মালানের হাতের রেখায়…

ঠিক এ মুহূর্তে যদি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি বলে সংস্করণটা ধরণী থেকে তুলে দেয়া হয়, তবে কমপক্ষে দশ ইনিংস খেলা ক্রিকেটারদের ভেতরে তার চাইতে বেশি গড় নিয়ে ক্যারিয়ারটা শেষ করবেন তিনজন। সবার ওপরে যিনি, কেনিয়ার সেই হিরেন ভারাইয়াকে নিয়ে কথা বলাটা বাড়াবাড়ি। ক্যারিয়ারটা মোটে ১২ ইনিংসের, তাতে আউট হয়েছিলেন মাত্র একবার। পরিসংখ্যানের ফাঁকির সুবিধেটা কড়ায়-গণ্ডায় নিয়ে এই বোলারের রান আর গড়টা তাই সমানে সমান ৫১। তালিকার পরের দুইয়ে যারা, তাদের নিয়ে নতুন করে কথা খরচা করাটা আবার নিরর্থক, বিরাট কোহলি আর বাবর আজমের স্ততি গাইতে তো কম শব্দ ব্যয় হয়নি এ অব্দি! তিন ফরম্যাট মিলে সময়ের সেরা ব্যাটসম্যানের স্বীকৃতিটা কোহলি পাচ্ছেন বেশ অনেকদিন ধরেই। সেই সিংহাসনে বাবরকেও বসানো যায় কি না, সেজন্যে বেশ আগডুম-বাগডুমও করছেন অনেকে।

আমাদের সেই তোড়জোড়ে নামবার কোনো ইচ্ছে আপাতত নেই। আমরা বরং বৈঠকে বসতে চাইছি তালিকার পরের ব্যাটসম্যানটিকে নিয়ে, শেষ দুই ম্যাচে ব্যর্থ হবার দরুন যার ব্যাটিং গড় নেমে এসেছে পঞ্চাশের নিচে। কোহলি আর বাবরের ১৩৮.২৫ কিংবা ১২৭.৯৩ স্ট্রাইকরেটের বিপরীতে যিনি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ব্যাট করছিলেন ১৪৬.১৭ স্ট্রাইকরেটে, গত বছরের শেষদিকে যিনি নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে তুলে নিয়েছেন ইংল্যান্ডের পক্ষে দ্রুততম শতক, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে দলকে জয় পাইয়ে দিয়েছেন সদ্যই, এবং এত সব কাণ্ডকীর্তির পরও যাকে মেলাতে হচ্ছে দলে জায়গা পাবার সম্ভাব্যতার অঙ্ক, ঘাঁটতে হচ্ছে নিষ্ঠুর সব সমীকরণ। আমরা আজ কথা বলতে যাচ্ছি সেই ডেভিড মালানকে নিয়ে।

***

২০১৭ সনে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে যে ম্যাচে অভিষিক্ত হয়েছিলেন মালান, সেদিনই খেলেছিলেন ৪৪ বলে ৭৮ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস। পরেরবার ইংল্যান্ডের লালরঙা জার্সিটা গায়ে চাপানোর আগে তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও প্রায় সাত মাস। সাত মাস বাদে ফিরে খেলেছিলেন চার ম্যাচ, তাতেই অর্ধশতকের দেখা পেয়েছিলেন তিনবার। এবং এর প্রতিদান ইংল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট দিয়েছিল তাকে পৌনে দু’বছর দলের বাইরে রেখে

ইংল্যান্ড তখন পরিকল্পনা আঁটছিল একদিবসী বিশ্বকাপ নিয়ে, যে পরিকল্পনায় মালান ছিলেন না কোনো কালেই। ওয়ানডে দলকেই ইসিবি কুড়ি-ওভারি ক্রিকেটে খেলিয়ে তৈরি করতে চেয়েছিল ২০১৯-য়ের জন্যে। সে লক্ষ্যে তারা সফল হয়েছিল পুরোপুরি, মালানকে দলের বাইরে রাখবার দোষে ইংল্যান্ড ম্যানেজমেন্টকে তাই দোষী করা চলে না কোনোমতেই।

বিশ্বজয়ের পরে ইংল্যান্ডের ফোকাসটা সরে এসেছিল টি-টোয়েন্টিতে, মালানও আবার জায়গা করে নিয়েছিলেন ইংল্যান্ড জাতীয় দলে। বিশ্বকাপের পর থেকে ইংল্যান্ডের খেলা ১৩ টি-টোয়েন্টির দশটিতেই একাদশে ছিল মালানের নাম। সে দশ ম্যাচে গড়টা ৫১.৩৭, যা কি না ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের ভেতরে সর্বোচ্চ। নিউ জিল্যান্ডে ৫১ বলে শতকপ্রাপ্তি, অস্ট্রেলিয়া-পাকিস্তানের বিপক্ষে ঝড়ো অর্ধশতকের ঘটনাগুলো ঘটিয়েছিলেন জাতীয় দলে তৃতীয়বার ফিরেই।

ক্রিকভিজের ব্যাটিং ইম্প্যাক্ট মডেল অনুযায়ী, ২০১৬ বিশ্ব টি-২০র পর থেকে যে পরিস্থিতিতে মালান ব্যাট করেছেন, তার ম্যাচপ্রতি মূল্য বাদবাকি ব্যাটসম্যানদের চাইতে ৮.৮ রান বেশি। অর্থাৎ, তার জায়গাতে অন্য যে কেউ থাকলে দল রান হারাতো প্রতি ম্যাচে প্রায় নয়টি করে।

Image credit: Cricviz

মালানের ইনিংসগুলোর আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে পুরো ইনিংসজুড়েই তার অসামান্য নিয়ন্ত্রণ। শেষ আড়াই বছরে শট খেলতে গিয়ে তার চাইতে কম ভুল করেছেন কেবলমাত্র জস বাটলার।

Image credit: Cricviz

পেসার কিংবা স্পিনার, এখন অব্দি মালানকে দুর্বল প্রমাণের সাধ্যিও হয়নি কারও। পেস বোলিংয়ের বিপক্ষে ওভারপ্রতি রান তুলেছেন ৮.৩০ করে, তো স্পিনারদের বিপক্ষে সে সংখ্যাটি লাফ দিয়েছে আরও ১.৩২ ঘর। পেসারদের বিরুদ্ধে তার ১১৭.৬৬ গড় মনে করিয়ে দিচ্ছে ব্র‍্যাডম্যানকে। তারপরেই যিনি আছেন, সেই কেভিন পিটারসেনের সঙ্গে তার গড়ের ফাঁরাকটা ৫৪.৪১।

এবং এই ব্র‍্যাডম্যানীয় পরিসংখ্যানের পুরষ্কার, স্কোয়াডে জায়গা পাবার লড়াইয়ের বদলে তাকে লড়াই করতে হচ্ছে একাদশে জায়গা পাওয়া নিয়ে।

Image credit: Cricviz

খোলতা করেই বলা যাক। ইংল্যান্ড দলের টপ-অর্ডারে জায়গা পাবার লড়াইটা এখন ত্রিমুখী কিংবা চতুর্মুখী নয়, বরং দশমুখী। জস বাটলার, জেসন রয়, জনি বেয়ারেস্টো, টম ব্যান্টন, স্যাম বিলিংস, জেমস ভিন্স, ডেভিড মালান, অ্যালেক্স হেলস, জো রুট এবং উদীয়মান ফিল সল্ট। ইংল্যান্ড দলের প্রথম তিনে জায়গা পাবার প্রত্যাশা এবং সামর্থ্য রয়েছে এদের প্রত্যেকেরই। ঘরোয়া ক্রিকেটে ব্যাটে নিত্যই ঝড় তুলছেন সল্ট, সামনের বিশ্বকাপ ভারতে বলে দলে জায়গা পাবার জোর দাবি রয়েছে রুটেরও, ব্যান্টন তো ব্যাট হাতে দুর্দান্ত কিছু ক্যামিও খেলে গোটা টি-টোয়েন্টি বিশ্বেই আজ হটকেক। জেসন রয় সাইড স্ট্রেইনের চোটে না পড়লে এবারের অস্ট্রেলিয়া সিরিজে ইংল্যান্ডের সম্ভাব্য টপ-অর্ডার লাইনআপ হতো বাটলার-রয়-বেয়ারেস্টোকে নিয়েই।

বর্তমান পরিসংখ্যান এবং ম্যাচে যা প্রভাব রাখছেন, তা মাথায় রেখে মালানকে বাইরে রাখবার দুঃসাহস দেখাতে চাইবে না কোনো দলই। তবে সম্ভাব্য সব বিকল্প প্রস্তুত থাকবার পরও মালানকে দলে নেবার সঙ্গে সঙ্গেই সামনে চলে আসবে আরও দুইটি প্রশ্ন:

এক, ইংল্যান্ড প্রথম পছন্দের দলের কাকে বাইরে ঠেলছে?

দুই, ইংল্যান্ড কীভাবে মালানকে নিয়েই টপ-অর্ডার সাজাতে পারে?

***

সবচেয়ে সহজ বিকল্প হতে পারতো বাটলারকে পুনরায় ফিনিশারের ভূমিকায় নিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ, বাটলার খেলবেন ছয়ে, রয়-বেয়ারেস্টোকে দেয়া হবে ইনিংস উদ্বোধনের সুযোগ, আর ফাঁকা তিন নম্বর জায়গাটা বরাদ্দ রইবে মালানের জন্যে। কিন্তু যত সহজে সমাধান বাতলে দেয়া গেল, তার বাস্তবায়ন কি আর অতই সরল নাকি! বরং, অবস্থাদৃষ্টে এই শর্ত বাস্তবায়নই সবচাইতে দুঃসাধ্য। বিশ ওভারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসে বাটলারের চাইতে বেশি গড় রয়েছে কেবলমাত্র একজন ওপেনারের, সঙ্গে ইংল্যান্ড ওভারপ্রতি ৯.৫০ রান পাচ্ছে বাটলারের বদৌলতেই। ‘দলের সেরা ক্রিকেটারকে খেলতে দিতে হবে যত বেশি সম্ভব বল’, ইংল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট মন্ত্রণা নিয়েছে এই বাক্যেই; এবং এ মুহূর্তে সাদা বলে ইংল্যান্ডের সেরা ক্রিকেটারটির নাম জস বাটলারই।

বাটলারকে তাই ছয়ে নামানো যাচ্ছে না কোনোমতেই। সল্ট-বিলিংস-ব্যান্টনের উত্থান এবং রুট-হেলস-ভিন্সের পুনঃআবির্ভাবের সম্ভাবনা যদি বাদও দিই, তবুও টপ-অর্ডারের বাদবাকি দু’টি শূন্যস্থানের জন্যে লড়াইটা তাই রয়ে যাচ্ছে ত্রিমুখী। রয়-বেয়ারেস্টোর সঙ্গে ডেভিড মালান।

Image credit: Cricviz

আগামী বছরের বিশ্ব টি-টোয়েন্টি আসর বসবে ভারতে, এবং গতবার আইপিএলে প্রথমবার সুযোগ পেয়েই বেয়ারেস্টো করেছিলেন ৪৪৫ রান। এজন্যে তাকে খেলতে হয়েছিল মাত্র ৯ ম্যাচ, গড়টা ছিল ৫৫ ছাড়ানো, ওভারপ্রতি রান তুলেছিলেন ৯.৪ করে। বেয়ারেস্টোকে এড়িয়ে রয়ের দিকে তাকাতে গেলে সামনে চলে আসছে ইংল্যান্ডের লাল জার্সি পরে তার পারফরম্যান্স। ৬৭ (৩১), ৬৯ (৩৬), ৭০ (৩৮), ৪০ (২৯) আর ৭ (৪) – রয়ের সর্বশেষ পাঁচ ইনিংসের স্কোরকার্ডগুলো এমনই।

মালান টপ-অর্ডারে সুযোগ পেয়েছিলেন এদের পরিবর্তে, চোট কিংবা বিশ্রামের সুযোগে। মালানকে টপ-অর্ডারে সুযোগ করে দিতে এদেরকেই এখন ইংল্যান্ড ছুঁড়ে ফেলে কী করে! মালানকে তাই দলে টানতে গিয়ে রান-স্ট্রাইকরেট ছাপিয়ে আতশকাঁচের তলায় আনতে হচ্ছে আরও সূক্ষ্ম কিছু পরিসংখ্যান। স্ট্রাইকরেটটা দিনশেষে যতই দেড়শ’র দোরগোড়ায় দেখাক, মালানের প্রতিটি ইনিংসের শুরুই হয় ভীষণ রকমের জড়োসড়ো। এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৬ বিশ্ব টি-টোয়েন্টির পর থেকে ইংল্যান্ডের হয়ে টপ-অর্ডারে যারা খেলেছেন, তাদের কেউই মালানের চাইতে ধীর শুরু করেননি। প্রথম ছয় ওভারের ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশনের সুযোগ নিয়ে ইংল্যান্ড যখন চাইছে রানগুলো যথাসম্ভব বাড়িয়ে নিতে, তখন মালানের ১৩ বলে ১৫ রানের ইনিংসগুলো তো সেই পরিকল্পনার সবচেয়ে বড় অন্তরায়।

Image credit: Cricviz

আর একবার স্টোকস ফেরত আসলে ব্যাট হাতে তার নিয়ন্ত্রণও হয়ে পড়বে মূল্যহীন। কেননা, দলের ব্যাটিং লাইনআপ তখন হবে আরেকটু লম্বা, লম্বা ব্যাটিং লাইনআপের সুযোগ নিয়ে ইংল্যান্ড ঝুঁকি নেওয়ার কিংবা শট খেলার সুযোগ পাবে আরেকটু বেশি, মালানের ধীরলয়ের শুরুও তখন বিরক্তিকর ঠেকবে আরও একটু বেশি।

রয়-বেয়ারেস্টোকে দলের বাইরে পাঠাবার কাজটা যে তাই অসম্ভবের নামান্তর, তা বুঝতে পারছেন মালানও,

“বিগত চার-পাঁচ বছর ধরে তাদের (রয়, বেয়ারেস্টো, বাটলার) পারফরম্যান্স রীতিমতো চোখধাঁধানো। তাদের টপকে কেউ যদি টপ-অর্ডারে জায়গা পেতে চায়, তবে তাকে অতিমাত্রায় ধারাবাহিক হতে হবে এবং একই সাথে ইংল্যান্ডকে ম্যাচ জেতাতে হবে।”

পরিস্থিতির আগাপাশতলা বুঝেশুনে মালান তাই ভাবছেন ব্যাটিং পজিশন বদলাবার কথা, চাইছেন নিচে নেমে যেতে। রয়-বেয়ারেস্টোদের সঙ্গে লড়ার চাইতে মঈন আলি, স্যাম বিলিংসদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকেই সহজ মানছেন তিনি এক্ষণে। মরগানের সঙ্গে তার কথাও হয়েছে এ নিয়ে, অধিনায়কের কাছে জানতে চেয়েছেন, ঘরোয়া ক্রিকেটে নিচে ব্যাট করে নিজেকে পরখ করে দেখবেন কি না। মরগান জানিয়েছেন, নিচে নেমে মালান সফল হতে পারলে আপত্তি নেই তার কিংবা ইসিবির নির্বাচকদের তরফ থেকে। তবে ব্যর্থ হলে ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে তোলার স্বপ্নটা মালানকে জলাঞ্জলি দিতে হবে আপাতত।

ঘরোয়া ক্রিকেটে এই ঝুঁকিটা মালানের নেয়া উচিৎ হবে কি না, তা বুঝতে গিয়ে গলদ দেখা যাচ্ছে অন্য এক জায়গাতে। মালানের সেরাটা যে বেরিয়ে আসে গায়ের জার্সিটা কেবলমাত্র ইংল্যান্ডের হলেই! বিপিএলে কুমিল্লা ওয়ারিয়র্সের হয়ে তার এক মৌসুমের পারফরম্যান্সকে যদি রাখা হয় হিসেবের বাইরে, তবে ইংল্যান্ডের মতো প্রভাব তিনি রাখতে পারেননি অন্য কোনো টি-২০তেই।

Image credit: Cricviz

এবারে অতীতকে আপাদমস্তক বদলে দিয়ে সফল হবেন নিচের দিকে ব্যাট করে, এমন হলে হচ্ছে গয়ে ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’। আর না হলে সেই চিরচেনা সান্ত্বনা তো বরাদ্দই আছে মালানের জন্যে, ‘আদতে দোষটা ছিল ওর নক্ষত্রে।’       

This article is in Bangla language. This article is on those difficulties that Dawid Malan is facing despite his peak form with the bat. Necessary hyperlinks are attached inside.

Featured image © Getty Images        

Related Articles

Exit mobile version