সাইফুদ্দিন যখন নিজের তৃতীয় ওভার করতে বল হাতে নিলেন, বাংলাদেশের জয় ছিল তখন সময়ের ব্যাপার। ম্যাচের আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার্থে ইনিংসের ১৮তম বল করতে আসলেন গত ম্যাচে অভিষেক হওয়া সাইফুদ্দিন। শ্রীলঙ্কার তখন প্রয়োজন ছিল ১৮ বলে ৫৩ রান! হাতে আছে মাত্র ১টি উইকেট। প্রথম ৫টি বল ঠেকিয়ে দিলেও ওভারের শেষ বলে ভিকুম সঞ্জায়া সজোরে হাঁকাতে গিয়ে ধরা পড়লেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের হাতে। সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টি-টুয়েন্টিতে বাংলাদেশ ৪৫ রানের জয় তুলে নিয়ে সিরিজে আনলো সমতা। টেস্ট এবং ওডিআই-এর পর টি-টুয়েন্টি সিরিজও শেষ হল ১-১ এ সমতায়। টানা ৮টি টি-টুয়েন্টিতে জয়হীন বাংলাদেশ অবশেষে জয় মুখ দেখলো মাশরাফির বিদায়ী ম্যাচে।
আজকের ম্যাচটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার শেষ টি-টুয়েন্টি ম্যাচ। তার সম্মানার্থে ক্যারিয়ারের শেষ টি-টুয়েন্টিতে তাকে জয় উপহার দিতে চেয়েছিল দলের বাকি সদস্যরা। ম্যাচের শুরু থেকেই ক্রিকেটারদের শরীরের ভাষাই সেটা ইঙ্গিত করে।
প্রথম টি-টুয়েন্টির মতো দ্বিতীয় টি-টুয়েন্টিতেও টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। পিঠের ইনজুরির কারণে দলে নেই টি-টুয়েন্টিতে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তামিম ইকবাল। তাসকিনকে বিশ্রাম দিয়ে খেলানো হয়েছে টেস্ট ও ওডিআই-এর চেনা মুখ মেহেদি হাসান মিরাজকে, এটি তার প্রথম আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টি ম্যাচ ছিল।
তামিমের বদলে সুযোগ পাওয়া ইমরুল কায়েস ব্যাটিংয়ে নেমে শুরু থেকেই শ্রীলঙ্কান বোলারদের উপর চড়াও হন সৌম্য সরকারকে সাথে নিয়ে। পাওয়ার প্লের ৬ ওভারে দুজন মিলে যোগ করেন ৬৮ রান। পাওয়ার প্লে শেষ হওয়ার সাথে সাথে সৌম্য সরকার ১৭ বলে ৪টি চার এবং ২টি ছয়ের সাহায্যে ৩৪ রান করে গুনারত্নের হাতে ফিরতি ক্যাচ দেন। এতে করে দুজনের উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে গড়া ৭১ রানের জুটি ভেঙে যায়।
প্রথম টি-টুয়েন্টির মতো ভালো শুরু করার পর হঠাৎ করে ম্যাচের লাগাম হাতছাড়া হওয়ার ভয় তৈরি হয় তার বিদায়ে। সেটা আরো জোরালোভাবে দেখা দেয় ইমরুল কায়েসের ৩৬ রানের ইনিংসটি রান আউটের মধ্য দিয়ে শেষ হওয়ার পর। কিন্তু কাপ্তানের শেষ ম্যাচটি স্মরণীয় করে রাখতে ম্যাচের লাগাম হাতছাড়া হতে দেননি সাকিব আল হাসান এবং সাব্বির রহমান। সাব্বির রহমান যখন ১৯ রান করে আউট হয়ে প্যাভিলিয়নের পথ ধরেন, তখন বাংলাদেশের সংগ্রহ ১৩.১ ওভারে ৩ উইকেটে ১২৪ রান।
তখনো বাংলাদেশ বড় সংগ্রহের দিকেই এগোচ্ছে। কিন্তু থিসারা পেরেরা, নুয়ান কুলাসেকারা এবং অভিজ্ঞ পেসার লাসিথ মালিঙ্গার অসাধারণ বোলিং নৈপুণ্যে সে আশা পূরণ হয়নি। ১৩ ওভারে ২ উইকেটে ১২৪ রান থেকে নির্ধারিত ২০ ওভার সংগ্রহ ৯ উইকেটে ১৭৬ রান। সাকিব আল হাসান ৩১ বলে ৩৮ রান করে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন। শেষের দিকে মুশফিকের ৬ বলে ১৫ রানের ইনিংসটি বাংলাদেশকে ১৭৬ রানের বড় সংগ্রহ দাঁড় করাতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশের বড় সংগ্রহের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ান লাসিথ মালিঙ্গা। প্রথম ৩ ওভারে ৩০ রান দেওয়া লাসিথ মালিঙ্গা নিজের শেষ ওভার করতে বল হাতে তুলে নেন ইনিংসের ১৯তম ওভারে। এর আগের ওভারের শেষ দুই বলে ১০ রান নিয়ে ব্যাট হাতে ক্রিজে ছিলেন মুশফিকুর রহিম। লাসিথ মালিঙ্গা নিজের প্রথম ৩ ওভারে পিটুনি খেয়ে শেষ ওভারে টানা স্লো ইয়র্কার দিতে থাকেন। ওভারের তৃতীয় বলে মুশফিককে প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠিয়ে ম্যাচে নিজের প্রথম উইকেট শিকার করে নেন তিনি। মুশফিকের আউটের পর ক্রিজে আসেন শেষ টি-টুয়েন্টি খেলা মাশরাফি বিন মর্তুজা। দ্রুত রান তোলার তাগিদে থাকা মাশরাফি প্রথম বলেই গোল্ডেন ডাকে আউট হয়ে ব্যাট হাত আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটে নিজের শেষ ইনিংসটিকে স্মরণীয় করে রাখতে পারেননি।
মাশরাফিকে আউট করে লাসিথ মালিঙ্গা নিজের প্রথম টি-টুয়েন্টি হ্যাট্রিকের সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলেন। তার হ্যাট্রিক বল মোকাবেলা করতে ক্রিজে আসেন অভিষিক্ত মেহেদি হাসান মিরাজ। মালিঙ্গার স্লো বল ব্যাটে-বলে করতে না পেরে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়েন মিরাজ। সেইসাথে লাসিথ মালিঙ্গা আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টিতে নিজের প্রথম হ্যাট্রিক পূরণ করেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে লাসিথ মালিঙ্গার এটি চতুর্থ হ্যাট্রিক, এর আগে ওডিআইতে তিনবার হ্যাট্রিকের স্বাদ পেয়েছেন তিনি।
মাশরাফির বিদায়বেলায় শ্রীলঙ্কাকে জয়ের জন্য ১৭৭ রানের লক্ষ্য ছুড়ে দেয় বাংলাদেশ। অধিনায়ক মাশরাফি প্রথম ওভার তুলে দেন সাকিব আল হাসানের হাতে। ক্রিজে তখন প্রথম ম্যাচের নায়ক কুশাল পেরেরা। সাকিবের করা প্রথম বলেই চার হাঁকান কুশাল পেরেরা, দ্বিতীয় বলে সরে মারতে গিয়ে বোল্ড হয়ে যান বিপদজনক এই ব্যাটসম্যান। সাকিবের করা দ্বিতীয় ওভারের দৃশ্যপটও প্রায় একই। ওভারের প্রথম বলে চার হাঁকানো অপর ওপেনার দিলশান মুনাবিরা তৃতীয় বলে তুলে মারতে গিয়ে রিয়াদের হাতে ধরা পড়েন।
অধিনায়ক থারাঙ্গা এবং অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান চামারা কাপুগেদারা এরপর উইকেটে থিতু হওয়ার চেষ্টা করেন। তৃতীয় উইকেট জুটিতে ২১ রান যোগ করার পর রিয়াদের করা ইনিংসের ৫ম ওভারের ৫ম বলে দ্রুত রান তোলার তাগিদে থারাঙ্গা (২৩) ক্যাচ দিয়ে বসেন মিরাজের হাতে।
৪০ রানে টপ অর্ডারের তিন ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে বিপাকে পড়ে যায় শ্রীলঙ্কা। মাশরাফি পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে মুস্তাফিজুর রহমানকে আক্রমণে আনেন। নিজের প্রথম বলেই মুস্তাফিজ প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠান গুনারত্নকে। গুনারত্নে কিছুদিন আগেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একাই একটি টি-টুয়েন্টি ম্যাচ জেতান। ক্রিজে থাকলে বিপদজনক হতে পারতেন তিনি। গুনারত্নে আউট হওয়ার পরের বলে শ্রীওয়ার্ধনেকেও সৌম্য সরকারের ক্যাচে পরিণত করেন মুস্তাফিজুর রহমান। দুই বলে দুই উইকেট নিয়ে মুস্তাফিজ জাগিয়ে তোলেন হ্যাট্রিকের সম্ভাবনা। থিসারা পেরেরা দেখেশুনে মুস্তাফিজের হ্যাট্রিক বলটি মোকাবেলা করেন, ততক্ষণে শ্রীলঙ্কা ৪০ রান তুলতেই ৫ উইকেট হারিয়ে বসে।
চামারা কাপুগেদারা এবং থিসারা পেরেরা বিপর্যয় কাটিয়ে আস্তে আস্তে বিপদজনক হয়ে উঠছিলেন। ৬ষ্ঠ উইকেট জুটিতে তারা যোগ করেন ৫৮ রান। দুজনেই আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান, তাই দ্রুত জুটি না ভাঙতে পারলে অঘটন ঘটতে পারতো। এই জুটি ভাঙার জন্য মাশরাফি বল তুলে দেন সাকিব আল হাসানের হাতে। নিজের প্রথম দুই ওভারে দুই উইকেট নেওয়া সাকিব তার কোটার তৃতীয় ওভারের ৫ম বলে থিসারা পেরেরাকে স্ট্যাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন। থিসারা পেরেরা আউট হওয়ার আগে ২৩ বলে ২৭ রান করেন।
ইনিংসের ১৬তম ওভার, বল হাতে মাশরাফি বিন মর্তুজা। টি-টুয়েন্টিতে মাশরাফির শেষ ওভার, ব্যাটিংয়ে সেকুগে প্রসান্না এবং চামারা কাপুগেদারা। দুজনেই বিপদজনক ব্যাটসম্যান। জয় নিশ্চিত করতে হলে তাদের জুটি ভাঙা দরকার। ক্যারিয়ারে অনেকবার ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে জুটি ভাঙার অভিজ্ঞতা আছে মাশরাফির ঝুলিতে। যেতে যেতেও সেই কাজটি করলেন তিনি, সেকুগে প্রসান্নাকে নিজের দ্বিতীয় শেষ বলে বোল্ড করে বাংলাদেশের জয় একপ্রকার নিশ্চিত করেন।
শ্রীলঙ্কাকে তখন জেতাতে হলে কাপুগেদারাকে খেলতে হবে অকল্পনীয় ইনিংস। কিন্তু মুস্তাফিজুর রহমান আক্রমণে এসে ৩৫ বলে ৫০ রান করা কাপুগেদারাকে প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠান। নিজের তৃতীয় ওভারের শেষ বলে মালিঙ্গাকে বোল্ড করে নিজের চতুর্থ শিকারে পরিণত করেন তিনি। শ্রীলঙ্কার সংগ্রহ তখন ৯ উইকেটে ১২৪ রান। পরের ওভারে সঞ্জায়াকে আউট করে বাংলাদেশের ৪৫ রানের জয় নিশ্চিত করেন সাইফুদ্দিন।
সাকিব আল হাসান ৩৮ রান এবং ৩ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতে নেন। সিরিজ সেরা নির্বাচিত হন লাসিথ মালিঙ্গা।
শ্রীলঙ্কার আর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে মাশরাফির বিদায়ী ম্যাচে তার সতীর্থরা ছিলেন বাঘের চেয়ে ক্ষিপ্র। একেকটা রান বাঁচানোর জন্য সবার চেষ্টা ছিল অন্যদিনের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। মাঠে নিজেদের শতভাগ উজাড় করে দিয়ে মাশরাফির শেষ টি-টুয়েন্টি ম্যাচে তারা দেশবাসীকে জয় উপহার দেন। ব্যক্তি মাশরাফি অবশ্য আগেই বলেছেন, শেষ ম্যাচে স্মরণীয় জয় পেতে হবে তা না। সবাই প্রতিদিন জয়ের জন্যই খেলেন।