মিরপুরের শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে যখন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশ খেলছে, তখন গ্যালারিতে হাজার হাজার দর্শক। ইমরুল-লিটনদের ব্যাটে কখনও রানের ফোয়ারা, কখনও বা ব্যর্থতার গ্লানি। ম্যাচের উত্তেজনার পারদ যখন তুঙ্গে, তখন হয়তো মাঠের খেলোয়াড় থেকে শুরু করে গ্যালারির দর্শক সবাই একটা শূন্যস্থান টের পেয়েছে। সেই শূন্যস্থানে একমাত্র তামিম ইকবালের নামই বসে। তামিম জিম্বাবুয়ে সিরিজে ফেরেননি, হাতের ইনজুরি থেকে ফিরে আসতে চালিয়ে যাচ্ছিলেন পুনর্বাসন। যে মাঠে জিম্বাবুয়ে-বাংলাদেশ লড়ছিলো, তার শ’খানেক কদম পাশেই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) একাডেমি মাঠ। সেখানে একাকী নীরবে-নিভৃতে অনুশীলন করে যাচ্ছিলেন বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান। সঙ্গী কেবল দু-একজন নেট বোলার।
সেই তামিম ফিরলেন পরের সিরিজেই, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে। প্রথম ম্যাচে ১২ রান করলেন, পরের দুই ম্যাচে ব্যাক টু ব্যাক হাফ সেঞ্চুরি। ২-১ ব্যবধানে বাংলাদেশ সিরিজ জিতলো, তামিম পরলেন দুই দল মিলিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহকের পুষ্পমালা।
তামিম সেই পুরনো প্রবাদটি মনে করিয়ে দিলেন, পুরনো চাল ভাতে বাড়ে।
১.
এশিয়া কাপে ইনজুরিতে পড়লেন বাঁহাতি ওপেনার তামিম। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে ব্যাট হাতে সেই যে ইনিংসের শুরুতে হাতে চোট পেলেন, ছিটকে গেলেন কয়েক মাসের জন্য।
ওই ইনজুরির ম্যাচেও তামিম ত্রাতা হয়ে নেমেছিলেন দলের জন্য। বলে রাখা ভালো, ইনিংসের শুরুতে হাতের আঙ্গুলে এতোটাই গুরুতর চোট পেয়েছিলেন যে, হাতের গ্লাভস কেটে আঙ্গুল বের করতে হয়েছে।
পরের পুরোটা সময় তামিম ছিলেন ড্রেসিংরুমে। লঙ্কান বোলিং লাইনআপের সামনে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ধরাশায়ী হওয়ার দিনে বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল বড় সংগ্রহের। শেষদিকে মুশফিকুর রহিম একা দলকে টেনে নিয়ে গেলেও তাকে সমর্থন দেওয়ার মতো অপর প্রান্তে কেউ ছিল না। এমন সময় অনেকটা দায়ে পড়েই শেষ উইকেটে ‘রিটায়ার হার্ট’ তামিমকে মাঠে নামিয়ে দিলেন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। পুরো ঘটনা নাটকীয়ই ছিল বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তামিম নেমেছিলেন। সুরঙ্গ লাকমলের দু’টি বল খেলেছিলেন এক হাতে ব্যাট ধরে। তাতে করে তার ও মুশফিকের জুটিতে আরও ৩০ রান যোগ হয়।
সেই ম্যাচে বাংলাদেশ জিতেছিল ১৩৭ রানের বিশাল ব্যবধানে। তামিমের এহেন নায়কোচিত আচরণ তাকে বাহবা এনে দিলেও, দেশের প্রতিনিধিত্ব করার অন্যরকম একটা মুহূর্ত এনে দিলেও, মাঠের বাইরে যাওয়া আটকাতে পারেনি। তবে সেই ম্যাচে জয়ের মধ্য দিয়ে আবারও এশিয়া কাপের ফাইনালে জায়গা করেছিলো বাংলাদেশ।
২.
তামিম খুব দ্রুত মাঠে ফিরতে চেয়েছিলেন। এশিয়া কাপের পরপরই ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ে সিরিজ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ খেলতে মুখিয়ে ছিলেন তিনি। যে কারণে সিরিজ শুরুর আগে বারবার আলোচনায় এসেছেন তামিম। তাকে দলে অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে বারবার প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়েছে নির্বাচক প্যানেলের সদস্য থেকে শুরু করে জাতীয় দলের কোচ। কিন্তু শতভাগ ফিট না হওয়ার কারণে বিলম্বিত হয়েছে তার প্রত্যাবর্তন।
নিজেকে ফিরে পেতে অনুশীলনে ঘাম ঝরিয়েছেন, ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নে বিভোর হয়েছেন বারবার। তা হবে না-ই বা কেন? ওপাশের বিশাল মাঠে যখন উল্লাসের চিৎকার, তামিম তখন একাডেমিতে ব্যাটিং অনুশীলনে ব্যস্ত। একটু তো মন খারাপ হওয়ার মতোই।
তামিমের মন ভালো হলো ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে। শুধু নিজের নয়, সেই ম্যাচে তিনি মন ভালো করেছেন তার লাখো সমর্থকের, কপালের দুশ্চিন্তার ভাঁজ ভেঙেছেন টিম ম্যানেজমেন্টের, শনি ডেকেছেন প্রতিপক্ষের।
বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) মাঠে তামিম প্রায় আড়াই মাস পর ব্যাট হাতে নেমে শুরুটা করেছেন ঝড়ো সেঞ্চুরি দিয়ে। মাত্র ৭৩ বল খেলে ১০৭ রানের ইনিংসে নিজের ‘টর্নেডো তামিম’ নামের সঙ্গে পুরোপুরি সুবিচার করেছেন। কেমার রোচ, কিমো পল, দেবেন্দ্র বিশুদের একরকম পাড়ার বোলারেই পরিণত করেছিলেন। তার ৭৩ বল খেলার ইনিংসে ছিল ১৩টি চার ও ৪টি ছক্কা।
তামিমের এই ‘অনানুষ্ঠানিক প্রত্যাবর্তন’ এর ম্যাচে এমন পারফরম্যান্স দেখে নির্ভরতার ছায়া সবার মাথাতেই আসতে পারে। কিন্তু আগেই বেশি আশা করতে না করে দিয়েছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। দলের এই ওয়ানডে অধিনায়ক তামিমের ফেরাতে যেমনটা সন্তুষ্ট হয়েছিলেন, তেমনই সবাইকে বেশি আশা করার ব্যাপারেও খানিকটা দেয়াল তুলে দিয়েছিলেন।
ওই ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন,
‘তামিম দলে থাকা আমাদের জন্য বিরাট অ্যাডভান্টেজ। প্রস্তুতি ম্যাচেও তামিম দারুণ খেলেছে, এটা তামিমের জন্যও স্বস্তি, আমাদের জন্যও। আমি একইসঙ্গে বলবো যে, ইনজুরি থেকে আসা এবং এসে পারফর্ম করা কিন্তু সময়ের ব্যাপার। তামিমের আগের ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছে বলে প্রত্যাশা করতে পারেন না যে পরের ম্যাচে নেমেও এক্সট্রা-অর্ডিনারি ইনিংস খেলবে। আবার এর থেকে বেটারও খেলতে পারে, খারাপও হতে পারে। চোট থেকে ফিরলে কিন্তু বেশ কিছুদিন লাগে মানিয়ে নিতে। দুই মাস থেকে আড়াই মাস বাইরে ছিল ও। সো এটা গুরুত্বপূর্ণ। সাকিব হয়তো দুইটা টেস্ট ম্যাচ খেলে কিছুটা মানিয়ে নিয়েছে। তামিমের হয়তো কিছুটা সময় লাগতে পারে। কিন্তু ওরা দুইজন থাকা আমাদের জন্য, প্রত্যেক খেলোয়াড়ের জন্য স্বস্তিদায়ক ব্যাপার।’
৩.
অধিনায়কের সতর্কবাণী আর প্রত্যাশার চাপ, দুই নিয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আবারও নেমেছিলেন তামিম। কিন্তু তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম ম্যাচে ১২ রানে সাজঘরে ফেরাটা হয়তো তার অভিজ্ঞ অধিনায়কের সাবধানবাণীই স্মরণ করালো।
তামিম ফিরলেন পরের দুই ম্যাচে। একটিতে ৫০ রানের ইনিংস, শেষ ম্যাচ তথা সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচে অপরাজিত ৮১ রানের ইনিংস। তামিম চাইলে শেষ ইনিংসটা আরও বড় করতে পারতেন। করেননি সৌম্য সরকারের জন্য। সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের অভিষেক ওয়ানডে ম্যাচে সেঞ্চুরির পথে ছিলেন সৌম্য। লক্ষ্য ছোট হওয়ার কারণে তামিম খানিকটা রয়েসয়েই খেলেছেন। তাতে লাভ হয়নি, ব্যক্তিগত ৮০ রানে ফিরে গেছেন তামিম।
দারুণ এই প্রত্যাবর্তনের সিরিজে তামিম ছুঁয়েছেন দু’টি মাইলফলক। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে হাফ সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ক্রিকেটের তিন ফরম্যাট মিলিয়ে তামিম পূর্ণ করেন ১২ হাজার রান। শুধু তাই নয়, ভেন্যু হিসেবে মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে পূরণ করেছেন ৪ হাজার রানের মাইলফলক।
তবে দেশের হোম অব ক্রিকেটে ৪ হাজার রান পাওয়ার তালিকায় তামিম প্রথম নন, এই অর্জন আগেই নিজের নামে লিখে নিয়েছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন সাকিব আল হাসান। সেটাও তামিমের মাত্র এক ম্যাচ আগে। সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে ৩০ রানের ইনিংস খেলে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে মিরপুরে ব্যক্তিগত ৪ হাজার রান তোলেন বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডার।
পরিসংখ্যান, রেকর্ড আর মাইলফলকের তালিকায় তামিম এমনিতেও দেশের ক্রিকেটে সবার উপরে। কিন্তু এই তামিম সবচেয়ে বেশি পরিণত নিজের অভিজ্ঞতায়। ২০১৫ সাল থেকে ভাগ্যদেবতা যেন তামিমকে একরকম মুঠোভরে দিয়েছেন। এর পিছনে তামিমের পরিশ্রমও কম ছিল না। নিজেকে বারবার ভেঙ্গেছেন, গড়েছেন। প্রতি ম্যাচে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার যে আকুল প্রত্যয় তার ব্যাটে প্রতিধ্বনিত হয়েছে, যে আবেগ ছুঁয়ে গেছে, তা হয়তো চোখ এড়ায়নি কারোরই।
তামিম থাকবেন নিজের মতোই; কখনও উইকেটে টর্নেডো হয়ে, কখনও জলোচ্ছ্বাস হয়ে, কখনও বা বিকেলের গোধূলিতে স্নিগ্ধ নির্মল বাতাস হয়ে।