“It was the most disgraceful and selfish performance I have ever seen…”
কথাগুলো যিনি বলেছিলেন, সেই রামচাঁদকে আপনার কাছে অপরিচিত ঠেকলেও যাকে উদ্দেশ্য করে রামচাঁদ কথাটা বলেছিলেন, সেই সুনীল গাভাস্কারকে আপনি নিশ্চয়ই চেনেন।
দুয়ারে দাঁড়িয়ে বিশ্বকাপ, আর আলোচনার প্রসঙ্গ সুনীল গাভাস্কার। এতটুকু পড়ে ক্রিকেটের অনুসারীরা নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন, উপরের উদ্ধৃতিটুকুর প্রেক্ষাপট কি। লক্ষ্যমাত্রা ৩৩৫, এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে একজন ওপেনিং ব্যাটসম্যান খেললেন ১৭৪ বলে ৩৬ রানের ইনিংস, সে ইনিংসকে নিয়ে এমন কথা বললে ভুলটা কোথায়! সেই ইনিংসকে ভুলবার উপায়টাই বা কোথায়!
সেটা ছিল প্রথম বিশ্বকাপের পহেলা ম্যাচ। ২০.৬৮ স্ট্রাইক রেটের এক ইনিংসে সুনীল গাভাস্কার ওয়ানডে ক্রিকেট পরিসংখ্যানে সংযোজন করেছিলেন এক নতুন অধ্যায়, যে অধ্যায়ের শিরোনাম ‘বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সবচেয়ে মন্থর ইনিংস’।
এরপরের দশ বিশ্বকাপে এমন দৈন্যদশাধারী স্ট্রাইকরেটের ইনিংস যোগ হয়েছে ঢের। এদের মধ্য থেকেই সবচেয়ে মন্থরতম পাঁচ ইনিংস নিয়ে লেখা হচ্ছে এই রচনায়।
পাঠকের মনে কৌতূহল জাগতে পারে, বিশ্বকাপে শূন্য রানে আউট হয়েছেন, এমন ইনিংসও তো কম নেই। শূন্য রানে প্যাভিলিয়নে ফেরা মানে তো ব্যাটসম্যানের স্ট্রাইক রেটও নেই।তাহলে কি আমরা আজ শূন্যের কাব্য আবৃত্তি করতে বসেছি?
পাঠকের কৌতূহল নিবৃত্ত করা হচ্ছে এই তথ্য জানিয়ে, ‘বিশ্বকাপের মন্থরতম ইনিংসগুলো’ শিরোনামের এই লেখায় সে ইনিংসগুলো নিয়েই আলোচনা করা হবে, যে ইনিংসে ব্যাটসম্যান পঞ্চাশ রানের কোটা পেরিয়েছিলেন!
১. ঈশ্বর মরাজ (অপরাজিত ৫৩)
বিশ্বকাপের বিমানে চড়ার মূল্যে কানাডা ক্রিকেট দল যেন সেবার চড়েছিল কোনো উথালপাতাল রোলার কোস্টার রাইডে। প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে জয়ের আনন্দে ভাসার দিনকয়েক পরই পেয়েছিলো শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সবচেয়ে কম রানে অলআউট হবার লজ্জা। ব্যক্তিগত অর্জনের খাতা ভারি হয়েছিল জন ডেভিসনের, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচে গড়েছিলেন তৎকালীন সময়ের দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড। রেকর্ড গড়েছিলেন ঈশ্বর মরাজও, বিশ্বকাপে মন্থরতম অর্ধশতকের।
২০০১ সালের আইসিসি ট্রফিতে তিন ফিফটি করে কানাডাকে নিয়ে এসেছিলেন বিশ্বকাপের মঞ্চে। সেখানে এসে প্রথম চার ম্যাচে ছিলেন আশ্চর্য রকমের ব্যর্থ। করেছিলেন মোটে ৪৫ রান।
পঞ্চম ম্যাচে প্রতিপক্ষ পেয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকাকে। প্রথমে ব্যাট করে দক্ষিণ আফ্রিকা তুলেছিল ২৫৪ রান। শন পোলক, মাখায়া এনটিনি আর অ্যালান ডোনাল্ডের সাঁড়াশি আক্রমণে ২৮ রানেই কানাডা হারায় তিন উইকেট। জয়ের আশা নেই, জয়ের চেষ্টাটাও তাই বৃথাই, বুঝতে পেরেই ঈশ্বর মরাজ নিজেকে ঢুকিয়ে নিয়েছিলেন খোলসের ভেতরে। এতটাই যে, সেদিন বল খেলেছিলেন ১৫৫টি, চার মেরেছিলেন ৬টি, ২১৪ মিনিট স্থায়ী ইনিংসে রান করেছিলেন ৫৩। দক্ষিণ আফ্রিকার ফিল্ডাররাও যেন চাইছিলেন, ঈশ্বর মরাজ আজ একখানা রেকর্ড করে ফেলুন। নইলে এক ঈশ্বর মরাজেরই চার-চারটি ক্যাচ তারা কেন ফেলবেন!
এত বেশি বল খেলে পঞ্চাশ রান করার কীর্তি নেই আর কারও। অন্য কারও হবার সম্ভাবনাও সীমিত।
২. সুনীল গাভাস্কার (৫৫)
প্রথম বিশ্বকাপে মন্থরতম ফিফটির রেকর্ড মিস করলেও পরের বিশ্বকাপে আর করেননি। ২য় বিশ্বকাপের ষষ্ঠ ম্যাচে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে নিজের করে নিয়েছিলেন এই রেকর্ডটি।
সেদিন টস হেরে ব্যাট করতে নেমেছিল ভারত। উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে নেমেছিলেন সুনীল গাভাস্কার। আর ফিরতি পথ ধরেছিলেন সপ্তম ব্যাটসম্যান হিসেবে। মাঝখানে খেলেছিলেন ১৪৪ বল, রান করেছিলেন ঈশ্বর মরাজের মতোই ৫৫। এক কপিল দেবই যা রান-বলের পাল্লা দেয়া ইনিংস খেলেছিলেন, ২৪ বলে ২৫ রান করেছিলেন। ভারতের বাদবাকি সব ব্যাটসম্যানদের সামনে উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন সুনীল গাভাস্কার। গোটা দলের ইনিংসটা ৩৬০ বলে তাই ১৮২ রানের বেশি হয়নি।
মামুলি এ লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে নিউ জিল্যান্ডও হাঁসফাঁস করে মরেছিলো। ১৮৩ রান করতেই খেলেছিলো ৫৭ ওভার (একদিবসী ক্রিকেট তখন ৬০ ওভারে খেলা হতো)। ব্রুস এডগার করেছিলেন ৫০.৩০ স্ট্রাইক রেটে ৮৪ রান।
তবে সব ছাপিয়ে মূল চরিত্র তো একজনই, সুনীল গাভাস্কার। ১ম বিশ্বকাপে খেলা ২০.৬৮-এর পর এবারে যে স্ট্রাইক রেট ৩৮.১৯!
৩. সিদাথ ওয়েট্টিমুনি (৫০):
গাভাস্কারের রেকর্ড ভেঙে যাচ্ছিল এর পরের বিশ্বকাপেই। ভেঙে দিচ্ছিলেন উপমহাদেশেরই আরেক ক্রিকেটার সিদাথ ওয়েট্টিমুনি।
ভেন্যু ছিল সেই একই হেডিংলি, প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তান। জুনের ১৬ তারিখের সেই ম্যাচের আগে, সেই বিশ্বকাপেই আরেকবার পাকিস্তানের মুখোমুখি হয়েছিল শ্রীলংকা। ৯ জুনের ওই ম্যাচে ৫০ রানে পরাজয়ের দরুণ শ্রীলংকার সামনে বিশ্বকাপের ১৫তম ম্যাচটি ছিল প্রতিশোধের।
বোলাররা সেই প্রতিশোধের সুযোগ সৃষ্টিও করে দিয়েছিলেন। ক্রিকেট শ্রীলংকার বর্তমান প্রধান নির্বাচক অশন্তা ডি মেলের বোলিং তোপে পাকিস্তান পুরো ৬০ ওভার খেলে রান করেছিল ২৩৫, সেটাও ইমরান খান এক অধিনায়কোচিত শতক করেছিলেন বলে।
জবাব দিতে নেমে শ্রীলংকা হেঁটেছিল তখনকার দিনের প্রচলিত ‘নতুন বলটা দেখে খেলো’ রাস্তাতেই। দুই ওপেনার ওয়েট্টিমুনি আর ব্রেন্ডন কুরুপ্পুর শম্বুকগতির জুটি ভেঙেছিলো ২২ রানে। কুরুপ্পু ৩৬ বলে ১২ রান করে ড্রেসিংরুমে ফিরলেও ফেরেননি ওয়েট্টিমুনি। তিনি টিকে ছিলেন ১২৭ বল, বহু কষ্টেসৃষ্টে তুলে নিয়েছিলেন ক্যারিয়ারের চার হাফসেঞ্চুরির একটি।
এমন ইনিংসে ভর করে শ্রীলংকাও পারেনি ২৩৬ রানের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে। থেমে গিয়েছিল ১১ রান বাকি থাকতে।
সিদাথ ওয়েট্টিমুনি অবশ্য দাবি করতে পারেন, ‘দোষ কি কেবলই আমার ইনিংসের? আমি তো তাও টিকে ছিলাম, বাকিরা তো টিকতেই পারলো না!’
ফলাফল? নয় বল বাকি থাকতেই শ্রীলংকা অলআউট।
৪. মহসিন খান (৭০)
১৯৮৩ বিশ্বকাপেরই আরেক ম্যাচে সৃষ্টি হয়েছিল এই কীর্তির। পাকিস্তান মাঠে নেমেছিল সেদিনও। পার্থক্য হচ্ছে, এই ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তানের ইনিংসে।
বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর পাকিস্তান। প্রথম সেমিতে ভারতের জয়ের দরুণ সেই ম্যাচে পাকিস্তানের জয়টাই গোটা বিশ্বের ক্রিকেট অনুরাগীদের কাছে ছিল পরম প্রার্থিত। ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি হচ্ছে বিশ্বকাপ ফাইনালে, এ যে রীতিমতো রূপকথা!
কিন্তু রূপকথা তো রূপকথাই। তা তো আর প্রতিদিন লেখা যায় না, বিশেষ করে সর্বজয়ী সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তো বেশ চেষ্টাচরিত্র করেও না।
পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানরা সেই সেমিফাইনালে চেষ্টা করেছিলেন কি না, এ নিয়েও অবশ্য প্রশ্ন তোলা যায়। পুরো ৬০ ওভার খেলে পাকিস্তান তুলেছিল ১৮৪ রান, বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের লড়াইয়ে এ যে বড্ড বেমানান।
আর এমন কচ্ছপগতির ইনিংসে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মহসিন খান। গোটা ৬০ ওভারের প্রায় অর্ধেক বল খেলে রান করেছিলেন ৭০। স্ট্রাইকরেট ৪০ ছাড়ায়নি তার বেলাতেও।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে এ রান এমন কঠিন কী ব্যাপার? বিশেষ করে যে দলে খেলতেন স্যার ভিভ রিচার্ডস!
খানিক আগেই একই পিচে হাঁসফাঁস করা ব্যাটসম্যানদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন ব্যাটিংয়ের ‘অ-আ-ক-খ’। ৯৬ বলে ৮০ রানের ইনিংসে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘ব্যাটিং এভাবেই করতে হয়!’
৫. ব্রেন্ডন টেলর (৫০)
কিংস্টনের মাঠে সেদিন ব্রেন্ডন টেলরের ঘাড়ে ভূত চেপেছিল কি না, তা গবেষণার দাবি রাখে। ক্যারিয়ারের পুরোটা জুড়েই স্ট্রোকের ফুলঝুরি ছোটানো এই ব্যাটসম্যান সেদিন যেন হারিয়ে ফেলেছিলেন নিজেকে। নতুবা তার ১২১ বলে ৫০ রানের ইনিংসকে ব্যাখ্যা করার উপায় কী!
আগের চারজনের সঙ্গে পঞ্চমজনের যা পার্থক্য, সুনীল গাভাস্কারদের মতো ইনিংসের উদ্বোধন করেননি তিনি। বরং, ভুসি সিবান্দা জিম্বাবুয়ের ইনিংসের ১৪তম বলেই প্যাভিলিয়নের পথ ধরলে টু-ডাউন ব্যাটসম্যান হিসেবে নেমেছিলেন ব্রেন্ডন টেলর।
মিস আর ডিফেন্সের মেলা বসিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলারদের নিতে শুরু করেছিলেন ধৈর্য্যের পরীক্ষা। প্রথম বাউন্ডারি হাঁকিয়েছিলেন ৭৬ নম্বর বলে। গোটা ইনিংসে এরপর মেরেছিলেন আর একটিমাত্র চার। জিম্বাবুয়েও পারেনি ২০২ রানের বেশি তুলতে।
জবাব দিতে নেমে তাড়াহুড়ো করেনি ব্রায়ান লারার ওয়েস্ট ইন্ডিজও, ৪৭.৩ ওভার খেলে তুলে নিয়েছিল কাঙ্ক্ষিত জয়।
৪১.৩২ স্ট্রাইক রেটের ওই ইনিংসকে এই মন্থরতম ইনিংসের তালিকায় পাকাপাকিভাবে পঞ্চম স্থান দিয়েই দেয়া যায়। যেমনভাবে নিশ্চিত ঈশ্বর মরাজ কিংবা মহসিন খানদের স্বীয় অবস্থান ধরে রাখাও।
কে কত দ্রুত রান তুলতে পারেন, ক্রিকেট খেলাটা যখন এমনই, তখন কে-ই বা চাইবে এমন রেকর্ডে নিজের নাম লেখাতে! যতই রেকর্ড হোক, তবু রেকর্ডটা তো লজ্জার!