মাত্রই বছর চারেক আগের কথা। রাশিয়া বিশ্বকাপে গ্রুপপর্ব থেকেই একে একে বাদ পড়েছিল আফ্রিকা মহাদেশ থেকে সুযোগ পাওয়া পাঁচটা দেশই। আর এখন পর্যন্ত নকআউট পর্বে ইউরোপীয় দলগুলোর সঙ্গে খেলা ১০টি ম্যাচের মধ্যে ৯টিতেই যখন হেরেছে আফ্রিকান দেশগুলো, টুর্নামেন্ট শুরুর আগে স্যামুয়েল ইতোর ভবিষ্যদ্বাণী শুনে মুখ টিপে হাসার মানুষের বিশেষ অভাব ছিল না বৈকি। কী বলেছিলেন ইতো? বলেছিলেন, বিশ্বকাপ ফাইনালে মরক্কোকে ফাইনালে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতবে ক্যামেরুন।
ক্যামেরুন বাদ পড়ে গেছে গ্রুপপর্ব থেকেই, তবে শেষ ১৬’র টিকেট কেটেছে মরক্কো। তারা মুখোমুখি হয়েছিল ‘পরাক্রমশালী’ স্পেনের। সেই স্পেন, যারা ‘ফ্লুইড ফুটবল’ খেলে প্রথম ম্যাচে মন কেড়েছে, বুঝিয়েছে কেন তারা ফেভারিট। আবার এরপরই তারা ফিরে গেছে তাদের চিরাচরিত সমস্যায় – গোলস্কোরিং। গ্রুপপর্বে শেষ অবধি তো এমন পরিস্থিতিই দাঁড়িয়েছিল যে জার্মানির সাথে সাথে বাদ পড়তে পারত তারাও! স্পেন-জার্মানি-জাপান-কোস্টারিকায় গড়া গ্রুপটায় যদি প্রথম দুই দল হতো জাপান-কোস্টারিকা, তবে সে এক কাণ্ড হয়ে যেত বৈকি!
শেষ ১৬’তে মরক্কোর বিপক্ষে ম্যাচটার শুরুতে তবুও স্পেনই ফেভারিট। গোটা বিশ্বকাপ ইতিহাসেই মরক্কো এই নিয়ে মাত্র দ্বিতীয়বার নকআউট পর্বে খেলছে। শেষবার এই অবস্থানে এসেছিল সেই ১৯৮৬ সালে, পশ্চিম জার্মানির কাছে হেরে তারা বাদ পড়েছিল এই পর্ব থেকেই।
তবে ‘অ্যাটলাস লায়ন’রা গত কয়েক বছরে রীতিমতো অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে। শেষবার যখন স্পেনের মুখোমুখি হয়েছিল, সেবার পরপর দু’বার এগিয়েও গিয়েছিল মরক্কো। অবশ্য শেষ অবধি ইয়াগো আসপাসের শেষ মিনিটে গোলের ফলে ২-২ ড্র করতে বাধ্য হয় তারা।
তবুও মোটামুটি সবার হিসেবেই এগিয়ে ছিল স্পেন। একঝাঁক তারকা ফুটবলার দলে; পেদ্রি-গাভির মতো উঠতি তারকারা রয়েছেন, তোরেস-মোরাতা-ফাতি’র মতো স্ট্রাইকাররাও কম নামদার নন। সেই তুলনায় ‘অ্যাটলাস লায়ন’দের নামডাক খুব একটা নেই।
তাতে অবশ্য মাঠে থোড়াই কেয়ার করল তারা। গোটা কাতার বিশ্বকাপে মরক্কোর জালে বল জড়িয়েছে স্রেফ একবার, সেটাও আবার আত্মঘাতী। সেই ধারা বজায় রইল শেষ ১৬’র এই ম্যাচেও। পুরো ম্যাচেই যথারীতি একতরফা বল দখল রেখেছে স্পেন (৭৭%), কিন্তু কাজের কাজটা একবারও করতে পারেনি তারা। উপরন্তু গোটা ম্যাচে স্পেন অন-টার্গেট শট নিতে পেরেছে মাত্র একটি, সেখানে মরক্কো দুইবার করেছে সেটা। একবার তো রীতিমতো বিপদেই পড়ে গিয়েছিল স্পেন, গোলরক্ষক উনাই সিমোনের দারুণ এক সেইভে শেষ অবধি রক্ষা হয়েছিল সেবার। কিন্তু এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে যে অপেক্ষা করছিল অন্য এক নাটক!
গোটা আসরেই মরক্কোর রক্ষণ মোটামুটি সবার সেরা যদি না-ও বলা যায়, অন্যতম সেরা বলতে বিন্দুমাত্র বাধে না। এতে কোচ কিংবা রক্ষণভাগের কৃতিত্ব যতটা নজরে আসে, গোলরক্ষক বোনো খুব একটা নজরে আসেন না। তবে তিনি হয়তো নিজের সেরাটা তুলে রেখেছিলেন স্পেনের বিপক্ষে এই ম্যাচের জন্যই।
সাবিরি লক্ষ্যভেদ করে প্রথমবারের মতো এগিয়ে দিলেন মরক্কোকে। হালে পানি পেল এবার ‘অ্যাটলাস লায়নস’। তবে কি হয়েই যাবে এবার?
টাইব্রেকারে নামার আগে স্প্যানিশ গোলরক্ষক উনাই সিমোনের মাথায় হাত রেখে কিছু একটা বলছিলেন বোনো, চোখেমুখে আত্মবিশ্বাসের দীপ্তিটাও ছিল স্পষ্ট। টাইব্রেকার শুরু হতেই আত্মবিশ্বাসের প্রতিফলনও দেখা গেল বেশ। ঠিক দিকেই ঝাঁপ দিলেন, তবে সারাবিয়ার পেনাল্টি আটকে গেল গোলবারে। সেই সারাবিয়া, অতিরিক্ত সময়ের খেলা শেষের ঠিক আগ মুহূর্তে একটুর জন্য যিনি গোলের দেখা পাননি, সেই গোলবার ছুঁয়েই বেরিয়ে গিয়েছিল শটটা। রাজ্যের অন্ধকার নেমে এলো তার মুখে। স্প্যানিশ গ্যালারিতে হঠাৎ যেন নেমে এলো পিনপতন নীরবতা; সমর্থকরাও যেন বুঝতে পারছিলেন, কী ঘটতে চলেছে।
মরক্কোর হয়ে দ্বিতীয় শটটাতেও লক্ষ্যভেদ করলেন হাকিম জিয়েশ। সেই জিয়েশ, যিনি গত আফ্রিকান নেশন্স কাপটাও খেলেননি। গত আগস্টে কোচ ওয়ালিদ রেগ্রাগুই যখন ফিরলেন, প্রথমেই ফেরালেন হাকিমকে; আর বললেন, তার পরিকল্পনার ‘সেন্টারপিস’ হবেন হাকিমই। কী দারুণভাবেই না প্রতিদান দিচ্ছেন তিনি!
স্পেনের হয়ে দ্বিতীয় পেনাল্টি নিতে এগিয়ে এলেন কার্লোস সোলের, যিনি ম্যাচের ৬৩ মিনিটের মাথায় নেমেছিলেন গাভির পরিবর্ত হিসেবে। হা হতোস্মি, এবারও বলটা আটকে গেল এবার আটকে দিলেন বোনো নিজেই।
প্রমাদ গুনলেন লুইস এনরিকে। মুখটা ঢেকে ফেললেন হতাশায়। বুঝতে পারছিলেন, কঠিন হয়ে গেল এবার।
দুইটি করে পেনাল্টি নেওয়ার পর স্পেন যখন ০-২ ব্যবধানে পিছিয়ে, তৃতীয় শট নিতে এগিয়ে এলেন মরক্কোর বেনোন। খেলা শেষের মাত্র মিনিটখানেক আগেই নেমেছেন তিনি। তবে এবারের শটটা ডানদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আটকে দিলেন উনাই সিমোন। কিছুটা কি আশার আলো দেখতে পেল স্পেন?
বলা মুশকিল। তবে এবার এগিয়ে এলেন বর্ষীয়ান সার্জিও বুসকেটস, মাথায় তখন রাজ্যের চাপ। সেই বোঝাটাই বোধহয় মাথায় চেপে বসল জগদ্দল পাথরের মতো, তিনিও মিস করে বসলেন পেনাল্টি। কিংবা বলা ভালো, বোনো নামক দেয়ালে আটকে গেল তার শটটাও।
এনরিকের মুখের দিকে আর তাকানো যাচ্ছে না।
কফিনে শেষ পেরেকটা পুতে দিলেন আশরাফ হাকিমি। চতুর্থ শটটাকেও জালে জড়িয়ে মেতে উঠলেন উল্লাসে। স্বাভাবিক সেই উল্লাস শুধু শেষ আটে ওঠার নয়, আফ্রিকান ঝাণ্ডা আরো একটু উঁচুতে তুলে ধরার উল্লাস, নিজেদেরকে প্রমাণ করার উল্লাস, আর একটা রেকর্ড ছোঁয়ার উল্লাস। কী সেই রেকর্ড? এই ম্যাচ জয়ের মাধ্যমেই বিশ্বকাপে কোনো আফ্রিকান দলের টানা পাঁচ ম্যাচে অপরাজিত থাকার কৃতিত্বে ভাগ বসাল মরক্কো।
কোথায় পিছিয়ে পড়েছিল স্পেন? স্কিল কিংবা তারকাবহুল বহরের দিক থেকে তো একদমই নয়। তবে কি খেলার ধরনে? ৭৭ শতাংশ বল দখল রেখেও ম্যাচে স্রেফ একটিমাত্র অন-টার্গেট শট রাখতে পারায়? নাকি রক্ষণ দেয়াল ভাঙতে উপর্যুপরি ব্যর্থতায়?
নাহ, মরক্কো ম্যাচটা জিতে গিয়েছিল তাদের আত্মবিশ্বাসে, তাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞায়। কাতারের এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে তাই ‘আরব্য রজনী’ গড়তে তাদের বেগ পেতে হয়নি বিন্দুমাত্র। প্রচণ্ড চাপেও যারা ভেঙে পড়ে না, নকআউট পর্বের এই ধাপে যে তারাই শ্রেয়তর!