১.
হোম এবং অ্যাওয়ে লেগের যে ম্যাচগুলো হয়, তাতে অ্যাওয়ে গোল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো দল অ্যাওয়ে ম্যাচে ২-০ গোলে হারার চেয়ে ৩-১ গোলে হারার ফলাফলটাকে বেশি মূল্য দেয়। কারণ, উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবধান ২ গোলের হলেও একটি অ্যাওয়ে গোলের কল্যাণে হেরে যাওয়া দলটি ঘরের মাঠে ২-০ গোলে জিতলেও পরের পর্বে যেতে পারবে। ঠিক এই কারণেই বার্সেলোনা প্রথম লেগে চেলসির মাঠে গিয়ে ১-১ গোলে ড্র হওয়া ম্যাচটিকে নিয়ে মোটেও অখুশি নয়। মূল্যবান অ্যাওয়ে গোলটি থাকার সুবাদে ঘরের মাঠের পরের লেগের ম্যাচটি গোলশূন্য ড্র হলেও পরের পর্বে চলে যাচ্ছে বার্সেলোনা। অন্যদিকে ম্যাচটিকে ন্যূনতম টাইব্রেকারে নিয়ে যেতে হলেও একটি গোল করতে হবে চেলসিকে।
নিঃসন্দেহে ম্যাচটি শুরুর আগে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে বার্সেলোনা। গোলশূন্য ড্র করার জন্য প্রথম যে জিনিসটি প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে বলের দখল রাখা। এই দিকটাতে বার্সেলোনা বরাবরই অন্য দলগুলোর চেয়ে এগিয়ে। পজিশনাল ফুটবল খেলে থাকায় বার্সেলোনার খেলোয়াড়দের পায়েই বল সবসময়ই বেশি থাকে। গত লেগের ম্যাচের রিপোর্টটাই দেখুন। পুরো ম্যাচে বার্সেলোনার পায়ে বল ছিল ৭৩% সময়ে, বিপরীতে চেলসির খেলোয়াড়দের পায়ে বল ছিল মাত্র ২৭% সময়। যেহেতু বার্সেলোনা ‘স্লো বিল্ড আপ’ পদ্ধতিতে খেলার চেষ্টা করে, কাজেই পরিসংখ্যানটি অস্বাভাবিক নয়। এই দিকটা নিঃসন্দেহে বার্সেলোনাকে পরের লেগেও বাড়তি একটা সুবিধা দেবে।
তবে সমস্যা হচ্ছে, এই দিকগুলোর বিষয়ে চেলসিও সচেতন। তারাও ম্যাচের আগেই জানে, কোন দিকটিতে বার্সেলোনা এগিয়ে আছে আর কোন দিকটিতে তারা নিজেরা পিছিয়ে। ২৭% বলের দখল থাকা সত্ত্বেও গত ম্যাচের ফলাফল কিন্তু শেষপর্যন্ত ড্র-ই। ফুটবল ম্যাচে সারাদিন বল নিয়ে ঘোরাঘুরি করার চেয়ে যতটুকু সুযোগ পাওয়া যাবে সেটাকে কাজে লাগানোটাই দক্ষতার পরিচায়ক। সেই কাজটি চেলসি করতে পারবে না, সেটা বলাটা বোকামিই হয়ে যায়।
একটি যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ জেতার জন্য সৈন্যবাহিনীর সাথে সাথে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেনাপতির কৌশল। অনেক শক্তিশালী সেনাবাহিনীকেও শুধুমাত্র কৌশল দিয়ে পরাস্ত করার রেকর্ড ইতিহাসে রয়েছে। এই কৌশলের দিক থেকে ভালবার্দের চেয়ে কন্তে নিঃসন্দেহে একটু বেশি মাত্রায় পরীক্ষিত। তবে ভালবার্দের সুবিধার জায়গাটি হচ্ছে, তার দলেই রয়েছে বর্তমান বিশ্বের সেরা দুই খেলোয়াড়ের একজন লিওনেল মেসি। এই জাদুকর যেদিন জ্বলে উঠবেন, সেদিন বিশ্বের কোনো কৌশলই কাজে লাগবে না। এছাড়া চেলসির বিপক্ষে যে গোলশূন্যের রেকর্ডটি ছিল, সেটিও গত ম্যাচে ভেঙে ফেলেছেন মেসি। ঘরের মাঠে তাই মেসিসহ বার্সেলোনাকে হারানো কিংবা ন্যূনতম দুই গোল করে ড্র করাটা আপাতদৃষ্টিতে স্বপ্ন দেখারই মতো। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই বার্সেলোনা বর্তমান মৌসুমে এখন পর্যন্ত অপরাজিত।
আর চেলসি যেন গত মৌসুমের তুলনায় অনেকটাই অচেনা। ইতোমধ্যেই লিগ শিরোপা হাতছাড়া, ইএফএল কাপ থেকে সেমিফাইনালেই তারা বাদ পড়েছে আর্সেনালের কাছে হেরে। অন্যদিকে বার্সেলোনা আছে দুর্দান্ত ফর্মে। কোনো অঘটন না ঘটলে লিগ মোটামুটি নিশ্চিত, কোপা দেল রের ফাইনালেও পৌঁছানো হয়ে গিয়েছে। একমাত্র ক্লাব হিসেবে দুবার ট্রেবল জেতা দলটি স্বাভাবিকভাবেই চাইবে রেকর্ডটা আরেকটু ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যেতে।
২.
ঠিক এই কারণটিতেই চেলসিকে নিয়ে কিছুটা চিন্তিত বার্সেলোনা। আহত বাঘ সবসময়ই ভয়ঙ্কর। এর সাথে চেলসির জন্য যুক্ত হয়েছে ট্রফিবিহীন মৌসুম কাটার একটা সম্ভাবনা। এই মুহূর্তে চেলসি নিশ্চয়ই তাদের সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করবে টুর্নামেন্টে টিকে থাকবার, যেহেতু তাদের আর কোনো ট্রফি জেতার সম্ভাবনা কম।
তবে ম্যাচটি বার্সেলোনার মাঠে হওয়াতে সাম্প্রতিক কিছু ইতিহাস চেলসির জন্য একবারেই আশা জাগাচ্ছে না। বার্সেলোনা সর্বশেষ হোম ম্যাচে হেরেছে ২১ ম্যাচ আগে, রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে সুপার কাপে গত বছরের ১৪ই আগস্টে। এই সময়ে তারা ড্র করেছে মাত্র দুটি ম্যাচে।
বিপরীতে চেলসি তাদের সর্বশেষ চারটি অ্যাওয়ে ম্যাচেই হেরেছে যথাক্রমে ম্যানচেস্টার সিটির কাছে ১-০, ইউনাইটেডের কাছে ২-১, ওয়াটফর্ডে কাছে ৪-১ এবং আর্সেনালের কাছে ২-১ গোলে।
এই দুটি ইতিহাসই চেলসিকে যদি হতাশা জোগায়, তাহলে আশা জাগানোর মতো একটি তথ্যও দেওয়া যাক। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সর্বশেষ তিনটি অ্যাওয়ে ম্যাচের দুটিতেই জিতেছে চেলসি। এর মাঝে একটিতে স্প্যানিশ ক্লাব অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদকে তারা হারিয়েছে ২-১ গোলের ব্যবধানে।
এছাড়া বার্সেলোনার মাঠে হওয়া সর্বশেষ চারটি ম্যাচেও চেলসি ড্র করেছে। এমনকি বার্সেলোনার বিপক্ষে সর্বশেষ নয়টি ম্যাচে অপরাজিত রয়েছে চেলসি।
তবে সত্য কথা হচ্ছে, একটি নির্দিষ্ট ম্যাচ শুরু করার আগে খেলোয়াড়েরা মাঠে নামে সম্পূর্ণ নতুনভাবেই। ইতিহাসটা তাদের জন্য কিছুটা বাধা হয়ে দাঁড়ালেও, সেই বাধা অতিক্রম করার ক্ষমতা প্রতিটি বড় দলেরই থাকে।
নিঃসন্দেহে ম্যাচটিতে আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকবেন লিওনেল মেসি। চেলসির বিপক্ষে গোলখরা কাটিয়েছেন গত ম্যাচেই। তাছাড়া ঘরের মাঠে মেসি বরাবরই দুর্দান্ত। আজ কি আরেকটা মেসি-শো হতে যাচ্ছে?
অন্যদিকে চেলসির হাতেও রয়েছে উইলিয়ান কিংবা হ্যাজার্ডের মতো দক্ষ খেলোয়াড়। মোরাতার মতো স্কোরাররা নিজেদের দিনে যেকোনো প্রতিপক্ষকে হারাতে সক্ষম। এছাড়া প্রায় দুই বছর পর ন্যু ক্যাম্পে ফেরা ফ্যাব্রিগাসের জন্যেও আবেগের একটা রাত হতে পারে এটি।
৩.
কেমন হতে পারে আজকের ম্যাচের স্কোয়াড
সূত্র অনুযায়ী, বার্সেলোনা সম্ভবত খেলবে ৪-৩-৩ ফর্মেশনে। সম্ভাব্য একাদশ হচ্ছে: টের স্টেগান, সার্জিও রবার্তো, জেরার্ড পিকে, স্যামুয়েল উমতিতি, জর্ডি আলবা, সার্জিও বুসকেটস, ইভান রাকিটিচ, পাউলিনহো, ওসমান ডেম্বেলে, লিওনেল মেসি ও লুইস সুয়ারেজ।
ইনজুরির জন্য ডেনিস সুয়ারেজ দলের বাইরে আছেন, ইনজুরি কাটিয়ে দলে ফিরছেন আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা। তবে খুব সম্ভবত প্রথম একাদশে তার জায়গা হবে না।
চেলসির সম্ভাব্য ফর্মেশন ৩-৫-২। ইনজুরির জন্য ডেভিড সিলভা ম্যাচ থেকে বাদ পড়ছেন। দলে আছেন কন্তের মতো খেলোয়াড় কিংবা মোরাতার মতো স্কোরার। তবে একটি সূত্র বলছে, কন্তে আজকের ম্যাচে হ্যাজার্ডকে ‘ফলস নাইন’ হিসেবেও খেলাতে পারেন। প্রথম লেগের ম্যাচটিতে সেন্ট্রাল অ্যাটাকিং রোলে খেলে সন্তুষ্ট ছিলেন না হ্যাজার্ড, সেটি আবার তিনি প্রকাশও করে ফেলেছেন। চেলসির স্ট্রাইকার মোরাতার অফ ফর্মও কন্তেকে কিছুটা দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। তার সাথে আক্রমণভাগে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে ফ্রেঞ্চম্যান অলিভার গিরুর্ডের।
প্রথম লেগের ম্যাচটি ড্র হবার পর স্বভাব বিরুদ্ধভাবে ট্যাকটিক্সে খেলোয়াড়দের মতামত গ্রহণ করেছেন কন্তে। কন্তের ভাষায়,
“মাঝে মাঝে খেলোয়াড়দের সাথে দায়িত্ববোধ ভাগাভাগি করে নেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে আপনি যখন এই ধরনের ম্যাচের মুখোমুখি হবেন। প্রতিটি ম্যাচের আগেই আমি নিজে প্রাথমিক একাদশ নির্বাচন করি এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে খেলোয়াড়দের কোনো অংশগ্রহণ থাকে না। কারণ, খেলোয়াড়েরা শুধুমাত্রই একজন খেলোয়াড় আর ম্যানেজাররা ম্যানেজার। সবার কাজ ভিন্ন। কিন্তু মাঝে মাঝে, বিশেষ করে এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে খেলোয়াড়দের মাঝেও বিষয়টি ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। আমার মনে হচ্ছে, বার্সেলোনার বিপক্ষে জয় পেতে হলে আমাদের সবাইকে মিলে একটা খুবই ভালো পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।“
অন্যদিকে বার্সেলোনার কোচ ভালভার্দেও বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন। গতকালকেই ভালভার্দে টুইট করেছেন,
“আমরা জানি যে এই ধরনের ম্যাচে খুব সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয় পার্থক্য গড়ে দেয়। বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে, তবে এটিকে ধরে রাখাটা খুবই কঠিন।”
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, ম্যাচের আগে দু’দলেরই ঘুম ছুটে যাচ্ছে। রাত জেগে খেলা দেখে ঘুম নষ্ট করার মতো কষ্ট শুধুমাত্র দর্শকই করেন না, ম্যাচ জেতার জন্য কোচ কিংবা খেলোয়াড়দেরও ঘুম নষ্ট হয়ে যায়।
দেখা যাক, আজকের ম্যাচে কার কষ্ট স্বার্থক হয়!
ফিচার ইমেজ: Managing Madrid