পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবল লিগ হলো ইউরোপের শীর্ষ পাঁচটি লীগ (লা লিগা, প্রিমিয়ার লিগ, সেরি আ, বুন্দেস লিগা, এবং লিগ ওয়ান)। এই লীগগুলোতে ইউরোপের খেলোয়াড়রা তো বটেই, বাইরের মহাদেশের খেলোয়াড়রাও খেলার স্বপ্ন দেখে থাকেন। গণমাধ্যম এই লিগের প্রতিটা মুহুর্তের খবর প্রকাশ করতে ব্যস্ত থাকে, বিশ্বের তাবৎ ফুটবলপ্রেমী রাত জেগে এই লীগগুলোর খেলা দেখে থাকেন। প্রতিটা দেশেই কোনো না কোনো সময় এক বা একাধিক প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের আবির্ভাব ঘটে যাদের উপর সেসব দেশের ফুটবলপ্রেমী নাগরিকরা ভরসা করার সাহস পান, দিয়ে যান অকুণ্ঠ সমর্থন। সাধারণ মানুষের কাছে অনেক সময় এই খেলোয়াড়েরা হয়ে ওঠেন মানুষের চেয়েও বেশি কিছু। যেমন বলা যায় একটা সময় তুরস্কের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রতিভাবান খেলোয়াড় ভাবা হতো আর্ডা তুরানকে। তুরস্ক তো বটেই, লা লিগারও তার অসংখ্য সমর্থক তাকে নিয়ে আশায় বুক বেধেছিলেন।
আর্ডা তুরানের উত্থান ছিল পুরো গল্পের মতো। শৈশবের ক্লাব ছিল গ্যালাতাসারে। এই ক্লাবের বয়সভিত্তিক দলগুলোতে দারুণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করে মাত্র উনিশ বছর বয়সেই তাকে মূল দলে সুযোগ দেয়া হয়। মূল দলের হয়ে তার অভিষেক হয় চ্যাম্পিয়ন্স লীগের এক ম্যাচে, যে ম্যাচে দুই গোল করে নিজের আবির্ভাবের বার্তা দিয়েছিলেন সেসময়ে। ড্রেসিংরুমে কিংবা মাঠে তার নেতৃত্বসুলভ মানসিকতা ক্লাবের কর্মকর্তাদের চোখ এড়ায়নি। দলে তার চেয়ে অভিজ্ঞ খেলোয়াড় থাকার পরও নিয়মিত নৈপুণ্য প্রদর্শনের ফলে মাত্র একুশ বছর বয়সেই তার বাহুতে ক্যাপ্টেনের আর্মব্যান্ড পরিয়ে দেয়া হয়। ইউরোপের বড় বড় ক্লাবগুলো তার দিকে নজর দেয়া শুরু করে। এরপর বাইশ বছর বয়সেই লা লীগার দল অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ তাকে দলে ভেড়ায়। রাদামেল ফ্যালকাও, ডিয়েগো গডিনদের মতো তারকাদের পাশে নিজের ক্রীড়ানৈপুণ্য প্রদর্শনের সুযোগ পান এবার।
ডিয়েগো সিমেওনের যে দল ২০১১-১২ মৌসুমে ইউরোপা লীগ ও ২০১২-১৩ মৌসুমে লা লীগার শিরোপা জিতেছিল, সেই দলের সদস্য ছিলেন আর্ডা তুরান। লা লীগায় বার্সেলোনা ও অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের দ্বৈত আধিপত্য ভেঙে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের সাফল্যের পেছনে তার ব্যক্তিগত ক্রীড়ানৈপুণ্যের বড় অবদান ছিল। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে তার সাফল্যের কারণে স্পেনের আরেক বিখ্যাত ক্লাব বার্সেলোনা তার প্রতি আগ্রহী হয়। ২০১৫ সালে প্রায় ৪০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে তাকে বার্সেলোনায় নিয়ে আসা হয়েছিল। বার্সেলোনার তারকায় ঠাসা মিডফিল্ডে তার সাইনিংটি তার প্রতিভার একটি স্মারক হয়ে থাকবে। কোচ লুই এনরিকে তার দলবদলের পেছনে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু তার আগমনের পর পরই লুই এনরিকে-কে ক্লাবটির কোচের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়, এর্নেস্তো ভালভের্দে নতুন কোচ হিসেবে বার্সেলোনার ডাগআউটে পা রাখেন।
যারা ফুটবলের খোঁজখবর রাখেন, তারা বেশ ভালো করেই জানেন যে স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনা বরাবরই দুর্দান্ত প্রতিভাবান সব মিডফিল্ডার উপহার দিয়েছে বিশ্বকে। বার্সেলোনা শুধু জয়েই বিশ্বাসী নয়, একইসাথে দৃষ্টিনন্দন ফুটবল খেলা উপহার দেয়াও তাদের দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করে আসছে বছরের পর বছর ধরে। এই ক্লাবের যে দর্শন, সেই দর্শনকে পুঁজি করে মিডফিল্ডাররা মাতিয়েছেন পৃথিবীর বিখ্যাত সব স্টেডিয়াম, মন্ত্রমুগ্ধ করেছেন হাজার হাজার দর্শককে। বার্সেলোনার এই দর্শনগত স্বাতন্ত্র্যের কারণে পুরো বিশ্বেই তাদের একটি আলাদা পরিচয় আছে। সুতরাং এই ক্লাব যখন বাইরের কোনো মিডফিল্ডারকে দলে আনার জন্য বেশ বড় অংকের অর্থ ব্যয় করে, তখন এটা বুঝতে কষ্ট হয় না যে সেই প্লেয়ারের মধ্যে ক্লাবের স্কাউট ও কর্মকর্তারা ‘বিশেষ’ কিছু দেখেছেন।
বার্সেলোনায় আসার পর আর্ডা তুরানের ভাগ্য খারাপই বলতে হয়। ২০১৫ সালে গ্রীষ্মকালীন দলবদলের মৌসুমে তাকে বার্সেলোনা দলে ভেড়ালেও ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসের আগপর্যন্ত তিনি খেলতে পারেননি, বার্সেলোনার দলবদলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হওয়ার কারণে। ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে জুন– এই ছয় মাসে আর্ডা তুরান সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে খেলেছিলেন ষোলটি ম্যাচ, প্রতিপক্ষের জালে বল জড়িয়েছিলেন মাত্র একটি। এর পাশাপাশি একটি ঘটনা তাকে সমর্থকদের চক্ষুশুলে পরিণত করে। ২০১৫-১৬ মৌসুমে কোপা ডেল রে’র একটি ম্যাচে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মাদ্রিদের বিপক্ষে অপ্রয়োজনীয় ফাউল করে নিশ্চিত জয়ের ম্যাচটি ড্র করে সমর্থকদের চক্ষুশুলে পরিণত হন। তৎকালীন কোচ লুই এনরিকে ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে সরাসরিই তাকে দায়ী করেছিলেন। তবে এর পরের মৌসুমে তিনি তার নামের প্রতি কিছুটা সুবিচার করেন। ত্রিশটি ম্যাচ খেলে গোল করেছিলেন তেরোটি। একজন মিডফিল্ডার হিসেবে এই পরিসংখ্যান নিঃসন্দেহে দারুণ।
২০১৬-১৭ মৌসুমে জাতীয় দলের ম্যাচের জন্য যখন প্লেনে ভ্রমণ করছিলেন, তখন ঘটান একটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা। একজন সাংবাদিকের সাথে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হন। ইন্ডিপেন্ডেন্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ঘটনার আগে সাংবাদিক বিলাল মেসে তাকে তুরস্কের জাতীয় ফুটবল দলের সমন্বয়হীনতার জন্য দায়ী করেছিলেন। পরে প্লেনে ভ্রমণের সময় তাকে প্রথমে তার গলা চেপে ধরেন আর্ডা তুরান। তার সতীর্থরা তার হাত থেকে সাংবাদিক বিলালকে মুক্ত করেন। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বার্সেলোনার কর্মকর্তারা হতবাক হয়ে যান। ক্লাবটিতে তার চুক্তির যখন প্রায় আড়াই বছর বাকি, তখন কোচ ভালভের্দের পরামর্শে তাকে তুরস্কের আরেকটি বড় ক্লাব ইস্তাম্বুল বেসিকসেহিরে ধারে পাঠানো হয়। সেই ক্লাবের হয়ে একটি ম্যাচে তিনি লাইন্সম্যানকে ধাক্কা মেরে ষোল ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা পান। তুরস্কের ইতিহাসে এত বড় নিষেধাজ্ঞার ঘটনা দ্বিতীয়টি নেই। গণমাধ্যম তার সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে।
এরপর তিনি ঘটিয়ে বসেন আরেক এলাহি কান্ড। তুরস্কের পপ তারকা বের্কেই শাহিনের স্ত্রী-র বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বের্কেই শাহিন সরাসরি ফুটবলার আর্ডা তুরানের মুখোমুখি হন। একপর্যায়ে পপ তারকা শাহিনের নাক ফাটিয়ে ফেলেন আর্ডা তুরান। পরবর্তীতে গায়ক বের্কেই শাহিনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে আর্ডা তুরান ক্ষমা চাইতে সেই হাসপাতালে যান। কিন্তু সেখানেও বিবাদে জড়িয়ে একপর্যায়ে আর্ডা তুরান একটি লাইসেন্সবিহীন বন্দুক দিয়ে গোলাগুলি করেন। হাসপাতালে বীভৎস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। হাসপাতালের এই ঘটনার পর তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা হয়। মামলায় তার বিরুদ্ধে আড়াই বছর কারাদন্ড দেয়া হলেও তুরস্কের সাধারণ নিয়ম হচ্ছে একজন মানুষ অপরাধ করার পাঁচ বছরের মধ্যে যদি আরেকটি অপরাধ না করে, তাহলে তার শাস্তি হবে না। আর্ডা তুরান এই যাত্রায়ও কোনোমতে বেঁচে যান।
এতসব ঘটনার পর বার্সেলোনার পক্ষ থেকে যে তার চুক্তি নবায়ন করা হবে না, তা সুনিশ্চিতই ছিল। বার্সেলোনার চুক্তি শেষ হওয়ার পর তিনি তার শৈশবের ক্লাব গ্যালাতাসারেতে দুই বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। এই ক্লাবেই গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। এরপর তিনি আর ফুটবলের জগতে বিচরণ না করার সিদ্ধান্ত নেন, সোজা অবসর গ্রহণ করেন।
একটা সময়ে তাকে ভাবা হতো পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় প্রতিভাবান মিডফিল্ডারদের একজন। স্পেনের সবচেয়ে বড় দুটি ক্লাবে তিনি নিজেকে প্রমাণের সুযোগ পেয়েছিলেন, কিছুটা প্রমাণ করেছিলেনও। কিন্তু প্রতিভার পাশাপাশি ‘পেশাদারিত্ব’ না থাকলে প্রতিভা অবিকশিতই রয়ে যায়– এর জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছেন আর্ডা তুরান। তার উত্থানটা যেমন হয়েছিল গল্পের মতো, তার শেষটা হয়েছিল পুরোপুরি ট্র্যাজিক। তিনি তুর্কি ফুটবলের এক পতিত হওয়া নক্ষত্র হিসেবেই হয়তো ইতিহাসে পরিচিত হবেন।