ঝুলে রইল লিভারপুল-অ্যাটলেটিকোর ভাগ্য

উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের পঞ্চম গেমউইকে নক-আউট রাউন্ড নিশ্চিত করার লড়াইয়ে নেমেছিল বেশ কয়েকটি দল। এর মধ্যে পিএসজি ও রিয়াল মাদ্রিদের ম্যাচ নিয়েই সবচেয়ে বেশি আলোচনা ছিল। প্রথম চারটি ম্যাচে জেতার ফলে পিএসজির নক-আউট রাউন্ড নিশ্চিত হয়ে গেছিল আগেই, তবে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়া নিশ্চিত করার জন্য এ ম্যাচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অন্যদিকে পিএসজির বিপক্ষে ০-৩ গোলের হার দিয়ে আসর শুরুর করায় বেশ সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ। তাই, নিজেদের নক-আউট রাউন্ড নিশ্চিতের পাশাপাশি সেই সমালোচনার জবাব দেওয়ার জন্য হলেও মাদ্রিদের জন্য জয় পাওয়া বেশ জরুরি ছিল।

এমন হাই-ভোল্টেজ ম্যাচে দু’দলের কোচই কিছুটা অদ্ভুত একাদশ নামান। পিএসজি কোচ থমাস টুখেল দলের সেরা তারকা নেইমারকে বাইরে রেখেই একাদশ সাজান। অন্যদিকে অধিকাংশ ম্যাচ বেঞ্চে কাটানো ইস্কোকে এ ম্যাচেই নামানোর সিদ্ধান্ত নেন জিনেদিন জিদান। বার্নাব্যুতে ম্যাচের শুরু থেকেই দাপট দেখাতে থাকে পিএসজি, তবে ধারার বিপরীতে খেলার ১৭ মিনিটে দারুণ এক আক্রমণ শুরু করেন হ্যাজার্ড, সেখান থেকে কার্ভাহালের কাছ থেকে বল পেয়ে পেনাল্টি বক্সে থাকা ইস্কোর দিকে বাড়িয়ে দেন ভালভার্দে। ইস্কোর শট বারে লেগে ফিরলেও ফিরতি শটে গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেন করিম বেনজেমা। 

প্রথম গোলের পর উল্লসিত বেনজেমা; Photo Credit: TF-Images/Getty Images

ম্যাচের ৪২ মিনিটে বেশ নাটকীয় এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়, মাউরো ইকার্দিকে ফাউলের দায়ে রিয়াল মাদ্রিদের গোলরক্ষক থিবো কর্তোয়াকে লাল কার্ড দেখান রাফ্রি। কিন্তু রিপ্লেতে দেখা যায় ইকার্দির কাছে বল আসার আগেই মার্সেলোকে ফাউল করেছিলেন গুইয়ে, তাই লাল কার্ডের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেন রেফারি।

খেলায় ফিরতে মরিয়া পিএসজি দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই গুইয়েকে উঠিয়ে নেইমারকে নামায়। খেলার ৭৮ মিনিটে মার্সেলোর ক্রসে বেনজেমার গোলে উল্টো ব্যবধান দ্বিগুণ করে রিয়াল মাদ্রিদ। এর দুই মিনিট পরেই রাফায়েল ভারানের ভুলে ব্যবধান ২-১ করেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। আর ৮৩ মিনিটে দারুণ এক দলগত আক্রমণে গোল করে ২-২ গোলের ড্র নিশ্চিতের পাশাপাশি পিএসজির গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়াটাও নিশ্চিত করেন পাবলো সারাবিয়া। অবশ্য ক্লাব ব্রুগে ও গ্যালাতাসারের ম্যাচ ১-১ গোলে ড্র হওয়ায় রিয়াল মাদ্রিদের নক-আউট রাউন্ডও নিশ্চিত হয়ে গেছে। 

গ্রুপ বি এর ম্যাচে বেলগ্রেড রেড স্টারের বিপক্ষে অ্যাওয়ে ম্যাচে রীতিমতো গোলবন্যা বইয়ে দিয়েছে বায়ার্ন মিউনিখ। এ মৌসুমে অবিশ্বাস্য ফর্মে থাকা রবার্ট লেওয়ান্ডস্কির চার গোল এবং গোরেৎজকা ও টলিসোর এক গোলে ৬-০ গোলের জয় তুলে নিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়া নিশ্চিত করেছে জার্মান চ্যাম্পিয়নরা। গ্রুপের আরেক ম্যাচে মাত্র ১৯ মিনিটের মাঝে অলিম্পিয়াকোসের বিপক্ষে ০-২ গোলে পিছিয়ে পড়ে টটেনহ্যাম। এরপর হ্যারি কেইনের জোড়া গোল এবং অরিয়ের ও ডেলে আলির এক গোলে ৪-২ গোলের দারুণ এক জয়ে নক-আউট রাউন্ড নিশ্চিত করেছে স্পার্স। 

এ মৌসুমে অবিস্বাস্য ফর্মে আছেন লেভান্ডস্কি; Image Source: Maja Hitij/Bongarts/Getty Images

গ্রুপ সি এর ম্যাচে ঘরের মাঠে শাখতার দোনেৎস্কের মুখোমুখি হয় ম্যানচেস্টার সিটি। প্রথমার্ধ গোলশূন্য থাকার পর দ্বিতীয়ার্ধের ৫৬ মিনিটে গ্যাব্রিয়েল জেসুসের অ্যাসিস্টে গোল করে দলকে এগিয়ে দেন ইকেই গুন্ডোগান। তবে ৬৯ মিনিটে মানোর সলোমনের গোলে খেলায় সমতা ফেরায় শাখতার। শেষপর্যন্ত ম্যাচটি ১-১ গোলে ড্র হলেও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে সিটিজেনদের পরের রাউন্ডে খেলা নিশ্চিত হয়ে গেছে। গ্রুপের অন্য ম্যাচে ডায়নামো জাগরেবকে ২-০ গোলে হারিয়ে দিয়ে সিটিজেনদের সঙ্গী হয়ে পরের রাউন্ডে যাওয়ার লড়াইটা দারুণ জমিয়ে তুলেছে আটালান্টা।

গ্রুপ ডি এর মহারণে ঘরের মাঠে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের মুখোমুখি হয় জুভেন্টাস। প্রথমার্ধের ইনজুরি সময়ে ফ্রি-কিক থেকে পাওলো দিবালার দুর্দান্ত এক গোল ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেয়। ১-০ গোলের এই জয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে পরের রাউন্ড নিশ্চিত করেছে তুরিনের ওল্ড লেডিরা। এদিকে লকমোটিভ মস্কোর বিপক্ষে অ্যাওয়ে ম্যাচে ২-০ গোলের জয় তুলে নিয়ে অ্যাটলেটিকোর রাস্তা একটু কঠিন করে দিয়েছে বেয়ার লেভারকুজেন। নক-আউট পর্বে যেতে হলে শেষ ম্যাচে লকমোটিভ মস্কোর বিপক্ষে জয় পাওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে অ্যাটলেটিকোর জন্য। যদি জয় ভিন্ন অন্য কোনো ফল আসে, তবে তাদের তাকিয়ে থাকতে হবে জুভেন্টাস-লেভারকুজেন ম্যাচের দিকে। 

অনবদ্য সেই গোলের পর দিবালা; Marcio Machado/Eurasia Sport Images/Getty Images

গ্রুপ ই এর ম্যাচে অ্যানফিল্ডে লিভারপুল-নাপোলি দু’দলের সামনেই নক-আউট রাউন্ড নিশ্চিতের সুযোগ ছিল। ২১ মিনিটে লিভারপুলের অফসাইড ট্র্যাপকে ফাঁকি দিয়ে দারুণ এক গোল করে সেই লড়াইয়ে নাপোলিকে এগিয়ে দেন ড্রিয়েস মার্টেন্স। ৬৫ মিনিটে মিলনারের পাস থেকে গোল করে খেলায় সমতা ফেরান ডেহান লভ্রেন। শেষপর্যন্ত ১-১ গোলে অমীমাংসিতভাবে শেষ হয় ম্যাচ। অন্য ম্যাচে গেঙ্ককে ৪-১ গোলে হারিয়ে নক-আউট রাউন্ডের লড়াই দারুণ জমিয়ে তুলেছে রেড বুল সালজবার্গ। ১০ পয়েন্ট নিয়ে আপাতত পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে থাকলেও নিজেদের শেষ ম্যাচে সালজবার্গের কাছে হেরে গেলে গ্রুপ পর্বে বাদ পড়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে লিভারপুলের।

মৃত্যুকূপ হিসেবে আখ্যায়িত গ্রুপ এফ এর গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ন্যূ ক্যাম্পে বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের মুখোমুখি হয় বার্সেলোনা। আগের রাউন্ডে ঘরের মাঠে স্লাভিয়া প্রাগের বিরুদ্ধে গোলশূন্য ড্র করায় এ ম্যাচের শুরুতে বেশ চাপে ছিল বার্সেলোনা। কিন্তু যাদের দলে একজন লিওনেল মেসি আছেন, তাদের কি আর এত চিন্তা করার প্রয়োজন আছে! ম্যাচের ২৮ মিনিটে মেসির দারুণ এক বুদ্ধিদীপ্ত পাস থেকে গোল করে দলকে এগিয়ে দেন লুইস সুয়ারেজ। ৪ মিনিট পর সুয়ারেজের সাথে দারুণ ওয়ান-টু-ওয়ান পাস থেকে গোল করে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন মেসি। খেলায় ফেরার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকে বরুশিয়া, কিন্তু টার স্টেগানের দৃঢ়তায় তার কোনোটিই সাফল্যের মুখ দেখেনি। 

একাই ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন মেসি; Photo Credit:  David Ramos/Getty Images

উল্টো ম্যাচের ৬৬ মিনিটে সেন্টার সার্কেল থেকে একক নৈপুণ্যে দারুণভাবে বল টেনে এনে বাঁ প্রান্তে ফাঁকায় থাকায় গ্রিজম্যানের দিকে বল বাড়িয়ে দেন মেসি। এই সহজ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ৩-০ গোলে দলকে এগিয়ে দেন গ্রিজম্যান। ৭৬ মিনিটে অনবদ্য এক গোল করে অবশ্য ব্যবধান কমিয়েছিলেন জ্যাডন সাঞ্চো, তাতে ম্যাচের ফলে তেমন প্রভাব আসেনি। ৩-১ গোলের এই জয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে পরের রাউন্ড নিশ্চিত করেছে বার্সেলোনা।

গ্রুপের আরেক ম্যাচে স্লাভিয়া প্রাগের বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ অ্যাওয়ে ম্যাচে মুখোমুখি হয় ইন্টার মিলান। ম্যাচের ১৯ মিনিটে রোমেলু লুকাকুর পাস থেকে গোল করে ইন্টারকে এগিয়ে দেন লাউতারো মার্টিনেজ। তবে ৩৭ মিনিটে গোল করে প্রাগকে সমতায় ফেরান টমাস। দ্বিতীয়ার্ধের শেষদিকে মার্টিনেজ-লুকাকুর জুটি আবারো জ্বলে ওঠে। ৮১ মিনিটে ভ্যালেন্টিনো লাজারোর পাস থেকে গোল করে দলকে ২-১ গোলে এগিয়ে দেন লুকাকু। আর ৮৮ মিনিটে তার পাস থেকেই গোল করে দলের জয় নিশ্চিত করেন মার্টিনেজ। এই জয়ের পরেও ইন্টারের নক-আউট রাউন্ডে যাওয়ার রাস্তাটা বেশ কঠিন। শেষ রাউন্ডের ম্যাচে প্রাগকে যদি হারিয়ে দেয় বরুশিয়া, তবে স্যান সিরোতে বার্সার বিপক্ষে জয় ভিন্ন অন্য কোনো পথ ইন্টারের জন্য খোলা থাকবে না। 

ইন্টারের জয়ের মুল কারিগর এই জুটি; Image Source: Claudio Villa – Inter/Inter via Getty Images

গ্রুপ জি এর ম্যাচে ম্যাচের ৯০ মিনিট পর্যন্ত বেনফিকার বিরুদ্ধে ২-০ গোলে পিছিয়ে ছিল লাইপজিগ। কিন্তু ইনজুরি সময়ে এমিল ফোর্সবার্গের জোড়া গোলে শেষপর্যন্ত ২-২ গোলের ড্র নিয়ে মাঠ ছেড়েছে জার্মান ক্লাবটি। গ্রুপের অন্য ম্যাচে লিঁওর বিপক্ষে ২-০ গোলের জয় তুলে নিয়ে নক-আউট পর্বে যাওয়ার লড়াই বেশ জমিয়ে তুলেছে জেনিত।

গ্রুপ এইচ এর গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ভ্যালেন্সিয়া ও চেলসির ম্যাচ ছিল টানটান উত্তেজনায় পরিপূর্ণ। ৪০ মিনিটে ভ্যালেন্সিয়াকে এগিয়ে দেন কার্লোস সোলার। মাত্র এক মিনিট পরেই খেলায় সমতা ফেরান মাতেও কোভাচিচ। দ্বিতীয়ার্ধের ৫০ মিনিটে পুলিসিচের গোলে এগিয়ে যায় চেলসি। ৬৪ মিনিটে খেলায় ফেরার সুযোগ পেয়েছিল ভ্যালেন্সিয়া, কিন্তু ড্যানি পারেজোর নেওয়া পেনাল্টি ফিরিয়ে দেন কেপা। ৮২ মিনিটে সেই পারেজোর পাস থেকে ড্যানিয়েল ওয়াসের গোলে ম্যাচ শেষ হয় ২-২ স্কোরলাইনে। অন্য ম্যাচে হাকিম জিয়েখ ও কুইন্সি প্রমিসের গোলে ২-০ গোলে লিলেকে হারিয়েছে আয়াক্স। এই গ্রুপ থেকে কোনো দলের নক-আউট রাউন্ড নিশ্চিত হয়নি, শেষ রাউন্ডের নানা হিসাব-নিকাশে চূড়ান্ত হবে কোন দুই দল পরের রাউন্ডে যাওয়ার সুযোগ পাবে।

খেলাধুলার চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/

ফুটবল নিয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ

১) মুক্তিযুদ্ধে ফুটবল

২) ক্রিকেট ও ফুটবল খেলার আইন কানুন

  

This article is in Bangla language. It's an analysis about the fifth gameweek of UEFA Champions League. For references please check the hyperlinks inside the article.

Featured Image: Etsuo Hara/Getty Images

Related Articles

Exit mobile version