ছোটোবেলায় সবাই চায় নিজের পছন্দের মানুষের মতো হয়ে উঠতে, কারো সৌভাগ্য হয় আর কারো হয় না। স্কুল বয়সে সবার চোখেই রঙিন স্বপ্ন থাকে, দেখা যায় নিজেকে গড়ে তুলতে চেয়েছে নায়ক হিসাবে কিন্তু কর্মজীবনে গায়ক হিসাবেই বাজিমাত করে বেড়াচ্ছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাচ্চাদের ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানাবে এমন বাবা-মায়ের পাশাপাশি ছেলে/মেয়েকে বড় হলে ক্রিকেটার বানাবে এমন বাবা-মাও অনেক দেখা যায়। আর ঐসব বাচ্চারা ছোটো থাকতে নিজেকে তার আইডলদের জায়গায় ভেবে কেউ বিশ্ব কাঁপানো পেসার হতে চায় আবার কেউ শচীনের মতো ব্যাটসম্যান হতে চায়. শচীন হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে খেলা শুরু করা ছেলেটার প্রতিভা লুকিয়ে আছে বল হাতে।
একসময় শচীনও লম্বা চুল নিয়ে পেসার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে খেলা শুরু করেন, কিন্তু তার আসল প্রতিভা যে পেসারদের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়ার মধ্যে ছিলো তা তার গুরুর বুঝতে বেশি সময় লাগেনি। এমন অনেক নামকরা মানুষ আছে যাদের স্কুল জীবনে স্বপ্নের সাথে বর্তমানের কোনো মিল নেই, হয়তো তারা একসময় ঐ স্বপ্নের চেয়ে বর্তমানে যা করছে তাকে বেশি কাছে টেনে নিয়েছে।
ভারতের সর্বকালের সেরা অধিনায়কদের একজন মাহেন্দ্র সিং ধোনি একসময় ফুটবলের গোলকিপার ছিলেন। বাংলাদেশের সাকিব আল হাসানের বাবা চেয়েছিলো ছেলেকে ফুটবলার বানাবে। এরকম হাজারো উদাহরণ আছে।
অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথের গল্পটা সম্পূর্ণ আলাদা. শেন ওয়ার্নের দেশে জন্মে তার মতো হবে বলে অন্য ৮-১০ টা ছেলের মতোই ক্রিকেটের হাতেখড়ি। বিশ্ব ক্রিকেটে তার আবির্ভাব হয়েছে লেগ স্পিনার হিসাবেই। বছর না ঘুরতেই নিজেকে বদলে বনে গেলেন মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান, আস্তে আস্তে করে এখন বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যান হিসাবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ১৯৮৯ সালের জুনের ২ তারিখে জন্মগ্রহণ করেছিলেন স্টিভ স্মিথ। নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেট শুরু করেছিলেন তিনি। ২০০৮ সালে নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে লেগ স্পিনার হিসাবে সুযোগ পান তিনি। ঐ বছরেই বিগ ব্যাশ টুর্নামেন্টে এক ইনিংসে ৪ উইকেট সহ ৪ ম্যাচে ৯ উইকেট শিকার করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি স্টিভ স্মিথ। তার ঐ নৈপুণ্যের জন্য টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হয়েছিলেন।
নিউ সাউথ ওয়েলস ২০০৯ সালে টি-টুয়েন্টি চ্যাম্পিয়ন্স লীগের শিরোপা জিতেছিলো। স্টিভেন স্মিথ চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য ছিলেন। ফাইনালে ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগোর বিপক্ষে ৩৩ রান করার পাশাপাশি ২ উইকেট শিকার করেছিলেন।
ঘরোয়া লীগে নিজের দ্বিতীয় মৌসুম শেষে ব্যাটিং গড় ৫০ এর উপর থাকলেও বল হাতে ছিলো সাধারণ মানের। তবে মৌসুমের শেষ ম্যাচে ৬৪ রানের বিনিময়ে ৭ উইকেট নিয়ে শেন ওয়ার্নের নজরে চলে আসেন। শেন ওয়ার্ন তাকে ব্যক্তিগতভাবে পর্যবেক্ষণ করে তার মধ্যে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পান এবং তাকে লেগ স্পেনের বিভিন্ন কৌশল শিখিয়ে দেন।
লেগ স্পিনারদের সম্রাট শেন ওয়ার্নের স্থলাভিষিক্ত হয়ে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে লেগ স্পিনার স্টিভেন স্মিথের অস্ট্রেলিয়ার হয়ে অভিষেক হয় পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টুয়েন্টির মধ্য দিয়ে। ঐ মাসেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওডিয়াই ক্রিকেটে অভিষেক হয়ে যায় তার। ২০১০ সালের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে উইকেট প্রতি ১৪.৮১ রান খরচায় ৭ ম্যাচে ১১ উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি ছিলেন স্টিভেন স্মিথ।
২০১০ সালেই পাকিস্তানের বিপক্ষে লর্ডসে টেস্ট অভিষেক হয় স্টিভ স্মিথের, মূলত বোলার হিসাবেই তার অভিষেক হয়। নিজের খেলা দ্বিতীয় টেস্টে বোলারদের সাথে জুটি বেধে ৭৭ রান করে তার ব্যাটিং প্রতিভা সম্পর্কে সবাইকে জানান দেন। মূলত বোলার হিসাবে সুযোগ পেয়ে প্রথম ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে ৩ পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানকে সাজঘরে ফেরত পাঠান।
দুর্দান্ত সব ক্যাচ লুফে নিয়ে আইপিএল ফ্রাঞ্চাইজিদেরও নজর কাড়ে স্মিথ। ২০১০ সালের আইপিএলে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর ব্যাটসম্যান জেসি রাইডারের ইনজুরিতে ভাগ্য খুলে যায় স্টিভ স্মিথের। এরপর ২০১২ সালের আইপিএলেও মিচেল মার্শের ইনজুরির কারণে পুনে ওয়ারিওর্সের হয়ে খেলার সুযোগ পান স্মিথ। নিজের খেলা প্রথম ম্যাচেই ৩৯ রান করে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতে নেন।
২০১৪ সালে রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে খেলেন স্টিভেন স্মিথ। মূলত ঐ বছর থেকেই ব্যাটসম্যান স্মিথকে চিনতে শুরু করে ক্রিকেট বিশ্ব। আইপিএলের ঐ আসরে বেশ কয়েকটি ম্যাচজয়ী ইনিংস খেলে নিজেকে ব্যাটিংয়ে আরো উপরে তুলে আনতে বাধ্য করেন টিম ম্যানেজমেন্টদের।
সাধারণ মানের লেগ স্পিনার হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করে এখন অসাধারণ ব্যাটসম্যান, ক্রিকেটের জ্যামিতিক কিংবা ব্যাকরণসম্মত কোনো শট না খেলে নিজের স্টাইলে ব্যাট করে বোলারদের বেধড়ক পিটানো তার প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
মাইকেল ক্লার্কের অবসরের পর এখন অজি দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্টিভেন স্মিথ। মাত্র তিন বছরেই সম্পূর্ণ বদলে গিয়ে বর্তমানে বিশ্বসেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান স্টিভেন স্মিথ। ২০১০ সালে ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু করা স্টিভ স্মিথ প্রথম চার বছরে টেস্ট ক্রিকেটে ১৬ ম্যাচে ৯৭০ রান করেছিলেন। এরপর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ২০১৪ সালে ৮১.৮৫ ব্যাটিং গড়ে ১১৪৬ রান, ২০১৫ সালে ৭৩.৭০ ব্যাটিং গড়ে ১৪৭০ রান করেন। ঐ বছরে আইসিসি বর্ষসেরা টেস্ট ক্রিকেটার, বর্ষসেরা ক্রিকেটার, অস্ট্রেলিয়ার বর্ষসেরা ক্রিকেটার, উইজডেন ক্রিকেটার অব দ্যা ইয়ার, আইসিসির বর্ষসেরা টেস্ট এবং ওডিয়াই দলে সুযোগ পাওয়া সহ অনেক অ্যাওয়ার্ড তার দখলে গিয়েছে। ২০১৬ সালের শেষ টেস্ট ইনিংসে ম্যাচ সেরা ১৬৫* রানের ইনিংসের মধ্য টানা তিনবছর টেস্টে হাজারের অধিক রানের মাইলফলক অতিক্রম করেন, ৭১.৭৩ ব্যাটিং গড়ে করেন ১০৭৯ রান।
স্টিভেন স্মিথ বক্সিং ডে টেস্টে বরাবরই অসাধারণ ছিলেন। পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ ইনিংসে ১৬৫* রান করার পাশাপাশি গত বছরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে অপরাজিত ১৩৪* এবং ৭০* রান করেন। ২০১৪ সালের বক্সিং ডে টেস্টে ভারতের বিপক্ষে ১৯২ রান এবং ১৪ রান করেছিলেন বর্তমান সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান।
আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে স্টিভ স্মিথের সর্বশেষ রেটিং পয়েন্ট ৯৩৭, যা সর্বকালের সেরা রেটিং পয়েন্ট অর্জন করা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় দশম। যেখানে টেন্ডুলকারের রেটিং পয়েন্ট সর্বকালের সেরা রেটিং পয়েন্ট অর্জনকারীদের তালিকার ৩১ তম স্থানে আছে সেখানে স্টিভ স্মিথ অবস্থান করছেন দশম স্থানে।
এই চার বছরে শুধুমাত্র টেস্ট ক্রিকেটে না, ওডিয়াইতেও তার সাফল্য ছিলো চোখে পড়ার মতো। ক্যারিয়ারের প্রথম চার বছরে ৩৩ টি ওডিয়াইতে মাত্র ৩৮০ রান করা স্টিভেন স্মিথ ২০১৬ সালেই ৫০.১৭ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ১১৫৪ রান। এছাড়া ২০১৫ সালে ৫৩.৬৬ ব্যাটিং গড়ে করেন ৮০৫ রান এবং ২০১৪ সালে ৪৯.১৮ ব্যাটিং গড়ে করেন ৫৪১ রান।
স্টিভেন স্মিথ লেফ স্পিনার থেকে ব্যাটসম্যান হয়ে উঠেছেন খুব দ্রুতই, সেইসাথে আস্তে আস্তে কিংবদন্তি হয়ে উঠছেন স্টিভ স্মিথ। টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ইনিংসে বড় সংগ্রহ জমা করতে পারলে যেকোনো দল মানুষিকভাবে এগিয়ে থাকে। আর স্টিভেন স্মিথ সে কাজটা খুব ভালোভাবেই করতে পারেন। টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ইনিংসে ৯১.৬৮ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ২২৯৫ রান। প্রথম ইনিংসে ব্যাটিং গড়ের দিক দিয়ে তার উপরে আছে শুধুমাত্র ডন ব্রাডম্যান।
টেস্ট ক্রিকেটে কমপক্ষে ৯০ ইনিংস ব্যাট করা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে দ্বিতীয় সেরা ব্যাটিং গড় এখন স্টিভেন স্মিথের দখলে। এখন পর্যন্ত খেলা ৯০ টি টেস্ট ইনিংসে ৬০.৬৩ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ৪৬৬৯ রান, যার মধ্যে ১৯ টি অর্ধশতকের বিপরীতে আছে ১৭ টি শতক।
ক্রিকেটের ইতিহাসে মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান থেকে ওপেনার হয়ে উঠা, কিংবা মাঝেমধ্যে দুয়েকটি অসাধারণ ইনিংস খেলা বোলারদের সংখ্যা খুব একটা কম নয়। কিন্তু স্টিভেন স্মিথের মতো বিশ্বসেরা হয়ে উঠতে পারার ক্ষমতা সবার থাকে না। এখন তো স্টিভ স্মিথকে বল হাতে দেখাই যায় না, যা করার ব্যাট হাতেই করে দেন অদ্ভুতুড়ে স্টাইলে ব্যাট করা এই ব্যাটসম্যান। দিনদিন নিজেকে নিয়ে যাচ্ছে অনন্য উচ্চতায়, ক্যারিয়ার শেষে হয়তো আরো উঁচু স্থানেই তাকে দেখা যাবে।