আচ্ছা, আপনি দাবা খেলতে ভালোবাসেন? আমার সঙ্গে কি এক দান খেলবেন?
রাজি থাকুন কিংবা না-ই থাকুন, আমি কিন্তু বিনা অনুমতিতেই আপনার সঙ্গে খেলতে বসে গিয়েছি। আপনার কষ্ট কমাবার জন্যে অনেকগুলো চালও চেলে রেখেছি। আপনি খেলছেন সাদা ঘুঁটি নিয়ে, আমি সর্বশেষ চালে e7 ঘরের কালো বড়েটিকে দু’ঘর এগিয়ে রেখেছি e5 ঘরে।
আপনার জন্য চ্যালেঞ্জ, মাত্র এক চালে আমাকে কিস্তিমাৎ করুন তো!
আপনি চ্যালেঞ্জ জিততে থাকুন, ততক্ষণে আমরা বরং একটি গল্প শুনি। যে চাল আপনাকে বানালো জয়ী, সে চালের আদ্যোপান্ত জানাটিও তো জরুরি।
***
দাবা খেলাটি সর্বপ্রথম কোন অঞ্চলে খেলা হয়েছিল, তা নিয়ে বেশ দ্বিমত আছে এখনো। মহাভারতে ‘চতুরঙ্গ’ বলে এক খেলার উল্লেখ পাওয়া যায়, যা কি না দাবার সঙ্গে অনেকটা মিলে যায় বলে কেউ এর কৃতিত্ব দিতে চান ভারতকে, আবার জিয়াংকি বলে এক খেলার নিদর্শন মেনে চীনকে এই দাবার জনক বলেও মেনে নেন কতকে।
সে যা-ই হোক, প্রাচীনকালের সেই দাবা খেলাগুলোতেও সৈন্যগুলো ঠিক আজকের মতোই কেবল সামনের দিকে এগুতে পারতো, তবে প্রতি চালে তাদের যাত্রা মাত্র এক ঘরেই সীমাবদ্ধ ছিল। এক্ষেত্রে মুশকিলটা যা হতো, সাদা আর কালো দু’টি সৈন্য পরস্পরের মুখোমুখি হবার আগেই ব্যয় করতে হতো দুই চাল, ফলতঃ খেলার গতি হয়ে যেত ধীর। ভারতীয়রা কিংবা চৈনিকরা এই ধীরতায় অবশ্য কোনো ক্ষতি দেখছিল না। তবে ঘরোয়া খেলা হিসেবে এর জনপ্রিয়তা তো কেবল ভারতবর্ষেই আটকে ছিল না, বরং তা ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা এশিয়াতেই, এমনকি বাইজ্যান্টাইন আমলে পারস্য হয়ে পৌঁছে গিয়েছিল ইউরোপেও। এক হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপির কল্যাণে দশম শতকে ইউরোপে যে দাবাজাতীয় একটি খেলার অস্তিত্ব ছিল, তা জানা যায়।
সেই ইউরোপীয়রাই খেলার গতি খানিকটা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১২৮৩ সনে (অনেককাল আগের কথা, ঝুঁকি এড়াতে ত্রয়োদশ শতাব্দী উল্লেখ করাই শ্রেয়) এসে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যেকোনো সৈন্যের শুরুর চালে তাকে এক ঘরের বদলে দুই ঘর সামনে এগুনোর সুযোগ দেয়া হবে। তখন তো আর ‘ফিদে’ বলে দাবার কোনো নীতিনির্ধারণী প্রতিষ্ঠান ছিল না, এই চালের বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেতে তাই সময় লেগেছিল আরও প্রায় তিনশ’ বছর।
‘বড়ে’র এই দুই ঘর চাল মোটামুটিরকম স্বীকৃতি পাবার পর দানা বেঁধেছিল আরেক বিপত্তি। দেখা গেল, প্রথম চালে দুই ঘর এগিয়ে যাবার পরে অনেক ‘বড়ে’ই রূপ নিচ্ছে ‘পাসড পন’-এ।
এই সেরেছে, এই ‘পাসড পন’ আবার কী জিনিস?
প্রশ্ন করতে হবে না পাঠক, উত্তরটা তৈরিই আছে। পাসড পন (Passed Pawn) হচ্ছে সেইসব ‘বড়ে’, যার কিংবা যাদের সামনে অথবা আশেপাশে এমন কোনো ঘুঁটি নেই, যা তাকে প্রমোশন (আমরা জানি, কোনো বড়ে তার প্রাথমিক অবস্থান থেকে সোজাসুজি বোর্ডের অপর প্রান্তে পৌঁছালে তাকে কুইন, গজ, ঘোড়া কিংবা নৌকায় রূপ দেয়া যায়) পাওয়া থেকে আটকাতে পারে।
ওপরের ছবিটি লক্ষ্য করুন। c5 ঘরের সাদা বড়েটির সামনে কিংবা কোণাকুণি কোনো কালো বড়ে নেই, বোর্ডে নেই কোনো বড় ঘুঁটিও, তাই সাদা বড়ের প্রমোশন পাওয়াটা মোটামুটিরকম নিশ্চিতই। এরকম বাধাহীন বড়েগুলোকেই আমরা বলছি ‘পাসড পন’। দাবাতে ‘পাসড পন’-এর গুরুত্ব বোঝাতে খুব সম্ভবত অ্যারন নিজমোউইচের এই দুটো লাইনই যথেষ্ট হবে-
A passed pawn is a criminal which should be kept under lock and key. Mild measures, such as police surveillance, are not sufficient.
ষোড়শ শতকে বড়ের দুই ঘর চাল বৈশ্বিক অনুমোদন পাবার পর এরকম পাসড পনের সংখ্যা বেড়ে যেতে থাকে হু হু করে। সমস্যা তো আরও ছিল। দেখা গেল, খেলার শেষ পর্যায়ে বোর্ডে সাদা-কালো মিলিয়ে বড়ে রয়েছে চারটি, কিন্তু প্রত্যেকে মুখোমুখি থাকবার দরুন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘থ্রি-ফোল্ড রিপিটেশন’ নিয়ম মেনে ম্যাচ সমাপ্ত হচ্ছে নিষ্ফলা অবস্থায়। নিচের ছবি দু’টি লক্ষ্য করুন, বাঁয়ের ছবিতে d5 আর d6 বড়ে দুটো রয়েছে মুখোমুখি অবস্থায়, অন্য সাদা বড়েটি অবস্থান করছে c4 ঘরে। এমতাবস্থায় c7 চতুর্ক্ষেত্রে অবস্থানরত কালো বড়েটিকে যদি এগিয়ে দেয়া হয় c5 ঘরে, তবে অনেকবারেই ‘থ্রি-ফোল্ড রিপিটেশন’ ঘটিয়ে কোনো একজন খেলোয়াড় দাবি করতে পারেন ড্র-য়ের।
পরিস্থিতি যখন এমন রূপ নিচ্ছিল নিত্যই, তখন খেলোয়াড়েরাই অনুভব করেন নতুন নিয়মের প্রয়োজনীয়তার। আর এই নতুন বিকল্প হয়ে আবির্ভাব ঘটেছিল ‘অঁ পাসোঁ’ চালের। এবং পাঠক, আপনি ঠিক এ চাল অনুসরণ করেই আমাকে হারিয়ে দিয়েছেন শুরুর ধাঁধাতে।
***
‘অঁ পাসোঁ’ (en passant) চালটা ঠিক কী? স্বাভাবিক নিয়মে আমরা জানি, বড়ে দিয়ে প্রতিপক্ষের ঘুঁটি খেয়ে নেয়া যাবে, যদি সেই ঘুঁটিটি কোণাকুণি মাত্র এক ঘর সামনে অবস্থান করে। কিন্তু এন পাসান্টের নিয়মটা খাটবে, প্রতিপক্ষের বড়ে যদি ঠিক পাশের ঘরে অবস্থান করে, তবুও।
‘অঁ পাসোঁ’, জাতে ফরাসি শব্দটির ইংরেজি করা চলে ‘in passing’। ফিদের সংজ্ঞামতে,
A pawn attacking a square crossed by an opponent’s pawn which has advanced two squares in one move from its original square may capture this opponent’s pawn as though the latter had been moved only one square. This capture is only legal on the move following this advance and is called an ‘En Passant’ capture.
অর্থাৎ, এটি হলো দাবার বড়ে অধিগ্রহণের বিশেষ একটি প্রক্রিয়া, যা কার্যকর থাকবে কেবলমাত্র তার পরবর্তী চালে। যদি প্রতিপক্ষ তার কোনো বড়েকে অর্থাৎ শুরুর ঘর থেকে দুই ঘর এগিয়ে দেন, এবং ঠিক পাশের ঘরেই অর্থাৎ ফিফথ র্যাংকে আপনার একটি বড়ে থাকে, তবে আপনি চাইলেই মাত্রই দুই ঘর চাল দেয়া প্রতিপক্ষের বড়েটিকে অধিগ্রহণ করে নিতে পারবেন। যেমন, শুরুর ঘর থেকে কেবল এক ঘরই চাল দেয়া হয়েছিল, এবং স্বাভাবিক নিয়মেই কোণাকুণি ঘরে বড়েটিকে খেয়ে নিয়েছেন আপনি। আবারও লক্ষ্য করুন, প্রতিপক্ষ বড়েকে দুই চাল দেয়ার ঠিক পরের চালেই কেবল এ সুবিধা পাবেন আপনি। তাত্ত্বিক এ আলোচনায় পুরোপুরি পরিষ্কার না হলে নিচের ছবিটি দেখুন, তাতে নিশ্চিত করেই জট ছাড়িয়ে যাবে।
ওপরের সর্ববায়ের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, দু’টি সাদা বড়ে রয়েছে a2 আর b2 ঘরে এবং কালো বড়ে দু’টি রয়েছে a5 আর b4 ঘরে। প্রতিপক্ষ a2 ঘরের বড়েটিকে এখন দুই ঘর এগিয়ে দিয়ে স্থান দিলেন a4 ঘরে, যা দেখা যাচ্ছে ওপরের মাঝের ছবিতে। কিন্তু পূর্ব থেকেই আপনার একটি বড়ে ছিল পাশের b4 ঘরে। এমতাবস্থায়, আপনি যখন পরবর্তী চালটি চালবেন, তখন চাইলেই প্রতিপক্ষের a4 ঘরের বড়েটিকে অধিগ্রহণ করে নিজের বড়েকে স্থান দিতে পারবেন a3 ঘরে। যেন প্রতিপক্ষ a2 ঘরের বড়েটিকে মাত্র এক ঘরই এগিয়েছিলেন, এবং আপনার b4 ঘরের পনটি স্বাভাবিকভাবেই কোণাকুণি a3 ঘরে থাকা বড়েটিকে খেয়ে নিয়েছিল।
ঠিক কবে ‘অঁ পাসোঁ’ চালু হয়েছিল, তা নিয়ে নানাজনের রয়েছে নানা মত। তবে ১৫৬১ সালে সর্বপ্রথম স্প্যানিশ মাস্টার রুই লোপেজের লেখা বইতে উল্লেখ পাওয়া যায় এই নিয়মের। তখনকার দিনে দাবার নীতিমালা নির্ধারণের জন্যে কোনো স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান ছিল না বলে অঞ্চলভেদে তা খেলা হতো ভিন্ন ভিন্ন নিয়মে। রবিনসনের লেখা বই থেকে যেমন জানা যায়, মালয় অঞ্চলের দাবায় অঁ পাসোঁ নিয়মের প্রয়োগ করা যেত কেবল বড়ের সামনের ঘরে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকলে। যেমন ধরা যাক, সাদা বড়ে ছিল g2 আর h3 ঘরে এবং কালো বড়ে অবস্থান করছিল h4 চতুর্ক্ষেত্রে। যদি প্রতিপক্ষ এখন g2 ঘরের বড়েটিকে এগিয়ে দিতো g4 ঘরে, তবে h4 ঘরের কালো বড়েটি অঁ পাসোঁ নিয়মের প্রয়োগ করে এগিয়ে যেতে পারতো g3 ঘরে। কিন্তু যদি h3 ঘরে সাদা বড়ে না রইতো, তবে অ পাসোঁর বৈধতা থাকতো না মালয় দাবাতে।
এরই মাঝে অঁ পাসোঁ এবং স্টেলমেট নিয়ে দেখা দিয়েছিল নতুন আরেক গোল। চার্লস টমিলসোন তুলে ধরা নিচের সমস্যাতে দেখা যাচ্ছে, কালো রাজা অবস্থান করছে h6 ঘরে, এবং সাদা দু’টি বড়ে অবস্থান করছে যথাক্রমে g2 এবং h3 ঘরে। এ অবস্থায় যদি g2 ঘরের সাদা ঘুঁটিকে দুই ঘর এগিয়ে দেয়া হয় g4 ঘরে, তবে দেখা যাচ্ছে অঁ পাসোঁ প্রয়োগ না করলে হয়ে কালো ঘুঁটির জন্যে বাকি নেই আর কোনো চাল, ফলতঃ হয়ে যাচ্ছে স্টেলমেট। এমতাবস্থায় প্রয়োজন পড়ে অঁ পাসোঁ আইনে বদল আনবার। কেননা, এর আগ পর্যন্ত অঁ পাসোঁর প্রয়োগ ছিল খেলোয়াড়ের ঐচ্ছিক কর্ম। তাকে অঁ পাসোঁ করতেই হবে, এমন দিব্যি কেউ দেয়নি। এ সমস্যা সামনে আসবার পর সিদ্ধান্ত হয়, কোনো দাবাড়ুর সামনে যদি অঁ পাসোঁ ছাড়া স্টেলমেট আটকানোর আর কোনো উপায় না থাকে, তবে তাকে অঁ পাসোঁর প্রয়োগ করতেই হবে।
১৮৮০ সালে ইতালিয়ানরা অঁ পাসোঁর বৈধতা দেবার পর সব দেশের দাবাতেই এখন ব্যবহৃত হচ্ছে এই নিয়ম। ১৯২৪ সালে ফিদে প্রতিষ্ঠার পরে তাদের লেখা নিয়মাবলির ৩.৭ আইনের ঘ অনুচ্ছেদেও জায়গা পেয়েছে এই ‘অঁ পাসোঁ ক্যাপচার’। অঁ পাসোঁর সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ হয়ে রয়েছে ১৯২৮ পিৎস্কার ক্রিসমাস টুর্নামেন্টে গুনার গুন্ডাররসন বনাম এ এইচ ফাউলের ম্যাচটি। অঁ পাসোঁ চালেই ফাউল কিস্তিমাৎ হয়ে গিয়েছিলেন বলে ‘ফাউল প্লে’ নামেই বিখ্যাত হয়ে আছে ম্যাচটি।
লেখার শুরুতে উল্লিখিত ধাঁধার সমাধানটিও আপনি করে ফেলেছিলেন এই ‘অঁ পাসোঁ’ নিয়মের প্রয়োগেই। কমেন্ট বক্সে জানিয়ে যান দেখি, চ্যালেঞ্জটি আপনি জিততে পেরেছিলেন নাকি!