গত কয়েক বছর ইনজুরিটা বেশ ভুগিয়েছিল সাকিব আল হাসানকে। ইনজুরির কারণে খেলতে পারেননি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। নিউ জিল্যান্ড সফরে তো এক ম্যাচেও খেলতে পারেননি তিনি। আয়ারল্যান্ডের মাটিতে ত্রিদেশীয় সিরিজের গ্রুপপর্বে অসাধারণ পারফর্ম করার পরও খেলতে পারেননি শিরোপা-নির্ধারণী ম্যাচ। তবে বড় আসরের আগে নিজেকে ঠিকই প্রস্তুত করে নিয়েছিলেন তিনি। আইপিএলে খেলতে গিয়েও তার সম্পূর্ণ মনোযোগ ছিল বিশ্বকাপের উপর। সেখানে মূল একাদশে জায়গা না পাওয়াতে সাকিবের উপকারই হয়েছে বটে। নিজেকে বাড়তি সময় দিয়ে শরীর থেকে বাড়তি ওজন কমিয়েছিলেন।
সাকিব আল হাসান ভালো করার ব্যাপারে কতটা উন্মুখ ছিলেন, তা বিশ্বকাপের শুরু থেকেই দেখা যাচ্ছে। তিনি এর আগে তিন বিশ্বকাপ খেলে কখনও ম্যাচসেরার পুরস্কার জেতেননি। এই আসরে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত তিন ম্যাচে জয়লাভ করেছে, যার সবক’টিতে ম্যাচসেরার পুরস্কার জিতেছেন তিনি। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, সাকিব আল হাসান এখন যেদিনই মাঠে নামছেন, কোনো না কোনো কীর্তি গড়ছেন। কখনও ইতিহাসের প্রথম, কখনও বা কিংবদন্তি ক্রিকেটারদের পাশে রেকর্ড বুকে নিজের নাম লেখাচ্ছেন।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচশেষে সাকিব আল হাসান বেশ কয়েকটি রেকর্ড গড়েছেন। চলুন, এইসব রেকর্ড সম্পর্কে জেনে আসা যাক।
১.
ক্রিকেট বিশ্বে অনেক কিংবদন্তি অলরাউন্ডারের আগমন ঘটেছে। তাদের মধ্যে বিশ্বকাপ খেলেছেন অনেকেই। তাদের কেউ ব্যাটিংয়ে ভালো, পাশাপাশি বোলিংয়ে চলনসই। আবার অনেক অলরাউন্ডার আছেন, বোলিংয়ে ভালো, ব্যাটিংয়ে চলনসই। কিন্তু দলের সেরা বোলার হওয়ার পাশাপাশি ব্যাটিংয়েও দলের সেরা ব্যাটসম্যান, এমন ক্রিকেটার খোঁজে পাওয়া দুষ্কর। যতদিন না সাকিব আল হাসান নামের কেউ এসেছেন, এমনটা দেখতে পাওয়াও ছিল নেহায়েত সৌভাগ্যের বিষয়। সাকিব আল হাসান যে দলের সেরা ব্যাটসম্যান হওয়ার পাশাপাশি বোলিংয়েও দলের সেরা!
গত ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ব্যাট হাতে ৫১ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলার পথে বিশ্বকাপে প্রথম বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান হিসাবে সহস্রাধিক রান সংগ্রহের রেকর্ড গড়েছেন সাকিব। তিনি বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত ২৭ ম্যাচ খেলে দু’টি শতক এবং আটটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪৪.১৭ ব্যাটিং গড়ে ১,০১৬ রান সংগ্রহ করেছেন। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রাহকদের তালিকায় তার অবস্থান বর্তমানে ১৬তম।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে বল হাতেও দুর্দান্ত পারফর্ম করেছেন তিনি। দশ ওভারে মাত্র ২৯ রানের বিনিময়ে পাঁচ উইকেট শিকার করেছিলেন সাকিব আল হাসান। বিশ্বকাপে প্রথম কোনো বাংলাদেশি বোলারের ইনিংসে পাঁচ উইকেট নেওয়ার ঘটনাও এটিই প্রথম। আজকের পাঁচ উইকেটসহ তিনি বিশ্বকাপে মোট ৩৩ উইকেট শিকার করেছেন। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়া বোলারদের তালিকায় তার স্থান ১৭তম।
বিশ্বকাপে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বোলিংয়েও বাংলাদেশের সেরা পারফর্মার সাকিব আল হাসান। আজকে ব্যাট হাতে সহস্রাধিক রান পূর্ণ করার পর বল হাতে পাঁচ উইকেট শিকার করে বিশ্বকাপের প্রথম ক্রিকেটার হিসাবে ১,০০০+ রান এবং ৩০+ উইকেট শিকারের কীর্তি গড়লেন।
সাকিব আল হাসান চলতি আসরে ব্যাট হাতে ৯৫.২০ ব্যাটিং গড়ে দু’টি এবং তিনটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪৭৬ রান সংগ্রহ করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় শীর্ষস্থানে অবস্থান করছেন। বল হাতেও সফল তিনি, এখন পর্যন্ত আসরে স্পিনারদের মধ্যে ইমরান তাহিরের সাথে যৌথভাবে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারের তালিকায় সবার উপরে আছেন। তিনি ৩০.১০ বোলিং গড়ে দশ উইকেট শিকার করেছেন। বিশ্বকাপের এক আসরে ব্যাট হাতে ৪০০+ রান করার পাশাপাশি বোলিংয়ে ১০+ উইকেট শিকার করতে পারেননি আর কোনো ক্রিকেটার। সাকিব আল হাসানই প্রথম ক্রিকেটার হিসাবে এই কীর্তি গড়ে দেখালেন।
২.
আফগানিস্তানের বিপক্ষে ব্যাট হাতে ৬৯ বলে ৫১ রানের ইনিংস খেলার পর বল হাতে পাঁচ উইকেট শিকার করেছিলেন সাকিব আল হাসান। বিশ্বকাপে এক ম্যাচে অর্ধশতক হাঁকানোর পাশাপাশি পাঁচ উইকেট শিকার করা দ্বিতীয় ক্রিকেটার তিনি। এর আগে ২০১১ সালের বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে যুবরাজ সিং ব্যাট হাতে অপরাজিত ৫০ রানের ইনিংস খেলার পর ৩১ রানের বিনিময়ে পাঁচ উইকেট শিকার করেছিলেন।
সাকিব আল হাসান অনেকদিন থেকেই অনেকজনকে বুঝিয়েছেন, তিনি তিন নাম্বারে ব্যাট করতে প্রস্তুত। ২০১২ সালে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে তিনে ব্যাট করে সফল হওয়ার পরও নতুন কোচ হাতুরুসিংহে আসার পর আবারও তাকে মিডল-অর্ডারে ব্যাট করতে দেখা যায়। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের এক যুগ খেলার পর সবাইকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, তিনি তিনে ব্যাট করার জন্য উপযুক্ত। এই তিন নাম্বার ব্যাটিং পজিশন নিয়ে বাংলাদেশের কম মাথাব্যথা ছিল না। এই পজিশনে মোহাম্মদ আশরাফুল ৫১ ইনিংস ব্যাট করে মাত্র ৯৮৪ রান করেছিলেন, আফতাব আহমেদ ৫৪ ইনিংসে করেছিলেন ১,৩০৩ রান। এছাড়া সাব্বির রহমান, লিটন দাস কেউই এই পজিশনে দায়িত্ব নিয়ে খেলতে পারেননি। বিশ্বকাপকে সামনে রেখে শেষ পর্যন্ত সাকিব নিজেই তিনে ব্যাট করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।
সাকিব আল হাসান তিন নাম্বার ব্যাটিং পজিশনে ব্যাট করে এখন পর্যন্ত বেশ সফল। গত ম্যাচে ৫১ রানের ইনিংস খেলার মধ্য দিয়ে তিন নাম্বারে ব্যাট করে এক হাজার রানের মাইলফলক অতিক্রম করলেন। বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তিনে ব্যাট করে এর আগে শুধুমাত্র আফতাব আহমেদ সহস্রাধিক রান করেছেন। সাকিব মাত্র ২১ ইনিংসে দু’টি শতক এবং নয়টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫৮.১৬ ব্যাটিং গড়ে ১,০৪৭ রান সংগ্রহ করেছেন।
৩.
সাকিব আল হাসান বিশ্বকাপে নিজের প্রথম শতকটি হাঁকিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। অবশ্য ১২১ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেও দলকে শেষ পর্যন্ত জেতাতে পারেননি তিনি। তবে আফগানিস্তানের বিপক্ষে পাঁচ উইকেট শিকারের মধ্য দিয়ে বিশ্বকাপে নিজের প্রথম পাঁচ উইকেট শিকার করে দলকে ৬২ রানের জয় এনে দিয়েছেন তিনি। আজকে পাঁচ উইকেট শিকারের মধ্য দিয়ে বিশ্বকাপে তৃতীয় অলরাউন্ডার হিসাবে শতক হাঁকানোর পর পাঁচ উইকেট শিকারের কীর্তিও গড়েছেন তিনি। তার আগে বিশ্বকাপে শতক এবং পাঁচ উইকেট নিয়েছিলেন কপিল দেব (১৯৮৩ সালে) এবং যুবরাজ সিং (২০১১ সালে)।
বর্তমানে বিশ্বকাপে সাকিব আল হাসানের অর্ধশতকের সংখ্যা আটটি। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি অর্ধশতক হাঁকানোর তালিকায় তার অবস্থান শচীন টেন্ডুলকার এবং জ্যাক ক্যালিসের পরই। তার সাথে আটটি অর্ধশতক নিয়ে বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার যৌথভাবে তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছেন।
৪.
সাকিব আল হাসান তিনে ব্যাটিং করলে বাংলাদেশের সেরা দুই ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল এবং মুশফিকুর রহিমের সাথে জুটি বাঁধার বেশি সুযোগ তৈরি হয়। ব্যাটিং পজিশন অনুযায়ী তিনিই দুইজনের মধ্যমণি। আফগানিস্তানের বিপক্ষে তামিম ইকবালের সাথে ৫৯ এবং মুশফিকুর রহিমের সাথে ৬১ রানের জুটি গড়েছিলেন তিনি। মুশফিক এবং সাকিব ৬১ রানের জুটি গড়ার পথে নিজেদের মধ্যে জুটিতে তিন হাজার রান যোগ করার মাইলফলক অতিক্রম করেন। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম এবং বিশ্ব ক্রিকেটে ৩৬তম ব্যাটিং জুটি হিসাবে তিন হাজার রানের মাইলফলক অতিক্রম করেছেন তারা।
মুশফিক এবং সাকিব এখন পর্যন্ত ওয়ানডে ক্রিকেটে ৮২ ইনিংসে জুটি বেঁধে ছয়বার শতরানের এবং ১৯ বার অর্ধশত রানের জুটি গড়েছেন। তাদের জুটিতে ৩৯.১৮ ব্যাটিং গড়ে ৩,০১৭ রান এসেছে। সাকিব তিনে উঠে আসার পর তামিমের সাথে জুটিটাও বেশ জমেছে। সাকিব এবং তামিম এখন পর্যন্ত ৪০ ইনিংসে জুটি বেঁধে তিনবার শতরানের এবং ১৪বার অর্ধশত রানের জুটি গড়েছেন। তাদের জুটিতে ৪৮.৯২ গড়ে ১,৯০৮ রান এসেছে।
ম্যাচ বাকি আছে দু’টো, সাকিবও মুখিয়ে আছেন ভারত-পাকিস্তানের বিপক্ষে দুই ম্যাচে নিজেকে আরেকবার তুলে ধরার জন্য। তাতে রেকর্ডের ঝাঁপি খুলে আরেকবার বসতে হলে দর্শকেরা যে খুব একটা বিমুখ হবেন না, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না বৈকি!