ফিফা বর্ষসেরা পুরস্কারের ইতিহাস

মানুষ সবসময়েই তার কাজের স্বীকৃতি চায়। পুরস্কার হচ্ছে সেই স্বীকৃতির একটি অংশ। বর্ষসেরা পুরস্কার হলো নির্দিষ্ট এক বছরে কোনো একটি বিভাগের সেরা পারফর্মার নির্বাচন করা। অন্যান্য সেক্টরের মতো ফুটবলেও বর্ষসেরা পুরস্কার দেওয়া হয়। আর অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতো এখানেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকেই এই পুরস্কার দেওয়া হয়। তবে ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা যেহেতু ফিফা, তাই ফিফার দেওয়া পুরস্কারটি একটু বাড়তি কদর রাখে।

ফিফার প্রথম পুরস্কার পাওয়া ও একমাত্র জার্মান খেলোয়াড়; source: Finance Magnates

অবাক করা বিষয় হচ্ছে, ফুটবলের ইতিহাস অনেকদিনের হলেও ‘ফিফা বর্ষসেরা পুরস্কার’ এর প্রচলন হয় ১৯৯১ সালে। সেটাও শুধু মাত্র পুরুষদের জন্য। নারীদের জন্য এই পুরস্কারের প্রচলন হয় ২০০১ সাল থেকে।

২০০৯ সাল পর্যন্ত পুরস্কারটি ‘ফিফা বর্ষসেরা’ নামেই পরিচিত ছিল। তবে ২০১০ সাল থেকে এই কমিটি আরেকটা স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ‘ব্যালন ডি অর’ এর সাথে যুক্ত হয়ে ‘ফিফা ব্যালন ডি অর’ নামে পুরস্কার দেওয়া শুরু করে। ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর এই নামেই পুরস্কারটি দেওয়া হয়। ২০১৬ সাল থেকে আবার দুই প্রতিষ্ঠান আলাদা হয়ে যায়। ফিফা পুরস্কারের নাম পরিবর্তন করে ‘ফিফা বেস্ট’ নামে একে চালু করে।

মার্তা, মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বার পেয়েছেন এই পুরস্কার; source: Stuart Franklin – FIFA/FIFA via Getty Images

বর্তমানে ফিফা ৭টি ক্যাটাগরিতে বর্ষসেরা পুরস্কার দেয়। এগুলো হলো-

  • Fifa Best Men’s player
  • Fifa Best Women’s player
  • Fifa Best Men’s Coach
  • Fifa Best Women’s Coach
  • Fifa Best Goalkeeper
  • Fifa Puskas Award
  • Fifa Fan’s Award

তবে এখনো পর্যন্ত পুরো বিশ্বের দর্শকদের কাছে মূল আকর্ষণ আসলে সেরা পুরুষ খেলোয়াড়ের পুরস্কারটিই।

ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, নতুন ট্রফি পাওয়া প্রথম খেলোয়াড়; source: goal.com

বাছাই প্রক্রিয়ার নিয়মাবলী ও বিবর্তন

শুরুর দিকে ফিফা বর্ষসেরা পুরস্কারের জন্য সকল জাতীয় দলের কোচদের ভোট গ্রহণ করা হতো। এতে প্রত্যেকে তিনটি করে ভোট দিতে পারতেন। প্রথম পছন্দের জন্য ৫ পয়েন্ট, দ্বিতীয় পছন্দের জন্য ২ আর ৩য় পছন্দের জন্য ১ পয়েন্ট ধরে খেলোয়াড়দের মোট পয়েন্ট হিসেব করা হতো।

Claudio Ranieri, প্রথম কোচ হিসেবে জিতেছেন এই পুরস্কার; source: sports.yahoo

২০০৩ সাল পর্যন্ত এই নিয়ম চালু ছিল। ২০০৪ সাল থেকে নিয়মে পরিবর্তন আনা হয়। এই বছর থেকে জাতীয় দলের কোচদের সাথে সাথে অধিনায়কেরাও ভোট দেওয়ার সুযোগ পান। এতেও প্রত্যেকে তিনটি করে ভোট দিতে পারতেন। প্রথম পছন্দের জন্য ৫ পয়েন্ট, দ্বিতীয় পছন্দের জন্য ২ আর ৩য় পছন্দের জন্য ১ পয়েন্ট ধরে খেলোয়াড়দের মোট পয়েন্ট হিসেব করা হতো

একমাত্র ডিফেন্ডার হিসেবে পাওয়া খেলোয়াড় ক্যানাভারো; source: sport.gentside.com

২০০৯ সাল থেকে যখন ‘ফিফা ব্যালন ডি অর’ নামে পরিচিত হয় পুরস্কারটি, তখন থেকে কোচ আর অধিনায়কদের সাথে মিডিয়ার বিভিন্ন সাংবাদিকদের ভোটও হিসেবে আনা হয়।

২০১৬ সালে আবার ফিফা আর ব্যালন ডি অর আলাদা হয়ে যায়। সেই বছর থেকে জাতীয় দলের কোচ, অধিনায়ক, সাংবাদিকদের ভোটের সাথে সাথে সাধারণ মানুষদের ভোটও গ্রহণ করা হয়। সাধারণ মানুষদের এই ভোটিং অনলাইনে গ্রহণ করা হয়। এই চার রকমের ভোটের প্রতিটিকে ২৫% করে মোট হিসেব করা হয়

সবচেয়ে কমবয়সী খেলোয়াড় হিসেবে জয়ী রোনালদো; source: Daily Mail

বর্তমানে ভোটিংয়ের ক্ষেত্রে সাধারণ কিছু নিয়ম বলা হলো-

  • প্রতি বছরই পুরস্কার দেওয়ার আগে একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। যেমন, ২০১৬ বর্ষসেরা নির্বাচনের জন্য ২০শে নভেম্বর ২০১৫ থেকে ২২শে নভেম্বর ২০১৬ এর মাঝে পারফর্মেন্সকে বিচার করা হয়েছিল
  • পুরস্কারের ক্ষেত্রে মাঠের পারফর্মেন্সকে মূল ধরা হলেও, এর সাথে মাঠ এবং মাঠের বাইরে খেলোয়াড়ের আচরণকেও আমলে আনা হয়।
  • জাতীয় দলের অধিনায়কেরা তাদের কোচদেরকে ভোট দিতে পারবেন।
  • জাতীয় দলের কোচ এবং অধিনায়ক দুজনেই তাদের নিজ দেশের যেকোনো খেলোয়াড়কেও ভোট দিতে পারবেন।
  • কোনো অধিনায়ক কিংবা কোচই নিজেকে ভোট দিতে পারবেন না।
  • জুরি মেম্বারদের ভোট থেকে ১ম স্থানের জন্য ৫ পয়েন্ট, ২য় স্থানের জন্য ৩ পয়েন্ট এবং ৩য় স্থানের জন্য ১ পয়েন্ট হিসেব করে মোট পয়েন্ট গণনা করা হয়।
  • যদি হিসেব শেষে দুজন খেলোয়াড়ের পয়েন্ট সমান থাকে, সেক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়, কোন খেলোয়াড় ১ম স্থানের জন্য ভোট বেশি পেয়েছেন। যদি এই ক্ষেত্রেও সমান থাকে তাহলে দেখা হবে ২য় স্থানের জন্য এই দুজনের মাঝে কে বেশি ভোট পেয়েছেন। যদি এটিও সমান থাকে, তাহলে যুগ্মভাবে দুজনকেই পুরস্কার দেওয়া হবে

বিগত বছরগুলোর পুরুষদের মাঝে পুরস্কার প্রাপ্তদের তালিকা



ফিফার পুরস্কারের কিছু খুঁটিনাটি

মেসি, এখন পর্যন্ত একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন টানা চারবার; source: gqindia.com

  • পুরুষদের মাঝে সবচেয়ে কম বয়সী খেলোয়াড় হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন ব্রাজিলের রোনালদো। ১৯৯৬ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সেই তিনি পুরস্কারটি পান।
  • পুরুষদের মাঝে সবচেয়ে বেশি বয়সী খেলোয়াড় হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন ইতালীর ফ্যাবিও ক্যানাভারো। ২০০৬ সালে পুরস্কার পাওয়ার সময় তার বয়স ছিল ৩৩।
  • একমাত্র ডিফেন্ডার হিসেবে এই পুরস্কার পেয়েছেন ফ্যাবিও ক্যানাভারো।
  • এই পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বার প্রবর্তিত এই পুরস্কার পেয়েছেন লিওনেল মেসি। তিনি ৫ বার এই পুরস্কার পেয়েছেন।
  • একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে টানা চারবার (২০০৯-২০১২) এই পুরস্কার পেয়েছেন মেসি। আর কোন খেলোয়াড় টানা তিনবারও জিততে পারেননি।
  • ব্রাজিলের সবচেয়ে বেশি (৫ জন) খেলোয়াড় এই পুরস্কার জিতেছেন। ৫ জন মিলে জিতেছেন ৮ বার।
  • ক্লাবের মধ্যে বার্সেলোনার খেলোয়াড়েরা সবচেয়ে বেশি বার পুরস্কারটা জিতেছেন। তাদের ৫ জন খেলোয়াড় মোট ১০ বার এই পুরস্কার জিতেছেন। বার্সার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে রিয়াল মাদ্রিদ। তাদের ৪ জন খেলোয়াড় জিততে পেরেছেন ৭ বার।
  • সেরা কোচের পুরস্কার দেওয়া শুরু হয় ২০১৬ সাল থেকে। প্রথমবার এই পুরস্কার পেয়েছেন লেইষ্টার সিটিকে রূপকথার মতো শিরোপা পাইয়ে দেওয়া ক্লদিও রানিয়েরি।
  • নারীদের মধ্যে ব্রাজিলিয়ান মার্তা সর্বোচ্চ পাঁচবার এই পুরস্কার পেয়েছেন। এছাড়া একমাত্র নারী খেলোয়াড় হিসেবে জার্মান খেলোয়াড় বির্জিত প্রিঞ্জ টানা তিনবার এই পুরস্কার পেয়েছেন।
  • নারীদের মাঝে মার্তা মাত্র ২০ বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে এই পুরস্কার পান। সবচেয়ে বেশি বয়সী খেলোয়াড় হিসেবে ৩৫ বছর বয়সে ২০১৩ সালে এই পুরস্কার পান নাদিন অ্যাঙ্গারার।
  • ২০১৭ সালে প্রথম বারের মতো ফিফা থেকে বর্ষসেরা গোলকিপারের পুরস্কারের প্রচলন করা হয়।

কে হচ্ছেন ফিফা বেস্ট ২০১৭

১৭ই আগস্ট ২০১৭ সালে ২৪ জন খেলোয়াড়ের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয় পরবর্তী ফিফার পুরস্কারের জন্য। ভোটারদের ভোট দেওয়ার সময়সীমা ছিল ২১ আগষ্ট ২০১৭ থেকে ৭ আগষ্ট ২০১৭। পারফর্মেন্স হিসেব করা হবে ২০ নভেম্বর ২০১৬ থেকে ২ জুলাই ২০১৭ পর্যন্ত।

এই দুজনের হাতেই উঠেছে গত ৯ বছরের পুরস্কার; source: theScore Philipp Schmidli/Getty Images)

আজ ২৩ অক্টোবর বর্তমান সেরাদের নাম ঘোষণা করা হবে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, গত ৯ বছর ধরে প্রতিযোগিতাটি সমসাময়িক দুই খেলোয়াড় লিওনেল মেসি আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর মাঝেই চলমান রয়েছে। বাকি খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণ কেবলমাত্র যেন শুধু আনুষ্ঠানিকতা। এই বছরেও মূল প্রতিযোগিতাটা মেসি আর রোনালদোর মাঝেই বিদ্যমান। তৃতীয় প্রতিযোগী হিসেবে রয়েছেন নেইমার।

দেখা যাক শেষ হাসিটা কে হাসেন।

ফিচার ইমেজ- Stars and Stripes FC

Related Articles

Exit mobile version