২৬ মার্চ, ২০০৫। বিশ্বকাপ ’০৬ এর বাছাইপর্বে মুখোমুখি ইসরায়েল ও আয়ারল্যান্ড, কিন্তু ভীষণ অস্বস্তিতে ফিলিস্তিনিরা। অন্যদিকে ইসরায়েল সমর্থকরাও যথেষ্ট ক্ষুব্ধ, কারণ ইসরায়েলের হয়ে মাঠে নামছেন একজন আরব। ইসরায়েলি আরব জাতীয়তার আব্বাস সুয়ান নিজেও খুব একটা স্বস্তিতে নেই, কেননা ইসরায়েল দলের হয়ে খেলা আরবদের প্রতি সমর্থকদের আচরণ একেবারেই ইতিবাচক নয় এবং ইতিপূর্বে তিনিও ইসরায়েল সমর্থকদের বিদ্বেষমূলক আচরণের স্বীকার হয়েছেন। ০-১ গোলে আয়ারল্যান্ড প্রায় পুরো ম্যাচ এগিয়ে থাকার পর খেলার শেষ মুহূর্তে আব্বাসের গোলে সমতায় ফিরে আসে ইসরায়েল, তখনই বদলে যায় ইসরায়েলিদের আচরণ। তারা সমস্বরে স্লোগান দিতে থাকে, “সে ইহুদি, সে ইহুদি!”
উল্লেখ্য, ইসরায়েল কর্তৃক দখল করা ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে বসবাসরত ইহুদিরা ফিলিস্তিন ফুটবল দলে সুযোগ পায় না, যদিও আরবরা ইসরায়েলের হয়ে খেলেছে। অবশ্য ইসরায়েলি আরবরা ইসরায়েলের জাতীয় সংগীতের সময় নীরব থাকে, অন্যদিকে জাতীয় দলের ক্যাম্পে তাদের আরবি ভাষায় কথা বলতে দেওয়া হয় না যেন দলে বিভাজন তৈরি না হয়।
শাখনিন হচ্ছে ইসরায়েলের সর্বোচ্চ লিগে খেলা একমাত্র আরব দল, যাদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী বেইতার জেরুজালেম। বেইতারের রয়েছে একদল উগ্র সমর্থক, যারা ‘লা ফামিলা’ নামে পরিচিত এবং আরবদের জন্য তাদের মনে ঘৃণা ব্যতীত আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। বেইতারের বনাম শাখনিনের ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় নিরবচ্ছিন্ন নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে এবং পুরো ম্যাচ থাকে অত্যন্ত উত্তেজনায় পূর্ণ। প্রায়ই মাঠের খেলা ছাপিয়ে আলোচনায় চলে আসে দুই দলের সমর্থকদের আচরণ এবং স্লোগান। বেইতারের উগ্র সমর্থক গোষ্ঠী মাঠে স্লোগান তুলে “Death to Mohammad,” অন্যদিকে শাখনিন সমর্থকদের হাতে শোভা পায় “Jerusalem is Ours” লিখিত ব্যানার!
উপরের দুটি ঘটনা উল্লেখ করার উদ্দেশ্য কোনো উপসংহার কিংবা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো নয়। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরায়েলি আগ্রাসনের কারণে সৃষ্ট সংকট ফিলিস্তিনিদের জীবনের সবকিছুর সাথে আক্রান্ত করেছে তাদের ফুটবল দুনিয়াকেও! ১৯৯৮ সালে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল জাতীয় দল ফিফার অনুমোদন পায় এবং দুটি দলই যখন ফিফার সদস্য, সেখানে ফুটবল সংক্রান্ত যেকোনো সংকটে ফিফার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আদৌ কি ফিফা নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সংকট সমাধানের চেষ্টা করছে? এই প্রশ্নের উত্তর এবং ফিফার আচরণ সম্পূর্ণ একটি প্যারাডক্স, যা ধীরে ধীরে আরও জটিল আকার ধারণ করছে।
ফিলিস্তিনের নিষেধাজ্ঞা প্রস্তাব
ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের পশ্চিম তীর ও জর্ডান উপত্যকায় ইসরায়েলের জোরপূর্বক দখলকৃত অঞ্চলে মোট ছয়টি ইসরায়েলি ফুটবল ক্লাব অবস্থিত যারা ইসরায়েলের লিগে অংশগ্রহণ করে, যা সম্পূর্ণ অবৈধ। ফিফার নীতিতে স্পষ্ট করে বলা আছে, সদস্য ফুটবল সংস্থার ফুটবল ক্লাবগুলো পূর্ব অনুমতি ব্যতীত অন্য সদস্য সংস্থার অঞ্চলে খেলতে পারবে না। ইসরায়েলি ক্লাবগুলো ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে শুধু খেলছেই না, বরং ক্লাবগুলো জোরপূর্বক সেখানে অবস্থান করছে। ফিলিস্তিন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (পিএফএ) দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যেন ক্লাবগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং ফিফার নিয়ম ভঙ্গের শাস্তি স্বরূপ ইসরায়েলকেও ফিফা থেকে বহিষ্কার করা হয়। স্পষ্ট একরোখা মনোভাব ও আগ্রাসনের সাথে ইসরায়েল ফিফার নিয়ম ভঙ্গ করে চললেও ফিফার কাউন্সিলে পিএফএ’র প্রস্তাব লম্বা সময় ধরে আলোচনার নিমিত্তে প্রলম্বিত হচ্ছে। চলতি বছরের মে মাসে বাহরাইনের রাজধানী মানামাতে ফিফার বাৎসরিক কাউন্সিলে পিএফএ একই প্রস্তাব আবারো তুললে সদস্যদের বড় একটি অংশ তা ভোট পর্যন্ত না গড়াতে দিয়ে আলোচনার টেবিলে সীমাবদ্ধ রাখে। অক্টোবরেও ফিফার কাউন্সিলে বরাবরের মতো ফলাফল এবং এই প্রস্তাবটির ব্যাপারে ফিফা পঞ্চমবারের মতো সুনির্দিষ্ট সমাধান ও প্রস্তাবনায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হলো। একইসাথে পরের বছর মার্চে নতুন করে আলোচনার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে ফিফা। একটি বিবৃতিতে বিশ্ব ফুটবল সংস্থাটি জানিয়েছে যে, ক্লাবগুলোকে নিষিদ্ধ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এই মুহূর্তে নেওয়া একটি অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত হবে।
শান্তির জন্য ফুটবল ম্যাচ
পিএফএ’র প্রস্তাবের বিপক্ষে ইসরায়েল সুকৌশলে বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালিয়ে আসছে এই বলে যে, তারা চায় খেলাধুলাকে সম্পূর্ণ রাজনীতির বাইরে রাখতে, অন্যদিকে ফিলিস্তিন চায় ফুটবল মাঠের ঠিক কেন্দ্রে রাজনীতি নিয়ে আসতে। ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের একটি রাজনৈতিক জয় হিসেবে দেখা হবে যদি ফিফা কর্তৃক ক্লাবগুলো নিষিদ্ধ হয় কিংবা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইসরায়েলি ভূখণ্ডে ক্লাবগুলো সরে যেতে বাধ্য হয়। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরাসরি ফিফার ভোটের বিপক্ষে গিয়ে পিএফএ’র প্রস্তাব বাতিল করার জন্যে ফিফা প্রেসিডেন্টকে আহ্বান জানান। তার দাবি, ক্লাবগুলো ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডে অবস্থিত। কৌশলী ইসরায়েলের পাল্টা প্রস্তাবনাটি হলো, শান্তির জন্য ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে একটি ফুটবল ম্যাচ, যা সাবেক ফিফা প্রেসিডেন্ট ব্লাটার ২০১৫ সালে দিয়েছিলেন। ইসরায়েলি ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (আইএফএ) প্রধান অফের আইনি মনে করেন, ম্যাচটি হবে জনগণকে একটি বন্ধনে আবদ্ধ করার সেতু এবং ম্যাচ থেকে প্রাপ্য লভ্যাংশ ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি ফুটবলের উন্নয়নে কাজে লাগাতে চায় আইএফএ।
আইএফএ মুখপাত্র বারজেল বলেন, “আমরা যেকোনো স্থানে আসব। হেব্রোন, জেরুজালেম, তেল আবিব, বাহরাইন।” ফিলিস্তিনের প্রস্তাবটি যতক্ষণ ফিফার আলোচনা সূচিতে রয়েছে, ততক্ষণ আদতে ইসরায়েলের প্রস্তাবিত শান্তির জন্য ফুটবল ম্যাচটি কতটুকু ফলাফল বয়ে আনবে? যদিও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ মনে করে, ২০১৪ সালে ভেঙে পড়া শান্তি আলোচনার পরিবেশ উন্নয়নেও ম্যাচটি ভূমিকা রাখতে পারবে।
বাস্তবতা
ইসরায়েলের প্রস্তাবে অবশ্য তেমন একটা আগ্রহ নেই ফিলিস্তিনের, কারণ মুখে শান্তির জন্য ফুটবল ম্যাচের কথা বললেও ফিলিস্তিন ফুটবলে তাদের আগ্রাসন থেমে নেই। পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরের মতো ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর তল্লাশির কবলে পড়তে হয়েছে পিএফএ’র সদর দপ্তরটিকেও। গাজার ফুটবল দল ও ফিলিস্তিন জাতীয় দলটির উপরে রয়েছে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এবং ২০১২ সালে গাজার একটি ফুটবলে মাঠে বোমা বর্ষণের অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। ফিলিস্তিনের বাইরে খেলতে যেতে হলে দলগুলোর ইসরায়েলের তেলআবিবে অবস্থিত বিমান বন্দর বা ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল দিয়ে জর্ডান হয়ে যাওয়া লাগে, সেক্ষেত্রে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের এই নিষেধাজ্ঞা ফিলিস্তিন ফুটবলের প্রতি বিন্দু মাত্র বন্ধুসুলভ আচরণ নয়। প্রস্তাবিত ফুটবল ম্যাচটি যে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের ফাঁপা বুলি, তা তাদের কর্মকাণ্ডে পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে ফিলিস্তিনিরা। তবুও পিএফএ প্রেসিডেন্ট জিব্রিল রজব ফুটবল ম্যাচের প্রস্তাবে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করে বলেন, “আমরা প্রস্তাবটি পছন্দ করেছি এবং এটি অনেকবার বলেছিও।” কিন্তু সবকিছুর শুরুতে রজব চান পিএফএ’র সকল শর্ত ও চাওয়া মেনে নিয়ে ম্যাচটি আয়োজনের একটি নির্দিষ্ট পথ তৈরি করা হোক। পিএফএ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট সুসান সালাবিও বলেন, “যখন তারা আমাদের দিকে একটি সত্যিকার পদক্ষেপ নিবে, তারা দেখবে যে তাদের দিকে আমরা দু’পা এগিয়ে যাব।”
ফিফার ভূমিকা
বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সবসময় চেয়েছে ফুটবল থেকে রাজনীতিকে দূরে সরিয়ে রাখতে এবং এই ব্যাপারে তারা সর্বদা কঠোর ভূমিকা পালন করে আসছে। ফুটবলে যেকোনো দেশের সরকার জোরপূর্বক ও অবৈধ হস্তক্ষেপ করলে ঐ দেশকে ফিফা সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে বহিষ্কারের পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞার আওতায় এনে থাকে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে ইসরায়েলি ক্লাবগুলোর অবস্থান ও খেলা চালিয়ে যাওয়া ফিফার নীতির স্পষ্ট লঙ্ঘন হওয়া সত্ত্বেও, তাদের আচরণ নিরপেক্ষতা ও পূর্বের কঠোরতার বিচারে দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
২০১৫ সাল থেকে পিএফএ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, অন্ততপক্ষে ক্লাবগুলোকে তাদের ভূমি থেকে ফিফা সরে যেতে বাধ্য করে। বারবার ফিফার একই অজুহাত, তারা রাজনৈতিক ব্যাপারে জড়াতে চায় না এবং নিরপেক্ষ থাকতে চায়। অক্টোবরের সভা শেষে ফিফা এই ব্যাপারে তাদের অবস্থান নিয়ে একটি বিবৃতিতে জানায়, “পশ্চিম তীরের চূড়ান্ত অবস্থা আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষের ব্যাপার, ফিফা কাউন্সিল একমত যে, ফিফার নিজস্ব নীতি অনুযায়ী রাজনৈতিক সংক্রান্ত বিষয়ে তারা অবশ্যই নিরপেক্ষ থাকবে।” একইসাথে পশ্চিম তীরে ইসরায়েল কর্তৃক দখলকৃত অবৈধ অঞ্চলে গত বছর আয়োজিত ম্যাচে ফিফার সমর্থন সংস্থাটির দ্বিমুখী নীতির স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল অঞ্চলের পরিচালক সারি বাসি বলেন, “চুরি করা ভূমিতে ম্যাচের আয়োজন, ফিফা ফুটবলের সৌন্দর্যকে কলঙ্কিত করছে।”
ফিচার ইমেজ- Luo Jie