জন্মেই নিজেকে দেখেছিলেন উদ্বাস্তু শিবিরে।জীবনের রং যে কেমন, সেটাই জানতেন না মোহাম্মদ নবী। সেই উদ্বাস্তু শিবিরে শিখেছিলেন ক্রিকেট খেলা। একটু জ্ঞান হতেই শুনেছিলেন দেশে তার যুদ্ধ আর যুদ্ধ। একসময় সেই যুদ্ধ থেমে গেল। পত্রিকায় দেখলেন, ক্রিকেট খেলার জন্য দল করা হবে। নাম লেখালেন সেই দলে।
ক্রিকেটকে বুকে নিয়েই একদিন কাবুল শহরে পা রেখেছিলেন। প্রথম নিজের দেশে ফেরার কথা মনে করে মোহাম্মদ নবী বলছিলেন, “আমি আসলেই প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। রাস্তা-ঘাট, বাড়ি-ঘর সব কেমন যেন বিধ্বস্ত হয়ে আছে। একটাও দেয়াল দেখিনি, যেখানে গুলি বিঁধে ছিল না। বাড়িগুলোর দরজা, জানালা ও দেয়ালে গুলি লেগে আছে। কেমন যেন সিনেমার দৃশ্যের মতো। যুদ্ধের সিনেমার শেষে দেখা যায় না? ওরকম।” সেই যুদ্ধ বিধ্বস্ত পুরী থেকে উঠে এসেছেন মোহাম্মদ নবীরা।
এটা শুধু মোহাম্মদ নবীর একার গল্প নয়। পুরো আফগানিস্তান ক্রিকেট দলের গল্পটাই এরকম। উদ্বাস্তু শিবির থেকে যুদ্ধ বিধ্বস্ত পরিবেশ হয়ে উঠে আসার গল্প। এই গল্পে কোনো রূপকথা থাকার কথা নয়। এই গল্প সংগ্রামেই শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু মোহাম্মদ নবীদের প্রতীজ্ঞা ছিল অন্যরকম। তারা নিজেদের জীবন দিয়ে রূপকথা লিখতে চেয়েছিলেন। সেই রূপকথার চলার পথে আরও একটা বিশাল অর্জন হলো। আফগানিস্তান এবার বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের চ্যাম্পিয়ন হয়ে শেষ করলো অভিযান। বাছাইপর্বের সেরা দল হিসেবে ২০১৯ বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছে মোহাম্মদ নবী, রশীদ খানদের আফগানিস্তান। এ যেন সত্যিই এক রূপকথার পথচলা।
আফগানিস্তানে ক্রিকেটের আদিমতম নজির পাওয়া যায় ১৮৩৯ সালে। সে বছর কাবুলে ব্রিটিশ সেনারা নিজেদের মধ্যে একটি ম্যাচ খেলেছিল। ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য জায়গায় ব্রিটিশদের এই খেলাটির একটি ধারাবাহিকতা স্থানীয়রা রক্ষা করেছে। কিন্তু আফগানিস্তানে তেমন কোনো ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদের ওখানে ক্রিকেট গেলো ওই উদ্বাস্তু শিবিরের হাত ধরে।
নব্বই দশকে পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকাগুলোতে স্থাপিত আফগান শিবিরগুলোতে জনপ্রিয় হয়ে উঠলো খেলাটি। সেখানে স্থানীয় ক্রিকেটারদের সাথে দাপটের সাথে ক্রিকেট খেলতে শুরু করলো আফগান ক্রিকেটাররা। সেই অভিজ্ঞতা নবী তার সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন-
“এমনিতে ক্যাম্পের বাচ্চাদের সঙ্গে বা মহল্লায় প্লাস্টিক বল, রাবার বল, টেনিস বলে ক্রিকেট খেলতাম। পুরো পাকিস্তানের মতো পেশোয়ারেও সব জায়গায় এরকম খেলা হয়। আমার ওটা খুব ভালো লাগতো; তাই খেলতাম। এরপর একটা ক্রিকেট ক্লাবে শুরু করে ফেললাম। ক্লাবটার নাম ছিল শিরি মহল ক্রিকেট ক্লাব। পেশোয়ারের বেশ জনপ্রিয় ক্লাব। মূলত পাকিস্তানীরাই খেলতো। উমর গুল, ইয়াসির হামিদ, আরশাদ খান; এরা এই ক্লাব থেকে এসেছে। গুলদের সঙ্গে আমি ওখানে একসঙ্গে খেলেছিও। ওদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। পরে ওখানে ইসলামিয়া ক্রিকেট অ্যাকাডেমি হলো একই ম্যানেজমেন্টের অধীনে। আমার এখনো ওদের সঙ্গে সম্পর্কটা আছে। আশরাদ খান ওখানে এখন কোচিংও করায়।”
আফগান শিশু-কিশোরদের এই উৎসাহ দেখে ১৯৯৫ সালে আফগানিস্তানে গঠন করা হয় আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড। তালেবান সরকার অন্যান্য খেলা নিষিদ্ধ রাখলেও এই খেলাটিকে অনুমোদন দেয়। ২০০১ সালে আইসিসিও আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডকে স্বীকৃতি দেয়।
সে বছরই আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের পতন ঘটে এবং আফগানিস্তান জাতীয় দল তার প্রথম সফরে যায় পাকিস্তানে। পাকিস্তানের ঘরোয়া কিছু দলের বিপক্ষে এই সফরে ম্যাচ খেলে তারা। কোনো জয় না পেলেও প্রথম অভিযান হিসেবে বেশ দাগ কেটে যাওয়ার মতো কিছু পারফরম্যান্স ছিল তাদের।
২০০৪ সালে আফগানিস্তান অংশ নেয় এসিসি ট্রফিতে। সেখানে বাহরাইনকে হারিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম জয় তুলে নেয় তারা। ২০০৬ সালে মুম্বাইয়ে মাইক গ্যাটিংয়ের এমসিসি দলকে হারিয়ে দেয় আফগানিস্তান। সে বছরই ইংল্যান্ড সফরে কাউন্টি দলগুলোর দ্বিতীয় একাদশের বিপক্ষে ৭ ম্যাচে ৬ জয় পায় আফগানিস্তান। ২০০৭ সালে, এসিসি ট্রফিতে অংশ নেওয়ার তিন বছরের মাথায় সেই টুর্নামেন্টে শিরোপা জেতে আফগানরা।
২০০৮ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়নশিপ, ডিভিশন ফাইভ থেকে শুরু করে ২০১১ বিশ্বকাপে উত্তীর্ণ হওয়ার অভিযান। জার্সিকে হারিয়ে ডিভিশন ফাইভ, তানজানিয়াকে হারিয়ে ডিভিশন ফোর জয় করে তারা। পরের বছরও এই অভিযান অব্যহত থাকে। ডিভিশন থ্রি জিতে বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। একবারে পঞ্চম বিভাগ থেকে প্রথম বিভাগে চলে আসার এমন নজির আর ক্রিকেট ইতিহাসে নেই।
বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে অবশ্য প্রথম অভিযানে সুবিধা করতে পারেনি তারা। তবে বাছাইপর্বের ও ডিভিশনগুলোতে তাদের পারফরম্যান্স এতটাই ভালো ছিল যে, আফগানিস্তানকে ওয়ানডে স্ট্যাটাস প্রদান করে আইসিসি। ওয়ানডে বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব পার হতে না পারলেও ২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব পার করে ফেলে আফগানিস্তান। অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টে কোনো জয় না পেলেও মাঠের পারফরম্যান্স দিয়ে মন কেড়ে নেয় তারা। সে বছরই আইসিসির সহযোগী দেশগুলোকে নিয়ে আয়োজিত প্রথম শ্রেণীর প্রতিযোগিতা আইসিসি ইন্টারন্যাশনাল কাপ জয় করে আফগানিস্তান।২০১৪ সালের এশিয়া কাপে বাংলাদেশকে হারিয়ে হইচই ফেলে দেয় আফগানিস্তান।
এরপর আসে সবচেয়ে বড় অর্জনটা। ২০১৫ বিশ্বকাপে খেলার ছাড়পত্র পেয়ে যায় আফগানিস্তান। বিশ্ব ক্রিকেট লিগের রানার্সআপ হিসেবে এই অর্জন করে তারা। বিশ্বকাপে বলার মতো কিছু করতে না পারলেও এই বিশ্বকাপের পর যেন আরও উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে আফগানদের ক্রিকেট। বিশ্বকাপের পরপর তারা জিম্বাবুয়েকে ওয়ানডে সিরিজ হারায় ৩-২ ব্যবধানে। এটা ছিল কোনো নন-টেস্ট প্লেয়িং দেশের পক্ষে প্রথম কোনো টেস্ট খেলুড়ে দেশের ওয়ানডে সিরিজ জয়।
২০১৬ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত দ্বিপাক্ষিক সিরিজে বাংলাদেশের বিপক্ষে আবার একটি ম্যাচ জেতে তারা। আফগানিস্তানের এই বড় দলগুলোর বিপক্ষে জয়যাত্রা চলতেই থাকে। এর পাশাপাশি আফগানিস্তানের যুব দল এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স দিয়ে প্রমাণ করতে থাকে এই দলটির ভবিষ্যতও দারুণ শক্তিশালী। এর মধ্যে আয়ারল্যান্ডের সাথে আফগানিস্তান টেস্ট স্ট্যাটাসও পেয়ে যায়। আফগানিস্তানে উঠে আসেন মোহাম্মদ নবীদের পরের প্রজন্ম রশীদ খান, মোহাম্মদ শাহজাদরা। এর মধ্যে রশীদ খান ইতিমধ্যে বিশ্বের অন্যতম সেরা বোলারে পরিণত হয়েছেন মাত্র ১৯ বছর বয়সে।
অবশেষে আসে এই বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব। এখানে টানা তিন ম্যাচ হেরে বিশ্বকাপের পথ থেকে ছিটকেই পড়েছিল যেন। কিন্তু এই দলটি তো ভাঙতে জানে না। সেখান থেকেই তাই ফিরে আসে তারা। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে সুপার সিক্সে নিজেদের অবস্থান করে নেয়। বাছাইপর্ব পার করে ফেলে আয়ারল্যান্ডকে হারিয়ে। আর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আরো একবার হারিয়ে জিতে নেয় ট্রফিটাই।
কাবুলে অবশেষে একটা বড় ট্রফি নিয়ে ফিরেছে আফগানিস্তান দল। এই দিনটার স্বপ্নের কথা একদিন বলেছিলেন মোহাম্মদ নবী। সেদিন তিনি জোর গলায় বলেছিলেন, আফগানিস্তান নিজেই একদিন টেস্ট খেলবে। তাদের দেশের শক্ত কাঠামোর কথা জোর গলায় বলেছিলেন। বিশ্বাস না করাতে নিজের মোবাইল ফোন থেকে ছবি বের করে দেখিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “যে দেশে এত মানুষ ক্রিকেট ভালোবাসে। সেখানে সাফল্য না এসে পারে না। দেখবেন একদিন আমরা অবশ্যই কাবুলে একটা বড় ট্রফি নিয়ে ফিরবো।”
এখন একটা ট্রফি নিয়ে ফিরলেন আফগান ক্রিকেটাররা। নিশ্চয়ই আরো বড় বড় ট্রফি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য।
Featured Image: Dunya News