২০১৮ সালটি বেশ কিছু কারণে ঐতিহাসিক ও রোমাঞ্চকর ছিল। এ বছরে ঘটা প্রত্যেকটি ঘটনা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই সুখ ও দুঃখের স্মৃতিবিজড়িত। ইতিহাসে প্রথমবার রিয়াল মাদ্রিদ জিতেছে টানা তৃতীয় চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফি। নতুন মৌসুমে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুকে বিদায় জানিয়ে ইতালিতে পাড়ি জমিয়েছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। বহু দিনের সম্পর্ক পেছনে ফেলে ন্যু ক্যাম্পকে বিদায় জানিয়েছেন আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা। এ বছরই মাঠে গড়িয়েছে বিশ্বকাপ। তাতে আরও একবার হতাশ হয়েছেন লিওনেল মেসি, ক্রোয়েশিয়ার অন্যবদ্য ফুটবলের পর চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তারুণ্যে উচ্ছ্বসিত ফ্রান্স। মেসি, রোনালদোকে পেছনে বিশ্বসেরা হয়েছেন লুকা মদ্রিচ। বছরটা শেষ হয়েছে জোসে মরিনহোর প্রিমিয়ার লিগ থেকে বিদায়, মোনাকোর দুর্দশা ও কোপা লিবার্তাদোরেসের ফাইনালের হামলার মতো ঘটনা দিয়ে।
ফুটবলের ইতিহাসে এতসব ঘটনা যখন ঘটে গেছে মাত্র ৩৬৫ দিনে, তখন তো সে বছরটি স্মরণীয় হতেই হবে! তাই বছরশেষে একটি গবেষণামূলক ফিচার এটি। এ লেখায় বর্ষসেরা একাদশকে বেছে কেন তারা বর্ষসেরা, তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তবে এখানে কে তার ক্লাব বা দেশের হয়ে কতগুলো ট্রফি জিতেছে, তা মুখ্য নয়। সারাবছর মাঠের ফুটবলে যারা সবসময় সেরা ছিলেন, এই বর্ষসেরা একাদশে তারাই সর্বোচ্চ প্রাধান্য পাবেন।
১. অ্যালিসন বেকার (লিভারপুল/ব্রাজিল)
চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে লরিস কারিউসের শিশুতোষ ভুলের পর ক্লপ একরকম সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলেন যে, এইরকম মধ্যম মানের গোলরক্ষক দিয়ে আর পোষাবে না। একজন বিশ্বমানের গোলরক্ষক তার দলের জন্য আবশ্যক। ক্লপ এগিয়ে গেলেন অ্যালিসনের কাছে। লিভারপুল যেকোনো মূল্যে গোলরক্ষক কিনবে বুঝেই রোমা দাবি করলো আকাশচুম্বী ট্রান্সফার ফি। অকূল পাথারে পড়া লিভারপুল বাধ্য হলো রেকর্ড পরিমাণ ট্রান্সফার ফি’য়ের বিনিময়ে অ্যালিসনকে অ্যানফিল্ডে আনতে। কিন্তু এমন বৃহৎ অঙ্কের অর্থের সাথে অ্যালিসন কি মানানসই?
সে বিতর্ক এখন নেহায়েত অবান্তর। এই পরিমাণ অর্থ খরচ করে লিভারপুল যে ভুল করেনি, তার প্রমাণ মাঠে অ্যালিসন নিজেই দিয়েছেন। চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ১৬’এর ড্রয়ের পর কিংবদন্তী গোলরক্ষক অলিভার কান নিজেই এগিয়ে রেখেছেন অ্যালিসনকে। তিনি ‘গোল ডট কম’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন,
“বর্তমানে অ্যালিসন সেরা। সে যে একজন বিশ্বসেরা গোলরক্ষক,তা সে নিজে বিশ্বকাপে প্রমাণিত করেছে।”
প্রিমিয়ার লিগে লরিস, ডি হেয়া, এডারসন, আরিজাবালাগার মতো গোলরক্ষক থাকলেও এ মৌসুমে তিনি সবসময় সবার থেকে এক ধাপ উপরে। লিভারপুলের হয়ে লিগে ক্লিনশীট রেখেছেন ১২টি। এ পর্যন্ত সব থেকে কম গোল হজম করার রেকর্ড তার দখলে, সাথে অবিশ্বাস্য কিছু সেভ তো আছেই। বিশ্বকাপ ব্রাজিল না জিতলেও বড় মঞ্চে অ্যালিসন নিজের দক্ষতা ঠিকই প্রমাণ করে এসেছেন। চ্যাম্পিয়নস লিগেও একই ধারাবহিকতা বজায় রেখেছেন তিনি। তার বদৌলতেই লিভারপুল এখন শেষ ষোলোতে। শেষ দুই ম্যাচে পিএসজির ৬টি দুর্দান্ত গোলসুযোগ রুখে দিয়েছিলেন। আর নাপোলিকে গোলবঞ্চিত রাখতেও তার অবদানই সব থেকে বেশি।
ইয়ান অবলাক, মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগান, হুগো লরিস বা কোর্তোয়ার মতো অনেকেই এ মৌসুমে তাদের সেরাটা দিয়ে দলকে শিরোপার আরও নিকটে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সব বিভাগ থেকে অ্যালিসন এগিয়ে থাকার কারণে বছর সেরা গোলরক্ষকের খেতাব তাকে দেওয়াই বাঞ্ছনীয়।
২. কিয়েরন ট্রিপিয়ার,(ইংল্যান্ড/ টটেনহাম হটস্পার)
রাশিয়া বিশ্বকাপে তরুণদের নিয়ে গড়া ইংল্যান্ড দলটি ছিল একদম আনকোরা। হ্যারি কেইনকে ক্যাপ্টেন রেখে ডেলে আলি, রাহিম স্টার্লিং, নিক পোপ, কিয়েরন ট্রিপিয়ার, হ্যারি ম্যাগুয়ের বা রুবেন লফটাস চিক, কারও ছিল না বিশ্বকাপ অভিজ্ঞতা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই দলটি মুগ্ধ করেছে সবাইকে। মুগ্ধতা ছড়ানো সেই দলের অন্যতম সেরা পারফর্মার ছিলেন রাইটব্যাক কিয়েরন ট্রিপিয়ার। যদিও ট্রিপিয়ার রাইটব্যাক নন, গ্যারেথ সাউথগেটের স্কোয়াডে তিনি একজন উইংব্যাক হিসেবেই বেশি খেলেছেন।
তবে শুধু বিশ্বকাপ নয়, এ বছর প্রিমিয়ার লিগেও তিনি ছিলেন অনবদ্য। কাইল ওয়াকারের চলে যাবার পর স্পার্সের ডান পাশের দায়িত্ব তারই কাঁধে। আর প্রতিনিয়ত উন্নতি করে চলা ট্রিপিয়ার এ বছর সেই দায়িত্ব দুর্দান্তভাবে পালন করেছেন। তার অন্যতম দক্ষতা হলো, তিনি আক্রমণ ও রক্ষণ দু’দিক সমানভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। স্পার্সের হয়ে হ্যারি কেইন বা সন হিউং-মিনদের অনেকগুলো গোলের অ্যাসিস্টই ট্রিপিয়ারের।
শুধু বিশ্বকাপ বা প্রিমিয়ার লিগ নয়, ইউরোপের সেরা রাইটব্যাকদের সাথে তার তুলনা করলে ট্রিপিয়ার অধিকাংশ দিকে থেকেই বেশ ব্যবধানে এগিয়ে আছেন। ২৭ বছর বয়সে এসে ট্রিপিয়ারকে ঠিক ‘ইয়াংস্টার’ খেতাব দেওয়া যায় না বটে, তবে এটাই সঠিক সময় তার ক্যারিয়ারকে আরও এক ধাপ উপরে নিয়ে যাবার।
৩. রাফায়েল ভারান (রিয়াল মাদ্রিদ/ফ্রান্স)
রাফায়েল ভারান ও স্যামুয়েল উমতিতি উভয়ই লা লিগা’তে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী, কিন্তু এক জায়গায় তারা দু’জনে মিলে গেছেন। দু’জন শুধু জাতে ফরাসি নন, ফ্রান্স দলে রক্ষণের দায়িত্বও তারা নিজেদের ভেতর ভাগাভাগি করে নেন। ক্রমশঃ অনেক দিক থেকেই ভারানকে পেছনে ফেলে দিয়েছিলেন উমতিতি। যদিও বিশ্বকাপ দু’জনই জিতেছেন, কিন্তু ভারান নিজেকে নিয়ে গেছেন ভিন্ন এক উচ্চতায়।
দারুণ একটি বছর শেষ করলেন রাফায়েল ভারান। টানা দুইবারের পর এ বছরও তৃতীয় চ্যাম্পিয়নস লিগের ট্রফি ছুঁয়ে দেখলেন, বিশ্বকাপে গিয়ে ফরাসিদের হয়ে বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফি পর্যন্ত ঘরে তুললেন, কয়েক সপ্তাহ আগে জিতেছেন ক্লাব বিশ্বকাপ। আর এসবের সবকিছুই মাত্র ২৫ বছর বয়সে। এক বছরে বিশ্বকাপ আর রিয়ালের মাদ্রিদের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে রবার্তো কার্লোস, স্যামি খেদিরা ও টনি ক্রুসের পর নিজের নামও রেকর্ডবুকে খোদাই করে ফেলেছেন ভারান। তাই কোনো সন্দেহ ছাড়াই এবারের বর্ষসেরা ডিফেন্ডারদের একজন তিনি।
৪. ভার্জিল ভ্যান ডাইক (লিভারপুল/নেদারল্যান্ড)
মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ভার্জিল ভ্যান ডাইকের অ্যানফিল্ডে ১ বছর পূর্ণ হলো। ১২ মাস আগে বিপুল অর্থের বিনিময়ে লিভারপুল যখন তাকে কিনেছিলো, তখন তিনি ছিলেন অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে কেনা মধ্যম পর্যায়ের একজন ডিফেন্ডার। কিন্ত লিভারপুলের হয়ে ১২ মাসের শান্ত, মনোযোগী এবং অসামান্য নেতৃত্বগুণ তাকে পৌঁছে দিয়েছে বর্তমান সময়ের সেরা ডিফেন্ডারদের পর্যায়ে। কোনো আলোচনা ও বিতর্ক ছাড়াই ভ্যান ডাইক এই মুহূর্তে প্রিমিয়ার লিগের, তথা বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম সেরা রক্ষণভাগের খেলোয়াড়।
কিন্তু ভ্যান ডাইক কিভাবে ১২ মাসে নিজেকে প্রমাণ করলেন? লিভারপুলের রক্ষণজনিত সমস্যা বহু পুরনো। তারা অনেক সময় হোঁচট খেয়েছে এই রক্ষণ সমস্যার জন্য। তবে ভ্যান ডাইক’কে কেনার পর বর্তমানে সেই সমস্যা নেই বললেই চলে। চলতি মৌসুমে লিভারপুল কোনো ম্যাচ হারেনি, গোল হজমও করেছে মাত্র ৭টি। গত শীতকালীন দলবদলে ভ্যান ডাইক আসার পর লিভারপুলের বদলে যাওয়া যেন একদম স্বপ্নের মতোই ছিল।
অদ্ভুতুড়ে প্রশ্নটা হলো, ভ্যান ডাইকের বয়স বর্তমানে ২৭ বছর। বড় দলে আসতে তিনি কেন এত দেরি করে ফেললেন?
৫. লুকাস হার্নান্দেজ (অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ/ফ্রান্স)
অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের হয়ে দারুণ সময় অতিবাহিত করা লুকাস হার্নান্দেজকে দিদিয়ে দেশম স্কোয়াডে রেখেছিলেন বদলি খেলোয়াড় হিসেবে। কিন্তু বেঞ্জামিন মেন্ডির ইনজুরির সুযোগে সেই লুকাস হয়ে গেলেন প্রথম পছন্দের লেফটব্যাক।
লুকাস হার্নান্দেজ একজন প্রথাগত ডিফেন্ডার। আক্রমণে প্রভাব বিস্তার করা খুব একটা পছন্দ নয় তার, তাই অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের হয়ে সেরা মৌসুমেও তার কোনো গোল নেই। ডিয়েগো সিমিওনের দলে গডিন বা গিমেনেজের ইনজুরির কারণে তৈরি হওয়া যে শূন্যস্থান, সেটা বোঝা যায়নি শুধুমাত্র লুকাসের কারণে। বিশ্বকাপেও ফ্রান্স লাভবান হয়েছে তার রক্ষণাত্মক মনোভাবের কারণে। লুকাস এমন একজন লেফটব্যাক, যার কারণে অন্য খেলোয়াড়ের পজিশন নিয়ে ভাবতে হয় না। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ বা ফ্রান্স, কোনো দলের লেফট-মিড বা লেফট উইংকেই কখনো ভাবতে হয়নি নিচে নেমে রক্ষণে বাড়তি সাহায্য করার কথা।
লুকাস হার্নান্দেজের বয়স মাত্র ২২। এটা অনুমেয় যে, আগামী কয়েক বছরের ভেতরই তিনি বিশ্বের সেরা ও দামী লেফটব্যাকদের একজন হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতে যাচ্ছেন।
৬. এনগোলো কান্তে (চেলসি/ ফ্রান্স)
নিঃশব্দে কাজ শেষ করে নিঃশব্দে প্রস্থান করার বিষয়টি এনগোলো কান্তের সাথে দারুণভাবে মিলে যায়। যিনি জয় করা বিশ্বকাপে একটি চুমু দিতে লজ্জাবোধ করেন, তাকে নিয়ে ফুটবল মঞ্চে কম আলোচনা হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। আর ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারদের প্রশংসার আলোতে আনতে অনেকেই চান না।
ব্যালন ডি অর এবং কান্তে সম্পর্কে তার প্রাক্তন কোচ আন্তোনিও কন্তে বলেছেন,
“আমি জানি না, কান্তের যেমন জীবনধারণ পদ্ধতি আর খেলোয়াড়সূলভ চিন্তাভাবনা, এতে সে কখনো ব্যালন ডি’অর জিতবে কিনা! সে খুব একটা গোল করবে না, কিন্তু সে খুবই কর্মঠ। একজন কোচ হিসেবে বলছি, এ পুরস্কার তার অবশ্যই জেতা উচিত। যদিও সেরকম ঘটা খুবই কঠিন। পাওলো মালদিনি বিশ্বের সেরা ডিফেন্ডার হয়েও কখনও এ পুরস্কার জেতেননি। জিয়ানলুইজি বুফন কখনো ব্যালন ডি’অর ছুঁয়ে দেখেননি, অথচ তিনি বিশ্বের সেরা গোলরক্ষক। এটাই ব্যালন ডি’অরের ইতিহাস।”
আন্তোনিও কন্তে’র চেলসি কিংবা ফ্রান্সের হয়ে বিশ্বকাপ, দু’জায়গাতেই দলের মাঝমাঠ থেকে আক্রমণ থামিয়ে দেবার দায়িত্ব সমর্পিত ছিল কান্তে’র উপর। চুপিসারে তিনি তা করে গেছেন। বিশ্বকাপে তার ট্যাকল করার সফলতা ৭৪%। চেলসিতে কান্তের ট্যাকটিকসে তার পাসের সফলতার হার ৮৯%। এছাড়াও ইন্টারসেপশন, ড্রিবলিং, বল ক্লিয়ারেন্স এবং ডুয়েলে তার সফলতার হার অন্যদের থেকে অনেক বেশি। বিশ্বকাপে মেসিকে একাই থামিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বেলজিয়াম এবং উরুগুয়ের বিপক্ষে ম্যাচগুলোতে তাদের আক্রমণ মাঝমাঠেই উবে গেছে একজন কান্তের জন্য। তাই সকল পরিসংখ্যান, পর্যালোচনা ও তুলনার ভিত্তিতে এ বছরের সেরা রক্ষনাত্মক মিডফিল্ডার এনগোলো কান্তে।
৭. লুকা মদ্রিচ (রিয়াল মাদ্রিদ/ক্রোয়েশিয়া)
লুকা মদ্রিচের এ বছরের সব থেকে বড় অর্জন সম্ভবত মেসি ও রোনালদোকে পেছনে ফেলে ব্যালন ডি’অর জিতে নেওয়া। তবে তিনি যে শুধু ব্যালন ডি’অর জিতেছেন, এমন নয়। নিজস্ব অর্জনের ভেতর আছে ফিফা বর্ষসেরা ও উয়েফা বর্ষসেরার মতো পুরস্কারও। ক্রোয়েশিয়াকে বিশ্বকাপ ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে তার অবদানই সর্বাধিক। আর্মব্যান্ড হাতে সবার সামনে থেকে দলকে শক্তি জুগিয়েছেন, ৭ ম্যাচে ২ গোলের পাশাপাশি ১ অ্যাসিস্ট আছে তার। রিয়াল মাদ্রিদের টানা তৃতীয় চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা জেতা দলে মধ্যমাঠের সব থেকে নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় ছিলেন মদ্রিচ। রোনালদো জুভেন্টাসে পাড়ি দেবার পর অধিকাংশ ক্যামেরার নজর তার দিকে। এরই মাঝে ফিফা বিশ্বকাপ জিতে নিলেন এই মিডফিল্ডার।
নতুন মৌসুমের শুরুতে যুঝতে থাকা টানা খেলার ধকল সামলে আবারও ফিরতে শুরু করেছেন তিনি। ২৪টি ম্যাচও খেলে ফেলেছেন। যদিও কোন গোল করেননি, অ্যাসিস্ট করেছেন ৪টি। তবে মধ্যমাঠ থেকে আক্রমণের শুরুটা তাকে কেন্দ্র করেই হচ্ছে।
৮. ইভান রাকিটিচ (বার্সেলোনা/ক্রোয়েশিয়া)
গত মৌসুমে ইভান রাকিটিচ যেকোনো ফুটবলার থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক ম্যাচ খেলেছেন। বার্সেলোনায় আর্নেস্তো ভালভার্দে ও ক্রোয়েশিয়ার জলাৎকো দালিচের স্কোয়াডে তিনি ছিলেন নির্ভরতার প্রতীক। এ বছর রাকিটিচ নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। বার্সেলোনার হয়ে লিগ ও ডমেস্টিক কাপ এবং ক্রোয়েশিয়ার সর্বোচ্চ অর্জনের দলে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছেন। জলাৎকো দালিচ তো বলেই দিয়েছেন,
‘এটাই রাকিটিচের সেরা পারফরম্যান্স, যা আমাদের উপভোগ করা উচিত। সে মদ্রিচকে পাশে রেখে বিশ্বকাপের সেরা মিডফিল্ড জুটি তৈরি করেছে।’
রাকিটিচ এমন কোনো খেলোয়াড় নন, যিনি নিয়মিত গোল বা অ্যাসিস্ট করেন। তবে তার দক্ষতা হলো মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণে রাখা। বল দখলে রাখায় রাকিটিচ নির্ভুল, তিনি একাদশে থাকার অর্থ হলো দলে সাম্য বজায় রাখা। এ বছর লা লিগায় সর্বোচ্চ ২৪৩৬টি সফল পাস সম্পন্ন করেছেন তিনি, যা অন্য যেকোনো খেলোয়াড় থেকে বেশি। বার্সেলোনায় যখন কোনো আক্রমণ তৈরি হয়, সেখানে যেমন তার ভুমিকা থাকে, তেমনই প্রতিপক্ষ যখন আক্রমণাত্মক রূপ ধারণ করে আচমকা আক্রমণে যায়, তা রুখে দিতেও তার ভূমিকা থাকে। গত মৌসুমে লা লিগায় রাকিটিচের পাস দেবার সফলতা ছিলো ৯০ শতাংশ। গোল সুযোগ তৈরি করেছেন ১০টি। চলতি মৌসুমে ১৫ ম্যাচে গড় রেটিং ৭.১৯। পাসিং অ্যাকুরেসি আগের মতোই, সফলতার হার ৯২ ভাগ। সারা বছর সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলা একজন সেন্টার মিডফিল্ডার যখন এভাবে টানা ভালো পারফরম্যান্স বজায় রাখেন, তখন অবশ্যই তিনি বর্ষসেরা সম্মাননার যোগ্য।
৯. লিওনেল মেসি (বার্সেলোনা/আর্জেন্টিনা)
২০১৮ বছরটি মেসির ক্যারিয়ারের সেরা বছর ছিল না। ২০১৮ এর শুরুতে ব্যালন ডি’অর জিতেছিলেন রোনালদো, সেখানে এ বছর শেষেও মেসিকে ৫ম অবস্থানে রেখে ব্যালন ডি’অর জিতলেন লুকা মদ্রিদ। ট্রফি জিতেছেন মাত্র তিনটি। বিশ্বকাপে গিয়ে হতাশ করেছেন, চ্যাম্পিয়নস লিগটাও হাতছাড়া হয়েছে। কিন্তু আদতে মেসি ছিলেন মেসিসুলভই।
গত মৌসুমে ইউরোপে সর্বোচ্চ গোল, সর্বোচ্চ অ্যাসিস্ট, সর্বোচ্চ ড্রিবল, সর্বোচ্চ ফ্রি-কিকে গোল করা এবং সর্বাধিক গোল সুযোগ তৈরি করার রেকর্ড এখন পর্যন্ত তার দখলে। এ মৌসুমে শুধুমাত্র লা লিগা’র ১৫ ম্যাচে করেছেন ১৫ গোল ও ১০ অ্যাসিস্ট। ২০১৮ সালে খেলেছেন ৫৪টি ম্যাচ; তাতে গোল সংখ্যা ৫১, অ্যাসিস্ট করেছেন ২৬টি।
চোখের সামনে রিয়াল মাদ্রিদ টানা তিনটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে ফেললো। রোনালদো ও মদ্রিচ জিতে নিলেন সকল ব্যক্তিগত ট্রফি। তবুও লিওনেল মেসি আছেন তার পথেই। প্রতি বছর করে চলেছেন পঞ্চাশেরও বেশি গোল। আর ইনিয়েস্তা বিদায় নেবার পর থেকে দলকে নেতৃত্বটাও দিচ্ছেন সামনে থেকে।
১০. কিলিয়ান এমবাপে (পিএসজি/ফ্রান্স)
২০ বছর বয়সে আর কী জেতা বাদ রাখলেন কিলিয়ান এমবাপে? এ বছরটা তিনি এমনভাবে নিজের করে নিলেন, পিএসজিতে নেইমারকে সরিয়ে সেরা খেলোয়াড় হবার উপক্রম হয়েছে তার। স্বপ্নের মতো একটি বছর কেটেছে তার। ২০১৭ সালে নির্বাচিত হয়েছিলেন সে বছরের সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়। এ বছর ফিফার সেরা একাদশেও জায়গা করে নিয়েছেন তিনি, সাথে গ্রিজমানকে পেছনে ফেলে নির্বাচিত হয়েছেন ২০১৮ এর সেরা ফরাসি খেলোয়াড়। বিশ্বকাপে ৬ ম্যাচে ৪ গোল করে বিশ্বকাপ জেতার পেছনে বড় অবদান রেখেছেন এমবাপে। বিশ্বকাপের সেরা তরুণ খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হয়েছেন, সাথে পিএসজির হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ ছাড়া প্রায় সকল শিরোপা জিতে ফেলেছেন মাত্র ২০ বছর বয়সে।
পিএসজির আক্রমণত্রয়ীর অন্যতম খেলোয়াড় তিনি। কাভানি ও নেইমারের সাথে পাল্লা দিয়ে গত মৌসুমের মতো এ বছরে চলতি মৌসুমেও একই গোলধারা বজায় রেখেছেন এ ফরাসি সুপারস্টার। লিগ ওয়ানে ১২ ম্যাচেই করে ফেলেছেন ১৩ গোল। ২০১৮-১৯ মৌসুমে প্রতি ৭১ মিনিটে পিএসজির হয়ে গোল করার রেকর্ড আছে তার। একই সাথে পাসিং অ্যাকুরেসি, ড্রিবল করার সফলতার হারও খুবই উচ্চমানের। সাফল্যময় একটি বছর পার করার পর এমবাপে নিজের ক্যারিয়ারকে কোন স্তরে নিয়ে যেতে পারেন, সেটাই এখন দেখবার বিষয়।
১১. ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো (জুভেন্টাস/পর্তুগাল)
নিজের সেরা ফর্ম থাকতে থাকতে নতুন ঠিকানা খুঁজে নিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে ক্যারিয়ারের প্রায় সকল কিছুই জিতে ফেলেছেন তিনি। যে মৌসুম শেষে জুভেন্টাস পাড়ি জমালেন, সে মৌসুমেও জিতেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগ। জুভেন্টাসের হয়ে নাম লিখিয়েছেন নতুন চ্যালেঞ্জের খোঁজে। সেই চ্যালেঞ্জেও বাজিমাত করে ইতালিও মাতিয়ে তুলছেন এই পর্তুগীজ সুপারস্টার।
২০১৮ বছরটি শুরু করেছিলেন বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে টানা তৃতীয় চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার যুদ্ধে তিনি করেছেন ১৫ গোল। যে জুভেন্টাসের হয়ে বর্তমানে মাঠ মাতাচ্ছেন, সেই তুরিনো বুড়ি’দের একাই নাজেহাল করেছিলেন গত মৌসুমে। জুভেন্টাসে পাড়ি দেবার পর নিন্দুকেরা তার নামে সমালোচনা করেছিলো, তিনি নাকি বুড়িয়ে গেছেন। বেশ কয়েক মৌসুম পর ব্যক্তিগত কোনো অর্জন ছাড়া বছর শেষ করলেও রোনালদো তার দলকে এখনও সেরাটা দেবার জন্য সর্বদা তৈরি। জুভেন্টাসের হয়ে নতুন পরিবেশে ১৫ ম্যাচে ১২ গোল ও ৮ অ্যাসিস্টই তার প্রমাণ।
এছাড়াও আন্তোনিও গ্রিজমান, মোহাম্মদ সালাহ, হ্যারি কেইন, জর্জো কিয়েলিনি, কেভিন ডি ব্রুইন, জর্ডি আলবা, লুইস সুয়ারেজ, হুগো লরিস ও থিবো কোর্তোয়ার মতো খেলোয়াড়ের নাম বিশেষভাগে প্রণিধানযোগ্য।