী ভেন্যু, যা অলিম্পিক শেষ হবার পর ভেঙে ফেলা হয়।
অবকাঠামোতে তেমন কোনো অর্থ ব্যয় না হওয়ায়, এবং আগের অলিম্পিকের সব রেকর্ড ভেঙে ২৮৬.৯ মিলিয়ন ডলারে সম্প্রচারস্বত্ত্ব বিক্রি করায় লস অ্যাঞ্জেলস এখন পর্যন্ত একমাত্র শহর যারা অলিম্পিক আয়োজনের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে, যার পরিমাণ ২১৫ মিলিয়ন ডলার।
লস অ্যাঞ্জেলসের সফলতার পর অলিম্পিক বিডে আগ্রহী শহরের সংখ্যা আবার বাড়তে থাকে। যেখানে ১৯৮৮ সালের জন্য বিডে অংশ নিয়েছিল দুটি শহর, সেখানে ২০০৪ সালের জন্য অংশ নেয় ১১টি। এতে আইওসির হাতে সুযোগ আসে সেসব শহর বেছে নেয়ার, যাদের পরিকল্পনা উচ্চাভিলাষী, এবং অর্থ ব্যয়ে যারা কার্পণ্য করবে না। আবার এদিকে গত বিশ বছরে উন্নত দেশগুলোর মধ্যে থেকে অলিম্পিক বিডে অংশ নেয়ার সংখ্যা বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
কিন্তু সমস্যা আবার দেখা দেয় বেইজিং, সোচি বা রিওর মতো তিনটি ব্যয়বহুল আসরের কারণে। ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে চীন ২০ বিলিয়ন ডলারের প্রাথমিক বাজেট উতরিয়ে খরচ করে ৪৫ বিলিয়ন, যা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যয়বহুল গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক। আর ২০১৪ সোচি শীতকালীন অলিম্পিকে রাশিয়া খরচ করে ৫১ বিলিয়নেরও বেশি, যেখানে ১০ বিলিয়ন ছিল তাদের প্রাথমিক বাজেট।
এর কাছাকাছি সময়ের অলিম্পিক আসরগুলোতে খরচ এত বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়ায়, বেশ কিছু শহর ২০২২ এবং ২০২৪ সালের বিড প্রত্যাহার করে নেয়। ২০২২ শীতকালীন অলিম্পিকের জন্য চীনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী অসলো এবং স্টকহোম যখন বুঝতে পারে তারা যা ধারণা করছে মূল খরচ তার চেয়েও বেশি হবে, তখন তারা আয়োজকের দৌড় থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। এদিকে বোস্টন ২০২৪ সালের অলিম্পিক আয়োজনের জন্য বিডে অংশগ্রহণ করলেও বাসিন্দাদের আন্দোলনের মুখে তা শুরুতেই প্রত্যাহার করে নেয়। একই পথ অনুসরণ করে সেই আসর আয়োজনের আগ্রহী শহর হামবুর্গ, রোম এবং বুদাপেস্ট। যে কারণে শেষপর্যন্ত ২০২৪ অলিম্পিকের আয়োজনের প্রার্থী ছিল কেবল দুটি শহর, প্যারিস এবং লস অ্যাঞ্জেলস। তখন জটিলতা এড়াতে আইওসি এই দুটি শহরকে যথাক্রমে ২০২৪ এবং ২০২৮ অলিম্পিকের আয়োজক হিসেবে ঘোষণা করে।
তো এখন প্রশ্ন আসতে পারে- এত অর্থ আসলে কোন খাতগুলোতে ব্যয় হয়? একেবারেই শুরুর দিকে তাকালে দেখা যায়, অলিম্পিক আয়োজনের জন্য আগ্রহী হয়ে বিডে অংশ নিতেই ১০ মিলিয়ন ডলারের মতো ব্যয় হয়। আইওসি সেখান থেকে প্রাথমিকভাবে যাচাই-বাছাই করে ৩-৫টির মতো শহর বেছে নেয়। তারপর আইওসি প্রতিনিধিরা সেসব শহর, এবং যে অঞ্চলে আয়োজন করতে চায় তা পরিদর্শনে যায়। এই প্রক্রিয়াতে আগ্রহী শহরের ৫০-১৫০ মিলিয়ন ডলারের মতো খরচ হয়, যেখানে তারা এই আসর আদৌ আয়োজন করতে পারবে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা থাকে না।
২০১৬ অলিম্পিক আয়োজনের জন্য টোকিও নগর পরিকল্পনা, অনুষ্ঠানের আয়োজন, আর্কিটেকচার ফার্ম ইত্যাদি মিলিয়ে ১৫০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে। একইভাবে সেই একই আসরের জন্য শিকাগো খরচ করে ১০০ মিলিয়নের মতো। কিন্তু সবশেষে সেই আসর চলে যায় রিওর কাছে। টোকিও এরপরের আসর আয়োজনের সুযোগ পেলেও তাতে তাদের অতিরিক্ত আরো ৭৫ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়।
তাছাড়াও, এই অলিম্পিক বিড নিয়ে দুর্নীতির বেশ কিছু অভিযোগ এসেছে। ঘুষ কেলেঙ্কারির কথা উঠে এসেছে ১৯৯৮ এবং ২০০২ শীতকালীন অলিম্পিকের সময়ে। ২০১৭ সালে রিও অলিম্পিক কমিটির প্রধানকে অভিযুক্ত করা হয় রিওতে অলিম্পিক নিশ্চিত করতে ২ মিলিয়ন ডলার ঘুষ দেয়ার জন্য। টোকিওর ক্ষেত্রেও একই অভিযোগ আসে ২০২০ অলিম্পিক নিয়ে।
আয়োজক হিসেবে কোনো শহর নির্বাচিত হবার পর, তাদের হাতে সাত থেকে দশ বছরের মতো সময় থাকে এই আসর আয়োজনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করার।
আয়োজক কমিটিকে আইওসির দেয়া সবগুলো নিয়ম এবং চাহিদা মেনেই এগোতে হয়। যেমন- মিডিয়া, আইওসি এক্সিকিউটিভস, পরবর্তী আসর আয়োজক কমিটির প্রতিনিধি, ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস ফেডারেশনের প্রতিনিধিসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির জন্য ৪০ হাজারের বেশি হোটেলরুম নিশ্চিত করতে আইওসি থেকে বলা হয়। রিওতে আগে থেকে এত বিশাল পরিমাণ হোটেল রুম না থাকায় তাদেরকে নতুন করে ১৫ হাজার হোটেল রুম নির্মাণ করতে হয়। এটা শুধুই যারা অলিম্পিক পরিচালনায় যুক্ত থাকে তাদের জন্যই, পর্যটক বা অ্যাথলেটরা এই হিসেবের বাইরে।
১৯২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিক থেকেই প্রতিটি আয়োজক শহর শুধুমাত্র অ্যাথলেট, কোচ এবং প্রশিক্ষকদের থাকার জন্য আলাদাভাবে নির্মাণ করে ‘অলিম্পিক ভিলেজ’। আইওসির দেয়া নির্দেশ অনুযায়ী- এই ভিলেজ থেকে সবগুলো স্টেডিয়ামের দূরত্ব ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে হতে হবে। যদি তা না হয়, তাহলে সেই ভেন্যুর জন্য আলাদাভাবে আরেকটি অলিম্পিক ভিলেজ নির্মাণ করতে হবে। যেমন- ২০১৪ শীতকালীন অলিম্পিকে সোচিতে একটি অলিম্পিক ভিলেজ নির্মাণ করা হয়, যেখানে সবগুলো ইনডোর ইভেন্ট হয়েছিল। কিন্তু আউটডোর ইভেন্টগুলো আরো ৭০ কিলোমিটার দূরের রোসা কুটোর স্কি রিসোর্টে হওয়ায় সেখানে আরেকটি অলিম্পিক ভিলেজের প্রয়োজন হয়।
এই অলিম্পিক ভিলেজ কেবল নামে নয়, বাস্তবিকই একটি ‘ভিলেজ’। কারণ অ্যাথলেটদের থাকার জন্য যত প্রকার সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন, তার সবকিছুই অলিম্পিক ভিলেজে থাকতে হবে। সেখানে থাকতে হবে অলিম্পিক মার্চেন্ডাইজ স্টোর, ব্যাংক, মিডিয়া সেন্টার, পোস্ট অফিস, রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে, অ্যাথলেটদের জন্য আলাদা প্রশিক্ষণ রুম, ক্লিনিক, ট্রাভেল অ্যাজেন্ট, ছোটখাট শপিংমলসহ প্রয়োজনীয় সব কিছুই। ২০২০ অলিম্পিকের জন্য এমনই একটি ভিলেজ নির্মাণে টোকিওর খরচ হয়েছে ২ বিলিয়ন ডলার।
অলিম্পিকের মূল আকর্ষণে থাকে উদ্বোধনী এবং সমাপনী অনুষ্ঠান। তাই আয়োজক শহরকে নিশ্চিত করতে হয় সেই অনুষ্ঠান আয়োজনের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ দর্শক ধারণক্ষমতার স্টেডিয়াম যাতে তাদের থাকে। এই স্টেডিয়াম নির্মাণেও বেশ বড় অংকের অর্থ ব্যয় করতে হয় তাদের। মন্ট্রিয়লের গল্প তো শুনিয়েছি, তেমনই টোকিও অলিম্পিকের জন্য আয়োজকরা তাদের ন্যাশনাল স্টেডিয়াম ভেঙে নতুন করে নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই স্টেডিয়ামের জন্য তারা বিখ্যাত স্থপতি জাহা হাদিদের করা ডিজাইনের দিকে প্রথমে আগ্রহ দেখালেও, ২ বিলিয়ন ডলারের মতো ব্যয় হবে বলে সরে আসে। পরবর্তীতে তারা জাপানী স্থপতি কেনগো কুমার ডিজাইনের ৬৮ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতাসম্পন্ন স্টেডিয়াম নির্মাণ করে, যাতে তাদের খরচ হয় ১.৪ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে করোনা মহামারির কারণে উদ্বোধনী এবং সমাপনী অনুষ্ঠানের সময় প্রায় পুরো স্টেডিয়ামই ছিল ফাঁকা!
গত বিশ বছরে আরেকটি খাত ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে, তা হলো নিরাপত্তা। ১৯৭২ সালের মিউনিখ এবং ১৯৯৬ সালের আটলান্টা অলিম্পিকে হামলার পর নিরাপত্তা ইস্যু আয়োজক কমিটির মাথাব্যাথার কারণ ছিল। কিন্তু ৯/১১ এর পর এটি অন্যতম চিন্তার বিষয় হয়ে ওঠে। যেমন- ২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিকে নিরাপত্তার জন্য খরচ হয় ২৫০ মিলিয়ন ডলারের মতো। এরপরের আসর যেহেতু ৯/১১ এর পর প্রথম অলিম্পিক আসর, তাই গ্রীসকে নিরাপত্তা জোরদার করতে হয়, যাতে তাদের খরচ হয় ১.৬ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি! তবে অবাক হবার বিষয় এটি যে, সেবার তাদের প্রাথমিক বাজেটই ছিল ১.৫ মিলিয়ন ডলার! এরপরের যতগুলো আসরই হয়েছে, সবগুলোতে নিরাপত্তার জন্য ১.৫-২ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে।
টোকিওকে অলিম্পিক আয়োজন করতে গিয়ে করোনা মহামারীর সম্মুখীন হতে হয়। ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও আইওসি এবং টোকিও আয়োজক কমিটিকে ১ বছরের জন্য পেছাতে হয় অলিম্পিক। ১ বছর দেরি হওয়াতে টোকিওর অতিরিক্ত ২.৮ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। আরো ১ বিলিয়ন অতিরিক্ত খরচ হয় এই মহামারি প্রতিরোধের ব্যবস্থা হিসেবে।
তবে আয়োজকদের মোট খরচের বেশ বড় একটি ব্যয় হয় রাস্তাঘাট উন্নয়ন, আইওসি এক্সিকিউটিভদের জন্য আলাদা লেন নির্মাণ, এয়ারপোর্ট সংস্কার, মিডিয়া এবং টেলিভিশন সেন্টার, নতুন সাবওয়ে লাইন এমন সব খাতে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই খাতে ব্যয় মূল অলিম্পিক আয়োজনের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হয়। তাই দেখা যায়- প্রথমে যা ভেবেছিল তার চেয়েও বেশি খরচ করে ফেলেছে আয়োজক শহর। ১৯৮০ সাল থেকে যা গড়ে ২৫২% বেশি।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, এত বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে অলিম্পিক আয়োজন করে, আয়োজক শহর আসলে কোন দিক থেকে উপকৃত হচ্ছে? বা আসল লাভটা কোথায়? অর্থনৈতিকভাবে লাভবান লস অ্যাঞ্জেলস বাদে আর কেউই হতে পারেনি। অলিম্পিক আয়োজন করে যে অর্থ আয়োজকের কাছে আসে, তা ব্যয়ের তুলনায় নস্যি। যেমন- ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিক থেকে আয় ৩.৬ বিলিয়ন ডলার, যা তাদের মোট ৪৫ বিলিয়ন ডলারের আয়োজনের কাছে কিছুই না। তেমনি লন্ডন ৫.৬ বিলিয়ন আয় করলেও তাদের খরচটা ছিল ১৮ বিলিয়ন ডলার। তবে এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আছে। আয়ের পুরোটাই কিন্তু আয়োজকদের কাছে যায় না, বেশ বড় একটি অংশ চলে যায় আইওসির কাছে।
অলিম্পিক থেকে যে আয় হয়, তা মূলত আসে সম্প্রচারস্বত্ত্ব বিক্রি, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন স্পন্সরশিপ, টিকেট এবং অন্যান্য পণ্য বিক্রির মাধ্যমে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশই আসে টেলিভিশন সম্প্রচারস্বত্ত্ব বিক্রির মাধ্যমে। যেমন- লন্ডন অলিম্পিকের ৫.৬ বিলিয়ন ডলার আয়ের ২.৬ বিলিয়নই সম্প্রচারস্বত্ত্ব থেকে পাওয়া।
১৯৮৪ লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিকের আগে আয়োজক শহর সম্প্রচারস্বত্ত্বের প্রায় পুরোটাই পেত। যেমন- ১৯৮০ সালের মস্কো অলিম্পিকে আয়োজকরা সম্প্রচারস্বত্ত্ব বিক্রি করে যা আয় হয় তার ৯০% পেয়েছিল। কিন্তু ১৯৮৪ অলিম্পিকে আইওসি স্বত্ত্ব বিক্রির প্রায় ৩৩% নিয়ে নেয়। এরপর তা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে, এবং বর্তমানে এই সম্প্রচার স্বত্ত্ব থেকে আয়ের অর্ধেকেরও বেশি যায় আইওসির কাছে।
অলিম্পিকের মাধ্যমে যেহেতু আয়োজক শহরের অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভবনা খুবই কম, তাই আয়োজক কমিটিগুলো অলিম্পিক আয়োজনকে একপ্রকার বিনিয়োগ হিসেবে ধরে। তারা ধরে নেয়- এর ফলে তারা কিছু স্বল্পমেয়াদী এবং কিছু দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা পাবে। স্বল্পমেয়াদী সুবিধাগুলোর মধ্যে আছে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, স্থানীয় ব্যবসার প্রসার। যেহেতু অলিম্পিকের জন্য স্টেডিয়াম, বিভিন্ন ভেন্যু, হাইওয়ে বা বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজন হয়, সেসময়ে এই প্রজেক্টগুলোতে অনেক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়।
স্বল্পমেয়াদী সুবিধার ক্ষেত্রে পদক জয়ের বিষয়টিও যুক্ত করা যায়। নিজস্ব মাঠ, পরিচিত আবহাওয়া, দর্শকদের সমর্থন প্রায় সব খেলাতেই আয়োজক দেশের জন্য ভাল একটি প্রভাব ফেলে। অলিম্পিকেও একই বিষয় ঘটে, এবং দেখা যায়- আয়োজক দেশ আগের আসরের চেয়ে বেশি পদক অর্জন করেছে। আবার, ২০১৬ সালে অলিম্পিকের নতুন এক নিয়মানুযায়ী আয়োজক শহর বেশ কিছু নতুন খেলা অলিম্পিকে যুক্ত করার সুপারিশ করতে পারবে। এই কারণেই জাপান বেসবল, কারাটে, স্কেটবোর্ড, স্পোর্ট ক্লাইম্বিং এবং সার্ফিং যুক্ত করে, যা তাদের ৫১টি পদক জয়ে বেশ বড় ভূমিকা রাখে।
দীর্ঘমেয়াদী সুবিধাগুলোর মধ্যে কয়েকটি ভাগ আছে। প্রথমত, যে ভেন্যুগুলো নির্মাণ করা হয়, তা সেই দেশের খেলাধুলার প্রসার ঘটাতে সাহায্য করবে, এবং পরবর্তী প্রজন্ম সেগুলো ব্যবহার করতে পারবে। দ্বিতীয়ত, অলিম্পিকের কারণে রাস্তা, এয়ারপোর্ট কিংবা শহরের অন্যান্য অবকাঠামগত যে উন্নয়নগুলো হবে, তা শহরের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান বাড়াবে। তৃতীয়ত, মিডিয়ার বদৌলতে এই অলিম্পিক বিশ্ববাসীর কাছে সেই শহরের বিজ্ঞাপন হিসেবে কাজ করবে, যা পর্যটকদের সেই শহরের প্রতি আকৃষ্ট করবে। আর সবশেষে অলিম্পিকের মাধ্যমেই শহরটি বিদেশী বিনিয়োগকারীদের নজরে পড়বে, এবং বৈদেশিক বাণিজ্যও বৃদ্ধি পাবে।
তবে এতগুলো আয়োজক শহরের মধ্যে এই বিষয়টির উদাহরণ কেবল একটিমাত্র শহরের মাধ্যমে দেয়া সম্ভব, সেটি বার্সেলোনা।
১৯৯২ অলিম্পিকের আগে বার্সেলোনা আজকের মতো অতটা বিখ্যাত শহর ছিল না। অলিম্পিককে কেন্দ্র করেই তারা তাদের সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলগুলোকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলে। তীরবর্তী কারখানা ভেঙে ২ মাইল লম্বা সমুদ্রসৈকতসহ তারা নতুন সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে। এয়ারপোর্ট আধুনিকায়ন করে, নতুন হাইওয়ে নির্মাণ করে। অর্থাৎ অলিম্পিকের মাধ্যমে বার্সেলোনাকে তারা নতুনভাবে গড়ে তোলে। এতে অলিম্পিকের পর পরই বার্সেলোনা পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, এবং বর্তমানে ইউরোপে ভ্রমণের জন্য অন্যতম বিখ্যাত শহর বার্সেলোনা। এদিকে শুধু পর্যটন নয়, ব্যবসারও বেশ ভাল প্রসার ঘটে। সাথে সাথে বেকারত্ব কমে আসে। আর অলিম্পিকের জন্য ভেন্যু এবং ট্রেনিং সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমেই স্পেনে ফুটবল, সাইক্লিং, বাস্কেটবল বা টেনিস ইত্যাদি খেলার প্রসার ঘটেছে, এবং বিশ্বমানের তারকাদের সৃষ্টি হয়েছে।
বার্সেলোনার দেখানো পথে অনেক শহর হাঁটতে চেয়েছিল, তাদের কেউই সফল হয়নি। যার খুব সাম্প্রতিক উদাহরণ রিও।
২০১৬ রিও অলিম্পিকের পর্দা নামার আগেই দেশটি তখন ১৯৩০ সালের পর সবচেয়ে ভয়াবহ মন্দার মুখে পড়ে। অলিম্পিক শুরুর ৫০ দিন আগে রিও ডি জেনেইরো রাজ্যের গভর্নর জারি করেন অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা। সেই সময়ে রিও কোনোভাবেই ১৪ বিলিয়নের মধ্যে অলিম্পিক আয়োজন সম্পন্ন করতে পারছিল না, তা গিয়ে পৌঁছায় ২০ বিলিয়নেরও উপরে। অবস্থা এতটাই বাজে পর্যায়ে যায় যে, অলিম্পিক শুরুর মাত্র ৩৫ দিন আগে নিরাপত্তা খাতে ব্যয়ের জন্য রিও কেন্দ্রীয় সরকার থেকে প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়। একই সময়ে বাড়ছিল বেকারত্ব। শিক্ষক, পুলিশ বা অন্যান্য সরকারি চাকরিজীবীরা কয়েকমাস ধরে কোনো বেতন পাচ্ছিলেন না। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সব দিক থেকেই নাজেহাল ছিল ব্রাজিল।
রিওর যে অংশে অলিম্পিক পার্ক নির্মাণ করা হয়, সেখান থেকে ২০০৯ সাল থেকে অলিম্পিক শুরু আগপর্যন্ত ৭৭,২০০ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করা হয়, যারা সবাই রিওর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।
২০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে রিওতে অলিম্পিকের জন্য ভেন্যুসহ অন্যান্য অবকাঠামো বাদেও রিওতে হাইওয়ে নির্মাণ, বন্দর সংস্কার, দূষিত গুয়ানাবারা বে পরিষ্কার, নতুন সাবওয়ে লাইন, পর্তো মারাভালা সংস্কারসহ অনেক কিছুই করা হয়। আয়োজকরা রিওকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, অলিম্পিকের জন্য যতগুলো নতুন স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে, সব অলিম্পিকের পর শিক্ষা এবং খেলাধুলার প্রসারে ব্যবহার করা হবে। যেমন, হ্যান্ডবলের ভেন্যুকে ভেঙে ৪টি নতুন স্কুলে পরিণত করা হবে, যেখানে ২,০০০ শিক্ষার্থী পড়ার সুযোগ পাবে, ছয়টি ভেন্যুকে বদলিয়ে ব্রাজিলের প্রথম অলিম্পিক ট্রেনিং সেন্টার বানানো হবে। কিন্তু এসবের কিছুই হয়নি। সবগুলো ভেন্যু এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
এছাড়াও অলিম্পিক ভিলেজের জন্য নির্মাণ করা ৩১টি ভবনকে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে পরিণত করার পরিকল্পনা থাকলেও বেশিরভাগ ভবন এখন খালি। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণও বেশ ব্যয়বহুল, বছরে প্রায় ১৪ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়।
অলিম্পিক থেকে রিও ডি জেনেইরোর বাসিন্দারা যে কোনো সুযোগ-সুবিধা যে পায়নি তা-ও না। নতুন বাস লাইন, পার্ক বা নতুন সাবওয়ে লাইন তাদের কাজে আসছে। যদিও এই সুবিধা মোটামুটি সব আসরে সব শহরই পায়। যেমন- মন্ট্রিয়ল অলিম্পিক ব্যর্থ হলেও এর ফলে বাসিন্দারা নতুন মেট্রো লাইন পায়, যা তাদের যাতায়াত অনেক সহজ করেছে।
মূলত, অলিম্পিক আয়োজনে যেসব স্থাপনার প্রয়োজন হয়, আয়োজক শহরে তার বেশিরভাগই থাকে না। তাই বড় কোনো পরিকল্পনা বাদে বিশাল অংকের অর্থ ব্যয়ে এসব অবকাঠামো নির্মাণের পর, সে শহর আসলে জানেই না এগুলো দিয়ে পরবর্তীতে তারা কী করবে। তাছাড়াও, এগুলো রক্ষণাবেক্ষণও বেশ ব্যয়বহুল। যেমন- ৪৬০ মিলিয়ন ডলারে নির্মিত বেইজিংয়ের বিখ্যাত বার্ড নেস্ট স্টেডিয়াম রক্ষণাবেক্ষণে প্রতিবছর খরচ হয় ১০ মিলিয়ন ডলার। এই খরচের চাপ সামলাতে না পারায়, শহরগুলো এগুলো রক্ষণাবেক্ষণে খুব একটা মনোযোগ দেয় না। যেমন- রিও অলিম্পিকের মতোই, ২০০৪ অ্যাথেন্স অলিম্পিকের অনেক ভেন্যু বা স্থাপনা আজও পরিত্যক্ত। অনেকেই মনে করেন, প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলারের অলিম্পিকের আয়োজন কিছুটা হলেও সাহায্য করেছে গ্রীসকে দেউলিয়া হতে।
পরিবেশের উপর অলিম্পিকের প্রভাবটা না বললে পুরো বিষয়টা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ২০১৮ সালের দক্ষিণ কোরিয়ার পিয়ংচ্যাং শীতকালীন অলিম্পিকে জিওংসিয়নে অলিম্পিক স্কি ট্র্যাক তৈরির জন্য ৫০০ বছরের পুরোনো দশ হাজারেরও বেশি গাছ কেটে ফেলা হয়, যেটা অনেক বন্য প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল ছিল।
অলিম্পিক আয়োজনে আয়োজক শহরগুলোর এই দুর্দশা দেখে, এখন প্রায় সবাই অলিম্পিক আয়োজনের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। ২ বছর পর পর আয়োজিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়ার আসরকে টিকিয়ে রাখার উপায় কী তাহলে?
আন্দ্রে জিম্বালিস্ট, যিনি স্মিথ কলেজের একজন প্রফেসর, অলিম্পিকের অর্থনীতি নিয়ে বেশ দক্ষ, তার এই বিষয়ে একটি পরামর্শ আছে। তিনি বলেন, অলিম্পিক ভিন্ন ভিন্ন শহরে আয়োজন না করে একটি নির্দিষ্ট শহরকেই পছন্দ করা, যেখানেই প্রতি চার চার বছর পর অলিম্পিকের আসর বসবে, যেখানে সব অবকাঠামো, ভেন্যু আগে থেকেই আছে। তার মতে, গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের জন্য লস অ্যাঞ্জেলস আদর্শ একটি শহর।
ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির কাছে এই পরামর্শ খুব একটা পছন্দ নয়। কিন্তু তাদের হাতেও বেছে নেয়ার মতো তেমন কোনো আয়োজক শহর নেই। গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের জন্য ২০৩২ সাল পর্যন্ত শহর ঠিক করা শেষ আইওসির। যেহেতু অলিম্পিকের এই বিশাল ব্যয়ের জন্য তাদেরকেও দোষারোপ করা হচ্ছে, তাই তারা এখন চাইছে খরচ যতটা সম্ভব কমিয়ে অলিম্পিককে আরো টেকসই করতে। তাদের ২০২০ অলিম্পিক এজেন্ডাতে ঠিক তেমনই কয়েকটি বিষয় তারা তুলে ধরে। যেমন- অলিম্পিক বিডের জন্য শহরকে তাদের নিজস্ব পরিকল্পনা উপস্থাপনে আমন্ত্রণ জানানো, বিডে অংশ নেয়া শহরগুলোর সুবিধা এবং ঝুঁকি মূল্যায়ন করা, অলিম্পিক বিডের খরচ কমানো, অলিম্পিক আয়োজনের সব দিককে টেকসই করে তোলা, এবং অলিম্পিক ব্যবস্থাপনার সব দিকের খরচ কমিয়ে আনা।
আইওসির এই এজেন্ডা অনুযায়ী, এখন আয়োজক শহরকে নতুনভাবে কোনো ভেন্যু নির্মাণ করতে হবে না। তবে আয়োজক কমিটি যদি ভবিষ্যতের জন্য কোন ভেন্যু একান্তই নির্মাণ করতে চায়, তাহলে তারা তা করতে পারবে।
যেহেতু নতুন কোনো ভেন্যুর প্রয়োজন হচ্ছে না, আয়োজক চাইলে সাময়িকভাবে কিছু স্থাপনা নির্মাণ করতে পারে। ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস বা ভলিবলের মতো গেমসের ক্ষেত্রে এগুলো ভালোই কার্যকর। অথবা আয়োজক চাইলে তারা আশপাশের শহর বা দেশের বাইরের কোনো ভেন্যু ব্যবহার করতে পারবে।
প্যারিস অলিম্পিকে এই বিষয়টি আমরা দেখতে পাব। তবে প্যারিস অলিম্পিক কমিটি জানিয়েছে, ৯৫% অবকাঠামো আগে থেকেই আছে প্যারিসে। তারা আর্চারির আয়োজন করবে লি ইনভালিস মিউজিয়ামের বাইরে, ফেন্সিং আর তায়কোয়ান্দো অনুষ্ঠিত হবে গ্র্যান্ড পালের ঐতিহাসিক প্রদর্শনী হলে। আয়োজক কমিটি আশাবাদী, লস অ্যাঞ্জেলসের মতো অর্থনৈতিকভাবে সফল একটি অলিম্পিক আয়োজন করতে পারবে।
অলিম্পিকের ইতিহাস অনেক পুরনো। সেই প্রাচীন গ্রীস থেকে আজকের এই অলিম্পিক গেমস সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বৃহত্তম কোনো আন্তর্জাতিক ক্রীড়ার আসর। অলিম্পিক বর্তমান বিশ্বের ঐক্যে, সংহতির প্রতীক। এটি এখনও তার আসল কাজ করে যাচ্ছে, পুরো বিশ্বকে একসাথে নিয়ে এসে সৌহার্দ্যের নতুন নতুন ইতিহাস রচনা করছে। তাই অবশ্যই এর গুরুত্ব আছে মানবজাতির জন্য। কিন্তু আয়োজক শহর বা দেশের জন্য যে বিপর্যয়ের কারণ হয়ে ওঠে, তাতেই গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ এখন প্রশ্নবিদ্ধ। আইওসি যদিও নতুন কিছু পরিকল্পনা সাজিয়েছে, তা আসলে কতটুকু কার্যকর হবে তা বোঝা যাবে প্যারিস আসরের পরেই।