অ্যানফিল্ডে লিভারপুল বনাম রোমার যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিলো, স্তাদিও অলিম্পিকোতে আজ সমাপ্তি হতে যাচ্ছে সে যুদ্ধের। অ্যানফিল্ডে একতরফা লড়াইয়ে প্রথম লেগেই অনেকটা ফাইনাল নিশ্চিত করে ফেলেছিলো অলরেডরা। কিন্ত ম্যাচের শেষ দশ মিনিটে পাশার দান উল্টে যায়। পরপর জোড়া গোলে রোমা ম্যাচে একদম ফিরে আসেনি ঠিকই, তবে আশার টিমটিমে একটা বাতি তারা জ্বালিয়ে রেখেছে। নিজেদের মাঠে তাদের করতে হবে ক্লিনশিটসহ তিন তিনটি গোল। যদিও লিভারপুলের মতো শক্তিশালী দলের বিপক্ষে এভাবে ঘুরে দাঁড়ানো কতটা জটিল তা অনুভব করতে পারছেন ইউসেবিও ডি ফ্রান্সিসকো। কিন্ত এই রোমাই নিজেদের মাঠে ৩-০ গোলে হারিয়েছিলো স্প্যানিশ জায়ান্ট বার্সেলোনাকে। তাই ঘরের মাঠে ৫ গোল করে ও ৩ গোলের লিড নিয়েও ইতালিতে ইয়ুর্গেন ক্লপের দল নির্ভার থাকতে পারছে না।
অ্যানফিল্ডে হেরে আসার পরও দুই দলের মুখোমুখি পারফর্মেন্সে রোমা এগিয়ে আছে। প্রথম লেগ মিলিয়ে লিভারপুল ও রোমা মুখোমুখি হয়েছে মোট ৮ বার। যার ৪টিতে জিতেছে রোমা, ১টি হয়েছে গোলশূন্য ড্র এবং বাকি ৩ ম্যাচে জয় পেয়েছে লিভারপুল। নিজেদের মাঠে রোমার জয়ের রের্কড বরাবর ভালো। তবে নিজেদের মাঠে ইউসেবিও ডি ফ্রান্সিসকোর দল ফেভারিট হলেও ইতিহাস বলছে অন্য কথা।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসে এ পর্যন্ত ৫ গোল হজম করার পর কোনো দল ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ১৯৯৯-২০০০ মৌসুমে ভ্যালেন্সিয়া লাৎসিওকে নকআউট থেকে বিদায় করে দিয়েছিলো ৫-৩ অ্যাগ্রিগেটে। প্রথম লেগে ভ্যালেন্সিয়ার মাঠে ৫-২ গোলে হেরে এসেছিলো লাৎসিও। নিজেদের মাঠে ০-১ গোলের জয় পেলেও পরের রাউন্ডে পৌঁছাবার সৌভাগ্য হয়নি। তাই কোনোভাবে যদি লিভারপুলের বিপক্ষে রোমা ঘুরে দাঁড়ায় এবং অলরেডদের হারিয়ে ফাইনাল নিশ্চিত করে, তাহলে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসে জন্ম নেবে নতুন রেকর্ড। তাই রোমার জয়ের সম্ভবনা আপাতদৃষ্টিতে কম। এবং ইতালিতে খেলা হলেও সেখানে সালাহ, ফিরমিনোদের লিভারপুলই ফেভারিট।
আজ স্তাদিও অলিম্পিয়াকোতে স্কোয়াড সাজাতে ইয়ুর্গেন ক্লপের হিমশিম খেতে হতে পারে। ইনজুরির কারণে আজও পাবেন না জোয়েল মাটিপকে। এ্যামেরি চ্যানের মাঠে নামার সম্ভাবনা অনেক কম। রোমার সাথে প্রথম লেগে গুরুতর ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়ে এ মৌসুম শেষ হয়ে গেছে অালেক্স অক্সালিড চেম্বারলিনের। প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচে চোট পেয়ে নতুন করে ইনজুরিতে পড়েছেন জো গোমেজ। তবে সুখবর মাত্র একটি, দলের সাথে ইতালিতে গেছেন অ্যাডাম লাল্লানা। তবে তিনি মাঠে নামার জন্য পুরোপুরি ফিট কিনা, তা নিশ্চিত নয়। তাই গোলকিপারের দায়িত্ব লরিস কৌরিওসকে রেখে প্রথম লেগের মতো রক্ষণ সাজানোর সম্ভাবনা বেশি। পরিবর্তন আসতে পারে মধ্যমাঠে। জেমস মিলনারকে বামপাশে রেখে চেম্বারলিনের বদলে মাঠে নামতে পারেন জর্জিনিয়ো ওয়াইনালদুম। আর এ্যামেরি চ্যান যদি মাঠে না নামেন তবে তার পরিবর্তে ডিফেন্সিফ মিডফিল্ড সামলাবেন জর্ডান হেন্ডারসন। আর আক্রমণভাগে সালাহ, ফিরমিনো ও মানে ত্রয়ী তো থাকছেনই।
ইনজুরি ধাক্কা আছে রোমার জন্যও। ইনজুরির জন্য কেভিন স্ট্রুটম্যান ও ডিয়েগো পেরত্তির খেলা অনিশ্চিত। তাই আজ লিভারপুলের বিপক্ষে দলের প্রধান দুই খেলোয়াড়কে ব্যাবহার করতে পারবেন না ইউসেবিও ডি ফ্রান্সেসকো। তবে গোলকিপার ও রক্ষণে কোনো পরিবর্তন নয়। ফ্যাজিও, কোলারভ, ফ্লোরেঞ্জি ও মানোলোনাসের সমন্বয়ে ৪-৩-৩ ফর্মেশনের দল দেখার সম্ভাবনা আজ বেশি। কেভিন স্ট্রুটম্যানের পরিবর্তে শুরুর একাদশে থাকার সম্ভবনা লরেঞ্জো পেল্লেগ্রিনোর। আর নাইংগোলন ও ড্যানিয়েল ডি রসির খেলতে কোনো অসুবিধা নেই আজকের ম্যাচে। তবে সম্ভাব্য ৪-৩-৩ ফর্মেশনের কারণে আক্রমণে এডিন জেকোর সাথে স্টিভেন এল স্যারাউই এবং প্যাট্রিক সিচকের দেখা পাওয়ার সম্ভবনা বেশি। দ্বিতীয় লেগে উভয় দল তাদের পূর্ণাঙ্গ দল পাচ্ছে না। তাই শক্তি ও সামর্থ্যে দুই দলের অবস্থান থাকছে এক স্তরে।
প্রথমত, রোমার মাঠের লড়াই আত্মবিশ্বাস ও শেষপর্যন্ত লড়ে যাবার প্রবণতা তাদেরকে দারুণভাবে প্রেরণা দেয়। অ্যানফিল্ডে শুরুটা কিন্ত করেছিলো রোমা। কিন্ত প্রথম ৩০ মিনিট অতিক্রম করার পর খেই হারিয়ে ফেলে তারা, যার সুযোগে লিভারপুলের দেওয়া পাঁচ পাঁচটা গোল হজম করতে হয় তাদের। কিন্ত পাঁচ গোল হজম করার পরও তারা একবিন্দু আত্মবিশ্বাস হারায়নি। শেষপর্যন্ত লড়ে যাবার ইচ্ছাশক্তির জন্য আবারো ম্যাচে ফিরে এসে দুটো গোল ফেরত দিয়েছিলো লিভারপুলকে। এই অ্যাওয়ে গোলের সুবাদে তারা আরো সজীব হয়ে উঠতে পারে দ্বিতীয় লেগে। মহা গুরুত্বপূর্ণ সেকেন্ড লেগের ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে রোমার মাঠে। নিজেদের মাঠে, নিজেদের পরিচিত দর্শকদের সামনে রোমা যে আরো ভয়ংকর।
লিভারপুলের কিয়েভ যাত্রা আরো জটিল করে তুলতে পারে এডিন জেকো ও রোমার মধ্যমাঠের খেলোয়াড়রা। এডিন জেকোর বিশেষ উচ্চতার কারণে শূন্যে ভাসিয়ে বল দেবার কৌশল গত কয়েক ম্যাচে লক্ষ্য করা গেছে। লিভারপুলের বিপক্ষে জেকোর একমাত্র গোলটিও এ কৌশলে করা। ইনজুরির কারণে নেই জোয়েল মাটিপ। তাই লিভারপুলের বর্তমান ডিফেন্সে একমাত্র দীর্ঘদেহী ফুটবলার ভার্জিল ভ্যান ডাইক। রোমা যদি আবারো জেকোর উচ্চতা কাজে লাগিয়ে গোল করার পরিকল্পনা করে তবে তা রুখে দেওয়া ভার্জিল ভ্যান ডাইকের পক্ষে সম্ভব না। আর উঁচু লাফ বা ক্ষিপ্র গতি না থাকার কারণে লভরেন বা রাগ্নার ক্লাভান পর্যাপ্ত সহায়তা করতে পারবেন না ভ্যান ডাইককে। তাই রোমার এ কৌশল বানচাল করার একটা মাত্র উপায় তাদের মধ্যমাঠ নিস্ক্রিয় করে রাখা।
এ সিজনে ক্রমে ক্রমে রোমার ভরসার প্রতীক হয়ে উঠছেন অ্যালিসন বেকার। লিভারপুলদের সাথে প্রথম লেগে পাঁচটি গোল হজম করলেও তার কোন ভুলো ছিলো না। গোলগুলো হয়েছিলো লিভারপুল অ্যাটাকারদের সুনিপুণ প্রচেষ্টায় ও রোমা রক্ষণের কিঞ্চিত ভুলে। তাই দ্বিতীয় লেগেও চোখ থাকবে অ্যালিসনের দিকে। বার্সেলোনার বিপক্ষে ৩-০ জয়ে বার্সেলোনাকে প্রায় একাই রুখে দিয়েছিলেন অ্যালিসন। ইনিয়েস্তা, সুয়ারেজ থেকে মেসি পর্যন্ত তার সামনে হয়ে যাচ্ছিলো ম্রিয়মাণ। স্তাদিও অলিম্পিয়াকোতে আরো একবার হিরো হবার মোক্ষম সুযোগ তিনি কীভাবে ব্যবহার করবেন আজকের ম্যাচের পর সে প্রশ্নের জবাব তৈরি থাকবে।
রোমার মাঠে মোহাম্মদ সালাহ আরো একবার নিজের পেশাদারিত্বের প্রমাণ দিতে হবে। আবেগ, ভালোবাসাকে দূরে সরিয়ে প্রাক্তন রোমার রক্ষণ ভেদ করতে আরো একবার মত্ত হয়ে উঠবেন এ মিসরীয় ফুটবলার। রোমা থেকে লিভারপুলে দল বদলের পর এবার প্রথমবার সালাহ ফিরছেন তার অনেকদিনের চিরচেনা মাঠে। কিন্ত দৃশ্যপট পাল্টে এত দ্রুত তাকে সেমিফাইনালের মতো কঠিন ম্যাচ খেলতে হবে সদ্য ছেড়ে আসা বসতবাড়িতে, সেটা কে ভেবেছিলো? অ্যানফিল্ডে ২ গোল ও ২ অ্যাসিস্ট করে রোমাকে বিধ্বস্ত করার অন্যতম নায়ক মোহাম্মদ সালাহ। আজও অ্যানফিল্ড দর্শকরা তার দিকে চেয়ে থাকবে আরো একটি দুর্দান্ত ৯০ মিনিটের। এ মৌসুমে হোম গ্রাউন্ড বা অ্যাওয়ে গ্রাউন্ড কোনটাকে বাঁধা হিসেবে দেখেননি সালাহ। তার অসামান্য ড্রিবলিং দক্ষতায় আর ঠান্ডা মাথার ফিনিশিং প্রায় সব ম্যাচে দেখা গেছে। তবে কি রোমার মাঠে আরো একবার চিরচেনা সালাহ জ্বলে উঠবেন?
সব নজর সালাহর দিকে দিয়ে রাখলে কিছুটা ভুল করা হবে। কারণ গোল বা অ্যাসিস্টে রাঙিয়ে দিতে রবার্তো ফিরমিনো যে প্রস্তুত। মোহাম্মদ সালাহর পাশাপাশি চলতি মৌসুমও দারুণ কাটছে ফিরমিনোর। রোমার সাথে প্রথম লেগে করেছিলেন জোড়া গোল। আজও তেমনি কিছু করে দেখানোর জন্য প্রস্তুত ফিরমিনো। সালাহ ফিরমিনো জুটির রসায়ন এ সিজনে বিশেষভাবে লক্ষনীয়। দুজনের বোঝাপড়া আর ডিফেন্সে সামান্য ভুল ম্যাচের পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। তাই শুধু সালাহ নয় মানোলোনাস ও ফাজিওদের ছক কষে রাখবে হবে রবার্তো ফিরমিনোর জন্যও। প্রথম লেগে চোট পেয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন অক্সালিড চেম্বারলিন। আর্সেনাল থেকে লিভারপুলে আসার পর ক্রমে ক্রমে মধ্যমাঠের ভরসা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কিন্ত সেই চেম্বারলিনকে আজকের ম্যাচে পাচ্ছে না লিভারপুল, পাবে না চলতি মৌসুমের আর কোনো ম্যাচেই। তবে প্রথম লেগে চেম্বারলিনের বদলে ওয়াইনালদুম মাঠে নেমে মধ্যমাঠে প্রাণ ফিরিয়ে এনেছিলেন। তাই চ্যান, চেম্বারলিন ব্যতীত আজকে লিভারপুলের মিডফিল্ড তেমন আগ্রাসী রূপে মেলে ধরতে পারার কথা না। তবে জর্জিনিয়ো ওয়াইনালদুম থাকার কারণে কিছুটা ভরসা রাখতেই পারে অলরেড সমর্থকেরা।
রোমার ইতিহাসে তারা ফাইনাল পৌঁছানো তো দূরের কথা, কখনো সেমিফাইনালে খেলার যোগ্যতাও অর্জন করতে পারেনি। সেখানে যদি আজ লিভারপুলকে হারিয়ে দিয়ে রোমা ফাইনালে পৌঁছায় তা হবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসে অন্যতম অবিশ্বাস্য রেকর্ড। আর সেই স্টিফেন জেরার্ডের আমলের পর চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা ছোঁয়া হয়নি অলরেডদের। ক্লপের ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া লিভারপুলের দীর্ঘ ১৩ বছরের অপেক্ষা ঘোচানোর এই তো মোক্ষম সুযোগ।