ব্রেন্ডন ম্যাককালাম হতে চেষ্টা করো।
মৌসুম শেষে মানুকাউ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রায় দু’বছর আগে বাচ্চাদেরকে দেয়া তার উপদেশ।
রঙিন জার্সি গায়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খুব একটা খেলা হয়নি। বিদেশি লিগে টাকা-পয়সার ঝনঝনানি শোনেননি, তিন ঘণ্টা মাঠে কাটিয়ে এসে ব্যাংক ব্যালেন্স হু হু করে বাড়তে দেখেননি। যতই বীরোচিত ইনিংস খেলেন না কেন, যতই ম্যাচ বাঁচান বা ম্যাচ জেতান না কেন, যতই দুর্দান্ত ক্যাচ ধরেন না কেন, দিনশেষে তিনি শুধুই একজন টেস্ট ক্রিকেটার।
দুঃখজনক, তবুও সত্য।
‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’ সিনেমাটি সবাই মনে রেখেছে টম হ্যাংক্সের অসাধারণ অভিনয়ের জন্য। কিন্তু জানুজ কামিনস্কিকে ক’জন মনে রেখেছে? বা আদৌ ক’জন চেনে?
ব্র্যাডলি-জন ওয়াটলিংকে আমরা ধরে নিতে পারি ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’ সিনেমার জানুজ কামিনস্কি হিসেবে। নিউজিল্যান্ডের কথা আসলেই মাথায় আসবে ব্রেন্ডন ম্যাককালামের ধুন্ধুমার সব ইনিংস, রস টেইলরের দুর্দান্ত সব শট, মার্টিন গাপটিলের আক্রমণাত্মক ব্যাটিং কিংবা বোল্ট-সাউদির মায়াবী সুইংয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা। কে-ই বা মনে রাখবে বিজে ওয়াটলিংকে?
নিউজিল্যান্ড দলটা যথেষ্ট আন্ডাররেটেড। ক্রিকেটে ‘আন্ডাররেটেড’ শব্দটার প্রতিশব্দই যেন নিউজিল্যান্ড। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের ‘নিউজিল্যান্ড’ কে? দক্ষিণ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত বিজে ওয়াটলিং। নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে আন্ডাররেটেড ক্রিকেটার।
২০০৯ এর ডিসেম্বরে নর্দার্ন ডিস্ট্রিক্টের ২৪ বছর বয়সী ওয়াটলিংকে দলে ডাকা হয়। এসময় নিউজিল্যান্ড দলে স্টিফেন ফ্লেমিং, নাথান এস্টল ও ক্রেইগ ম্যাকমিলানের শূন্যতা পূরণ করতে ঘরোয়াতে ভালো করা তরুণদের সুযোগ দেয়া হচ্ছিল।
প্রথম ম্যাচেই আস্থার প্রতিদান দেন ওয়াটলিং। পাকিস্তানের বিপক্ষে ২০৮ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ৬২ বলে ৬০ রানে অপরাজিত থাকাবস্থায় বৃষ্টি খেলা পন্ড করে দেয়।
মনে হচ্ছিল ওপেনিং জুটির একটা সমাধান বুঝি পাওয়া গেলো। কিন্তু ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের বিপক্ষে দেশের বাইরে সুবিধা করতে পারেননি তিনি। ৮ ইনিংসে ১৮ গড়ে কেবল ১৮৫ সংগ্রহ করতে পারেন। ফলাফল, এক বছরের জন্য দলের বাইরে।
২০১১ সালে দলে ফেরেন ওয়াটলিং। এবার জায়গা হয় মিডল অর্ডারে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর পর্যন্ত দলে জায়গা ধরে রাখতে পারলেও ঐ সফরে নিউজিল্যান্ডের লজ্জাজনক হার ওয়াটলিংকে আবারো দলের বাইরে বের করে দেয়।
মনে হচ্ছিলো একটা সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ারের অকালমৃত্যু ঘটবে। কিন্তু ২০১২ সালের বহুল আলোচিত এক বিতর্ক আবারো ওয়াটলিংয়ের জন্য ‘লাইফলাইন’ হয়ে আসে। আকস্মিকভাবে রস টেইলরকে সরিয়ে ব্রেন্ডন ম্যাককালামকে অধিনায়কত্ব দেয়া হয়। এটা শুধুমাত্র নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের জন্যই নয়, সুখবর বয়ে এনেছিল ওয়াটলিংয়ের জন্যও।
২০১৩ এর জানুয়ারিতে ওয়াটলিং তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার নতুনভাবে শুরু করেন। ২৭ বছর বয়সে ‘মেকশিফট’ উইকেটরক্ষক হিসেবে পুনরায় দলে ফেরা আর অধিনায়ক ম্যাককালামের তার উপর আত্মবিশ্বাস দলের জন্য দারুণ ফলাফল বয়ে আনে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২-০ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ হারলেও ৪ ইনিংসে যথাক্রমে ০, ৪২, ৬৩ ও ৬৩ রান করেন ওয়াটলিং।
ডগি ব্রাউনলির পর এই সিরিজে দলের হয়ে ২য় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন ওয়াটলিং। বছরের শেষদিকে বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্টে ১০৩ রানের অসাধারণ ইনিংস খেলেন তিনি। শেষ উইকেট জুটিতে ট্রেন্ট বোল্টের সাথে যোগ করেন ১২৭। এই ইনিংসটাই নিউজিল্যান্ড দলে উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়াটলিংয়ের জায়গা মোটামুটি পাকা করে দেয়।
২০১৪ সালে বেসিন রিজার্ভে ভারতের বিপক্ষে ইতিহাস গড়েন ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। প্রথম কিউই ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টে ত্রিশতক হাঁকিয়ে পাদপ্রদীপের আলো পুরোপুরি নিজের দিকে টেনে নেন তিনি। অন্য প্রান্তে দেয়ালের মতো অবিচল দাঁড়িয়ে ছিলেন ওয়াটলিং। ৩৬৭ বলে ১২৪ রানের ইনিংসটা একপ্রকার ব্রেন্ডন ম্যাককালামের ছায়ায় পড়ে রইল। ৭৩৮ বলে ৩৫২ রানের ম্যারাথন জুটিতে তিনিই ছিলেন ম্যাককালামের সাথে।
এক বছর পর যখন ওয়েলিংটন ক্রিকেট কর্তৃপক্ষ এই রেকর্ডটি স্মরণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন সকল পরিকল্পনা ভেস্তে দেন কেন উইলিয়ামসন। এবারও তার ‘পার্টনার-ইন-ক্রাইম’ বিজে ওয়াটলিং। ৬ষ্ঠ উইকেট জুটিতে ৩৬৫ রান যোগ করে নতুন রেকর্ড গড়েন তারা। এর ছয় মাস আগে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে ২-১ এ টেস্ট সিরিজ জিতেছিল নিউজিল্যান্ড। ৫১.৭৫ গড়ে সেই সিরিজে ২০৭ রান করা ওয়াটলিংয়ের ব্যাপারে খোদ অধিনায়ক ম্যাককালাম বলেছিলেন, “ধীরে ধীরে ও আমার প্রিয় খেলোয়াড় হয়ে উঠছে।“
এতকিছুর মধ্যেও ওয়াটলিংয়ের উপর পাদপ্রদীপের আলো আসছিল না। একপ্রকার অলক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছিলেন। সম্ভবত আশেপাশের খেলোয়াড়দের তারকাখ্যাতি এবং তার নিজের সবকিছুর আড়ালে থাকার প্রবণতাই এর কারণ। লাইমলাইটে না আসলেও তার দৃঢ়তা ও চোয়ালবদ্ধ মনোভাব তাকে বানিয়ে দেয় নিউজিল্যান্ডের ‘ব্যাকস্টেজ হিরো’ বা ‘পর্দার পেছনের নায়ক’।
২০১৫ সালে লিডসে সমীহ জাগানিয়া ইংল্যান্ড দলের বিপক্ষে শতক হাঁকান ওয়াটলিং। ২০১৮ সালে একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে নিউজিল্যান্ড যখন ৩০৭ রানের জবাবে ৩৬ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে কাঁপছে, তখন কলিন ডি গ্রান্ডহোমকে নিয়ে বিপদ থেকে দলকে উদ্ধার করেন ওয়াটলিং। ৩০৬ মিনিট ধরে ব্যাট করে নিউজিল্যান্ডকে ২৭৮-এ নিয়ে যান। নিউজিল্যান্ড সিরিজ জেতে সেবার। অন্য কেউ হলে হয়তো মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতেন। কিন্তু মানুষটা যে বিজে ওয়াটলিং। গান গাওয়া ব্যক্তিকে মনে রাখে সবাই, গানের লিরিক লেখা ব্যক্তিকে ক’জন আর মনে রাখে!
২০১৮ সালে ৫০ বছরের ব্যবধানে প্রথমবার দেশের বাইরে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ জেতে নিউজিল্যান্ড। সেই সিরিজে দুটো ম্যাচ জয়ে সরাসরি ব্যাট হাতে অবদান রাখেন ওয়াটলিং। প্রথম টেস্টের ২য় ইনিংসে ৫৯ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেন তিনি। নিউজিল্যান্ড ঐ ম্যাচে জেতে ৪ রানে। তৃতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসেও খেলেন অপরাজিত ৭৭ রানের অসাধারণ ইনিংস।
সম্ভবত শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অপরাজিত ১০৫ রানের ইনিংস তাকে তার প্রাপ্য স্বীকৃতির কিছুটা দেয়। এশিয়ায় তার রেকর্ড নিয়ে যে সমালোচকেরা প্রশ্ন তুলেছিলেন তারাও তার দৃঢ়তার প্রশংসা করতে কার্পণ্য করেননি।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বে ওভালে তার ২০৫ রানের ম্যারাথন ইনিংস আরো একবার প্রমাণ দেয় তার শক্ত-সমর্থ চরিত্রের, কখনো হাল ছেড়ে না দেয়া মানসিকতার। হোক এশিয়া, ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ঘরের মাঠ, প্রথম ইনিংস বা টেস্ট ম্যাচের ৪র্থ-৫ম দিন, সাথে টেলএন্ডার থাকুক বা দলের কোনো তারকা- বিজে ওয়াটলিংয়ের ফর্মুলা একটিই- ধৈর্য ধরে প্রতিপক্ষের বোলারদের ধৈর্যকে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া।
বে ওভালের ২০৫ রানের ইনিংস দিয়ে প্রথম কিউই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে দ্বিশতক হাঁকান ওয়াটলিং। তার ব্যাপারে আলোচনা করতে গেলে সামনে হয়তো ব্যাটিংটাই আসবে। কিন্তু ক’জন জানেন নিউজিল্যান্ডের ৯০ বছরের টেস্ট ইতিহাসের সফলতম উইকেটরক্ষক তিনি? ২৩৯টি ডিসমিসাল নিয়ে নিউজিল্যান্ডের হয়ে সফলতম টেস্ট উইকেটরক্ষক বিজে ওয়াটলিং।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ইতিমধ্যে ১০ বছর পার করেছেন তিনি। নিউজিল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন ৭০ টেস্ট। ৩৮.৫০ গড়ে রান করেছেন ৩,৬৫৮। ১৮ অর্ধশতকের সাথে রয়েছে ৮ শতক। এশিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ- সব জায়গায় রান পেয়েছেন। উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়েছেন অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে। অ্যাডাম গিলক্রিস্ট তাকে বলেছেন বর্তমান সময়ের সেরা উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান।
ক্রিকেটের বৈশ্বিক অর্থনীতি হয়তো একজন বিজে ওয়াটলিংয়ের মূল্য বুঝবে না। কিন্তু এতে তার কিছুই যায়-আসে না। হয়তো ব্র্যান্ডন ম্যাককালাম বোলারদের মাঝে যে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলেন, সেরকম পারেননি, কিন্তু এটা নিশ্চিত যে প্রতিপক্ষের বোলাররা তাকে উইকেটে আসতে দেখলে মনে মনে বিরক্তির সুরে বলে, “Ah crap, here he comes!“