বিশ্বের সবচেয়ে জমজমাট ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল)। এনআরসি-ক্যাব নিয়ে উত্তাল কলকাতায় গত ১৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে টুর্নামেন্টের ১৩তম আসরের নিলাম। কাড়ি-কাড়ি ডলারে বিকিকিনি হয়েছে বিশ্বের নামীদামি ক্রিকেটারদের। কিন্তু সীমান্তের ওপারে অনুষ্ঠিত নিলাম রাজ্যের হতাশা উপহার দিয়েছে বাংলাদেশকে। ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে অনেক আশা-ভরসার মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিলামে দল পাননি বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটারই।
সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তোলা হয়েছিল মুশফিকুর রহিমকে নিয়ে। এমনকি প্রথমে নাম অন্তর্ভুক্ত না করা মুশফিককে নাকি কয়েকটি ফ্র্যাঞ্চাইজের আগ্রহেই নিলামের তালিকায় রাখা হয়েছিল। নিলামের আগের দিনও ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের মূল্যায়নে স্পষ্ট ছিল, এবার দল পেতে যাচ্ছেন মুশফিক। অভিজ্ঞ এই উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যানের মতো মুস্তাফিজুর রহমানও অবিক্রিত থেকে গেছেন আইপিএলের নিলামে।
দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশী কোনো ক্রিকেটার ছাড়া মাঠে গড়াতে যাচ্ছে আইপিএল। এর আগে ২০১০ সালে আইপিএলে দল পাননি কোনো বাংলাদেশী ক্রিকেটার। ৯ বছর পর আবারও বাংলাদেশী কোনো ক্রিকেটারকে দলে নেয়নি আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো।
এবারের আসরের নিলামের জন্য ৩৩২ জন খেলোয়াড়ের তালিকা চূড়ান্ত করেছিল আয়োজক কর্তৃপক্ষ। সেখানে মুশফিকসহ বাংলাদেশের পাঁচ ক্রিকেটারের নাম ছিল। বাংলাদেশের বাকি চার ক্রিকেটার ছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মুস্তাফিজুর রহমান, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন ও সাব্বির রহমান।
প্রাথমিক তালিকায় অবশ্য ছিল না মুশফিক ও সাব্বিরের নাম। তবে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর আগ্রহের ভিত্তিতে তাদের রাখা হয়েছে। এমনকি অফ ফর্মে থাকা সাব্বিরের নামটা যুক্ত করা হয়েছিল তার এক এজেন্টের চাপাচাপিতে। মুশফিককে নিয়ে আগ্রহী কয়েক ফ্র্যাঞ্চাইজি এমন খবর বিসিবির বারান্দায় শোনা গিয়েছিল, ভারতীয় সংবাদ ম্যাধ্যমেও ফলাও করে প্রচার হয়েছিল। চূড়ান্ত তালিকায় জায়গা পাননি প্রাথমিক তালিকায় থাকা তামিম ইকবাল, মেহেদী হাসান মিরাজ, সৌম্য সরকার ও তাসকিন আহমেদ।
আইপিএলে বাংলাদেশের নিয়মিত মুখ সাকিব আল হাসান। ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব গোপন করে এখন নিষিদ্ধ তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে তিনিই একমাত্র বাংলাদেশী ক্রিকেটার, যিনি নিয়মিত আইপিএলের আসরে অংশ নেন। সাকিব লম্বা সময় কলকাতা নাইট রাইডার্সে খেলার পর সর্বশেষ খেলেছেন সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে। আইসিসির নিষেধাজ্ঞার কারণে তাকে এক বছরের জন্য ঘরোয়া, আন্তর্জাতিক কিংবা ফ্র্যাঞ্চাইজভিত্তিকসহ সব রকমের ক্রিকেট থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে।
বাংলাদেশিদের মধ্যে সর্বোচ্চ ভিত্তিমূল্য ছিল মুস্তাাফিজের। তার ভিত্তিমূল্য ধরা হয়েছিল ১ কোটি রুপি। অন্যদিকে, মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহর ভিত্তিমূল্য ছিল ৭৫ লাখ রুপি। সাইফউদ্দিন ও সাব্বিরের ভিত্তিমূল্য ধরা হয়েছিল ৫০ লাখ রুপি।
অবিক্রিত মুশফিক-মুস্তাফিজ ও আয়ারল্যান্ড সফর
নিলামের আগে জানা গিয়েছিল, আইপিএলের তিনটি ফ্র্যাঞ্চাইজি মুশফিককে দলে টানতে ইচ্ছুক। ভারতভিত্তিক ক্রিকেট ওয়েবসাইট ক্রিকট্র্যাকারের প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, আগ্রহী তিন ফ্র্যাঞ্চাইজি ছিল রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু, কলকাতা নাইট রাইডার্স ও দিল্লি ক্যাপিটালস। এর মধ্যে বেশি আগ্রহ ছিল ব্যাঙ্গালুরু এবং কলকাতার। আর দলগুলোর আগ্রহের বিশেষ কারণ ছিল মুশফিক মূলত উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান।
বিরাট কোহলি-ডি ভিলিয়ার্সদের ব্যাঙ্গালুরু বিদেশি ক্রিকেটারদের মধ্যে উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে মুশফিককে নেয়ার গুঞ্জন ছিল। কারণ দলে উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে ছিলেন শুধুমাত্র পার্থিব প্যাটেল। বয়সের ভারে ফিটনেসেও ঘাটতি রয়েছে প্যাটেলের। দলে নেই আর কোনো বিশেষজ্ঞ উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যানও। সে কারণেই মুশফিকের প্রতি নজর ছিল তাদের।
এদিকে কলকাতার আগ্রহের মূলে ছিল বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যান মুশফিকের প্রতি। এছাড়া দ্বিতীয় কোনো উইকেটকিপার ছিল না দলটিতে এবার। অপরদিকে, দিল্লির আগ্রহ ছিল দ্বিতীয় উইকেটকিপার হিসেবে মুশফিককে নেয়ার। ঋষভ পান্ত ছাড়া দলটিতে আর কোনো উইকেটকিপার ছিলেন না।
কিন্তু নিলামের দিন এত সব সম্ভাবনা আলোর মুখ দেখেনি। প্রথম ডাকেই মুশফিকের প্রতি আগ্রহ দেখায়নি কোনো দল। পরেও নাম তোলার সুযোগ ছিল। কিন্তু দলগুলোর আগ্রহ না থাকায় আর তোলা হয়নি মুশফিকের নাম।
ফর্মহীন মুস্তাফিজের প্রতিও আগ্রহ ছিল না আইপিএলের দলগুলোর। গত বছর অনুমতি না পেলেও এবার বিসিবি থেকে আইপিএল খেলার ছাড়পত্র পেয়েছিলেন বাঁহাতি এই পেসার। কিন্তু গত কয়েক মাসে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ও বিপিএলের মতো টুর্নামেন্টে বল হাতে বিবর্ণ মুস্তাফিজকে দলে টানেনি কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি।
তবে মুশফিক-মুস্তাফিজদের দল না পাওয়ার একটি ভিন্ন কারণও রয়েছে। সেটি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। আগামী বছর এপ্রিল-মে মাসে অনুষ্ঠিত হবে আইপিএল। ঠিক একই সময়ে আয়ারল্যান্ড সফর রয়েছে বাংলাদেশ দলের। একটি টেস্ট বাতিল হলেও আইরিশদের বিরুদ্ধে টি-২০ সিরিজ খেলবে বাংলাদেশ দল। সেক্ষেত্রে পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের পাবে না আইপিএলের দলগুলো। মুস্তাফিজদের প্রতি সবার অনাগ্রহের পেছনে এটিও একটি কারণ বটে।
আইপিএলে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা
বাংলাদেশের পাঁচ ক্রিকেটার এখন পর্যন্ত আইপিএল খেলেছেন। তারা হলেন; আব্দুর রাজ্জাক, মাশরাফি বিন মুর্তজা, মোহাম্মদ আশরাফুল, সাকিব আল হাসান ও মুস্তাফিজুর রহমান। সবচেয়ে বেশি বার খেলেছেন সাকিব। এছাড়া দল পেলেও ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি তামিম ইকবাল। ২০১২ সালে এই বাঁহাতি ওপেনারকে দলে নেয় পুনে ওয়ারিয়র্স। সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বাধীন দলে অবশ্য একটি ম্যাচ পাননি তামিম।
-
আব্দুর রাজ্জাক
২০০৮ সালে আইপিএলের প্রথম আসরে দল পান বাংলাদেশের বাঁহাতি স্পিনার আব্দুর রাজ্জাক। তখন দারুণ ফর্মে ছিলেন তিনি। সেবার রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু বাংলাদেশের এই অভিজ্ঞ স্পিনারকে দলে ভেড়ায়। রাহুল দ্রাবিড়ের নেতৃত্বাধীন ব্যাঙ্গালুরুর হয়ে আইপিএলের ওই আসরে একটি মাত্র ম্যাচ খেলার সুযোগ পান রাজ্জাক। তারপর আর ডাক পড়েনি তার।
-
মাশরাফি বিন মুর্তজা ও মোহাম্মদ আশরাফুল
২০০৯ সাল তথা আইপিএলের দ্বিতীয় আসরের নিলামে সাড়া ফেলে বাংলাদেশ। সেবার কাড়াকাড়ি পড়ে যায় মাশরাফিকে নিয়ে। ডানহাতি এই পেসারকে পেতে লড়েছিল কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব ও কলকাতা নাইট রাইডার্স। বলিউড অভিনেত্রী জুহি চাওলা-প্রীতি জিনতার লড়াই শেষে মাশরাফিকে পায় কলকাতা। একই আসরে মোহাম্মদ আশরাফুলও দল পান আইপিএলে। তাকে দলে নিয়েছিল শচীন টেন্ডুলকারের মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স।
ডেকান চাজার্সের বিরুদ্ধে একটি ম্যাচই খেলেছিলেন মাশরাফি। বল হাতে সুবিধা করতে পারেননি। ৪ ওভারে ৫৮ রান দিয়েছিলেন। উইকেট পাননি। পরের আসরে মাশরাফিকে ডেকেছিল কলকাতা। অবশ্য কয়েক ম্যাচ পরই তাকে ছেড়ে দেয় দলটি।
মুম্বাইয়ের জার্সিতে আশরাফুল খেলেছিলেন একটি ম্যাচ। দিল্লি ডেয়ারডেভিলসের বিরুদ্ধে ১০ বল খেলে ২ রান করে ফিরেন আশরাফুল। পরে আর তাকে ডাকেনি আইপিএলের কোনো দল।
-
সাকিব আল হাসান
২০১১ সালে অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে দলে নেয় কলকাতা। এরপর টানা সাত আসর কলকাতা দলে ছিলেন সাকিব। এরপর ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে খেলেন বাঁহাতি এই অলরাউন্ডার। আইপিএলে মোট ৬৩ ম্যাচ খেলে দুটি হাফ সেঞ্চুরিতে ৭৪৬ রান করেছেন তিনি। সর্বোচ্চ অপরাজিত ৬৬ রান, ২০১৬ সালে। বাঁহাতি স্পিনে উইকেট নিয়েছেন ৫৯টি। সেরা বোলিং ১৭ রানে ৩ উইকেট, ২০১২ সালে।
২০১১ সালে ৭ ম্যাচ খেলে ১১ উইকেট ও ২৯ রান করেছিলেন সাকিব। ২০১২ সালে ৮ ম্যাচে ৯১ রান ও ১২ উইকেট পান তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ব্যস্ততার কারণে ২০১৩ সালে আইপিএল খেলা হয়নি তার। ২০১৪ সালে ১৩ ম্যাচে ২২৭ রান ও ১১ উইকেট নেন এই বাঁহাতি অলরাউন্ডার। ২০১৫ সালে বেশি ম্যাচ পাননি। চার ম্যাচে ৩৬ রান ও ৪ উইকেট পান সাকিব। ২০১৬ সাল আবার ব্যাটে-বলে ভালো যায়নি সাকিবের। ১০ ম্যাচে ১১৪ রান ও ৫ উইকেট নিয়েছেন তিনি। যার প্রভাব পড়েছে পরের বছর। ২০১৭ সালে মাত্র একটি ম্যাচ খেলেছেন তিনি কলকাতার হয়ে, যেখানে ১ রান ও উইকেটশূন্য ছিলেন তিনি। তারপরই সাকিবকে ছেড়ে দেয় কলকাতা।
নতুন করে সানরাইজার্স হায়দরাবাদ দলে টেনে নেয় এই অলরাউন্ডারকে। ২০১৮ সালে ১৭ ম্যাচ খেলেছেন হায়দরাবাদের হয়ে। রান করেছেন ২৩৯, উইকেট নিয়েছেন ১৪টি। ২০১৯ সালে তিন ম্যাচে ৯ রান ও ২ উইকেট পান সাকিব।
-
মুস্তাফিজুর রহমান
২০১৫ সালে ঘরের মাঠে অভিষেকেই ভারতকে গুড়িয়ে দিয়েছিলেন মুস্তাফিজ। কাটার মাস্টার উপাধিও পেয়েছিলেন। তার বদৌলতে ২০১৬ সালে এই বাঁহাতি পেসারকে দলে নেয় আইপিএলের দল সানরাইজার্স হায়দরাবাদ। টুর্নামেন্টে নিজের প্রতি সুবিচার করেছিলেন মুস্তাফিজ। বল হাতে দলকে দারুণ সার্ভিস দিয়েছিলেন। ১৬ ম্যাচে ১৭ উইকেট পান তিনি। একই দলের হয়ে ২০১৭ সালে ১ ম্যাচ খেলে উইকেটশূন্য ছিলেন। পরে হায়দরাবাদ ছেড়ে দেয় মুস্তাফিজকে। বাংলাদেশের এই তরুণকে দলে টানে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স। ২০১৮ সালে মুম্বাইয়ের হয়ে ৭ ম্যাচে ৭ উইকেট নেন তিনি, সঙ্গে ১ রান করেছেন তিনি।
আইপিএলের ১৩তম আসরে বাংলাদেশের ঝান্ডা উড়ানোর মতো কেউই থাকছেন না। দেশের ক্রিকেটমোদীরাও আগের মতো খুঁজে ফিরবে না, কবে সাকিব-মুস্তাফিজদের খেলা। তবে ফর্ম-ফিটনেস ঠিক থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ঠিকই বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব থাকবে বিগ বাজেটের টুর্নামেন্ট আইপিএলে।
আইপিএল সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন বই। পড়তে পারেন নিচের বইটি। অনলাইনে কিনতে ক্লিক করুন নিচের লিংকে-