“আর ব্যাপারটা কি জানো? বলটা এখনও একই দূরত্বেই যাচ্ছে।”
কথাটা বলেছিলেন ডেভিড ওয়ার্নার, সেই ২০১৭ সালে যখন এমসিসি (মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব) ব্যাটের আকারের ওপর নানা নিয়ম পরিবর্তন করতে শুরু করল। আর এই নিয়ম পরিবর্তনের স্রোতেই ওয়ার্নারের গ্রে-নিকোলসের ব্যাটটাই হয়ে উঠল সবার আলোচনার মধ্যবিন্দু। হবে না-ই বা কেন? কাবুম নামের এই ব্যাটটা ছিল প্রায় ৮৫ মিলিমিটার মোটা, আর চওড়ায় প্রায় ৫০-৬০ মিলিমিটার। অবশ্যই সেই সময়ে বড় ব্যাট ব্যবহারের তালিকায় ওয়ার্নারের নামটাই একমাত্র নাম ছিল না, কিন্তু ‘অন্যতম’ বলতেই হবে।
“ব্যাটের আকারের ওপর কড়াকড়ি আরোপের সময় সম্ভবত চলে এসেছে।”- এমসিসি কমিটির চেয়ারম্যান মাইক ব্রিয়ারলি সে সময় ঠিক এভাবেই ব্যাটের আকারের ওপর নিয়ম আরোপের ব্যাপারে বলেছিলেন,
“এটা তো অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। ১৯০৫ সাল নাগাদ ব্যাটগুলি ছিল প্রায় ১৬ মিলিমিটার চওড়া। ১৯৮০ সালে এসে সেটি ১৮ মিলিমিটার হয়ে গেল। আর এখন তো এটি পেশাদার ক্রিকেটে গড়ে ৩৫-৪০ মিলিমিটার হয়ে থাকে, কখনও কখনও তো এটি ৬০ মিলিমিটারও দেখা যাচ্ছে। আর এটাই প্রমাণ করে, পরিবর্তনগুলি কত দ্রুত ঘটে যাচ্ছে।”
আর এরপর নিয়ম যেটা দাঁড় করানো হলো, সেটা অনেকটা এমন – ব্যাটের প্রান্ত ৪০ মিলিমিটারের বেশি চওড়া হতে পারবে না, আর ব্যাটের প্রস্থ কোনোভাবেই ৬৭ মিলিমিটারকে অতিক্রম করতে পারবে না।
তবে ব্যাটের যে জায়গাটা কোনোরকম নিয়মের বেড়াজালে আটকে যায়নি, সেটা হলো সুইট স্পট। আর এ কারণেই ডেভিড ওয়ার্নার বলেছিলেন, এত নিয়ম আরোপের পরও বলটা তো আসলে এখনও একই দূরত্বেই যাচ্ছে। ধারাভাষ্যকারেরা অবশ্য এখন ব্যাটের মাঝের এই সুইট স্পটের অংশটা বড় হওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু ব্যাপারটা কি আসলেই তাই?
সুইট স্পট
সুইট স্পটের সবচেয়ে সহজ সংজ্ঞা দিতে হলে বলতে হবে, ব্যাটের যে জায়গাটাতে বল লাগলে সবচেয়ে বেশি জোরে আঘাত করে আর ব্যাটারের হাতেও সবচেয়ে কম ভাইব্রেশন অনুভূত হয়, সেটাই সুইট স্পট। তবে ব্যাটের কোণা আর প্রস্থ যখন বেশি চওড়া হয়ে যাচ্ছে, তখন ধারভাষ্যকারদের সাথে কিন্তু আমাদের একমত হতেই হবে – ব্যাটের সুইট স্পট আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। আর তাই কোনো একটা শট খেলার পর সেটা মিসশট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও কমে যাচ্ছে। কিন্তু এরপরও আমাদের এটাও মানতে হবে, ব্যাটের এই বড় সুইট স্পটের মধ্যেও মাত্র একটা অংশই থাকে যেটাকে আমরা ইংরেজিতে Best Part বলতে পারি!
তবে সুইট স্পট নিয়ে লেভার এন্ড উড এর স্থপতি ও ব্যাট প্রস্তুতকারক জেমস লেভারের মন্তব্যটা কিন্তু একটু আলাদা। তিনি মনে করেন, ব্যাটের মাঝে বড়সড় সুইট স্পট পাওয়ার আসলে তেমন কোনো উপায় নেই,
“ব্যাটের গড়নটাই এমন যে সেটা আপনাকে এত বড় সুইট স্পট এনে দিতে পারবে না। একটা ব্যাটে একটা নির্দিষ্ট আকারের চেয়ে বেশি সুইট স্পট থাকতে পারে না।”
ব্যাটের বলবিদ্যা বুঝতে হলে অবশ্য আমাদের আগে তাকাতে হবে ব্যাটের আকারের দিকে। দিনের পর দিন ব্যাটের আকার শুধু বড়ই হয়নি, বরং বাঁকাও হয়েছে বেশ। ১৯৯০ এর দিকের ব্যাটগুলি যেখানে সোজাসাপ্টা লম্বাকৃতির ছিল, এখনকার ব্যাটগুলি সেখানে কিছুটা বাঁকা করেই তৈরি করা হচ্ছে। তার অর্থ কিন্তু পরিষ্কার – ব্যাট তৈরিতে এখন আগের চাইতে বেশি কাঠের দরকার হচ্ছে। তবে ব্যাট প্রস্তুতকারকদের মতে এই বাঁকা আকৃতির ব্যাটের পেছনে যুক্তি অবশ্য একটু ভিন্ন। তারা মনে করেন, এটা শুধু শট খেলার জন্যেই নয়, বরং ব্যাটটাকে ব্যবহার করতে ও তুলতেও ব্যাটারের কাজকে সহজ করে দেয়।
“সুইট স্পটটাই হলো ব্যাট-বলের সংঘর্ষের জন্য সুষ্ঠু জায়গা, যেটা সাধারণত গোড়া থেকে ১৫০-১৬০ মিলিমিটার উপরে রাখা হয়।”
কথাগুলি বলছিলেন কোকাবুরা ব্যাট প্রস্তুতকারকদের একজন ল্যাকলান ডিংগার, যিনি ল্যাবুশেইন, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, অ্যালিসা হিলির ব্যাট নিয়ে কাজ করেন। ডিংগার অবশ্য মনে করেন, ব্যাটের সব জায়গায় উইলো রাখলেই হবে না। সেটা একজন ব্যাটারের জন্যে সুবিধাজনক হবে না।
তবে ব্যাটটাকে যদি একটা লেভার এর সাথে তুলনা করি, তাহলে দেখা যায় – ব্যাটের সুইট স্পট আসলে প্রস্থের উপরে নয়, বরং নির্ভর করে ব্যাটের দৈর্ঘ্যের উপরে। ব্যাটের দৈর্ঘ্য যদি সর্বোচ্চ ৯৬৫ মিলিমিটার হয়, তাহলে ব্যাটের সেন্টার অফ পারকাশন (যে জায়গাতে আঘাত করলে বল সবচেয়ে জোরে যায়) খুব একটা পরিবর্তন হয় না। ডিংগারই যেমনটা বলেছেন,
“আমরা এখন যে পরিবর্তন নিয়ে কাজ করি, সেটা হলো ব্যাটে যেন ভরের বিন্যাস ঠিকঠাক হয়। এতেই ব্যাটের সুইং আর শট ব্যাটারের জন্যে সবচেয়ে সুবিধাজনক হয়।”
তবে অনেকে মনে করে থাকেন, ব্যাটে কাঠের পরিমাণ বৃদ্ধি করলেই বুঝি ব্যাটটা একটা ভাল ব্যাট হয়ে যাবে। কিংবা ব্যাটের বলে আঘাত করার ক্ষমতা বাড়বে। ব্যাপারটা কিন্তু আসলে মোটেও সত্যি নয়। কিংবদন্তী ক্রিকেটার স্যার ভিভ রিচার্ডসের ব্যাটের ভর ছিল মাত্র ১,১০০ গ্রাম। এমনকি ওয়ার্নারের যে ব্যাট নিয়ে এতসব কাণ্ড ঘটে গেল, চওড়া হওয়া সত্ত্বেও ওয়ার্নারের সেই গদা আকৃতির ব্যাটের ভর ছিল মাত্র ১,১৯০ গ্রাম। তাই এটা অনুমিতভাবেই বলা যায়, ক্রিকেটের দুই প্রজন্মের দুই মারকুটে ব্যাটার ভিন্ন ভিন্ন আকৃতির ব্যাট নিয়ে মাঠে মাতম দেখালেও দু’জনের ব্যাটের ভরে আসলে খুব একটা পার্থক্য ছিল না।
আর তাই বড় ব্যাট বলতে ব্যাটারদের যদি কিছু সুবিধা দেয়, সেটা একমাত্র মনস্তাত্ত্বিক সুবিধা। ব্যাটার মনে করেন, ব্যাটের আকৃতি বড় হলে বোলারের ছোঁড়া বলে তিনি সহজে বেশি বাউন্ডারি পাবেন। লিয়াম লিভিংস্টোনই ইএসপিএন ক্রিকইনফোকে যেমনটা বলছিলেন,
“আপনি আপনার ব্যাটের দিকে তাকিয়েই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হতে চাইবেন। ৮০ গজের বাউন্ডারি তো আপনাকে পার করতে হবে।”
কিন্তু সবচাইতে বড় সত্যিটা হল, বাউন্ডারি মারার সক্ষমতা সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে ব্যাটারের বিগ-হিটিংয়ের ক্ষমতার ওপর, এই সংক্রান্ত অনুশীলনের ওপর। সেখানে পুরোপুরিভাবে ব্যাটের ওপর নির্ভর করা কিংবা ব্যাটকেই সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দেওয়াটা আসলে বাহুল্যই হয়ে যায়।
ব্যালেন্স পয়েন্ট ইন্ডেক্স
ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের লেভেল-থ্রি কোচ শ্যানন ইয়ং। শ্যানন মনে করেন ব্যাটারের জন্যে বায়োমেকানিক্স আর সুইং ডিনামিক্স বোঝাটা জরুরী,
“আমাদের বায়োমেকানিক্স এবং সুইং ডিনামিক্স বুঝতে হবে। সবাই মনে করে, যদি আমি ব্যারি রিচার্ডসের হাতে ডেভিড ওয়ার্নারের ব্যাট দিই কিংবা ব্র্যাডম্যান যদি আধুনিক ক্রিকেটের কোনো ব্যাট দিয়ে ব্যাট করেন, তাহলে হয়তো তারা নিজেদের সময়ের চাইতে বেশি বাউন্ডারি মারতে পারবেন। কিন্তু আমি মোটেও সেটা মনে করি না। আমার কাছে ব্যাটারের ডিনামিক্সটাই আসল।”
শ্যানন ইয়ং-এর কিন্তু আরও অনেক পরিচয় আছে। তিনি কোকাবুরার পাশাপাশি ব্যাট-ফিটার (যারা ক্রিকেটারদের জন্যে কাস্টমাইজড ব্যাট তৈরি করে) ও ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড মুরাবিন-এর প্রতিষ্ঠাতা ক্রিস হলের সাথে কাজ করেন। ইয়ং আর হল দু’জনে মিলে আবার মেলবোর্নে প্রতিষ্ঠা করেছেন ক্রিকেট পারফরম্যান্স ল্যাব। আর এই ল্যাবেই ব্যাট-ফিটিং এর জন্যে একটা মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করেছেন তারা, নাম দিয়েছেন ব্যালেন্স পয়েন্ট ইন্ডেক্স (বিপিআই)।
“বিপিআই আসলে শুরু হয়েছিল বেসবলের জন্যে। বেসবল খেলোয়াড়দের জন্যে এই মানদণ্ড সেট করা হয়েছিল এটা বুঝতে যে কেন একটা ব্যাট দিয়ে মারা শট অন্য ব্যাটের চাইতে বেশি বা কম দূরে যায়” – বলছিলেন ক্রিস হল।
ব্যাটের নিচের অংশ যত বেশি চওড়া হবে, ব্যাটের বিপিআই হবে তত বেশি। তবে এই বিপিআই বেশি হওয়ার ব্যাপারটা যদি সাদামাটাভাবে বোঝাতে হয়, তাহলে বলতে হবে – যে ব্যাটের বিপিআই যত বেশি হবে, সেই ব্যাটের বলকে আঘাত করতে শুরুতে বেশি বল (Force) লাগবে। প্রাসঙ্গিক উদাহরণেই জানিয়ে রাখি, গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের ব্যাটের বিপিআই ৮৭, যেটা কি না বিপিআই স্কেলে সবচেয়ে উপরের রেঞ্জ আর তর্কাতীতভাবে এটাই হার্ড-হিটিং ব্যাটের বিপিআই। তবে ল্যাবে পরীক্ষার সময় ক্রিস হল কিন্তু একটু ভিন্ন ফলাফলই পেয়েছিলেন। ল্যাবে পরীক্ষামূলক অনুসন্ধানে হল দেখেছিলেন, একটা ব্যাটের বিপিআই যত বেশি হবে, ব্যাটারের পারফরম্যান্স তত খারাপের দিকে যাবে। তিনি এ-ও পেয়েছিলেন, ব্যাটারের ব্যাটের আকারের ওপর পারফরম্যান্সের খুব একটা হাত নেই। হলের ভাষ্যমতে,
“ব্যাটের আকার যত বড়, পারফরম্যান্স তত ভাল – এই লাইনটা একটা মিথ ছাড়া কিছুই না।”
তবে বলের ওপর ব্যাট কত জোরে আঘাত করবে, সেটা নিয়ে ইয়ংয়ের ধারণা একটু ভিন্ন। তিনি বলেন,
“সাধারণত কী মনে করা হয়, যদি কোনো জিনিস হালকা হয়, তাহলে আমরা ওটাকে দ্রুত মুভ করাতে পারি, ফলে এটা অন্য কিছুর ওপর বেশি বল প্রয়োগ করতে পারে। আর অনুমিতভাবেই যার ওপর বেশি বল প্রয়োগ করা হয়, সেটা বেশি দূরে যায়। কিন্তু ব্যাপারটা কী জানেন? আমরা কিন্তু ল্যাবে পেয়েছি ঠিক এর উল্টো। আমরা পেয়েছি, ঠিকঠাক ক্রিকেট ব্যাট পেতে হলে আপনাকে ঠিকঠাক বিপিআই-এর দিকে নজর দিতে হবে। বেশি হালকা ক্রিকেট ব্যাট ব্যবহার করলে ব্যাট প্রয়োজনের চাইতে বেশি দ্রুতই মুভ করে।”
তবে ব্যাট যারা প্রস্তুত করেন, তারা কিন্তু নজর দেন সেই প্রথমে বলা সুইট স্পটের দিকেই। সুইট স্পটের জায়গাটা জোরালো হয়, ব্যাটের ভর যেন ব্যাটারের জন্য সহনশীল হয় আর বলকে যেন জোরে আঘাত করতে পারে, সেটাই প্রস্তুতকারকদের মূল উদ্দেশ্য থাকে। তবে এর জন্য ভরের বিন্যাসটাও তো জরুরী।
আধুনিক ব্যাট
আধুনিক ক্রিকেটে ব্যাটের এই বড় আকৃতির পিছনে অনেকে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের দায় দেখতে পান। তবে ব্যাটের আকার-আকৃতি কিন্তু ফুলেফেঁপে ওঠা শুরু করেছে ক্রিকেটে টি-টোয়েন্টি যুগ আসারও আগে থেকে। ভারতীয় ক্রিকেট সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক সান্সপ্যারেইল গ্রিনল্যান্ড-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ও মার্কেটিং ডিরেক্টর পরশ আনন্দ যেমনটা মনে করেন,
“নব্বই দশক অব্দি ক্রিকেটাররা ব্যাটের আকৃতি নিয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিল না। আর এরপর নব্বই দশকের শেষের দিকে শচীন যখন প্রায় ১,৩৫০ গ্রামের এক ব্যাট নিয়ে ব্যাটিং করতে নামলেন, তখনই ব্যাটের আকার-আকৃতি নিয়ে হইচই শুরু হল। শচীন যেখানে তখন ১,৩৫০ গ্রামের এক ব্যাট নিয়ে ক্রিজে নেমে গেলেন, সে সময় অন্যরা কেবল ১,১৫০ থেকে সর্বোচ্চ ১,২০০ গ্রামের ব্যাট নিয়ে নেমে যাচ্ছে। আর সাধারণত ১,৩৫০ গ্রামের একটা ব্যাটের আবেদন ১,১৫০ গ্রামের একটা ব্যাটের চাইতে অনেক আলাদা হবে, এটাই স্বাভাবিক।”
শচীন টেন্ডুলকার যে ব্যাটটা নিয়ে নেমে পড়েছিলেন, সেটা ছিল অন্য সব ব্যাটের চাইতে আলাদা। ব্যাটের কোণার দিকটা ছিল একটু চওড়া, ব্যাট ছিল একটু বেশিই ভারী। আর শচীনের এই ব্যাট ব্যবহারের সময়ই ২০০১ সালে ভারত সফরে আসে অস্ট্রেলিয়া। সেই সফরের সময়ই অস্ট্রেলিয়ানরা শচীনের ব্যাট দেখে অনুপ্রাণিত হন। পরশ আনন্দ বলেন, সেই সময়ই অস্ট্রেলিয়ার সেরা ক্রিকেটারদের কাছ থেকে তিনি শচীনের মতো ব্যাট তৈরি করে দেওয়ার অনুরোধ পেয়েছিলেন। আর দ্রুতই ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার এই বড় ব্যাট ব্যবহারের ধারণাটা ছড়িয়ে পড়ে পুরো ক্রিকেট দুনিয়াতে। দ্রুতই বড় আর ভারী ব্যাট ব্যবহার একটা ট্রেন্ডে পরিণত হতে শুরু করে। ভারতীয়দের মধ্যেই রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষ্মণ আর বীরেন্দর শেবাগ শচীনের পদানুসরণ করেন।
“আর ওটাই ছিল ব্যাটের বিবর্তন। ব্যাটগুলি আস্তে আস্তে ভারী আর মোটা হতে শুরু করে। আর সবচেয়ে বড় কথা, ক্রিকেটের বড় নামগুলি যখন এই ভারী ব্যাট তৈরির অনুরোধ জানাতে শুরু করে, ব্যাট প্রস্তুতকারকেরাও আস্তে আস্তে নড়েচড়ে বসেন। আসলে ওদের নড়েচড়ে বসতেই হতো। যদিও এই ট্রেন্ডে কোনো ব্যাটই সেসময় ১২০০ গ্রামের বেশি ভারী করে বানানো হয়নি। আর ২০০২-০৩ সালের এই ট্রেন্ডের ফলাফলই শেষ অব্দি ওয়ার্নারের ঐ গদা আকৃতির ব্যাট” – বলছিলেন পরশ আনন্দ।
তবে কোকাবুরা কিন্তু ঠিকই একসময় এমন ব্যাট বানানো শুরু করল, যেগুলির কোণার দিকটা ৫০ মিলিমিটার চওড়া। উসমান খাজাই একসময় যে Gray Nicolls XP80 ব্যাট ব্যবহার শুরু করেন, সেটিই ছিল নিচের কোণার দিকে প্রায় ৮০ মিলিমিটার চওড়া। তবে আপনি যদি ভেবে থাকেন, ব্যাটের এই বড় আর ভারী হওয়ার ব্যাপারটা বিগ হিটিং-এর জন্যে সুবিধাজনক, তাহলে কিন্তু ভুল ভাববেন। আমি বরং আপনার এই ভাবনার বিপরীতেই জানিয়ে রাখি, এমসিসির ২০১৭ সালের ব্যাটের আকারের ওপর এই কড়াকড়ি আরোপের পরই বরং ক্রিকেটে ছয়ের হার বেড়ে গেছে। অন্তত নিচের এই পরিসংখ্যান সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে।
২০০৭ সাল থেকে ২০১২ সাল অব্দি প্রতি পঞ্জিকাবর্ষে সব ফরম্যাট মিলিয়ে গড়ে ইনিংসপ্রতি ছয়ের সংখ্যা ছিল ২.৫ থেকে ৩.১। ২০১৩ সালে এসে সেটা উঠে যায় ৩.২তে। আর এরপর থেকে মাত্র এক বছরই সেটা ৩.৭-এর নিচে নেমেছে।
তবে ব্যাটের আকৃতি নিয়ে সাবেক ইংরেজ ব্যাটার মার্ক বুচারের মতামত আবার এই পরিসংখ্যানকেই সাক্ষ্য দেয়। তিনি বলেন, ২০০১ সালে হেডিংলিতে এক ম্যাচে তিনি যে ‘ওল্ড স্টাইল’ ব্যাট নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন, সেটা এই আধুনিক ব্যাটগুলির চাইতে অন্তত দশগুণ ভাল।
ব্যাট প্রস্তুতিতেও বেশ খানিকটা পরিবর্তন কিন্তু এরপরই হয়ে গেছিল। যেমন, ব্যাট যদি হালকা হয় তাহলে ব্যাট তৈরির সময় ঘনত্বের দিক থেকে ছাড় দিতে হয়। আর আধুনিক ব্যাটগুলিতে যেটা হচ্ছে, ব্যাটগুলির মেয়াদকাল কমে যাচ্ছে। ব্যাটগুলি টিকছে আগের চাইতে অনেক কম সময়। এসজির একটা ব্যাট দিয়ে এখন টেস্টে গড়ে ৮০০ থেকে ১০০০ রান করা যায়। তবে টি-টোয়েন্টির ক্ষেত্রে কিন্তু এখানে একটা বড় পরিবর্তন আছে।
“টি-টোয়েন্টির ক্ষেত্রে কিন্তু একটা ব্যাট দিয়ে গড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ রানের বেশি করা যায় না,” পরশ আনন্দই বলছিলেন, “কারণ এই ফরম্যাটে আপনি একটা ইয়র্কারকেও মারার চেষ্টা করবেন। কিন্তু আপনি যদি ২০ বছর আগে ফেরত যান, যখন কোনো টি-টোয়েন্টি ছিল না, তখন যদি বোলার একটা ইয়র্কার দেয়, ব্যাটার নিশ্চিতভাবেই ডিফেন্ড করবে। আর এ কারণেই ব্যাটের মেয়াদকালও টি-টোয়েন্টির কারণে কমে যাচ্ছে।”
তবে ব্যাট প্রস্তুতকারকেরা আধুনিক ক্রিকেটে আরো যে পরিবর্তনটা দেখতে পাচ্ছেন সেটা হল, এখনকার ক্রিকেটাররা আলাদা আলাদা কন্ডিশনের জন্যে আলাদা আলাদা ব্যাট ব্যাবহার করতে আগ্রহী নন। সব কন্ডিশনের জন্যেই তারা একই রকম ব্যাট ব্যাবহার করছেন, যেগুলির বেশিরভাগেই কোণার দিকটা একটু চওড়াই রাখা হয়। আর এ কারণেই ২০০১ সালে রাহুল দ্রাবিড় যে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের জন্যে আলাদা ব্যাট নিয়ে সফল হয়েছিলেন, এমন উদাহরণ আর খুব একটা দেখা যায় না।
তবে এই দেখা না যাওয়ার পেছনে অবশ্য অন্য কারণকেও দাঁড় করানো যায়। ক্রিকেটে এখন আগের চাইতে ফরম্যাট যেমন বেড়েছে, তেমনই বেড়েছে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের দৌরাত্ম্য। এভাবে আলাদা আলদা টুর্নামেন্টে যদি আলাদা আলাদা ব্যাট ব্যাবহার করতে হয় তাহলে সেটা ক্রিকেটারদের জন্যে বেশ ঝক্কিই হয়ে যায় ।
১৯৮০ সালের একজন ক্রিকেটারের সাথে আধুনিক ক্রিকেটের একজন ক্রিকেটারের বেশ পার্থক্যই রয়েছে। সে সময় ব্যাটারের ‘ফলস শট’ যেমন বেশি হতো, টেকনিকেও বেশিরভাগ ব্যাটার ছিল এখনকার ব্যাটারের চাইতে দুর্বল। আর তাই ‘বড় ব্যাট মানেই ভাল ব্যাট’ কি না, এই প্রশ্নের আসলে কোনো উত্তর নেই। বরং ক্রিকেটারের ভুলের সংখ্যা কমানো আর ব্যাট টেকনোলজির সুইট স্পটের দিকে নজর দিলেই একজন ব্যাটার পারবেন তার রানের সংখ্যা বাড়াতে, বেশি বেশি বাউন্ডারি হাঁকাতে।
আর তাই ভালো ব্যাটের বেশি রানের একটাই উত্তর – সুইট স্পট!