মুশফিকুর রহিম ব্যাট হাতে মাঠে নামতেই গ্যালারি থেকে আত্মা কাঁপানো দুয়োধ্বনি। দিল্লীর ফিরোজ শাহ কোটলা স্টেডিয়াম যেন বাংলাদেশের সবচেয়ে পরিশ্রমী এই ব্যাটম্যানকে একরকম হুমকিই দিয়ে রাখল। মনে করিয়ে দিল সেই ২০১৬ সালের কথা। সেইদিনের কথা, যেদিন জয়ের জন্য ৩ বলে ২ রান বাকি থাকতেই উল্লাসে মেতে উঠেছিলেন উইকেটে থাকা এই মুশফিক, অপর প্রান্তে ছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।
প্রকৃতি কতই না বিচিত্র। সেদিনের জবাবটা ঠিক ঠিক ফিরিয়ে দিলেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক এই অধিনায়ক। ভারতের বিপক্ষে নিজেদের নবম টি-টোয়েন্টি ম্যাচে মুখোমুখি হয়ে লিখলেন প্রথম জয়ের গল্প। কাহিনীর মঞ্চায়নে মনে হলো, এ যেন এক দেজা ভ্যু। শুধু এবার তফাৎ, সেই মুশফিক-মাহমুদউল্লাহই এবার আর ভুল করলেন না, উইকেটে থেকে জিতলেন ভারতের বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচ।
১.
দলে সাকিব নেই। কিন্তু সাকিবকে নিয়ে আলোচনা থেমে নেই। এমনকি ভারতীয় দলের অধিনায়ক রোহিত শর্মাকেও এ নিয়ে প্রশ্ন শুনতে হয়েছে। দলে তামিম ইকবালও নেই, যিনি কি না বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান। কে আছেন? আছেন মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ। তাদের হাত ধরে রয়েছেন লিটন, সৌম্য, মোসাদ্দেক, মুস্তাফিজ, শফিউলরা। আছেন তরুণ আমিনুল, নাঈম শেখ।
এই দল নিয়ে ভারত বধ? যেন শুরুতেই একটু থমকে গিয়েছিল সবাই। ভারতে পৌঁছে, অনুশীলনে, সংবাদ সম্মেলনে; সবখানেই যেন একটা গুমোট ভাব। কিন্তু সেই গুমোট ভাব নিয়ে তো চলে না। খেলতে হবে, লড়াই করতে হবে। সেটাই করেছে বাংলাদেশ। শুধু করেনি, জিতেছেও।
ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের উত্তাপ প্রায় নিভু নিভু। সেই উনুনে নতুন হাড়ি বাংলাদেশ। এখন ভারত কিংবা বাংলাদেশ; দুই দেশেই বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচের আবেদন পাকিস্তানের চেয়েও অনেক বেশি। এর অন্যতম কারণ বোধ হয় গেল কয়েক বছরে ভারতের বিপক্ষে জয়ের খুব কাছ থেকে বাংলাদেশের ফিরে আসার ঘটনা। গ্যালারিজুড়ে উত্তেজনা, ক্রিকেটারদের শরীরী ভাষা; সব কিছু মিলিয়ে লড়াইটা শুধুই ব্যাট-বলের থাকে না কখনোই। বিতর্কের নৌকা পাল তুলে এগিয়ে যায় আরও অনেকখানি।
তবে বাংলাদেশের এই তীরে গিয়ে তরি ডোবানোটা যেন ভারত দলকেও মাঝে মাঝে ভাবিয়ে তোলে। অন্তত এই সিরিজে সেটা বোঝা গেল খুব করে। ভারতীয় অধিনায়ক রোহিত যেমন বলেই দিয়েছেন, বাংলাদেশের ম্যাচ জেতা আর ‘আপসেট’ নয়। তারা শক্তিশালী দল বলেই ম্যাচ জেতে।
রবিবারের ম্যাচ শেষেও বাংলাদেশের ব্যাটিং নিয়ে, বোলিং নিয়ে সেই প্রশংসা লুকানোর চেষ্টা করলেন না রোহিত। অকপটে স্বীকার করে বললেন,
‘পুরোটাই বাংলাদেশের কৃতিত্ব। আমরা যখন ব্যাটিং করছিলাম, তখনকার ব্রেক-থ্রুগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ছিল। আমি মনে করি, আমরা যে রান তুলেছিলাম, তা দিয়েও আমরা লড়তে পারতাম। কিন্তু ফিল্ডিংয়ে আমরা কিছু ভুল করেছি, রিভিউগুলো হারিয়েছি। ফিল্ডিংয়ে আমাদের অনেক ভুল ছিল। মুশফিকুর রহিম যেভাবে শেষের ওই ওভারটা খেলেছে… প্রতি বলে কীভাবে বাউন্ডারি বের করেছে… (হাসি) এখানে কারো কিছু করার ছিল না।’
বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর কন্ঠে এল দলগত পরিকল্পনা, শুরু থেকে প্রতিপক্ষকে চেপে ধরার গল্প,
‘আমি মনে করি, শুরুতে আমাদের বোলাররা দারুণ করেছে। সবাই সবকিছু ঠিকভাবে করেছে। সবাই ভালো পারফর্ম করেছে বলেই অধিনায়কত্বটা সহজ হয়ে গেছে। মুশফিক সব কৃতিত্ব পাওয়ার দাবিদার… সে এবং সৌম্য। নাঈমও অভিষেকে ভালো করেছে। শুরুতে আমরা যেটা চেয়েছিলাম, সেটা এনে দিয়েছে।’
মুশফিকুর রহিমের জন্য প্রতিপক্ষ হিসেবে ভারত যেন সবসময়ই আলাদা। এই দলটিকে ঘিরে মুশফিককে কত বিতর্কের মুখে পড়তে হয়েছে, তা কে বা না জানে! তারপরও, ভারতের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানসংগ্রাহক এই উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান প্রায় প্রতি ম্যাচেই ভারতের বিপক্ষে লড়াই করার চেষ্টা করেছেন। দিল্লীর ফিরোজ শাহ কোটলাতেও সেই একই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতেই মাঠে নেমেছিলেন তিনি। দিনশেষে জয়ী হয়েছেন, অন্তত একবার জয়ী হলেন। ৪৩ বলে ৬০ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে মুশফিক ম্যাচসেরার পুরস্কার তো জিতলেনই, হাফ-সেঞ্চুরি কিংবা জয়ের উদযাপন; সবখানেই পরিচয় দিলেন বড় মাপের ক্রিকেটারের।
পুরস্কার বিতরণীতে অনুষ্ঠানেও পাওয়া গেল একই মুশফিককে। ব্যাটিংয়ে নামার সময় যে দর্শকরা তাকে দুয়োধ্বনি দিয়েছিল, তাদেরকে উদ্দেশ্য করেই যেন বললেন,
‘আমরা গ্যালারিভর্তি সমর্থকের সামনে খেলেছি, খুব স্পেশাল একটা ব্যাপার। আমি এবং সৌম্য ব্যাটিংয়ের সময় বারবার কথা বলে নিয়েছি। আমরা ভেবেছিলাম, ম্যাচটা এগিয়ে নিতে পারবো। আলহামদুলিল্লাহ আমরা পেরেছি, সৌম্য দারুণ খেলেছে। নাঈমও ভালো করেছে, বোলারদের সবাই তাদের কাজ করেছে। ক্রিকেটার হিসেবে বাংলাদেশের হয়ে প্রতিটি ম্যাচে আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব ভালো পারফরম্যান্স করার।’
২.
তখন জয়ের জন্য ২৫ রান বাকি। হাতে আছে আড়াই ওভারের মতো। টিভিতে ধারাভাষ্যকার মনে করিয়ে দিলেন ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের বারবার জয়ের কাছ থেকে ফিরে আসার ‘দুর্ভাগ্যের’ কথা। এটাও মনে করিয়ে দিলেন, আজই হতে পারে সেই দুর্ভাগ্য কাটানোর সেরা সুযোগ। তা-ই হলো, ৩ বল হাতে রেখেই ৭ উইকেটের জয় তুলে নিল লাল-সবুজ জার্সিরা।
বিরাট কোহলি, বুমরাহদের বিশ্রাম দিয়ে রোহিত শর্মাকে অধিনায়ক করে তুলনামূলক কম শক্তিশালী দল গড়েছিল ভারত। তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল নতুন ক্রিকেটারদের। অন্যদিকে, গেল কয়েক সপ্তাহ বাংলাদেশের ক্রিকেটের উপর দিয়ে যে ঝড় গিয়েছে, সেই ঝড় কোনোমতে থামিয়ে ভারতে সিরিজ খেলতে যাওয়া বাংলাদেশও দল গড়েছে তরুণদের নিয়ে। নিষেধাজ্ঞার কারণে সাকিব আল হাসানের অনুপস্থিতি, পারিবারিক কারণে সিরিজ থেকে তামিম ইকবালের সরে যাওয়া; সব কিছু মিলিয়ে ‘তারকা’হীনতায় ভুগেছে বাংলাদেশও। কিন্তু দিনশেষে সিরিজের প্রথম ম্যাচে আলো কেড়েছেন তরুণ লেগস্পিনার আমিনুল বিপ্লব, অভিষিক্ত ওপেনার নাঈম শেখরা। পাশাপাশি নিজেদের কাজটা ঠিকই করে গেছেন সৌম্য সরকার, মুশফিকুর রহিম ও অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ। ফলাফল, সিরিজের প্রথম ম্যাচে জয়।
১৪৯ রানের লক্ষ্য। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায়, রানটা ‘এভারেজ’। এই রান তাড়িয়ে বহুবার ম্যাচ জিতেছে এই মুশফিকরাই। কিন্তু প্রতিপক্ষ ভারত বলেই যেন বাড়তি সতর্কতা, পুরনো অভিজ্ঞতা মনে করেই যেন শুরু থেকেই ‘স্মার্ট ক্রিকেট’ খেলার চেষ্টা।
শুরুটা অবশ্য বাংলাদেশের ভালো হয়নি। ৮ রানে লিটনের চলে যাওয়ার পর নাঈম শেখ জুটি গড়েন সৌম্য সরকারের সাথে। ২৮ বলে ২৬ রান করে যখন নাঈম আউট হলেন, তখন বাংলাদেশের সংগ্রহ ২ উইকেটে ৫৪ রান। অভিষেকটা একেবারে খারাপ হয়নি নাঈমের। তৃতীয় উইকেটে মুশফিক-সৌম্য মিলে দলকে নিয়ে যান ১১৪ রান পর্যন্ত। সেখান থেকে মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে জয় পাওয়া।
এদিনও শেষদিকে গিয়েই বিপাকে পড়েছিল বাংলাদেশ। ১৮তম ওভার যখন শেষ হলো, ১২ বলে তখন জয়ের জন্য প্রয়োজন ২২ রান। ম্যাচের মোড় ঘুরে গেছে মূলত ১৯তম ওভারে। বাঁহাতি পেসার খলিল আহমেদের ওভারে টানা ৪ বলে চারটি বাউন্ডারি মেরে এক ওভারে ১৮ রান তুলে নেয় বাংলাদেশ। পরের ওভারে স্রেফ জয় নিশ্চিত করতে হয়েছে। আর মাহমুদউল্লাহ যেভাবে ছক্কা হাঁকিয়ে জয় নিশ্চিত করলেন, তাতে যেন বুঝিয়ে দিলেন, এই দিনের জন্য অপেক্ষা করেছেন দীর্ঘদিন।
এর আগে টস জিতে আগে ফিল্ডিং করতে নামা বাংলাদেশ শুরু থেকেই চেপে ধরেছিল ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের। দলীয় ১০ রানে রোহিত শর্মাকে আউট করার পর আরও ধীর হয়ে যায় স্বাগতিকরা। ৯৫ রানে যখন ৪ উইকেট, ম্যাচ ততক্ষণে ১৪.৫ ওভারে গড়িয়েছে। সেখান থেকে ওয়াশিংটন সুন্দর আর ক্রুনাল পান্ডিয়ার দুই ক্যামিওতে ২০ ওভারে ১৪৮ এ থামে ভারত।
প্রতিনিয়ত একটা লেগস্পিনারের অভাব যেমন প্রতিনিয়ত বাংলাদেশকে পুড়িয়েছে, তার খানিকটা হলেও যেন সৌভাগ্য নিয়ে এসেছে নবাগত আমিনুল বিপ্লবের বরাতে। তরুণ এই ক্রিকেটার মূলত ব্যাটসম্যান হলেও জাতীয় দলে তাকে নেওয়া হয়েছে একজন লেগস্পিনার হিসেবেই। তিনিও নিরাশ করেননি, ফিরোজ শাহ কোটলায় ৩ ওভারে ২২ রান খরচ করে তুলে নিয়েছেন ২ উইকেট। আফিফ হোসেন ৩ ওভারে খরচ করেছেন ১১ রান, সাথে ১ উইকেট। দীর্ঘদিন পর দলে ফেরা পেসার আল-আমিন হোসেন উইকেটশূন্য থাকলেও রান খরচে ছিলেন মোটামুটি কৃপণ।
দিনশেষে বাংলাদেশের এই তারুণ্যনির্ভর দলটি যেন দেশের ভবিষ্যৎ ক্রিকেটের চিত্রটাই দেখিয়ে দিল। এখন কেবল প্রয়োজন এই তরুণদের পরিচর্যা করা, সামনের দিনগুলোর জন্য তৈরি করা। ৩ ম্যাচের সিরিজে ১-০ তে এগিয়ে থাকা বাংলাদেশ যে পরের ম্যাচে বাড়তি আত্মবিশ্বাস নিয়েই মাঠে নামবে, তা একরকম নিশ্চিতই।
আপাতত দিল্লীর বায়ুদূষণ সামলে উঠে পরের ভেন্যু পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেই হলো।
প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘খেলাধুলা’ বিভাগে এখন থেকে নিয়মিত লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/