গোলরক্ষকদের জন্য নতুন এক যুগের সূচনা হল। এখন ফুটবল ম্যাচে হয়ত হরহামেশাই পেনাল্টি বাতিল হতে দেখা যাবে, সমালোচনা সৃষ্টি হবে। কারণ পেনাল্টি শট নেবার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি নতুন নিয়ম যুক্ত করা হয়েছে। এখন পেনাল্টি নেবার সময়ে গোলরক্ষকদের নতুন তিনটি নিয়ম মেনে চলতেই হবে:
- যে পেনাল্টি নিচ্ছে, তাকে গোলরক্ষকেরা উত্যক্ত বা মনোযোগ নষ্ট করার মতো কোনো কাজ করতে পারবেন না।
- পেনাল্টি নেবার সময় বাড়িয়ে দেরি করিয়ে দেয়া যাবে না।
- গোল পোস্ট এবং নেট ছুঁতে পারবেন না গোলরক্ষকরা।
নতুন এই তিন নিয়ম বাস্তবায়ন হবে আগামী পহেলা জুলাই হতে। এই তিন নিয়ম এত দ্রুত আসার কথা ছিল না। কারণ আজ থেকে দুই বছর আগেও এসব নিয়ে ফিফার মঞ্চে কানাঘুষো হয়নি। মূলত এই নিয়ম আনা হয়েছেই একমাত্র এমি মার্টিনেজের জন্য।
না, তিনি দোষের কিছু করেননি। পেনাল্টির সময় গোলরক্ষকেরা প্রতিপক্ষকে কথা ফাঁদে ফেলে মনোযোগ নষ্ট করবেন; বহু আগে থেকে এমনটা হয়ে আসছে। এমি এই কৌশলই মাঠে খাটিয়েছেন। পেনাল্টি নেওয়ার সময় তার কর্মকাণ্ড আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জেতার পেনাল্টি শ্যুটআউটে বড় রকমের সুবিধা রেখেছিল। কাতার বিশ্বকাপ এবং ব্রাজিল কোপা আমেরিকায় কলম্বিয়ার বিপক্ষে এমির ‘মাইন্ডগেম’ প্রতিপক্ষের মনোযোগ এবং আত্মবিশ্বাসে গুলি মেরে একদম ঝাঁঝরা করে দিয়েছিলেন। নিয়মটা যেহেতু এবার পালটে গেল, তাই ফুটবলে গোলরক্ষকদের এহেন চাল আর কখনো দেখা যাবে না। তাই এবার একবার এমি মার্টিনেজের মনস্তাত্ত্বিক খেলার ব্যবচ্ছেদ করে দেখা যাক।
গল্পের শুরু ২০২১-এর কোপা আমেরিকা থেকে। চলে যাওয়া যাক সুদূর লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে।
স্তাদিও নাসিওনালে কোপা আমেরিকার সেমিফাইনালের ম্যাচ। ১-১ গোলের সমতা নিয়ে আর্জেন্টিনা এবং কলম্বিয়া পেনাল্টি শুটআউটে। হুয়ান কুয়াদ্রাদো এবং লিওনেল মেসি যথাক্রমে তাদের নিজ নিজ দেশের হয়ে প্রথম পেনাল্টি জালে জড়াতে সক্ষম হয়েছেন। এবার পালা ইয়েরি মিনার। বল নিয়ে এগিয়ে আসলেন তিনি। আর্জেন্টিনার গোলবারে এমি মার্টিনেজ তাকে কিছু একটা বলে চলেছেন।
“তুমি নার্ভাস তাই না? তুমি হাসছো, মনে হচ্ছে তুমি নার্ভাস।”
ইয়েরি মিনা আসলেই হাসছিলেন। এবার বলেই ফেললেন,
“হ্যাঁ।”
এমি ক্রমাগত বলেই চলেছেন।
“তুমি নার্ভাস, তুমি নার্ভাস।”
মিনা এসে নির্দিষ্ট স্থানে বল বসালেন। তখন এমি বলছেন,
“দেখো। দেখো। ও বলটা তো আগে বসাল।”
এমির এসব কথা শুনে ম্যাচের রেফারির দায়িত্বে থাকা হেসুস ভ্যালেনজুয়েলা পর্যন্ত ভড়কে গেলেন। নিজে এসে খতিয়ে দেখলেন মিনা বল ঠিক জায়গাতে বসিয়েছে কি না।
এমি তখন ক্রমাগত বলে চলেছেন,
“আমি চিনি তোমাকে। দেখ আমার দিকে। তাকাও। দেখ আমি, কীভাবে জানি তুমি কোনদিকে শট নেবে। তারপর দেখো কীভাবে ঠেকাই।”
মিনা ততক্ষণে শট নিতে চলেছেন। এমি তখনও বলে চলেছেন,
“তুমি শেষ ভাই, তুমি শেষ।”
এসব ভড়কে দেয়া কথা বলতে বলতে তিনি ডানদিকে ঝাপ মেরে মিনার শট ঠেকিয়ে দিলেন। তারপর বুনো উল্লাস। কলম্বিয়ার তৃতীয় পেনাল্টি নেবার সময়ে যখন খেলোয়াড় এগিয়ে আসছেন। তাকে দেখেই এমি বলে বসেন,
“এই তুমি ভয় পাচ্ছ নাকি?”
তারপর ছাপার অযোগ্য কিছু ভাষার ব্যবহার। রেফারি এগিয়ে এলেন। বারবার এমিকে বললেন,
“মার্টিনেজ, চুপ করো। এসব কথা বলো না। এসব শব্দ বলা বাদ দাও।”
কিন্তু এমিকে থামায় কে! যদিও এই পেনাল্টি তিনি ঠেকাতে পারেননি। কিন্তু ঠিকই পরের পেনাল্টি ঠেকিয়ে আর্জেন্টিনাকে তুলেছিলেন ফাইনালের মঞ্চে। পরিষ্কারভাবে না হলেও, পেনাল্টি নেবার সময়ে এমি যে মাইন্ডগেম খেলার ওস্তাদ, সে বিষয়ে সুক্ষ্ম ধারণা সেদিন পাওয়া গিয়েছিল।
২০২১ থেকে এবার গত বছরের কাতার বিশ্বকাপে ফেরত আসি। ফাইনালে আর্জেন্টিনা আর ফ্রান্সের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। প্রায় জিতে যাওয়া ম্যাচে চোখের পলকে সমতায় নিয়ে এলেন এমবাপে। অতিরিক্ত মিনিটে মেসি গোল করে আবার আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে নিলেন। নাটক তখনও বাকি। আলবিসেলেন্তে সমর্থকদের স্তব্ধ করে কিছুক্ষণ পর আবার এমবাপের গোল। ৩-৩ গোলে সমতার ম্যাচ গড়ালো টাইব্রেকারে। কোলো মুয়ানির নিশ্চিত গোল ঠেকিয়ে আর্জেন্টিনার স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখা এমি মার্টিনেজের তখন দৃশ্যপটে আগমন।
কয়েন টস পর্ব শেষ হল। তিনি ছুটে গেলেন নির্ধারিত গোলবারের দিকে। তখনও ফ্রান্সের গোলরক্ষক হিউগো লরিস সেখানে আসেননি। কিছুক্ষণ পর লরিস সেখানে এলে এমি নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে তার সাথে হাত মেলালেন। যেন নিজের বাড়িতে অতিথিকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন তিনি। এমবাপে যখন প্রথম পেনাল্টি নিতে গেলেন এমি নিজে থেকে এসে তার সাথে হাত মেলালেন। যেন নিজের রাজ্যে অতিথিকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন তিনি। নিজে থেকে এগিয়ে এসে হাত মেলানো, উষ্ণ অভ্যর্থনা – এ সব কিছুই তার পরিকল্পনার অংশ। এরপর পেনাল্টি নেবার আগে এমবাপেকে বিরক্ত করে বসলেন তিনি। হাত উঁচিয়ে জানতে চাইলেন, সে ঠিক জায়গায় বল বসিয়েছে কি না। রেফারি পর্যন্ত গিয়ে পরীক্ষা করে এসে এমিকে জানালেন সব ঠিক আছে। প্রচণ্ড চাপের মাঝে পরে এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই গুবলেট পাকিয়ে বসেন। এমির এমন ব্যবহার সেই চাপের আগুনে ঘি ঢেলে দেবার মতো। যদিও এই মনস্তাত্তিক লড়াইয়ে জিতে গেছেন এমবাপে। এমি মার্টিনেজ ঠিক দিকে ঝাঁপ দিলেও প্রথম পেনাল্টি ফ্রান্স ঠিকই জালে জড়িয়েছিল।
কিন্তু এমবাপে এই লড়াইয়ে জিতে গেলেও হেরে গেছেন কিংসলে ক্যোমান। প্রথম থেকেই খানিকটা চাপে ছিলেন তিনি। পেনাল্টি নিতে এসে আবার পড়লেন এমির তোপের উপরে। এমি বারবার বলছেন বল লাইনের উপরে আছে কি না। রেফারি গিয়ে আবার দেখে এসে বললেন, সব ঠিক আছে। এতে খানিকটা সময় পার হয়ে গেছে। ক্যোমানের ততক্ষণে কম্ম কাবার। তার নেওয়া শট খুব সহজেই অনুমান করে ফেললেন এমি।
পেনাল্টি সেভ করে সেভাবে উদযাপন করতে দেখা যায় না। কিন্তু এমি মার্টিনেজ তো অন্য ধাতুতে গড়া। তিনি বুনো উল্লাসে মাতলেন। এই উল্লাস বলে দিল এমি এবং আর্জেন্টিনার আধিপত্য। ক্যোমান পেনাল্টি মিস করেছেন, কিন্তু কিছুক্ষণ পর ঠিকই সফলভাবে পেনাল্টি নিয়েছেন পাওলো দিবালা। পেনাল্টি স্কোর আর এমির উদযাপন মিলিয়ে ফ্রান্সের খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরতে শুরু করছে। ধীরে ধীরে তারা জয়ের দৃশ্যপট থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে।
ফ্রান্সের হয়ে তরুণ এক মিডফিল্ডার এবার এগিয়ে এলেন পেনাল্টি নিতে। চুয়ামেনি সম্পর্কে এমি খুব ভালো জানেন। পড়াশোনাটা যে আগেই করে রেখেছেন। বয়স কম, প্রচণ্ড চাপে পড়ে ভুল করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক সেই দুর্বলতার সুযোগ নিলেন। বলটা ছিল এমির হাতে। চুয়ামেনি এগিয়ে যাচ্ছিলেন তার হাত থেকে বল নিতে। তিনি কাছাকাছি যাওয়ার সাথেই এমি বলটা দূরে ছুড়ে মারলেন। অগত্যা চুয়ামেনিকে আবার বল নিতে যেতে হলো।
সামনে থেকে বল ছুড়ে মারা এবং বল আবার আনতে যাওয়ার মধ্যকার সময়েই হেরে গেলেন তিনি। এমির কাণ্ড দেখে আর্জেন্টাইনরা আরও জোরে গর্জে উঠেছে। চুয়ামেনি এসে শটটা মারলেন একদম বাইরে। বাম বারের কোনা ঘেঁষে বেরিয়ে গেল বলটি। বল ছুড়ে মেরে এমি বোঝাতে চেয়েছেন এই গোলবারের রাজা কে! চুয়ামেনি আত্মবিশ্বাস কমে গেছে সেখানেই।
চুয়ামেনি তো মিস করলেন। এমি বারবার ফ্রান্সের খেলোয়াড়দের মনোযোগ নষ্ট করছেন, বিভ্রান্ত করার চেস্টা চালাচ্ছেন। এসব কিছু দেখে ফরাসি শিবিরে সবাই তো এখন বসে রইবে না। হিউগো লরিসও এখন চেষ্টা করবেন কিছু করার। কিন্তু এমি সেই সুযোগ দিলেন না। চুয়ামেনির মারা বল নিজে তুলে দ্রুত তুলে দিলেন পারেদেসের হাতে। যাতে লরিসের কিছু করার সুযোগ না থাকে।
কোলো মুয়ানি যখন পেনাল্টি নিতে আসেন তখন এমি তার মাইন্ডগেমের লেভেল আরও এক ধাপ বাড়িয়ে দিলেন। চোখে হাত দিয়ে বুঝিয়ে বলতে লাগলেন,
“দেখছি তোমাকে!”
তবে মাঠে থাকা রেফারি ততক্ষণে এমির এই খেলা ধরে ফেলেছেন। তিনি তাকে থামিয়ে দিলেন। কোলো মুয়ানির কাছেই ঘেঁষতে দিলেন না। এমিকেও দেখালেন হলুদ কার্ড। কোলো মুয়ানি এই পেনাল্টি থেকে গোল করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাতে কিছুই আসে যায় না। কারণ তার ঠিক পরের শটও জালে জড়িয়ে দিয়েছেন মন্তিয়েল এবং আর্জেন্টিনা ততক্ষণে জিতে গেছেন তাদের তৃতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা।
গোলবারের নিচে এমি মার্টিনেজ একজন দানবই বটে। তাকে টপকে পেনাল্টিতে গোল করা যেমন মুশকিল, তেমনই তার খেলা মাইন্ডগেম উপেক্ষা করে শান্ত থাকা আরও কঠিন। গোলবারের আশপাশ যেন তার পাতা ফাঁদ। এই ফাঁদে পা যেন প্রতিপক্ষকে দিতেই হবে। নিজে থেকে না দিলেও এমি মার্টিনেজ ফাঁদে ঠেলে ফেলে দেবেন।
তবে নিয়ম বদলে গেছে। তিনি তার বিখ্যাত কৌশলের প্রয়োগ আর ফুটবল মাঠে করতে পারবেন না। স্লেজিং বা কথার প্যাঁচে ফেলে আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেওয়ার সুযোগ এখন আর নেই। এখন তাকে নির্ভর করতে হবে শুধুমাত্র তার পেনাল্টি ঠেকানোর দক্ষতার উপর।