ফুটবলের দলবদল পদ্ধতি একদম চোখের পলকে বদলে গেছে। খেলোয়াড়ের ট্রান্সফার ফি নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করার সেসব দিন শেষ। শুধু পর্যাপ্ত অর্থ থাকলে যেকোনো খেলোয়াড়কে খুব সহজেই বর্তমান যুগে লুফে নেওয়া সম্ভব। এই সুযোগ ব্যবহার করে প্রত্যেক ক্লাবই। যদিও খেলোয়াড় কেনাবেচার ধরন পাল্টে দিয়েছে এমন এক ক্লাব, যারা কখনও দলবদল মৌসুমে সেভাবে আগ্রহীই ছিলো না। এক নেইমারের পিএসজি যাওয়া ছিল বহুল আলোচিত ঘটনা। সেই অর্থ দিয়ে বার্সেলোনাও ইচ্ছামতো খেলোয়াড় কিনেছে। কৌতিনহো, দেমবেলের পর ফ্র্যাঙ্কি ডি ইয়ংয়ের দামও কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত বলেই বিবেচনা করা হয়।
একই পথ অনুসরণ করেছে ম্যানচেস্টার সিটি, চেলসি, লিভারপুল বা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মতো ক্লাব। এমনকি সবসময় হিসেব করে চলা বায়ার্ন মিউনিখও আকাশচুম্বী দামে খেলোয়াড় কেনায় আগ্রহী। অর্থের ছড়াছড়ি বর্তমান ফুটবল বিশ্বের এ আবহাওয়ার বাইরে অবস্থান করছে লন্ডনের একটি ক্লাব- টটেনহ্যাম হটস্পার। অদ্ভুত হলেও সত্য যে, অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে খেলোয়াড় দলে ভেড়ানো তো দূরের কথা, ১৮/১৯ মৌসুমে তারা কোনো খেলোয়াড়ই কেনেনি। সর্বশেষ কেনা খেলোয়াড় ব্রাজিলিয়ান লুকাস মৌরা, তা-ও সেই দেড় বছর আগের ঘটনা। তবে টটেনহ্যাম কোচ পচেত্তিনো খেলোয়াড় কিনতে চাননি, এমন নয়। চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। ক্লাবের উপর মহল থেকে অনুমতি মেলেনি।
কিন্তু এ ক্লাবের বর্তমান সাফল্য পুরো বিশ্বকে অবাক করেছে। অর্থ দিয়ে গড়ে তোলা শক্তিশালী সব দলকে পেছনে ফেলে স্পার্স যখন চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালের মঞ্চে পৌঁছায়, প্রশ্ন উঠতেই পারে পর্যাপ্ত খেলোয়াড় ও ক্লাবের বোর্ডের সহায়তা না থাকার পরও কীভাবে তা সম্ভব হলো? উত্তরটা মরিসিও পচেত্তিনোর কাছে, যিনি ধৈর্য্য ও পরিশ্রমকেই সাফল্যের চাবিকাঠি বলে মানেন।
মরিসিও পচেত্তিনোর জন্ম আর্জেন্টিনার মারফি অঞ্চলে সান্তা ফের গ্রামে। সান্তা ফের প্রধানত কৃষি অঞ্চল। পচেত্তিনোর বাবাও কৃষি কাজ করতেন। ফুটবলের সাথে পরিচয় হয় বাবার হাত ধরে। ১৯৭৪ বিশ্বকাপের মাধ্যমে ফুটবলের সাথে প্রথম সম্পর্ক তৈরি হয় তার। কিন্তু মারফির মতো কৃষিপ্রধান অঞ্চলে ফুটবল খেলা শুধু শখের জন্যই সম্ভব। তার বয়স যখন ১৪, তখন থেকেই পচেত্তিনোকে নজরে রাখতে শুরু করেছিলেন ফুটবল স্কাউট হোসে গ্রিফা ও মার্সেলো বিয়েলসা। ১৯৮৭ সালে মার্সেলো বিয়েলসা তখন নিউ ওয়েলস ক্লাবের প্রধান স্কাউটদের একজন। সে বছর সান্তা ফের গ্রামে গিয়ে পচেত্তিনোকে নিয়ে এলেন নিউ ওয়েলসের অ্যাকাডেমিতে। পরের বছরই প্রিমিয়ার ডিভিশনে অভিষেক ঘটে গেল তার। যে পাগলাটে ভদ্রলোক পচেত্তিনোর ক্যারিয়ার গড়ে দিলেন, সেই বিয়েলসা নিউ ওয়েলসের কোচ হলেন দুই বছর পরই। পচেত্তিনো বেড়ে উঠতে লাগলেন তার গুরুর ছায়া ও দর্শনে।
তবে ফুটবল ক্যারিয়ার তার খুব বর্ণাঢ্য হয়েছিল, বললে ভুল হবে। খেলতেন রক্ষণাত্মক ভূমিকায়। বিয়েলসার হাত ধরে নিউ ওয়েলস ক্লাবের সকল ধাপ পার করে তিনি গিয়েছিলেন স্পেনের এস্পানিওলে, সেখান থেকে পিএসজি ও বোর্দে। তবে নিউ ওয়েলস ও এস্পানিওলের সমর্কদের কাছে এখনও ভীষণ প্রিয় তিনি। ১৯৯৯ থেকে ২০০২ এর ভেতর আর্জেন্টিনার জাতীয় দলে ২০ ম্যাচও খেলেছেন তিনি। এস্পানিওল থেকে অবসর নেন খুব সাধারণ মানের একজন ফুটবলার হিসেবে। কারণ ক্যারিয়ারজুড়ে কোনো নামডাক বা পরিচিতি তৈরি করতে পারেননি তিনি।
২০০৯ সালে এস্পানিওলের কোচ হয়ে আবার ফুটবলে ফিরে আসলেন পচেত্তিনো। এরপর সাউদাম্পটন, তারপর টটেনহ্যাম হটস্পার। ৪ বছরে এস্পানিওলের চেহারা বদলে দিয়েছিলেন তিনি। তবে সে প্রসঙ্গ আজ থাক।
২০১৪ সালে স্পার্সদের দায়িত্বে এসে তিনি দেখলেন, কাড়ি কাড়ি অর্থের বদলে বাকি সব দল যেভাবে দল সাজাচ্ছে, এ ক্লাবে তিনি সেই সুযোগ পাবেন না। কারণ টটেনহ্যাম ক্লাবটি একটি দীর্ঘ পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। তিনি আসার আগে গ্যারেথ বেলকে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে বিক্রি করে ক্লাবটি বিশাল অঙ্কের অর্থ পেয়েছিল। কিন্তু সে অর্থের সাহায্যে সঠিক খেলোয়াড় কিনতে পারেননি স্পার্স বোর্ড। বড় সাইনিংয়ের দিকেও যাননি স্পার্স সভাপতি ড্যানিয়েল লেভি।
তবে পরিস্থিতি ভিন্ন ছিলো ড্যানিয়েল লেভি সায় দিলেও স্পার্স খেলোয়াড় পেতো না। প্রিমিয়ার লিগে ১৭ জনের বাইরে বিদেশী খেলোয়াড় রাখার অনুমতি নেই। টটেনহামের ছিলো ১৮ জন। তাই খেলোয়াড় কিনতে হলে, প্রথমে বিক্রি করতে হতো তাদের। স্পার্স খেলোয়াড় বিক্রিও করতে পারেনি, কিনতেও পারেনি। দেশীয় খেলোয়াড় কেনার চেষ্টাও করেছিলো স্পার্স। কিন্তু সে সময় ক্লাবগুলোর চাহিদা ছিলো আকাশছোঁয়া। তারা অনেক খেলোয়াড় কিনতে গিয়েও পারেনি। আর পচেত্তিনো নিজেও চাইতেন না শেষ মুহূর্তে ঝোঁকের বশে খেলোয়াড় কিনে বসতে।
পচেত্তিনো পাগলাটে কোচ মার্সেলো বিয়েলসার অনুসারী। হাত খুলে যখন খেলোয়াড় কিনতে পারবেন না, তখন বিয়েলসার পুরনো কৌশল প্রয়োগ করতে শুরু করলেন তিনি। শুরু থেকে পচেত্তিনো এমন কিছু ট্রান্সফার করেছেন, যারা পরবর্তীতে নামকরা খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছে। টটেনহ্যামের প্রথম মৌসুমে তিনি এনেছিলেন বেশ ক’জনকে। তাদের ভেতর পরিচিত নাম এরিক ডায়ার, আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার ফ্রেদ্রিকো ফাজিও ও বেন ডেভিস। টটেনহ্যাম দলের তখন যায় যায় অবস্থা, পজিশন অনুযায়ী খেলোয়াড়ের অভাব। পরের মৌসুমে একে একে আসলেন কিয়েরন ট্রিপিয়ার, ডেলে আলি, টবি ভেরাল্ডওয়াইল্ড এবং হিউং মিন সন। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৬ সাল, এই দুই বছরে পচেত্তিনো বেশ কিছু খেলোয়াড় দলে ভেড়ালেও কোনোটাই বড় চুক্তি ছিলো না। টটেনহ্যামের ম্যানেজারের চেয়ারে বসে তিনি সবচেয়ে বড় অঙ্কের ট্রান্সফার করেছেন মাত্র একটি, তা-ও ২০১৭ সালের দিকে এসে।
একের পর এক মৌসুম চলে যায়, দলে শিরোপার দেখা নেই। বিপরীতে স্পার্স সভাপতির চিন্তাভাবনা ভিন্ন। তার পরিকল্পনা ছিল ক্লাবের ভবিষ্যৎকে ঘিরে। ভবিষ্যতে টটেনহামকে ইউরোপের নামকরা ক্লাবে পরিণত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে বর্তমানে খরুচে হওয়া চলবে না। এসব কিছুই তাদের নতুন স্টেডিয়ামকে কেন্দ্র করে। তাই ২০১৬ সালে ড্যানিয়েল লেভি ক্লাবের ব্যয়ের পরিমাণ আরও কমিয়ে আনলেন। নতুন করে ঝামেলায় পড়ে গেলেন পচেত্তিনো।
কিন্তু এবারও এ সমস্যা খুব দ্রুত সমাধান করলেন পচেত্তিনো। আবারও ফিরে গেলেন মার্সেলো বিয়েলসার দর্শনে, যে দর্শন বলে বিপদে ক্লাবের অ্যাকাডেমির কাছে সাহায্য নিতে, অ্যাকাডেমির তরুণ প্রতিভার খোঁজ করতে। ২০১৬-১৭ মৌসুমে তার আবিষ্কার হ্যারি উইংস। বর্তমান স্পার্সে পচেত্তিনোর ট্যাকটিক্সে পরিচিত মুখ। পরের বছর স্পার্সের অনূর্ধ্ব-২৩ দল থেকে নিয়ে আসেন কাইল ওয়াল্কার-পিটার্সকে। আর এ বছর তার নতুন আবিষ্কার অলিভার স্কিপ। আর এ তরুণদের ক্লাবে শুধু অভিষেকের পর বেঞ্চে বসিয়ে রাখেননি পচেত্তিনো, প্রায় সময়ই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে স্পার্সের একাদশে তাদের দেখা মেলে।
২০১৬ সালে প্রিমিয়ার লিগ জেতার একদম কাছে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু সে যাত্রায় রূপকথার গল্প লেখে লেস্টার সিটি। শেষ চার মৌসুমে ম্যানচেস্টার সিটি বাদে আর কোনো দল ধারাবাহিকভাবে প্রিমিয়ার লিগের শেষ চারে খেলেনি, টটেনহ্যাম খেলেছে। এ দল গড়তে ও ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে কঠোর শারীরিক ও মানসিক শ্রম দিয়ে গেছেন পচেত্তিনো। সবকিছু সেই শৈশবে শিখে আসা বিয়েলসার দর্শনেই। সবাই যখন অর্থের বিনিময়ে খেলোয়াড় কিনে শক্তি সঞ্চয় করেছে, পচেত্তিনো শিখেছেন নিজের কাছে যা আছে, ততটুকু ব্যবহার করে সাফল্যকে ধরতে। এ কারণে তিনি টটেনহ্যামকে কখনোই একটি ফর্মেশনে খেলাননি। প্রত্যেক ম্যাচে তিনি নতুন ফর্মেশন ব্যবহার করেছেন, খেলোয়াড় বদল করে করে একেকটি ম্যাচ পার করেছেন। যার ধকল প্রতি মৌসুমের শেষের দিকে বোঝা যায়। কারণ টানা ভালো খেলেও প্রতিবার প্রবল ধকলের কারণে শেষের দিকে টটেনহ্যাম দুর্বল হয়ে পড়ে।
টটেনহ্যাম সভাপতি ২০১৭ সালের দিকে পচেত্তিনোকে শেষবারের মতো খেলোয়াড় কেনার সুযোগ দেন। কাইল ওয়াকারকে বিক্রি করে দলটি কিছু অর্থ হাতে পায়। দলে সেন্টারব্যাক, কেইনের বদলি খেলোয়াড়, একজন রাইটব্যাক ও অতিরিক্ত গোলরক্ষক প্রয়োজন। কীভাবে সব পজিশন সামাল দেবেন পচেত্তিনো? আবারও কৌশলী পন্থা অবলম্বন করলেন তিনি। হুগো লরিসের বদলি হিসেবে ফ্রি ট্রান্সফারে আসলেন পাওলো গ্যাজানিকা। কেইনের বদলে অতিরিক্ত স্ট্রাইকার ফার্নান্দো লরেন্তেকে আনলেন পানির দামে। সস্তায় পেয়েছিলেন সার্জিও অরিয়েকে। শুধু সর্বোচ্চ ৩৬ মিলিয়ন দিয়ে আয়াক্স থেকে উড়িয়ে আনলেন ডেভিনসন সানচেজকে। টটেনহ্যামের হয়ে পচেত্তিনোর সর্বশেষ কেনা খেলোয়াড় পিএসজি ফ্লপ লুকাস মৌরা। এরপর দেড় বছর পার হয়ে গেছে, পচেত্তিনো কোনো খেলোয়াড় কেনার অনুমতি পাননি।
এই টানাপোড়েনের ভেতরও পচেত্তিনো স্বপ্ন দেখেছেন টটেনহ্যামকে শিরোপার মুখ দেখানোর। কিন্তু তা বাস্তবে হয়ে ওঠেনি। প্রতিটা সময়, অধিকাংশ মৌসুমে টটেনহ্যাম দুর্দান্ত শুরু করেছে। কিন্তু আস্তে আস্তে তা পরিণত হয়েছে হতাশায়। প্রিমিয়ার লিগের ব্যস্ত সূচি, এফএ কাপ ও পাশাপাশি চ্যাম্পিয়নস লিগের ধকল সইতে না পেরে দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় সময়ই। ব্যস্ত সূচিতে পচেত্তিনোর ট্যাকটিক্স কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ম্যাচে তিনি একাদশ নামাবার জন্য ১১ জনকে বাছাই করতে গিয়ে বিপদে পড়েছেন। মাঝে এক ম্যাচে তো ৯ জন খেলোয়াড় নিয়ে ম্যাচ শেষ করেছিলো স্পার্স। কিন্তু পচেত্তিনো দমে যাননি। তিনি জানতেন, তিনি যদি এই অবস্থায় দুর্বল হয়ে পড়েন, দলের ভেতর যে শক্তি জাগ্রত করেছেন, তা খুব দ্রুত হারিয়ে যাবে।
২০১৮-১৯ মৌসুম। প্রিমিয়ার লিগের যাত্রা শুরু হলো ভালোই। কিন্তু মাঝপথে ডেলে আলির ইনজুরি, একাদশ পরিবর্তন করলেন। তবে শুধু ডেলে আলি নয়, ইনজুরির প্রকোপে পড়েছেন দলের প্রত্যেকটা খেলোয়াড়। ২৬ সপ্তাহ পর্যন্ত প্রিমিয়ার লিগে তার দল হেরেছিল মাত্র ৫ ম্যাচ, কিন্তু শেষের দিকে খেলোয়াড়দের ইনজুরি আর ফর্মহীনতায় স্পার্স পয়েন্ট হারাল টানা ৪ ম্যাচে। লিগে শেষ ১১ ম্যাচে টটেনহ্যাম জিতেছে মাত্র ৩ ম্যাচ। অনেক ম্যাচে তাকে নামাতে হয়েছে হুয়ান ফয়েথের মতো তরুণ ডিফেন্ডার ও অলিভার স্কিপের মতো আনকোরা খেলোয়াড়দের। কিছু করার নেই, কারণ তাদের না ব্যবহার করলে তার একাদশই যে তৈরি হয় না!
প্রিমিয়ার লিগের স্বপ্ন থেমে গেছে মৌসুমের মাঝপথে। চেলসির বিপক্ষে টাইব্রেকারে হেরে বাদ পড়েছেন ইএফএল কাপ থেকেও। ক্রিস্টাল প্যালেস টটেনহামকে হারিয়ে এফএ কাপের স্বপ্নও চুরমার করে দিয়েছে। বাকি ছিল এক চ্যাম্পিয়নস লিগ, যেখানে আছে অর্থের বিনিময়ে বানানো দলগুলোর চোখ রাঙানি। এদের কাছে টটেনহ্যাম যে নিতান্ত শিশু! কিন্তু এই চ্যাম্পিয়নস লিগ ছিল পচেত্তিনোর এ মৌসুমের একমাত্র ভরসা।
পচেত্তিনোর এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ শুরু হয় হারের হতাশা দিয়ে। ইন্টারের মাঠে গিয়ে হেরে আসার পর বার্সেলোনা তাদের মাঠেই বিধ্বস্ত করে। পরবর্তীতে ইন্টারকে নিজেদের মাঠে হারানোর পর ক্যাম্প ন্যু পরীক্ষা, তারা যে যাত্রা পার করলো ১-১ গোলে ড্র করে। এরপর বরুশিয়া ডর্টমুন্ডকে উড়িয়ে ও ম্যানচেস্টার সিটিকে বিদায় করে পচেত্তিনো পৌঁছালেন সেমিফাইনালের মঞ্চে, যেখানে তার থাকার কথাই ছিল না।
হ্যারি কেইনের মৌসুম শেষ। নেই হিউং মিন সনও। ৩-১-৪-২ ফর্মেশনে গড়া খর্বিত দলের বিপক্ষে ০-১ গোলের গুরুত্বপূর্ণ জয় নিয়ে গেল আয়াক্স। তার উপর যোগ হলো ইয়ান ভার্টংগেনের ইনজুরি। ফিরতি লেগে অসামান্য প্রত্যাবর্তনের কথা পচেত্তিনো ভাবতে পেরেছিলেন কি না, বলা মুশকিল। কারণ তিনি তো ব্যস্ত ছিলেন দ্বিতীয় লেগে খেলানোর জন্য ১১ জনকে তৈরি করতে।
অ্যাওয়ে গোলে পিছিয়ে থাকা ম্যাচ। ম্যাচে ফিরতে হলে প্রথমেই করতে হবে গোল। কিন্তু ৫ মিনিটে ডি লিট আর ৩৬ মিনিটে হাকিম জিয়েখের গোলে টটেনহ্যামের প্রায় সব স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু টটেনহ্যাম ফিরে এলো দ্বিতীয়ার্ধে, এক একে লুকাস মৌরা করলেন তিন গোল। হাল প্রায় ছেড়ে দেওয়া একটি দল এভাবে ফিরে আসাকে লৌকিক বলে চালিয়ে দেওয়া যায় না। পচেত্তিনো কী বলেছিলেন ড্রেসিংরুমে, কীভাবে তাদের হারানো মনোবল ফেরত এনেছিলেন, তা হয়তো জানা যাবে না। কিন্ত তার সে প্রক্রিয়া যে কতটা কার্যকরী, তার উদাহরণ আমস্টারডামের ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তনের উপাখ্যান।
ম্যাচ শেষে পচেত্তিনো কেঁদেছেন, উদযাপন করেছেন, খেলোয়াড় থেকে গ্যালারিতে থাকা দর্শকদের সাথে আবেগে ভেসেছেন। একটু ধাতস্ত হবার পর বিটি স্পোর্টসকে বলেছেন,
এই আবেগ ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। ফুটবলকে ধন্যবাদ। আমদের খেলোয়াড়েরা প্রত্যেকে যোদ্ধা। আমি তো সবসময় বলেছি যে, ক্লাবটি যোদ্ধায় পরিপূর্ণ। দ্বিতীয়ার্ধে তারা দুর্দান্ত ফুটবল খেলেছে। ধন্যবাদ তাদেরকে, যারা সবসময় আমাদেরকে বিশ্বাস করে এসেছেন।
অপরিণত টটেনহ্যামকে পরাক্রমশালী মানসিকতায় পরিণত করে মরিসিও পচেত্তিনো যে উদাহরণ তৈরি করেছেন, তা অবিশ্বাস্য, অলৌকিক। ‘পরিশ্রম সৌভাগ্যের চাবিকাঠি’ – এই কথাটির সাথে আমরা সকলেই বেশ পরিচিত। কিন্তু এই কথাটি যে সত্য, পরিশ্রম ও ধৈর্য্যের কঠিন পরীক্ষার মাঝে নিজেকে ফেলে এই আর্জেন্টাইন তা প্রমাণ করে গেলেন।
লিভারপুলের বিপক্ষে সেই ফাইনালে জয় নিয়ে ফিরতে পারেননি পচেত্তিনো। স্পার্সের অবিশ্বাস্য এক জয় রথ থেমেছিলো ক্লপবাহিনীর বিপক্ষে ফাইনাল হেরে। গত মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগে দ্বিতীয় স্থান অর্জনের পর পচেত্তিনোর দলের ছন্দটা কেটে গেছে। আর ইতিহাসও সব সময় বিজয়ীদের স্বরণ করে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা লড়াকুকে কেউ মনে রাখে না। তাই মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে পচেত্তিনোর পাঁচ বছরের স্পার্স অধ্যায় শেষ হলো গতকাল।
টটেনহাম জানিয়েছে চলতি লিগের বাজে ফর্মের কারণে এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে তারা। আবেগ সবসময় খাটে না। তাই টটেনহামকে তিলে তিলে গড়ে তোলা মানুষটিকে তারা বিদায় জানাতে বাধ্য হয়েছে। মরিসিও পচেত্তিনো জানেন স্পার্সেই তার ক্যারিয়ারের শেষ নয়। সামনে অপেক্ষা করছে আরও বড় কিছু। তাই পরিশ্রমে বিশ্বাসী এই আর্জেন্টাইন এখন অপেক্ষায় থাকবেন নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে, যা তিনি তার কোচিং ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই করে চলেছেন!