করোনাভাইরাস প্রকোপে এক বছর পর ইউরোপজুড়ে শুরু হয়েছে ইউরো ২০২০। এক বছর পেছানোর কারণে দর্শকদের যে অধীর প্রতীক্ষা ছিল টুর্নামেন্টটি ঘিরে, এখন পর্যন্ত তা পূরণ করেই চলেছে ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের এ লড়াই।
ইউরোর শেষ রাউন্ডে দেখেছে দুর্দান্ত সব ম্যাচ, পর্দা উঠেছে দারুণ কিছু নাটকের। রোর বাংলার ইউরো আয়োজনের তৃতীয় পর্বে থাকছে ২১-২৩ জুনের ম্যাচগুলোর সেরা সব মুহূর্ত।
ডেনমার্কের রেকর্ড
ইউরোর এ আসরে মানসিকভাবে সব থেকে বেশি হোঁচট খাওয়া দল ডেনমার্ক। ইউরোতে তাদের যাত্রা শুরু হয় ফিনল্যান্ডের বিপক্ষের ম্যাচ দিয়ে। কিন্তু সে ম্যাচে মাঠেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তাদের মিডফিল্ডার ক্রিস্টিয়ান এরিকসেন। মাঠে যমে মানুষের টানাটানি, এরিকসেনকে নেওয়া হয় হাসপাতালে। সেদিনের ম্যাচ তখন পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এরিকসেন কিছুটা সুস্থ হয়ে নিজেই তার সতীর্থদের বলেন মাঠে ফিরতে। কয়েক ঘন্টা দেরিতে ম্যাচ আবার পুনরায় শুরু হয়। কিন্তু এরিকসেনের এমন অসুস্থতার পর ডেনমার্ক মাঠে ফিরলেও তারা মানসিকভাবে আর খেলায় ফিরতে পারেনি। সুন্দর ফুটবল খেলেও তারা হারে ১-০ গোলে।
দ্বিতীয় ম্যাচে বেলজিয়ামের বিপক্ষেও তারা দুর্দান্ত প্রতাপে লড়েছিল। দুই মিনিটের মাথা পৌলসেনের গোলের পর বেলজিয়ামকে গোল করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। কিন্তু লড়াকু ফুটবল খেলেও সেদিনের ম্যাচ জিততে পারেনি তারা। কিন্তু ফুটবল বিধাতা হয়ত চাননি, ডেনমার্কের এমন বিদায় হোক। এজন্যই গ্রুপপর্বে দুই ম্যাচে হেরেও তারা পৌঁছে গেছে পরের রাউন্ডে।
ডেনমার্কের শেষ ম্যাচ ছিল রাশিয়ার বিপক্ষে। সমীকরণটা সহজ, যেভাবে হোক জিততেই হবে। এজন্যই তারা আর ভুল পথে পা বাড়ায়নি, রুশদের জালে গুনে গুনে দিয়েছে চার গোল। আর এখানেই ব্যবধান গড়ে উঠেছে; ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও রাশিয়ার পয়েন্ট তিন থাকলেও গোল ব্যবধানে এগিয়ে গেছে ডেনমার্ক। আর এভাবেই ইউরোর ইতিহাসে প্রথমবার গ্রুপপর্বে দুই ম্যাচ হেরেও পরের রাউন্ড নিশ্চিত করতে পেরেছে তারা।
নকআউট পর্বে তারা মুখোমুখি হবে রামসি-বেলদের ওয়েলসের। এরিকসেন ইউরোর আর কোনো ম্যাচে নামতে পারবেন না। অবশ্য ফুটবলের মাঠেই আদৌ কখনও তাকে খেলতে দেখা যাবে কি না, তা নিয়েই ধোঁয়াশা আছে। তবে এরিকসেন মাঠে থাকবেন, সাহস জোগাবেন তার সতীর্থদের। আর এই সাহসই ডেনমার্কের সব থেকে বেশি প্রয়োজন।
অবশেষে ক্রোয়েশিয়া
২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপ ক্রোয়াট দলের ইতিহাসকে বদলে দিয়েছিল। কিন্তু সেই গল্পের পর এই দলের উন্নতি হয়েছে কতটা? দলে নতুন মুখ এসেছে, তৈরি করে নিচ্ছে নিজেদের স্থান৷ কিন্তু উন্নতির পারদ যে উপরে ওঠেনি!
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বিরক্তিকর ফুটবল খেলে এক গোলে হার। চেক প্রজাতন্ত্রের সাথে কিছুটা আশাজাগানিয়া ফুটবল খেললেও ১-১ গোলে ড্র। তাই স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ ম্যাচ ছিল তাদের ভাগ্যনির্ধারণী। হেরে গেলে সরাসরি বাদ, আর ড্র করে তৃতীয় স্থান পেলেও তাদের কোনো লাভ হতো না। তাই এ ম্যাচে জয়ের কোনো বিকল্প ছিল না।
ক্রোয়েশিয়া অবশ্য নিজেদের বাঁচা-মরার ম্যাচে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বলতে গেলে, ক্রোয়াটদের নকআউট মঞ্চে তুলেছে দলের বর্ষীয়ান খেলোয়াড়েরা। দলে ছিলেন পেতকোভিচ, ব্রেকালো, রেবিচ ও ভ্লাসিচরা। কিন্তু গোল করলেন সেই পেরিসিচ-মদরিচই। তাই আবারও ক্রোয়াট ফুটবলের ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়ের উপর নির্ভর করে তারা পার করল গ্রুপপর্ব।
নকআউট পর্বে তাদের প্রতিপক্ষ লুইস এনরিকের স্পেন। শেষ ম্যাচে ক্রোয়েশিয়া যে পারফরম্যান্স উপহার দিল, তা ধরে রেখে স্পেন-বাধা কি পার করতে পারবে তারা? উত্তর পাওয়া যাবে ২৮ তারিখেই।
সুন্দর ফুটবল, অসুন্দর সমালোচনা
ইউরোর এবারের আসরে সবচেয়ে বেশি গোলসুযোগ তৈরি করেছে স্পেন। তবে গোল সুযোগ তৈরি করলে কী হবে? গোল তো আর হয়নি। তাই সুন্দর পাসিং ফুটবলও হয়ে গেছে চোখের বিষ। আর স্পেন এবারের আসরে এখন পর্যন্ত সব থেকে বেশি সমালোচিত হওয়া দেশ।
সুইডেনের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ। স্পেন শুরু করল তাদের পাসিং ফুটবলের পসরা। কিন্তু পুরো ম্যাচে হাজারখানেক পাস দিয়েও তৈরি করা গেল না পর্যাপ্ত গোলসুযোগ৷ যে কয়েকটাও হলো, আলভারো মোরাতা তা হাতছাড়া করলেন।
পোল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচ। যে পোলান্ড নিজেদের প্রথম ম্যাচে হেরেছে স্লোভাকিয়ার কাছে, তাদের বিপক্ষে পাসিং ফুটবলের সাথে গোল সুযোগও তৈরি হলো অনেকগুলো। কিন্তু স্ট্রাইকারের ভূমিকায় থাকা মোরাতা গোলের সুযোগগুলো থেকে গোলে রূপান্তর করতে পারলেন মাত্র একটি। মোরেনো মিস করে ফেললেন পেনাল্টিও। আবার ড্র, আবার সমালোচনা।
প্রথম দুই ম্যাচে দুই পয়েন্ট। স্লোভাকিয়ার বিপক্ষে জয় না পেলে সমীকরণ বেশ জটিল হয়ে উঠবে। এনরিকে বেশ কয়েকটি বদল আনলেন। মাঝমাঠে ফিরলেন বুসকেটস। আর এবার লা রোহারা ফিরল স্বরূপে। ৬৬ শতাংশ সময়ে বল নিজেদের পায়ে রেখে স্পেন স্লোভাকিয়ার জালে শট নিয়েছে ১৯টি। তাতে গোল হয়েছে ৫টি। যেভাবে গোল সুযোগ তৈরি হয়েছে, তাতে আরও গোটা দুই গোল হলে অবিশ্বাস্য কিছু হতো না। কিন্তু ঐ যে লা রোহাদের ‘চোখের বালি’ মোরাতা, তিনি পেনাল্টিতে গোল করতে ব্যর্থ!
শেষ ম্যাচে নতুন করে আশা দেখিয়েছে অনেকে। সারাবিয়া ফিরেছেন স্বরূপে, মধ্যমাঠ থেকে নেতৃত্ব দেবার দায়িত্ব নিয়ে ফিরেছেন বুসকেটস।। মাঝমাঠ থেকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন কোকে আর পেদ্রি। এবার সামনে ক্রোয়াট বাধা। স্পেনের মতো শেষ সময়ে ছন্দে ফেরার আভাস দিয়েছে তারাও।
আত্মঘাতী গোল
স্পেন ও স্লোভাকিয়া ম্যাচে স্পেনের গোল-উৎসব শুরু হয়েছিল আত্মঘাতী গোল থেকে। ম্যাচের শুরুতে মোরাতার পেনাল্টি রুখে দিয়ে নায়ক বনে যাওয়া দুব্রাভকারই হয়ে বসেন খলনায়ক। কারণ স্পেনের প্রথম গোল পাইয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
এমন গোল আরও একটি হয়েছে এই ম্যাচে। ৬৯ মিনিটে বদলি হিসেবে নেমেছিলেন পাউ তোরেস। ৭১ মিনিটে তারই হেড ঢুকে যাচ্ছিল স্লোভাকিয়ার জালে। এজন্য ডিফেন্ডার জুরাজ কুচকা এগিয়ে এসেছিলেন বল ক্লিয়ার করতে। কিন্তু ক্লিয়ার করতে এসে তার গায়ে লেগেই বল জড়িয়ে যায় জালে।
কুচকার এই গোল এবারের আসরের অষ্টম আত্মঘাতী গোল। ইউরোর এক আসরে এত আত্মঘাতী গোল এর আগে কখনো হয়নি। ইউরোর আসরে প্রথম আত্মঘাতী গোল করেন অ্যান্টন ওনদ্রুস, সেটাও ১৯৭৬ সালের ঘটনা। এরপর ১৯৯৬ ও ২০০০ সালের আসরে একটি করে আত্মঘাতী গোল হয়। ২০০৪ সালে হয় দু’টি, ২০০৮ সালের আয়োজনে কোনো আত্মঘাতী গোলের ঘটনা নেই। আবার ২০১২ সালে দেখা যায় একটি আত্মঘাতী গোল। ২০১৬ সালের আয়োজনে তিনটি আত্মঘাতী গোলের দেখা মিলেছিল। কিন্তু এবার গ্রুপপর্বের ম্যাচ শেষ হতে না হতেই আটটি আত্মঘাতী গোল হয়ে গেছে। ইউরোর আরও ম্যাচ তো এখনও বাকি!
গোলমেশিনের শেষ চেষ্টা
প্রথম দুই ম্যাচে এক হার ও এক ড্র। রবার্ট লেওয়ানডস্কি যখন সুইডেনের বিপক্ষে নামলেন, পোলিশদের হাতে মাত্র এক পয়েন্ট। প্রথম বা দ্বিতীয় হবার সুযোগ ততক্ষণে হাতছাড়া। ওদিকে, স্লোভাকিয়ার সাথে লড়ছে স্পেন। তাই ক্ষীণ একটা সুযোগ ছিল তালিকার তৃতীয় স্থানে থাকার। আর এ লড়াই যেন একাই চালিয়ে গেলেন লেভান্ডডস্কি। শেজনি, জিলেনেস্কি, বেডনারেক, লেওয়ানডস্কি, গিল্কদের পোল্যান্ড এবার ইউরোর মঞ্চে প্রথম থেকেই গড়পড়তা ফুটবল খেলে এসেছে। লেওয়ানডস্কিকেও স্বরূপে দেখা যায়নি। কিন্তু শেষ ম্যাচে যখন তিনি একাই লড়ে গেলেন, সমর্থন পেলেন না তার সতীর্থদের থেকে।
এমিল ফর্সবার্গের টানা দুই গোলে প্রথমেই লিড নিয়েছিল সুইডেন। কিন্তু এরপরই লেওয়ানডস্কি করেন দুই গোল। ৯০ মিনিট পর্যন্ত ম্যাচ ছিল ২-২ গোলের সমতায়। কিন্তু শেষ সময়ে সুইডেনের আক্রমণ আর রুখতে পারল না পোলিশ ডিফেন্স। ৯৩ মিনিটে তাই গোল হজম করে ইউরোর কোনো ম্যাচ না জিতেই লেওয়ানডস্কির পোল্যান্ড বিদায় নিল। হয়ত ইউরোর মঞ্চে এটাই ছিল পোলিশ গোলমেশিনের শেষ ম্যাচ!
মরণকূপের মারণ লড়াই
গ্রুপ তো নয়, যেন সাক্ষাৎ মৃত্যৃকূপ। জার্মানি-পর্তুগালের সাথে এক গ্রুপে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স। আর বাঘা বাঘা দেশের সামনে এক পুঁচকে দল হাঙ্গেরি। কিন্তু হাঙ্গেরি যেভাবে লড়ে গেল, তাদের আর ‘পুঁচকে দল’ বলার অবকাশ নেই।
হাঙ্গেরি রুখে দিয়েছিল ফ্রান্সকে। তবে জার্মানির সাথে জয় ও হাঙ্গেরির সাথে ড্র করে ফরাসিরা নকআউট পর্ব আগেই নিশ্চিত করে রেখেছিল। অন্যদিকে, পর্তুগাল জার্মানির কাছে হেরে বসলেও হাঙ্গেরিকে তারা উড়িয়ে দিয়েছিল ৩-০ গোলে। তাই ফ্রান্স ছাড়া এই গ্রুপের বাকিদের ভাগ্য ছিল অনিশ্চিত।
শেষদিনে ক্ষণে ক্ষণে ম্যাচের ভাগ্য পাল্টেছে। জার্মানি ও হাঙ্গেরির ম্যাচে প্রথমে হাঙ্গেরি গোল দিলে পর্তুগালের বিদায় ঘনিয়ে আসতে থাকে। আবার ফ্রান্স বনাম পর্তুগাল ম্যাচে রোনালদো পেনাল্টি থেকে গোল এনে দিতেই তাদের দুঃস্বপ্নের মেঘ কেটে যায়। কিন্তু তা স্থায়ী হয়নি। পেনাল্টিতে বেনজেমা গোল করার পর দ্বিতীয়ার্ধে করেন আরও এক গোল। অন্য ম্যাচে কাই হাভার্টজ গোল করে সমতা আনলেও তা বেশি সময় টেকেনি, দুই মিনিট পরই হাঙ্গেরি গোল পরিশোধ করে আবার এগিয়ে গেছে।
এভাবেই চলেছে গ্রুপ ‘এফ’ এর শেষদিনের দুই ম্যাচের লড়াই, যেখানে ভাগ্য ক্রমাগত দল বদলেছে। যদিও দিনশেষে অঘটন ঘটেনি; হাঙ্গেরি পারেনি জার্মানদের হারাতে, ফ্রান্সও পারেনি পর্তুগালের বিপক্ষে ২০১৬ ইউরোর ফাইনাল হারের বদলা নিতে। দুটো ম্যাচই ২-২ গোলে ড্র হবার পর বিদায় নিতে হয়েছে প্রশংসনীয় ফুটবল খেলা হাঙ্গেরিকে। তৃতীয় হয়ে পরের রাউন্ডে উঠেছে পর্তুগাল, নকআউটে তাদের প্রতিপক্ষ বেলজিয়াম। আর দ্বিতীয় হয়ে জার্মানি পেয়েছে ইংল্যান্ডকে।
রোনালদোর রেকর্ডের রাত
পর্তুগালের নকআউট পর্ব নিশ্চিত করার পাশাপাশি রোনালদোও রেকর্ড ভেঙেছেন। ফ্রান্সের বিপক্ষে পেনাল্টি থেকে জোড়া গোল করে, বর্তমানে তিনি ইরানের কিংবদন্তি ফুটবলার আলী দাইয়ির সাথে যৌথভাবে আন্তর্জাতিক ফুটবলের সর্বোচ্চ গোলদাতা। ১০৯ গোল করতে রোনালদো খেলেছেন ১৭৮ ম্যাচ, যেখানে আলী দাইয়ি এই রেকর্ড গড়েছিলেন ১৪৯ ম্যাচ খেলে। দাইয়িকে যখন রোনালদো ধরে ফেলেছেন, তাকে পেছনে ফেলে যেতেও তার বেশি সময় লাগার কথা নয়। পর্তুগাল পৌঁছে গেছে নকআউটে। সেখানে প্রতিপক্ষ ডি ব্রুইনা-লুকাকুর বেলজিয়াম। গোলের রেকর্ড নিজের করে নেবার কাজটা কি রোনালদো ইউরোর মঞ্চেই সেরে ফেলবেন?
রেকর্ড ভাঙার পাশাপাশি রেকর্ড তিনি একটা গড়েছেনও। বিশ্বকাপ ও ইউরো মিলিয়ে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড এতদিন ছিল জার্মান কিংবদন্তি মিরোস্লাভ ক্লোসার দখলে। তিনি মোট করেছিলেন ১৯ গোল। ফ্রান্সের বিপক্ষে ম্যাচে দুই গোলের মাধ্যমে এই রেকর্ড এখন রোনালদোর একার; তিনি করেছেন ২১ গোল – বিশ্বকাপে ৭টি ও ইউরোতে ১৪টি।